ইনকা সাম্রাজ্যের নিখোঁজ শহর মাচু পিচ্চু

খামারবাড়িতে ভোজ ও পাচামামার পূজা

পেরুর মোরাস শহরের প্রান্তিকে একটি খামারবাড়িতে আয়োজিত হয়েছে খানাপিনার। আমাদের হোস্টেস বিধবা দুবোন অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন গোলাঘরের দেয়াল ঘেঁষে, সঙ্গে তাঁদের নাতনি—ছোট্টমোট্ট কিউট একটি শিশু। একজন মহিলা কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারেন। জানতে পারি, এথনিক পরিচয়ে এঁরা মেসতিসো বা স্প্যানিশ সেটলার পুরুষের সঙ্গে কেচোয়া সম্প্রদায়ের নারীর বিয়েতে সৃষ্ট মিশ্র গোত্রের মানুষ।

খামারবাড়ির ভেতরবাগে ঢোকার সময় আমি এক সুযোগে ছোট্ট মেয়েটির হাতে রং–পেনসিলের প্যাকেট ধরিয়ে দিই। সে চোখ তুলে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তিয়ানেস আলগো দে চকোলাতে?’ বস্তুটির বড়সড় সাপ্লাই নিয়ে আমি ঘোরাফেরা করছি। তো দুটি বের করে তাকে দেখাই। চোখমুখে ঝকমকে কৌতূহল নিয়ে সে ‘পর ফাভর’ বা ‘প্লিজ’ বললে মনে পড়ে, প্রায় আড়াই দশক আগে সফর সেরে ঘরে ফিরলে আমাদের কন্যা কাজরি ঠিক এ রকমভাবে হাত পাতত।

 খামারবাড়ির ভেতর দিককার আঙিনায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু পুষ্পিত তরু। ফলফলাদির গাছগুলোর ছায়ায় চাঁদোয়া খাটিয়ে আয়োজন করা হয়েছে মধ্যাহ্নভোজের। পরিবেশন করা হয় বেগুনি যবচূর্ণের সঙ্গে কাটা ফলপাকুড় মিশিয়ে তৈরি বরফ দেওয়া পানীয় চিচা-মোরাদা। কৃষি-গবেষক এক মার্কিন পর্যটক হাঁকডাক করে হোস্টেসের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেন লেদারে বাঁধানো সোনালি হরফের সুদর্শন একখানা বাইবেল। কয়েকটি পকেট বাইবেলও তিনি টেবিলে রেখে বলেন, ‘গাইজ, পারহ্যাপ্স ইউ নিড দ্য ওয়ার্ডস অব লর্ড হোয়াইল ট্র্যাকিং টু মাচু পিচ্চু,’ কিংবা ইনকা ট্রেইলে ট্র্যাক করার সময় হয়তো তোমাদের প্রয়োজন পড়বে ঈশ্বরের ঐশী বচন।

সিনিয়র হোস্টেস ‘বুয়েন প্রভেচো’ বা ‘এনজয় ইয়োর মিল’ বলে আমাদের খেতে আহ্বান জানালে কৃষি-গবেষক জোরেশোরে এসপানিওলে ‘পর হেসুক্রিস্ত, নোয়েস্ত্র সিনিয়র…আমেন’ বলে প্রার্থনার উদ্যোগ নেন। আমি না ভেবে পারি না, ঘটনাটি ইনকা-সম্রাটের শাসনামলে ঘটলে ইনাকে দড়ি দিয়ে আচ্ছামতো বাঁধাছাঁদা করে অতঃপর সূর্যদেবতা ইনতির মন্দিরে বলি দিয়ে বেদিতে উত্সর্গ করা হতো তাজা রক্ত। কয়েক শতাব্দী পর ট্রাভেল করার বদৌলতে মশাই জোর বেঁচে গেছেন!

টেবিলে তাজা ফুলপাতা দিয়ে করা আলপনার ফাঁকফোকরে রাখা হয়েছে খাবারের বাহারি ডিশগুলো। একটি প্লেটে পোড়া আলুর নকশার ভেতর স্পিনাচ শাকের থিকথিকে ক্বাথে খাবি খাচ্ছে ঝলসানো একটি গিনিপিগ। খাদ্যদ্রব্যের শিল্পিত উপস্থাপনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী পাকিস্তানি খানসাহেব তাঁর যুবতী ‘জানেমন’–এর জন্য দৃশ্যটি ভিডিও করতে শুরু করেন। জুনিয়র হোস্টেস এসে একটি ডিশের ঢাকনা তুললে আমাদের দিকে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তাকায় শূকরের কাটা মুণ্ড। ‘আস্তাগফিরুল্লা…’ পড়তে পড়তে বেজায় বিষম খান খানসাহেব। চিচা মরোদা পিয়ে তা সামলে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন সদ্য রেকর্ড করা ভিডিও থেকে বন্য বরাহের মস্তকটি ডিলিট করতে। বিড়বিড়ানো থেকে বুঝতে পারি, ডাইনিং টেবিলে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ এ জানোয়ারের উপস্থিতির কথা জানতে পারলে তাঁর বিবি তত্ক্ষণাৎ তাঁকে বাইন তালাক দেবে।

আহারাদির পালা শেষ হয়ে আসতেই আমার চেনা সুহৃদ উইলিয়াম গোল্ডম্যানের কাছ থেকে টেক্সট আসে। আমি বন্ধুস্থানীয় যে দুজন পুরুষ ও একজন নারীর সঙ্গে ইনকা ট্রেইল ধরে ট্র্যাক করব, উইলিয়াম তাদের একজন। এরা পেরুর নানা জায়গায় ঘোরাফেরা করে দুদিন আগে এসে মোরাস শহরের একটি বাড়িতে হোম–স্টে করছেন।

উইলিয়ামের পরবর্তী টেক্সটে আসে স্ক্যান করা হাতে আঁকা শহরের মানচিত্র। তাতে তাদের হোম–স্টে হাউসটিকে তারকাচিহ্নে হাইলাইট করা হয়েছে। কফির জন্য অপেক্ষা না করে গুডবাই বলে উঠে পড়ি।

সড়ক অবধি আমাকে এগিয়ে দিয়ে সিনিয়র হোস্টেস পইপই করে বুঝিয়ে দেন, কীভাবে কেবল একটি গলি পার হয়ে গির্জাঘরের পেছন দিকে কাঠে তৈরি লাল রঙের হোম–স্টে হাউসটি খুঁজে বের করার উপায়। আমি তাকে আদিওস বলে বিদায় নিই। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে, খড়ের গাদার ওপর দাঁড়িয়ে ছোট্ট মেয়েটি আমার দিকে হাত নাড়ছে।

 আমি অবগত যে এ শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো মাসতিসো বা মিশ্রবর্ণের মানুষ। কিন্তু কোথাও জনমানবের কোনো তত্পরতা দেখতে না পেয়ে অবাক হই! কেব্‌লস্টোনের পথ ধরে বেজায় নির্জন গলিটি অতিক্রম করতে করতে আমি আমার সুহৃদত্রয়ের কথা ভাবি। এরা সবাই ১৯৯০-এর দশকে কর্মরত ছিলেন যুগপৎ কম্বোডিয়া ও লাওসে। সেখানে একই সময়ে আমিও কাজ করতাম। লাওসে আমার প্রতিবেশী উইলিয়াম ছিলেন জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির মস্ত চাঁই। পেশায় ডাক্তার কেভিন ছিলেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণবিষয়ক একটি সংস্থার প্রধান। এঁদের মধ্যে উইলিয়াম বিপত্নীক। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে ট্র্যাজিক এক বিমান দুর্ঘটনায়।

কেভিন এখনো বিবাহিত। তবে তাঁর স্ত্রী তুমুলভাবে আক্রান্ত হয়েছেন ডিপ্রেশনে; এবং বিচ্ছিন্নভাবে তিনি একাকী অ্যারিজোনার একটি ট্রেইলারে বসবাস করছেন। এ যাত্রায় আমাদের একমাত্র নারী সঙ্গীর নাম গ্রেইস। একসময় সে নমপেনের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আর্ট-টিচার হিসেবে কাজ করত। বর্তমানে বিধবা এই রমণীর প্রতি এক যুগে আমার প্রবল ক্রাশ ছিল। হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করি, গ্রেইসকে ফের চাক্ষুষ করার সম্ভাবনা আমার মধ্যে তৈরি করছে তুমুল এক্সাইটমেন্ট।

গির্জাঘরের বাঁধানো চাতালে দানা খুঁটে খাচ্ছে বেশ কতগুলো কবুতর। যিশুখ্রিষ্টের মূর্তির তলায় ফোয়ারার পাড়ে বসে দীর্ঘচুলো একটি কিশোর তারের অচেনা একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে চেষ্টা করছে। আর মাঝেমধ্যে টিনের কৌটা থেকে পায়রাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে যবের দানা। আমি ইশারায় ছবি তোলার অনুমতি চাই। বিরক্ত হয়ে মাথা দুলিয়ে সে বলে, ‘নো মোলেসতেস আল পাখারোস (পাখিদের বিরক্ত করো না তো)।’ তার মাথার ঝাঁকুনিতে ডান কানে গাঁথা ইয়ারিংয়ের পাথরটি ঝলসে ওঠে। আর আমি খেয়াল করি, তাঁর গলায় পেঁচিয়ে আছে সবুজ রঙের একটি সাপও। গির্জার উঠান ঘেঁষে হেঁটে যেতে যেতে ছেলেদের ডান কানে পরা ইয়ারিংয়ের প্রতীক যে নিজেকে সমকামী হিসেবে আইডেন্টিফাই করার প্রবণতা, তা নিয়ে ভাবি।

ফিউশার পুষ্পিত ঝাড়ে বর্ণাঢ্য লোহিত কাঠের হোম–স্টে হাউসটি খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হয় না। ভেতরের আঙিনায় গার্ডেন-চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন উইলিয়াম। তাঁর সামনের টেবিলে ছড়ানো–ছিটানো ইনকা ট্রেইলবিষয়ক বইপুস্তক ও মানচিত্র। পাখি পর্যবেক্ষণের একটি বইয়ের পাশে রাখা পকেট সাইজের থিয়েটার-বাইনোকুলার। বিস্মরণের ঘোলা জল থেকে ঘাঁই মেরে ওঠে একটি বাসি স্মৃতি। আজ থেকে সাতাশ বছর আগে লাওসের ভিয়েনচার শহরে রামায়ণ নৃত্যের পালা দেখার জন্য আমি এই থিয়েটার-বাইনোকুলারটি ধার করেছিলাম।

উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন উইলিয়াম। এক যুগের ব্যায়ামঋদ্ধ শরীরের আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। তাঁর মাসলহীন কাঠামোকে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো জ্যাকেটের মতো মনে হয়। মাত্র মাস কয়েক আগে উইলিয়াম খালাস পেয়েছেন দ্বিতীয় দফা ক্যানসারের আক্রমণ থেকে। দস্তানাপরা কবজি দেখিয়ে বলেন, স্কিন ক্যানসার সম্পূর্ণ সেরেছে বটে, তবে ক্ষতবিক্ষত বাহু ও কবজি হয়ে আছে বেজায় সেনসেটিভ। রোদ লাগলে টাটিয়ে ওঠে।

কথা বলতে বলতে খেয়াল করি, ফিউশার ঝাড়ে দুটি সুচালো-চঞ্চু সবুজ পাখি যেন বাতাসে ছোবল মেরে মেরে ধরছে অদৃশ্য শিকার। নীরবে থিয়েটার-বাইনোকুলারটি তুলে একনজর দেখে উইলিয়াম তা পাস করে দেন আমার হাতে। ১২-১৪ ফুট দূরে আমি দেখতে পাই জোড়া পতঙ্গভুক পাখির ওড়াউড়ি। তাদের তুমুল অস্থিরতায় মিষ্টির দোকানে শোকেসের সামনে দাঁড়ানো যমজ দুটি শিশুর ইমেজ মনে আসে। কোনো কথা না বলে উইলিয়াম ইশারায় বার্ড-ওয়াচিংয়ের পুস্তকে ঠিক একই চেহারার পাখির ছবির নিচে ‘সিনেমন ফ্লাইক্যাচার’ শব্দটি দেখান।

অন্য সুহৃদ কেভিনের তালাশে বারান্দায় উঠতেই দেখি, উনি এক্সারসাইজ বাইকে বসে দুহাতের তালুতে ডলছেন দুটি ছোট্ট ধাতব-গোলক। আমার মতো স্ট্রোকের ভিকটিম কেভিনের করতল থেকে কমে গেছে স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা। কোনো কিছু শক্ত করে ধরতে তার অসুবিধা হয়। তাই তিনি ব্যায়াম হিসেবে মুঠো করে ডলছেন স্টিল-বল। গোলক দুটি দেখিয়ে বলেন, ‘ইউ নিড টু ট্রাই দিস। ভেরি এফেক্টিভ।’

আমার সমস্যা করতলে নয়, আঙুলের ডগা ও কবজিতে। টাইপ করতে কষ্ট হয়। স্টিল-বল ব্যবহার করে আমি কোনো ফায়দা পাইনি, তাই উত্সাহ দেখাই না। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার কেভিন সহজে ছাড়েন না। সাইড-টেবিলে রাখা ইনকাদের বনাজি ওষুধবিষুদ-সংক্রান্ত একটি বই দেখিয়ে বলেন, ‘সুলতান, আমি বুকমার্ক দিয়ে রেখেছি, জাস্ট রিড অ্যান্ড লেট মি নো হোয়াট ইউ থিংক অ্যাবাউট ইনকা হারবাল মেডিসিন।’ অনীহা গোপন রেখে আমি বইটি ব্যাকপ্যাকে পুরি। কানের কাছে মুখ এনে কেভিন চাপা স্বরে বলেন, ‘ইয়োর সুইটহার্ট ইজ ইন দ্য সিটিং রুম। শি ইজ ডায়িং টু সি ইউ।’

ফায়ারপ্লেসের পাশে তাস সাজিয়ে বসে গ্রেইস একা একা খেলছে সলিটেয়ার। আমার পদশব্দে চোখ তুলে মৃদু হেসে বলে, ‘গিভ মি আ ফিউ মিনিটস। উইল ইউ? কার্ড গেমটা গুছিয়ে এনেছি।’ আমার তর সয় না, কাছে গিয়ে হাত রাখি কাঁধে। চোখ না তুলে অভিমানী স্বরে বলে, ‘টু মোর মিনিটস,’ তারপর মুঠো করে হাতটি ধরে বলে, ‘থার্মোসে গ্রিন-টি করে রেখেছি।’ নিরুত্তাপ সংবর্ধনায় ভেঙে পড়ি না একেবারে। নির্লিপ্তভাবে সরে এসে থার্মোস থেকে পেয়ালায় ঢালি সবুজ চা। তারপর চুপচাপ এসে বসি সোফায়।

 তাসের সলিটেয়ার গেমটি অনেকটা আমাদের সমাজে পেশেন্স খেলার মতো। কার্ডগুলোর জোড় খুঁজে খুঁজে মেলাতে খানিকটা সময় লাগে। তো চা পান করতে করতে ভাবি, আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে, কম্বোডিয়ার নমপেন শহরে রাজপ্রাসাদের কাছে করেসপন্ডেস ক্লাবে নির্জন এক দুপুরে আমি গ্রেইসকে দেখেছিলাম এক কোণে চুপচাপ একাকী বসে সলিটেয়ার খেলতে। আমাদের মধ্যে কথা কিছু হয়নি, তবে দৃষ্টিবিনিময় হয়েছিল, সম্ভবত সে মৃদু হেসে ফিরে গিয়েছিল তার কার্ড-গেমে।

দূরের একটি টেবিলে বসে আমি চেষ্টা করছিলাম যুদ্ধোত্তর কম্বোডিয়ার প্রেক্ষাপটে বয়স্ক-শিক্ষার ওপর একটি বইয়ের আউটলাইন করতে। ওয়েটার এসে আমার টেবিলে রেখেছিল গ্রেইসের বিজনেস কার্ড, তার উল্টো পিঠে লেখা ছিল, ‘জয়েন মি ইন দ্য ব্যালকনি ফর আ ড্রিংক।’ লেবুর চাকতি বসানো জিন অ্যান্ড টনিক নিয়ে আমরা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের মধ্যে কথাবার্তা কিছু হয়েছিল কি? এত বছরের ব্যবধানে অতশত আর মনে নেই। তবে দুজনে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম, তনলাছাপ নদীপথে ভেসে এসে ঘাটে ভেড়া একটি নৌকা। তা থেকে নেমে এসেছিলেন গৈরিক বসনপরা মুণ্ডিতমস্তক ছয়জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। ভিক্ষাভাণ্ড হাতে শ্রমণেরা মন্ত্র জপতে জপতে চলে গিয়েছিলেন প্রাসাদ-সংলগ্ন সিলভার প্যাগোডায়। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘উইল ইউ গো উইথ মি টু সিলভার প্যাগোডা, গ্রেইস?’

দুচোখে তুমুল আতঙ্ক ফুটিয়ে গ্রেইস ব্যালকনি থেকে সরে যেতে যেতে বলেছিল, ‘সরি, ইটস মাই হাজব্যান্ড, দি বাস্টার্ড জাস্ট অ্যারাইভড হিয়ার।’ আমাকে ব্যালকনিতে দাঁড় করিয়ে রেখে গ্রেইস চলে গিয়েছিল লাউঞ্জের দিকে। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছিলাম, নিচে হার্লি ডেভিডসনের হেভি মোটরবাইক থেকে নামছে লেদার-জ্যাকেটপরা লালচুলো আইরিশম্যান মার্ক।

তাসগুলো গুছিয়ে পার্সে পুরে অতঃপর কাছে আসে গ্রেইস। প্রত্যাশিত হাগের উষ্ণ স্পর্শেও উদ্দীপ্ত হই। কিন্তু আমাদের অন্তরঙ্গতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। উইলিয়াম কামরায় ঢুকে, ‘কাম অন লাভ–বার্ডস, কাট ইট আউট, পাচামামা রিচ্যুয়ালের স্পটে নিতে যেতে ট্যুর কোম্পানি থেকে এসকর্ট এসে পড়েছে। গো অ্যান্ড গেট রেডি কুইক।’

গ্রেইস, উইলিয়াম ও কেভিন ওপরতলায় তাদের বেডরুমে যান। কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে প্রস্তুতি নিতে। আমাদের মিনিট বিশেক হেঁটে পৌঁছাতে হবে পাচামামা রিচ্যুয়াল বা জননীতুল্য পৃথিবীর পূজার লোকেশনে, যেখানে একজন শামান বা কেচোয়া গোত্রের পুরোহিত অর্চনার উপচার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমি বেরিয়ে আসি হোম–স্টে হাউসের আঙিনায়।

গার্ডেন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় একটু আগে গির্জাঘরের চাতালে দেখা বাদ্যযন্ত্র বাজানো কিশোরটি। তার শার্টের কলারে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর কোম্পানি লোগো আঁকা বাটন। নেমট্যাগ পড়ে বুঝতে পারি, ছেলেটির নাম কার্লোস ফনসি। পাচামামা রিচ্যুয়াল বা মাতৃরূপী পৃথিবীর সন্তুষ্টিবিধানে আয়োজিত পূজা-আচারের পদ্ধতি সম্পর্কে একটি লিফলেটও সে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। তা পড়তে পড়তে ফনসিকে ফের দেখে নিই। আইশেডপরা সুরমা রঙের চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে কিশোরটি যে মিশ্র-বর্ণের মাসতিসো-সন্তান, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। জানতে চাই, সে স্কুলে পড়ে কি না? বুঝতে পারি, চার্চ-পরিচালিত একটি স্কুলে সে পঞ্চম-মান অবধি পড়েছে। তারপর থেকে ফুটফরমাশ খাটছে ট্যুর কোম্পানির। কথা বলতে বলতে আমি খেয়াল করি, তার ব্যাকপ্যাকের সঙ্গে আটকানো তারের বাদ্যযন্ত্র ছাড়া কোমরের বেল্টে গোঁজা একটি বাঁশিও।

 ফনসি পর্যটকদের এসকর্ট হওয়া ছাড়া সুযোগ পেলে বিক্রি করে আলটিচিউড সিকনেসের প্রতিষেধক কোকা পাতার প্যাকেট। আমি কয়েকটি প্যাকেট কিনে নিয়ে জানতে চাই, পেরুর কোন জিনিসটি সে ভালোবাসে? জবাবে ফনসি জানায়, গির্জাঘরটি তার প্রিয়। সংগীতও খুব ভালোবাসে। বালক-বয়সে সে গির্জার অল্টার-বয় হিসেবে উপাসনার উপকরণ তথা ধূপদান ইত্যাদি বহন করত। ফনসির কথা শুনতে শুনতে খেয়াল করি, তার বেল্টে ঝোলানো পাউচ থেকে মাথা তুলছে লিকলিকে সবুজ একটি সাপ।

আঙিনায় একসঙ্গে নেমে আসেন কেভিন, উইলিয়াম ও গ্রেইস। পায়ে হেঁটে শহরের একটি ব্লক পাড়ি দিয়ে আমরা চলে আসি ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরে। মিহি স্বরে শিস দিয়ে আমাদের সামনে পথ দেখিয়ে হাঁটে ফনসি। তার চলাচলে ঘাস থেকে লাফ দিয়ে সরে যায় নাম না জানা পতঙ্গ, ওড়ে ঘাসফড়িং। আমি কিশোরটির সংগীতপ্রিয়তার কথা ভাবি। উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র হতে পারলে হয়তো ফনসি স্কুল-ব্যান্ডে বাজাতে পারত বাদ্যযন্ত্র। তুষার ছাওয়া একাধিক শিখর ঝলমলিয়ে দিগন্তজুড়ে দৃশ্যমান হয় আন্দিজ পর্বতমালা। ওই দিকে ইশারা করে উইলিয়াম বলে ওঠেন, ‘গাইজ, লুক অ্যাট দিস স্প্লেনডিড ইন্টারপ্লে অব ভ্যালি অ্যান্ড মাউন্টেন।’ কেভিন হিয়ারিং এইড অ্যাডজাস্ট করতে করতে নীরবে হাঁটেন। অত্যন্ত লাইভলি চরিত্রের কৌতুকপ্রিয় এই মানুষটির মৌনতায় অবাক হই! ব্লটিংপেপারে শুষে নেওয়া কালির মতো তার চোখেমুখে যেন জমাট বেঁধে আছে গাঢ় বিষাদ।

খুব মাপা পদক্ষেপে আমার পাশ দিয়ে হাঁটে গ্রেইস। আইভরি কালারের আধময়লা কোঁচকানো একটি গাউনের সঙ্গে সে একই মোটিফের স্কার্ফ পরেছে। ঠিক বুঝতে পারি না, এই আউটফিট তথা স্কার্ফ পরার নির্দিষ্ট ভঙ্গিমা যে আমার মধ্যে জ্বালবে আশ্চর্য এক ইন্ধন, গ্রেইস তা জানে কী?

মন নীরবে ফিরে যায় নব্বইয়ের দশকের নমপেনে। কম্বোডিয়ান ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে আমি কাজ করছি। আমাদের বয়স্ক-শিক্ষাসংক্রান্ত উপকরণ, তথা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করতে রাজি হয়েছে গ্রেইস। এক সন্ধ্যায় পার্টি জমেছিল দাতা সংস্থার প্রতিনিধি উইলিয়াম ও তার বন্ধুবত্সল স্ত্রী মিশি কোহেনের ফরাসি-ঔপনিবেশিক কেতার ভিলায়।

বাগানে ফিরিঙ্গি পানির পুষ্পিত কুঞ্জটির আড়ালে আমি গ্রেইসকে ঠিক একই রকম পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বলি, ‘হাই, হাউ আর ইউ ডুয়িং, গ্রেইস?’ চোখ মুছে সে জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি একদিন আমাকে তোমার সঙ্গে সিলভার প্যাগোডায় যেতে বলেছিলে। ইজ দিস ইনভাইটেশন স্টিল ওপেন?’ রাজ্যের এক্সপ্যাট উন্নয়নকর্মীতে সরগরম পার্টি থেকে চুপিসারে সটকে পড়তে বিশেষ কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রজেক্টের পিকআপ আমাদের ড্রপ করে দিয়েছিল সিলভার প্যাগোডার তোরণে।

ওই সন্ধ্যায় রাজকীয় এ মন্দিরের রুপাজলে রঞ্জিত অজস্র টাইলস চাঁদনির আভা মেখে যেন ছড়িয়েছিল বর্ণনাতীত ইন্দ্রজাল। আমরা ‘এমারল্ড বুডা’ বলে পর্যটকদের কাছে পরিচিত মরকত পাথরের সবুজ বুদ্ধমূর্তিকে মোমবাতির আলোয় যুগলে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। তারপর প্যাগোডা-চত্বরের একটি স্তূপের আড়ালে চুপচাপ বসেছিলামও বেঞ্চে।

উন্নয়নকর্মীদের নমপেনভিত্তিক এক্সপ্যাট-মহলে গ্রেইসের হাজব্যান্ড মার্কের পরিচিতি ছিল পাব-বারে ড্রাংক হয়ে মারপিট করা, রিভলবার দিয়ে শাসানো এবং বেপরোয়া মোটরবাইক চালানো প্রভৃতি বিষয়ে। কোনো পেশায় মার্ক জড়িত ছিল না। তবে শোনা যেত, সে বুদ্ধমূর্তি চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। গতকাল গ্রেইসের স্কুল হাফ-ডে হওয়ায় সে বাসায় ফিরেছিল নির্দিষ্ট সময়ের আগে। তখন পাশের কামরায় দাঁড়িয়ে সে মার্কের টেলিফোন কনভারসেশন শোনে। পরে এক সুযোগে গ্রেইস মার্কের মোবাইলে টেক্সটগুলো পড়ে নিশ্চিত হয় যে সে ব্যাংককভিত্তিক স্মাগলারদের একটি চক্রের কাছে কম্বোডিয়ার জঙ্গলে অবস্থিত ভগ্ন এক মন্দিরের একাধিক বিগ্রহের খুঁটিনাটি তথ্য সরবরাহ করেছে। তারপর আজ বিকেলে মোটরবাইক হাঁকিয়ে সে বেরিয়েছে স্মাগলারদের গাইড করে ওই মন্দিরে নিয়ে যেতে। গ্রেইসের ধারণা, ওরা ওখান থেকে বিরাট একটি বিগ্রহকে কেটে টুকরা-টুকরা করে, প্রতিটি টুকরায় নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে স্মাগল্‌ড আউট করে নিয়ে যাবে থাইল্যান্ডে। তারপর দক্ষ কারিগরের সহায়তায় তা জোড়া দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গোপন বাজারে প্রস্তুত করে তুলবে বিক্রির জন্য।

বিয়ে বাই ডেফিনেশন এক বিশেষ রকমের বন্ধন, কিন্তু সে নিগড় থেকে বেরিয়ে আসার পথ তো খোলা ছিল গ্রেইসের সামনে। সে কেন ডিসফাংশনাল ম্যারেজের জটাজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করছে না, এ বাবদে প্রশ্নাদি করে আমি তাকে বিব্রত করতে চাইনি। গ্রেইসও আমার কাছে কোনো সাজেশনের প্রত্যাশা করেনি। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘অল আই ওয়ান্ট টু ট্রাস্ট সামওয়ান অ্যান্ড শেয়ার মাই ট্রাবল।’

ওই রাতে মার্ক অনুপস্থিত বিধায় ঘরে দ্রুত ফেরার কোনো তাড়া ছিল না তার। তো আমরা বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসেছিলাম। সম্মোহিত হয়ে আমি উপভোগ করেছিলাম গ্রেইসের কবোষ্ণ সান্নিধ্য। শুভ্র স্কার্ফ, গাউন ও কটিদেশ প্যাঁচানো শ্যাষে তাকে দেখাচ্ছিল গন্ধরাজের জ্যোত্স্নামাখা পুষ্পটির মতো।

হেঁটে যেতে যেতে গ্রেইসের চলমান শরীর আমাকে ছুঁয়ে যায়। চোখে কোণ দিয়ে ফের তাকে দেখি। তিন দশকের তফাতটি চোখে পড়ার মতো। কোঁচকানো আধময়লা গাউনে আজ তাকে দেখাচ্ছে ঝরে পড়ার ঠিক আগে ম্লান গন্ধরাজটির মতো। আমাদের মধ্যে চকিতে চোখাচোখি হয়। না ভেবে পারি না, তবে কি আমাকেও দেখাচ্ছে নিলামি দোকান থেকে কেনা বোতামহীন রংচটা কোটের মতো, যা ব্যবহার করা যায় বটে, তবে নওল বস্ত্রের পরিধেয়টির মতো তা ছড়ায় না বাহারে জৌলুশ।

আমরা এসে পড়ি পাচামামা রিচ্যুয়ালের খোলামেলা স্পটে। অপেক্ষারত শামান বা পুরোহিত উঠে এসে—যেন দূরের কোনো গ্রাম থেকে অনেক দিন পরে আসা আত্মীয়স্বজনের মতো—আমাদের আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা করেন। তারপর চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে শঙ্খ বাজিয়ে ব্যাখ্যা করেন, পাচামামা বা মাদার আর্থ নদীনালা, পর্বত ও সমুদ্র সৃষ্টি করে সন্তানদের জন্য বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন ফসল উত্পাদনের। তার শরীরে পদচারণ করে আমরা এগিয়ে যাই সামনে। মাঝেমধ্যে সন্তানেরও উচিত জননীরূপী পৃথিবী যা আমাদের দিয়েছেন, তা প্রতীকীভাবে তাঁকে অর্পণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

তিনি জ্বলন্ত আগুনে শুকনা সেইজ ও মোনা পাতা ফেলে দিয়ে তৈরি করেন সুগন্ধি ধোঁয়া। তারপর চাপা কৌতুকের স্বরে বলেন, ‘বি আ গুড বয়, বি আ গুড গার্ল। আর মায়ের প্রাপ্য মাকে ফিরিয়ে দাও। ওই যে ইনকা ট্রেইল ধরে তোমরা হেঁটে যাবে, মা-জননীর অনুমতি না নিলে কেউ যদি তোমাদের ধরে-বেঁধে দেবতার থানে বলি দিয়ে উত্সর্গ করে, তা থেকে রক্ষা পেতে চাইলে, কাম অন গাইজ, লেট আস পুট আওয়ার অফারিংস টুগেদার।’ আমাদের হাসিঠাট্টা জমে যেতে তিনি জনে জনে আলিঙ্গন করে রীতিমতো হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয় মানুষ। এ সুযোগে আমি তাঁর সঙ্গে তুলে ফেলি যুগল আলোকচিত্র।

ফের শঙ্খ বাজিয়ে শামান মৃত্তিকা, জল, বাতাস ও অগ্নিকে আহ্বান জানান। আগুনের লকলকে শিখায় সেইজ ও মোনাচূর্ণ ফেলে তিনি কাগজের রুমালে দাবার ছকের মতো সাজান হরেক রকমের বীজ, ফলফলাদি, কোকা পাতা, চাল, গম ও যব প্রভৃতি শস্য। চিচা বা কর্ন-বিয়ার গ্লাসে ঢেলে আমাদের তা পান অথবা স্পর্শ করতেও বলেন। তারপর আলুর খামিরাতে—আমরা কে কী পেশার সঙ্গে জড়িত আছি, তার প্রতীকচিত্র তথা লেখক হিসেবে আমার জন্য কলম, ডাক্তারি পেশার কল্যাণার্থে কেভিনের জন্য ওষুধের শিশি প্রভৃতি আঁকেন। অগ্নিকুণ্ডের চতুর্দিকে পানীয় ছড়িয়ে, অর্পিত উপচার জড়ো করে কাগজের নৌকার মতো প্যাকেট বানান। অতঃপর মন্ত্র পড়ে ইনকা ট্রেইলে আমাদের শুভকামনায় পুড়িয়ে ছাইভস্ম ছড়িয়ে দেন পবিত্র উপত্যকায়।

দেখতে দেখতে পবিত্র উপত্যকা ভরে ওঠে গোধূলির মায়াবী আলোয়। শামানের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে আমরা মোরাস শহরের দিকে ফিরি। হোম–স্টে হাউসের দোরগোড়ায় আমাদের পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন প্রৌঢ় শামান। কিন্তু তাঁর হাস্যকৌতুকে উচ্ছল চমত্কার সান্নিধ্যের রেশ লেগে থাকে আমাদের দেহমনে।

ইনকা ট্রেইলের এন্ট্রি পয়েন্টে

ড্যাফোল-ব্যাগে এয়ার ম্যাট্রেস থেকে স্লিপিং ব্যাগ অবধি তাবৎ কিছু গোছগাছ করে রেখেছি। ট্রেইলে পোর্টারবাহিত ব্যাগ-বোঁচকার বরাদ্দ হচ্ছে ১৫ কেজি। যেহেতু আমি, কেভিন, উইলিয়াম ও গ্রেইস ভুগছি নানাবিধ স্বাস্থ্যসমস্যায়, ট্যুর কোম্পানি কলকাঠি নেড়ে এক্সট্রা ওষুধ-বিষুদ, ব্লাডপ্রেশার মেশিন, নেবুলাইজার প্রভৃতি বহনের বিশেষ অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উইলিয়াম ও কেভিন স্বাস্থ্যসংকটে হেলিকপ্টার ইভাক্যুয়েশনের বিমাও কিনেছেন। তাঁরা বহন করতে চাইছেন হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও। এ পর্বের গাইড আমারু আতুচি জানিয়েছেন, এসব জটিলতায় আমরা ট্রেইলে ঢোকার সুযোগ পাব সবার শেষে। সুতরাং এখনই তাড়াহুড়ার কিছু নেই।

সিঁড়ি বেয়ে ব্যাকপ্যাকার্স লজের নিচের লাউঞ্জে নেমে আসি। পরিসর বেজায় সরগরম হয়ে আছে। ট্র্যাকাররা মালপত্তর লাস্ট মিনিটে চেক করে নিচ্ছেন। কেউ কেউ দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছেন, বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে। চা-কফির জন্য এখনো চুলা ধরানো হয়নি, তবে কাউন্টারের থার্মোসে পাওয়া যায় গেল রাতের গরম জল। এক পেয়ালা চা নিয়ে চলে আসি হটস্পটে। ট্র্যাকারদের কেউ কেউ চেক করছেন মেসেঞ্জার ও ই–মেইল। আমিও সেলফোন টার্নড-অন করি।

কাউন্টারে এবার কফির সঙ্গে পাওয়া যায় যবের খামিরাতে প্রস্তুত তপ্ত তমালে। প্লেটে তা তুলতে তুলতে সচেতন হই, বিস্ফোরণে অজানা প্রজাতির ফুল থেকে ছড়িয়ে পড়া রেণুকার মতো আমার মধ্যে সম্প্রসারিত হচ্ছে ট্র্যাক করার উত্তেজনা। বুঝতে পারি, আমি ক্রমশ শিকার হচ্ছি অ্যাড্রেনালিন রাশের। এ হরমোনের রিলিজে দ্রুত হয় হার্টবিট, ব্লাডসুগার ও রক্তচাপ বৃদ্ধির আশঙ্কায় সতর্ক হই। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে কোনো কিছুর নিবিড় পর্যবেক্ষণে মনকে নিবদ্ধ করলে রেহাই পাওয়া যায় ইনটেন্স এক্সাইটমেন্টের ধিকিধিকি আক্রমণ থেকে।

গতকাল আমি উইলিয়ামের কাছ থেকে ধার চেয়ে এনেছি, বার্ডস আইডেন্টিফিকেশন-সংক্রান্ত প্যাম্ফলেট। এ পুস্তিকার সঙ্গে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসটি নিয়ে বেরিয়ে আসি আঙিনায়। গুছিয়ে বসার জন্য একখানা রকিংচেয়ার পাওয়া যায় বটে, কিন্তু উঠানের দুটি প্রায় নিষ্পত্র বৃক্ষে কোনো খেচরের আলামত দেখতে পাই না। তো আমি উঠে এসে দাঁড়াই পুষ্পিত এক ঝোপের কাছে। পতঙ্গগুলো এমন চটপটে হয়ে আছে যে তাদের দিকে আতশকাচ তাক করে ফোকাস করাও কঠিন মনে হয়। কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি ফের প্রসন্ন হন। মিনিট কয়েকের মধ্যে শুনতে পাই আধাচেনা বার্ড-কল। বেশিক্ষণ খোঁজাখুঁজি করতে হয় না। একটি গাছের মাঝবরাবর কাণ্ডে স্পট করি আন্দিজ পাহাড়ের ব্লু-তেনেজার নামক পাখিটিকে। খুশি হই, দেহমনে সংযত-উদ্যমের সঙ্গে ফিরে আসে কনফিডেন্স।

পক্ষী-পর্যবেক্ষণবিষয়ক একটি মকসুদ হাসিল হওয়াতে খোশমেজাজে ফিরি কামরায়। লাস্ট মিনিটের চেক সেরে ধীরেসুস্থে ব্যাকপ্যাকে কাঁধে নেমে আসি লাউঞ্জে। দেখি, ভগ্নদূতের কায়দায় দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের নো-ননসেন্স টাইপ গাইড আমারু আতুচি। বেজায় আমসি মুখে তিনি ঘোষণা করেন, ‘তদো লিসতো, তেনেমস এল পারমিসো,’ (সব প্রস্তুতি সারা হয়েছে, পার্মিশনও পেয়েছি)। অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে যেতে যেতে তাকে চিয়ারআপ করার জন্য বলি, ‘দিস ইজ আ ভেরি গুড নিউজ, সিনিয়র। পিসকো সাওয়ারের শট পিয়ে এটা সেলিব্রেট করতে হয়।’ তিনি রাশ টেনে ধরে বলেন, ‘নো অ্যালকোহল ইজ অ্যালাউড ইন ইনকা ট্রেইল।’ নেশানিরোধক দেবতাকে ইয়াদ করে আমি গাড়িতে চাপি।

আমার তিন ট্রেইল-সঙ্গীর সবাই বসে আছেন মাইক্রোবাসে। ছিপি-খোলা সোডা–বটলের মতো উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে তাঁরা আমাকে ওয়েলকাম করেন। নীরবে অনুভব করি, এদের ধমনিতেও নিঃসরিত হয়েছে অ্যাড্রেনালিন রাশজনিত চাপা উল্লাস। কেভিন পকেট থেকে ফ্লাক্স বের সিপ নিয়ে তা পাস করে দেন। মনে হয় তিনি ফিরে এসেছেন আগের মতো প্রাণবন্ত ফর্মে। গ্রেইস আইফোনে মিউজিক মেন্যু স্ক্রল করতে করতে জানতে চায়, ‘অ্যানি রিকোয়েস্ট?’

 আমি স্মৃতিবিধুর প্রেষণায় বলি, ‘ক্যান ইউ ফাইন্ড লা ফ্লোর দে লা কানেলা টাইটেলের পেরুভিয়ান লিরিকটি?’ ফ্লাক্স আমার হাতে আসে। স্বাদ নিয়ে বুঝতে পারি, কেভিন পেরুর আইকনিক শারাব পিসকোকে অবজ্ঞা করেননি। বেজে ওঠে পঞ্চাশের দশকে পেরুর সবচেয়ে লোকনন্দিত সংগীতকার চাবুকা গ্রানদার সুকণ্ঠে ইস্পানিক লিরিকটি। এর আশ্চর্য ঝংকার যেন আমাদেরকে অলীক এক টাইমমেশিনে চড়িয়ে নিমেষে নিয়ে যায় ১৯৯২ সালে খেমার রুজের আতঙ্কে উপদ্রুত নমপেন নগরীতে।

নমপেনে আমাদের সহকর্মী সেভ দ্য সিলড্রেন নামক একটি সাহায্যকারী সংস্থার কান্ট্রি ডাইরেক্টর, পেরুর নাগরিক আলেহান্দ্রো এবং তাঁর মেহমান-প্রিয় স্ত্রী কামিলার বাগানওয়ালা বিরাট বাড়িতে জমত ‘স্যাটারডে নাইট ফিভার’ বা ‘শনিবার রাতের গ্যাদারিং’। আলেহান্দ্রো ডিজের দক্ষতায় সিলেক্ট করতেন সম্ভাব্য যুগল-ড্যান্সের সহযোগী ইস্পানিক সংগীত। কামিলা নৃত্যের কোচ হিসেবে আনাড়িদেরও শিখিয়ে দিতেন বাচাতা, মেরেঙ্গে কিংবা পাসো-দবলে প্রভৃতি ড্যান্সের সঠিক মুভ।

স্মৃতিতে ফিরে আসে, এক সন্ধ্যায় লা ফ্লোর দে লা কানেলা বাজলে কামিলার তরজমায় লিরিকের প্রেক্ষাপট। তথা, পেরুভিয়ান এক নারীর হরেক রকমের পথ-ক্লেশ সয়ে, কাঠের নড়বড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পুলের ওপর দিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে, দিনের পর দিন ক্রোশ-কে-ক্রোশ অতিক্রম করে বাড়ি ফিরে, ঐশী কল্পনায় ক্রমশ দারুচিনির ফুল হয়ে ওঠার গল্প।

গ্রেইসের উত্সাহে আমি, পাসো-দবলে ড্যান্সে শরিক হওয়ার সবক নিতে গিয়ে তার পা মাড়িয়ে দিয়ে পুরো নৃত্য-আবহ যে কেঁচে গণ্ডূষ করে দিয়েছিলাম, তা সাড়ে তিন দশক পর মনে পড়তেই বিগতভাগে শরমিন্দা হয়ে আমি গ্রেইসের দিকে তাকাই। গাড়ি ব্রেক কষে। সড়ক আস্তে-ধীরে অতিক্রম করছে পুরো একপাল বেজায় লোমশ আলপাকা। গাইড আমারু আতুচি বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকতে আঁকতে বিড়বিড়িয়ে বলেন, ‘মুই বোয়েনা সুহার্তে পারা এল ভিয়াখে।’ বুঝতে পারি, যাত্রার শুরুয়াতে আলপাকা দর্শন হচ্ছে সৌভাগ্যের আলামত। ওলানতাইতামবো শহরে ঢোকার মুখে আমাদের মাইক্রোবাসটিকে মোকাবিলা করতে হয় যত্সামান্য ট্রাফিক। স্লো হয় গতি।

অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরের আধিকারিক, আমার দীর্ঘদিনের চেনা পুত্রপ্রতিম গাইড ইলিয়াসিন পালোমিনোর কাছ থেকে জরুরি ফোনকল আসে। লটবহর খানিকটা বেশি ক্যারি করার পারমিশন আমরা পেয়েছি বটে, তবে ওভার-ওয়েট ড্যাফোল-ব্যাগ বহন করতে ট্রেইলরক্ষীরা আপত্তি তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইলিয়াসিনে

র পরামর্শ হচ্ছে, ওলানতাইতামবো থেকে আরও দুটি ড্যাফোল-ব্যাগ কিনে এক্সট্রা দুজন পোর্টার দিয়ে তা বহন করানো। প্রস্তাবটি আমাদের মনে ধরে। পেরুভিয়ান কারুপণ্যের পর্যটকভোগ্য বিপণির কাছে গাড়ি থামানো হয়। গাইড আমারুকে নিয়ে উইলিয়াম বেরোন দুটি ড্যাফোল-ব্যাগ কিনতে। এ সুযোগে আমরা যে যার মতো হানা দিই দোকানপাটে।

ফ্যানি-প্যাক বা কোমরে বাঁধার মতো পাউচের তালাশে আমি একটি দোকানে ঢুকি। বস্তুটি পাওয়া যায় সহজে এবং সাক্ষাৎও হয় একজন শামানের সঙ্গে। পুরোহিত কাজ চালানোর মতো ইংরেজি বলতে পারেন। আমার কেনাকাটা সারা হওয়ার আগেই তিনি পাকড়ান এক মহিলা-ট্যুরিস্টকে। নিজেকে ‘হোলিম্যান’ ঘোষণা দিয়ে পারিতোষিকের বিনিময়ে অতঃপর বেচারীর কপালে সৌভাগ্যের ইনকা-প্রতীক এঁকে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে আমি বিলটি পে করে বেরিয়ে আসি সড়কে।

বেশ দেরিতে আমরা এসে পৌঁছেছি ওলানতাইতামবো শহরে। পোর্টারদের অনেকে মালমাত্তা ক্যারি করে অলরেডি ঢুকে পড়েছেন ইনকা ট্রেইলে। খোঁজাখুঁজির ভার গাইডের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা ঢুকি কফিশপে। ট্রেইলে আমাদের ভরসা করতে হবে, ইন্সট্যান্ট নেস-ক্যাফে কিংবা টি-ব্যাগের ওপর। তাই ড্রিপ কফির অর্ডার করে বসি সড়কের পাশে ছত্রীতলে।

উষ্ণ পানীয়র সঙ্গে পাওয়া যায় চমত্কার চিজ-ব্রেড। উইলিয়াম বছর কয়েক আগে কাজ করেছেন লিমাতে, যুক্তরাষ্ট্রের এইড এজেন্সি ইউএসএআইডির প্রধান হিসেবে। তিনি পর্যটনের একজন চেনাজানা কর্মকর্তাকে ধরে-করে তাকে দিয়ে ট্রেইল ব্যবস্থাপনার প্রধানকে টেলিফোনও করিয়েছেন। সুতরাং নিয়মবহির্ভূতভাবে খানিকটা বেশি লটবহর নিয়ে দেরিতে এন্ট্রি নেওয়ার ব্যাপারে আমরা বিশেষ একটা চিন্তিত হই না। কফির তিতকুটে স্বাদ উপভোগ করতে করতে দেখি, শুধু আমাদেরই লেট হয়নি, লিমায় ঘোরাফেরার সূত্রে মুখচেনা পাঁচজন ব্যাকপ্যাকারও লটবহরের বোঝা পিঠে হেঁটে যাচ্ছেন জোর কদমে।

সুঠামদেহী হাসিখুশি দুজন একস্ট্রা পোর্টার পাওয়ামাত্র আমরা স্বল্প সময়ের ড্রাইভে এসে পৌঁছাই ট্রেইলের এন্ট্রি পয়েন্ট পিসকাকুচো নামক একটি গ্রামে। ওজন করা হয় আমাদের মালসামান। ব্যাগ-বোঁচকা খুলে ভেতরের জিনিসপত্রও চেক করা হয়। ট্রেইল-রক্ষী আমাদের ওষুধ-বিষুদ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলে গাইড আমারু নার্ভাসভাবে ফিসফিসিয়ে বলেন, নারকোটিক পেইন-কিলার প্রভৃতির প্রেসক্রিপশন বের করে হাতে রাখতে। রক্ষী তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোধ করি আমরা দৈহিকভাবে ফিট কি না, তা যাচাই করেন। তরুণ ট্র্যাকারদের তুলনায় আমাদের বয়স গড়পড়তা আড়াই গুণ বেশি, কিন্তু কাউকেই ঠিক ‘ঘাটের মড়া’ বলা যায় না, সুতরাং তিনি ইশারায় ক্লিয়ারেন্স দেন।

দুপা এগিয়ে যেতেই আরেক রক্ষী এসে আমাকে থামান। ফ্যাঁকড়া বাঁধে আমার ব্যাকপ্যাকে হালকা-পাতলা একটি ল্যাপটপের উপস্থিতিতে। এন্ট্রি পয়েন্টের বুড়োসুড়ো ব্যবস্থাপক এসে বিষয়টা খানিক ঘোরালো করে তোলেন। সকালে তিনি নাকি অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরের ইলিয়াসিন পালোমিনোর টেলিফোন মারফত জানতে পেরেছেন, আমি একজন বাংলাদেশি লেখক। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার আগাপাছতলা চেক করে তিনি সওয়াল করেন, ‘তোমাদের দেশে লেখকেরা ধর্মযাজকের মতো পোশাক–আশাক পরে না?’ তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে সেলফোনের স্ক্রিনে তিনি খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিও দেখান। আমি কবিগুরুর তসবিরকে কুর্নিশি কায়দায় স্যালুট ঠুকে তিনি যে আমাদের মহান এই কবিকে ইন্টারনেটে খুঁজে পেয়েছেন, এ জন্য বারবার মাথা ঝুঁকিয়ে ‘মুচাস গ্রাসিয়াস, মুচিসিমাস গ্রাসিয়াস’ বা ‘ধন্যবাদ’ বলি। তোষামোদে কাজ হয়। আমাদের ট্রেইলে তুলে দিয়ে তিনি কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘এসক্রিবে আলগো বনিতো সবরে এল কামিনো ইনকা,’ (ইনকা ট্রেইল নিয়ে সুন্দর করে কিছু লিখো তো)।

এদিকে দেখতে পাই, ‘কামিনো ইনকা’ বা ‘ইনকা ট্রেইলে’র ফলকটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন একগুচ্ছ ট্র্যাকার। এঁরা একেকজন করে টার্ন নিয়ে আস্তে-ধীরে সেলফোনে তুলছেন ছবি। তাঁদের দিকে হাত নাড়িয়ে আমরা নীরবে হাঁটতে শুরু করি। খানিক হাঁটার পর উইলিয়াম সবাইকে ইশারায় দাঁড়াতে বলে অনুরোধ করেন, ‘লেটস্ হ্যাভ আ মোমেন্ট অব সাইলেন্স।’ আমরা নীরবে প্রতিফলন করি, আর সচেতন হই যে আর কখনো হয়তো এভাবে একত্রে ট্র্যাক করা হবে না। ভাবতে ভাবতে মুদে আসে চোখ, গ্রেইস খুব মৃদু আওয়াজে মেডিটেশনে ব্যবহৃত একটি ঘণ্টা বাজায়। ফের হাঁটতে শুরু করি।

এবার আমরা হেঁটে যাচ্ছি বিরাট সব বোল্ডার ভাসিয়ে ভাটির দিকে ছুটে যাওয়া উরুবাম্বা নদীটির পাড় ধরে। কিছুক্ষণ পথ চলি রেললাইনের সমান্তরালে। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পদক্ষেপ সহজ হয়ে আসে। চলে আসি কোরিওয়েরাচিনা ব্রিজের কাছে। পুল পাড়ি দিতে গিয়ে খাম্বাগুলো ঘিরে জমে থাকা শুভ্র ফেনার দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করি, কেন এ নদীজল পরিচিতি পেয়েছে ‘হোয়াইট ওয়াটার’ অভিধায়। পুল পুরোপুরি অতিক্রম করে ফের ফিরে তাকিয়ে দেখি, ইনকা আমলে নির্মিত ব্রিজটির শক্তপোক্ত ফাউন্ডেশন। কাছেই পাওয়া যায় ছোটখাটো কয়েকটি ছাপরা দোকানপাট। ট্র্যাকাররা এখান থেকে কিনেছেন লাস্ট মিনিটের রসদপত্র। গ্রিলের ওপর অঙ্গারের ধিকিধিকি আঁচে ঝলসাচ্ছে চিকেন বারবিকিউ। আমরা দরাজ হাতে পোর্টারের জন্য কিনি প্রোটিনরিচ খাবার ও পানীয়।

খানিক বিরতির পর ফের চলতে শুরু করি। নদীর ওপারে রেললাইন ধরে ঝিকিঝিকিয়ে মাচু পিচ্চুর দিকে যাচ্ছে ইনকা ট্রেন। যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে আমরা হাত নাড়ি আর ভাবি, চাইলে রেলগাড়িতে চড়ে অকুস্থলে আমরাও পৌঁছে যেতে পারতাম, মাত্র দেড় ঘণ্টায়। ট্রেইলে নওজোয়ান সুস্থ-সবল ট্র্যাকাররা মাত্র চার দিন তিন রাত পায়ে হেঁটে অবশেষে পৌঁছাবেন মাচু পিচ্চুর কিংবদন্তিসম নিখোঁজ শহরে। বয়োবৃদ্ধ হিসেবে আমরা দিন-ছয়েকে গন্তব্যে পৌঁছার পরিকল্পনা করছি। রেলযোগে যাওয়ার সম্ভাবনা আমরাও খতিয়ে দেখেছি, কিন্তু মনে হয়েছে ট্রেন পাকড়ে যাওয়া হবে, গ্রেইসের ভাষায়, ‘কমলালেবুর বদলে ভাইটামিন সি ট্যাবলেট গেলার মতো।’ সো উই আর ট্র্যাকিং, লেটস জাস্ট ওয়াক অ্যান্ড সি হোয়াট হ্যাপেনস।

ক্লাউড ফরেস্টের অন্দরমহলে

খানিক বেলা করে ভাঙে ঘুম। তাঁবুর সংকীর্ণ পরিসর ভরে আছে জলরঙের চিত্রটির মতো সবুজাভ আলোয়। স্লিপিংব্যাগ থেকে নিজেকে বের করতে করতে, আন্দিজ উপত্যকায় আধোঘুমে অনুভব করা অসামান্য নীরবতার কোয়ালিটি নিয়ে ভাবি। এ অনুভূতি একই সঙ্গে এমন আনকোরা ও আদিম যে বর্ণনার লাগসই কোনো উপমা খুঁজে পাই না। চেন টেনে তাঁবুর ম্যাস-ডোর খুলে মাথা বাড়াই বাইরে। মিহি আলোয় চতুর্দিকে যেন উড়ছে কুয়াশার অনেকগুলো চাঁদোয়া। বিকিরিত রশ্মির বর্ণালিতে কোথাও কোথাও তা হয়ে উঠেছে কিংখাবের চিত্রকল্প। বেরোতে হয় এবার।

বেশ দূরে পোর্টারদের টেন্টগুলোর আবছা আউটলাইনের সামনে উসকে-ওঠা ক্যাম্পফায়ারের শিখাকে শনাক্ত করি। ভেসে আসা কফির কড়া গন্ধের সঙ্গে আগুন ঘিরে বসা ছায়ামূর্তির মানুষগুলোর অবয়বও কিঞ্চিৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভোরের সামান্য হাঁটিহাঁটিতে ওয়ার্মআপ করে নিতে হয় পায়ের পেশি। আমি এক পা–দুপা করে সামনে বাড়ি। কবোষ্ণ রোদে চোখের সামনে মসলিনের একেকটি চাঁদোয়ার আকৃতি ভেঙেচুরে দেখতে দেখতে কেমন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।

ঘণ্টার মৃদু এক মরমি ধ্বনিতে শিউরে উঠে ঘাড় বাঁকাই। তাকাই এদিক–ওদিকে। ধাতব ধ্বনিটি রূপান্তরিত হচ্ছে অতিসংক্ষিপ্ত মিহি মূর্ছনায়। খানিক দূরে ইয়োগা ম্যাটে পদ্মাসনে বসে গাঢ় কুয়াশায় ধ্যানস্থ গ্রেইসকে স্পট করি। তার হাতে ধরা ধাতব বস্তুটি ‘সিংগিং বৌল’ নামে পরিচিত। সচরাচর ব্যবহৃত হয় তিব্বতি ঘরানার বৌদ্ধ মন্দিরের উপাসনায়। নমপেনবাসের দিনগুলোতে আমি তাকে বৌদ্ধ মন্দিরে মেডিটেশন করতে দেখেছি। সুতরাং অবাক হই না বিশেষ।

উইলিয়ামের তাঁবুর পাশ দিয়ে আমি হেঁটে যাই উপত্যকার আলোকিত পরিসরের দিকে। ওদিককার মেঘ-নিবিড় আকাশ ও শ্যামল ঝোপঝাড় দেখে নিশ্চিত হই, আমরা নিশিযাপন করেছি ক্লাউড ফরেস্টের অন্দরমহলে। ক্রমশ সোনালি হয়ে ওঠা আলোর বিবর্তনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। ডালপালায় হালকা ট্রেমার হয়। মনে হয় ঝোপে একটি নয়, শিশিরে আর্দ্র হয়ে উঠে ডানা ঝাড়ছে চার-চারটি বেজায় বড় হামিংবার্ড।

ক্যাম্পসাইট থেকে ভেসে আসা সমবেত কথাবার্তায় বুঝতে পারি, এবার ফেরা উচিত। ততক্ষণে কুয়াশার মসলিন-চাঁদোয়া উবে গেছে। ক্রমশ স্পষ্ট হয় বেশ দূরের একটি পাহাড়। ঢালে এবার আলোকিত হয় একের পর এক শিশির-সবুজে সতেজ ধাপ। মনে হয়, ইনকা-আমলের এ পাহাড়-সংলগ্ন টেরাস বা সিঁড়িগুলো এখনো কৃষি উত্পাদনে ব্যবহার করছে কেচোয়া জনগোষ্ঠী।

ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে ব্রেকফাস্টের পর গরম চা-টাও ভালো করে গিলতে পারেনি। গাইড কেবলই ঘড়ি দেখেন। অন্যরা বুটজুতার ফিতা কষে বেঁধে পিঠে ব্যাকপ্যাক তুলতে যাচ্ছেন। সুতরাং খানিক অনিচ্ছায় ট্র্যাকের প্রস্তুতি নিই। গাইডের বক্তব্য হচ্ছে, গতকাল আমরা অতিক্রম করতে পারিনি প্রত্যাশিত দূরত্ব। পিছিয়ে আছি গড়পড়তা ট্র্যাকারদের তুলনায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো। সুতরাং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে তিনি কোনাকুনি একটি সংক্ষিপ্ত ট্রেইল ধরতে প্ররোচিত করেন। নীরবে আমরা তাকে অনুসরণ করি।

ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর নেমে আসি কাঁচা সড়কে। দেখা হয়, মাস্কে মুখ ঢাকা কেচোয়া গোত্রের এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে। তাঁর গ্রামে বেশ কয়েকজন ভুগছেন কোভিডে। তাই ইনি ট্র্যাক করে যাচ্ছেন ওলানতাইতামবো শহরের দিকে, যদি বা জ্বরজারি, কফ–কাশির কোনো ওষুধবিষুদ পাওয়া যায়। আমাদের গন্তব্য জানতে পেরে, উল্টো দিকে খেতকৃষির ভেতর দিয়ে শর্টকাটে যাওয়ার পথ বাতলে দেন।

কানজোকা যবখেতের ভেতর দিয়ে শিশিরে আর্দ্র হয়ে রাজ্যের পোকামাকড় ও পতঙ্গ উড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে, শ্রীমান শ্রীকান্ত–সমভিব্যাহারে ইন্দ্রের মক্কা-খেতের ভেতর দিয়ে নৌকা টেনে নেওয়ার বর্ণনা। মিনিট বিশেক হাঁটার পর আপাতত কেটে যায় আমাদের গর্দিস। চলে আসি উরুবাম্বা নদীর কাছাকাছি। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রলম্বিত ভেঁপুর প্রতিধ্বনিতে প্রাণ রীতিমতো উচাটন করে দিয়ে মাচু পিচ্চুর দিকে ছুটে যায় ইনকা ট্রেন।

 চলতে চলতে সমতল থোকা থোকা শ্বেতশুভ্র পুষ্পে হয়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন। কেচোয়া-চাষিরা এখানকার আদিগন্ত প্রান্তরজুড়ে ফলিয়েছেন গ্লাডিওলা ফুল। জানতে পারি, চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর আরাধনায় প্রাক্‌-ইনকা যুগ থেকে অত্র এলাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে শিশিরসিক্ত সাদা ফুল। স্প্যানিশ সেটলাররা স্থানীয় এ সংস্কৃতিকে অভিযোজন করে গির্জার বেদিতেও সাদা ফুল অর্পণের রেওয়াজ চালু করেছেন। এসব তথ্যে যদিও ইনকা সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান খানিকটা বৃদ্ধি পায়, তারপরও ফুলখেতের নাজুক আলে পা টিপে টিপে হাঁটার ক্লেশ কিন্তু লাঘব হয় না। বিষয়টা প্রায় অসহনীয় হয়ে উঠলে আমি ‘আপথও পথ হয়, জঙ্গলও হয় মঙ্গল’ বলে একটি প্রবাদবাক্য জপতে জপতে হাঁটার মোটিভেশন বহাল রাখি।

চলে আসি রীতিমতো একটি পাহাড়ের পাদদেশে। এদিকে বইছে ভারি সুন্দর সুবাতাস। উপত্যকার মিঠে হাওয়ায় কারও কারও খিদের উদ্রেক হয়। বসে পড়ি আমরা ঘাসে। গ্রেইস কাজুবাদামের প্যাকেট খোলে। উইলিয়ামও দরাজ হাতে বিতরণ করেন চকলেট-বার। স্ন্যাকসের ভাগ পেয়েও গাইড তুষ্ট হন না। কেবলই কবজি উল্টে ঘড়ি দেখেন।

ট্র্যাকিং স্টিকে ভর দিয়ে আমরা উঠতে শুরু করি পাহাড়। অত্যন্ত সাবধানে অতিক্রম করি প্রতিটি ধাপ। চলার গতি হয়ে পড়ে বেজায় শ্লথ। কোনো কোনো ধাপে দাঁড়িয়ে পড়ে একটু জিরোইও। বিষয়টা গাইডের পছন্দ হয় না। দুষ্ট গরুর লেজ মুচড়ে দেওয়ার কায়দায় কেবলই ইশারায় পাহাড় ভাঙতে তাড়া লাগান। আমরা দারুণ রকমের মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করি দ্রুত ওপরে ওঠার।

আমাদের কাছপিঠ থেকে বুটজুতায় ভারী পদক্ষেপের সঙ্গে ভেসে আসে ভরাট কণ্ঠে গানের কলি। এথলিট গোছের কৃষ্ণাঙ্গ এক পুরুষ হিমালয় ডিঙানো শেরপার বিক্রমে ট্র্যাকিং স্টিক ছাড়া অবলীলায় উঠে আসছেন ওপরে আর ঘাসে পুঁতে থাকা পাথরের খাঁজ পাড়ি দিতে দিতে গাইছেন বব ডিলানের একটি জনপ্রিয় গানের কলি, ‘আই এইন্ট গনা ওয়ার্ক অন ম্যাগিজ ফার্ম…নো মোর/ নো, আই এইন্ট গনা ওয়ার্ক অন ম্যাগিজ ফার্ম…নো মোর…।’ আমাদের কাছাকাছি এসে না থেমে ধবধবে সাদা দাঁতে হেসে আওয়াজ দেন, ‘হাই, উইলিয়াম…গ্রেইস ডার্লিং…গুড ডে।’

থামেন না তিনি। আমি চকিতে দেখতে পাই, তাঁর জ্যাকেটে গাঁথা অনেকগুলো বোতাম। একটিতে ‘অল্টারনেটিভ টু ভায়োলেন্স ট্রেনিং’ লেখা লোগোটি শনাক্ত করে অবাক হই! একসময় আমি এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম সমন্বয় করতে যুক্তরাষ্ট্রের নানা কারাগারে যেতাম। প্রশিক্ষণ সফলভাবে সমাপন করলে একজন কয়েদি উপহার হিসেবে পান একটি করে বোতাম। কী ব্যাপার?

ততক্ষণে সুঠামদেহী সুদর্শন কালো মানুষটি উঠে পড়েছেন একদম ওপরের লেয়ারে। দাঁড়িয়ে তিনি আমাদের দিকে হাত নাড়লে আমরাও থেমে পড়ে দম ফেলি। মাউথ অর্গান বের করে তিনি অবিকল বব ডিলানের কায়দায় একই গানের সুর বাজিয়ে মাথা নুইয়ে বাও করেন। আমরা জোরেশোরে হাততালি দিই। ফের বাও করে তিনি পা বাড়ান। শ্বাস-প্রশ্বাসের তোড় সামলে নিয়ে উইলিয়াম জানান, উইন্ডস্পিয়ার জোনস নামে এই আফ্রো-আমেরিকান পুরুষটি শ্বেতাঙ্গ এক কিশোরকে খুনের ‘অভিযোগে’ আলাবামা অঙ্গরাজ্যের ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজনে ১৪ বছরের মেয়াদ পেয়েছিলেন। ৯ বছর জেল খাটার পর ডিএনএ টেস্টে বেকসুর প্রমাণিত হলে ইনি খালাস পান। গ্রেইস ও উইলিয়ামের সঙ্গে উইন্ডস্পিয়ারের সাক্ষাৎ ঘটে সপ্তা–দিন আগে লিমা নগরীর এক পানশালায়।

ফের আমাদের ডিঙাতে হয় পাহাড়। মিনিট বিশেকের বেহদ মেহনতে ঘেমেনেয়ে একপর্যায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা উঠে আসি প্রায় সমতল এক প্লাটোতে। পাওয়া যায় সংকীর্ণ একটি পায়ে চলার ট্রেইল। আমরা বিরতি নিতে চাই। কিন্তু গাইড রাজি হন না। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, নিজেকে পুশ না করলে আমাদের হাঁটাতে আসবে না ট্র্যাকের সহজাত রিদ্‌ম। আজও ফের পৌঁছাতে পারব না গন্তব্যে। অনিচ্ছায় আগ বাড়তে বাড়তে ভাবি, আমাদের কেউ কেউ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে ট্র্যাক করছি, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোটা প্রধান হলে এত দিনে তো সেখানে গিয়ে অলরেডি হাজির হতাম। গাইড ফের হাইপার অ্যাকটিভ হয়ে ওঠেন। আমি এর একটা বিহিত করার জন্য ফিকির খুঁজি।

আমাদের মধ্যে প্রশাসক হিসেবে সবচেয়ে দক্ষ উইলিয়াম। জিন্দেগিতে তিনি যত লোকের কর্মসংস্থান করেছেন, তার চেয়ে দ্বিগুণ–সংখ্যককে চাকুরিচ্যুত করে পেশাদারি জগতে খ্যাতিমান হয়েছেন। তাঁকে অ্যাপ্রোচ করে বলি, ‘ডু সামথিং অ্যাবাউট দিস।’ গাইড ফের আমাদের গতি বাড়াতে বললে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দেন, ‘দিস ইজ নট আ ফাকিং রেইস। আমরা ইনজুরির রিস্ক নিতে যাচ্ছি না। সো ডোন্ট ইভেন আস্ক আস টু ওয়াক ফাস্ট।’ কোমরে ঝোলানো রেডিও দেখিয়ে তার আচরণ সম্পর্কে ইলিয়াসিন পালোমিনোর কাছে রিপোর্ট করারও হুমকি দেন।

ধাতানিতে কাজ হয়। গাইড আমারু ‘কারণ দর্শাও নোটিশ’ পাওয়া কর্মচারীর মতো মুখ বেজায় গোমড়া করে চুপচাপ হাঁটেন। আমরাও কফি-ট্যাবলেট চুষতে চুষতে আস্তে-ধীরে তাঁকে অনুসরণ করি। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারি না, চাগিয়ে ওঠে হাঁটুর পুরোনো ব্যথা। অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে এটাকে এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে আখেরে মুশকিল হবে। সাতপাঁচ ভেবে ফ্যানি-প্যাক থেকে পেইনকিলার বের করি। ওয়াটার বটল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উইলিয়াম কপট অনুনয়ের সুরে বলেন, ‘বি ফ্রেন্ডলি অ্যান্ড হেল্প দ্য ওল্ডার গাই।’ তার ব্যাক সার্জারিতে সৃষ্ট ক্ষতও টাটিয়ে উঠেছে। সুতরাং একটি পেইনকিলার তার সঙ্গে শেয়ার করতে বাধ্য হই।

আমাদের গতি অত্যন্ত স্লো হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু হাঁটা একেবারে থামেনি। আশপাশে বৃষ্টি-বনানী দেখতে দেখতে খুব মৃদুভাবে আগাচ্ছি। মিনিট তিরিশেকের মধ্যে এসে পড়ি অনেকটা সিমলা-দার্জিলিংয়ের চা-বাগানের মতো পরিচ্ছন্ন একটি ছিমছাপ সড়কে। পায়ের মাসলে দপদপানো ব্যথাটি কমে এসেছে এবং পেইনকিলারজনিত নারকোটিকের প্রভাবে মুড-মেজাজও হয়ে উঠেছে প্রফুল্ল। ইচ্ছা হয় গল্পগাছা করে আরামসে হাঁটার। উইলিয়াম তব্দিল হয়ে একপা–দুপা করে আগ বাড়ছেন। গাইড কোনো চোটপাট করছেন না। কিন্তু গ্রেইস ও কেভিনের গতরে যেন সহসা জোয়ার এসেছে। কলকলিয়ে কথা বলতে বলতে এরা এগিয়ে যায়, দূর থেকে দূরে।

চতুর্দিকে খেলছে উজ্জ্বল রোদ। পরিবেশও উষ্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা জ্যাকেট খুলে কোমরে পেঁচিয়েছি। স্লিভলেস ও টাইটসে গ্রেইসের ইয়োগা-শাসিত ফিগারকেও তীব্র দেখাচ্ছে। কিন্তু কী ঘটনা? এত দ্রুত হাঁটছে কেন? আর কেভিনের সঙ্গে গ্রেইসের কী এমন জরুরি কথা যে আমাদের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও পাচ্ছে না এরা?

পথের দুপাশে পাখপাখালি কম, তবে হরেক রকমের পতঙ্গ প্রচুর। মাছের ঘাঁইয়ের মতো মাঝেমধ্যে এরা ঝোপঝাড়ের সবুজে ঝিলিক পাড়ছে, কখনো বা লাফিয়ে উঠে হারিয়ে যাচ্ছে শ্যামলিমায়। চলতে চলতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। উইলিয়াম জানতে চান, ‘ডু ইউ রিমেম্বার মিশি, মাই লাভলি ওয়াইফ অব থার্টি ইয়ার্স?’ চমকে উঠে জবাব দিই, ‘ওহ, ইয়েস, হোয়াট অ্যাবাউট মিশি?’ সরাসরি রেসপন্স না করে তিনি শ্বেতশুভ্র মেঘমালার দিকে ইশারা করে মন্তব্য করেন, ‘লুক, হাউ ক্লাউড ফরেস্ট হ্যাজ ডিফাইন্ড দিস পাথ।’ এরপর সম্পূর্ণ চুপচাপ হয়ে যান উইলিয়াম, কিন্তু আমার মনে ফিরে আসে মিশি কোহেনের স্মৃতি।

লাওসের ভিয়েনচান শহরে আমাদের ভদ্রাসনের কাছাকাছি একটি সুপরিসর ভিলায় বসবাস করতেন উইলিয়াম ও মিশি। তাদের দশ বছরের মেয়ে জেইডের ডল হাউসে তার তদারকিতে আমাদের ছোট্ট মেয়ে কাজরিকে রেখে আমরা কখনো বা আড্ডা দিয়েছি তাদের ককটেল লাউঞ্জে। একবার মিশি স্লাইডে ছবি দেখিয়ে বালিকা-বয়সে তার বেড়ে ওঠার গল্প বলেছিল। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হনুলুলুতে ছিল তাদের পরিবারের ভ্যাকেশন হোম। গ্রীষ্মের ছুটিতে তার বাবা ছোট্ট এক সেসনা বিমানে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতেন অন্যান্য দ্বীপমালার কোনো একটিতে, কিংবা মোনালোয়া ভলকেনোর ধোঁয়া ওড়া নীলিমায়। বাবাই তাকে শিখিয়েছিলেন, সলো-ফ্লাই করার কৃৎকৌশল। খুব অল্প বয়সে পাইলট হিসেবে মিশি প্যাসেঞ্জার ক্যারি করার লাইসেন্সও পেয়েছিল।

উইলিয়াম থেমে পরে জানতে চান, ‘ওয়াজ নট শি ভেরি প্রিটি?’ আমি রেসপন্স করার কোনো সুযোগ পাই না। দেখি, মুখখানা চারণের মতো উদাসীন করে মিহি গলায় তিনি গাইছেন, ‘আই হ্যাভ বিন থিংকিং আবাউট ইউ/ ডু ইউ থিংক আবাউট মি স্টিল…’

উইলিয়ামের গুনগুনানো লিরিক আমাকে আকর্ষণ করে না তেমন, কিন্তু প্লেন–ক্র্যাশে মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পরও মিশির দৈহিক সৌন্দর্যের রূপরেখা যে আমার মন থেকে মুছে যায়নি, তা ভেবে অবাক হই! একহারা গড়নের তন্বী মিশি ডিপ্লোমেটিক সার্কেলের বলনাচ প্রভৃতিতে মিনি স্কার্ট পরে ককটেল-গ্লাস হাতে ঘোরাফেরা করতে ভালোবাসত। আড়ালে-আবডালে সমুদ্রনীল চোখের সোনালি-চুলো এই নারীকে কেউ কেউ ‘নকআউট ব্লন্ড’ বলে উল্লেখও করতেন। একবার ফ্রেঞ্চ এমবাসির পান ও নৃত্যে সরগরম পার্টিতে মিশির ফিশনেট-সক্স পরা পায়ের দিকে তাকানো ছোট্ট একটি মেয়েশিশুকে, ‘মাম, লুক অ্যাট দিস বিগ বার্বিডল’, বলে বিস্ময় ছড়াতেও শুনেছি।

‘লিসেন, প্লিজ।’ বলে উইলিয়াম জানতে চান, ‘ক্যান আই টেল ইউ হাউ শি হ্যাড ক্র্যাশড?’ এ কাহিনি তিনি একাধিকবার টেলিফোনে আমাকে বলেছেন, কিন্তু তুমুল আবেগে ঘষা-কাচ হয়ে ওঠা তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি না বলতে পারি না। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে মিশিকে নিয়ে উইলিয়াম বসবাস করছিলেন ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা নগরীতে। তত দিনে প্রয়াত হয়েছেন মিশির পিতা, বিক্রি হয়েছে তাদের হনুলুলুর ভ্যাকেশন হোম; তবে উত্তরাধিকারসূত্রে সেসনা প্লেনের মালিকানা এসেছে মিশির হাতে। আদ্দিস আবাবার ফ্লায়িং ক্লাবে মাঝেমধ্যে প্লেনটি উড়িয়ে সময় কাটাচ্ছে সে।

হঠাৎ করে সুদান থেকে ইথিওপিয়ার একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে হাজার দশেক শরণার্থী ঢুকে পড়লে ওখানে ত্রাণ সরবরাহের কাজে প্রায়ই যেতে হতো উইলিয়ামকে। ওসব ট্রিপে সচরাচর ফ্লায়িং ক্লাব থেকে ছোট্ট প্লেন চার্টার করত উইলিয়ামের সাহায্যকারী সংস্থা। একদিন এ রকম একটি চাটার্ড প্লেনের ইঞ্জিন বিকল হলে মিশি তার নিজস্ব সেসনায় উইলিয়ামকে নিয়ে ফ্লাই করে। কিন্তু শরণার্থীশিবিরের কাছাকাছি পতাকা দিয়ে চিহ্নিত মাঠে ল্যান্ড করার সময় কী এক মিসক্যালকুলেশনে সে চিহ্নিত লাইনের বাইরে চলে গিয়ে ডানা কাত করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বালুকার স্তূপে। আহত অবস্থায় তাদের দুজনকে হেলিকপ্টারে মেডিভ্যাক করে নিয়ে যাওয়া হয় কেনিয়ার নাইরোবিতে। হাত-পা ও পাঁজরের হাড়গোড় জোড়া লাগিয়ে একপর্যায়ে সেরে ওঠেন উইলিয়াম। কিন্তু পুরো ছয় দিন সম্পূর্ণ সংবিৎহারা অবস্থায় কোমায় থেকে মৃত্যু হয় মিশির।

স্মৃতিচারণার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে হাঁটছিলাম। সড়কটি সরল-সিধা। সামনে গাইড কিংবা কেভিন ও গ্রেইস কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে আমাদের পথচলায় এসে গেছে সহজাত রিদ্‌ম। সুরুজ হেলে যাচ্ছে। রোদের তেজও আর আগের মতো নেই। মনে হচ্ছে চাইলে এভাবে হাঁটা যায় ক্রোশ পর ক্রোশ। অতিক্রমও করা যায় বিপুল পথপরিক্রমা।

কাঁধে হাত রেখে আমাকে দাঁড় করান উইলিয়াম। তার চোখে অস্বাভাবিক দৃষ্টি দেখে আমি সতর্ক হই, ঠিক বুঝতে পারি না। তবে কি একটিমাত্র আলট্রা স্ট্রং পেইনকিলার তাঁকে এফেক্ট করল? জিজ্ঞেস করি, ‘হোয়াটস আপ উইলিয়াম?’ খুব সাবধানে কানের কাছে মুখ এনে তিনি বলেন, ‘সামটাইমস আই ফিল হার…ফিল হার প্রেজেন্স…গত রাতে তাঁবুতে মিশি অনেকক্ষণ আমার পাশে ছিল। তার শরীরের সেন্ডেলউড ও অ্যাম্বারের নির্যাস মেশানো পারফিউমের গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম।’

রেসপন্সে আমি কিছু বলি না। কিন্তু তব্দিল হয়ে উইলিয়াম বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। একপর্যায়ে জানতে চাই, ‘ক্যান ইউ ওয়াক নাও?’ মাথা ঝাঁকিয়ে যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছেন এভাবে ‘ওহ ইয়েস, আই সার্টেনলি ক্যান ওয়াক’ বলে জোর কদমে হাঁটতে শুরু করেন। বেশ খানিকটা হেঁটে এসে দেখি, শুধুমাত্র সাদাটে-ধূসর পাথরে পূর্ণ একটি জলহীন ঝোরার পাশে ঘাসে বসে কেভিন ও গ্রেইস। খানিক দূরে গাইডসহ পোর্টাররা চেষ্টা করছে আগুন ধরানোর।

কেভিন চশমা চোখে একটি হারবাল মেডিসিনের বোতলের লেভেল পড়ার চেষ্টা করছেন। পাশে রোদচশমায় চোখ ঢেকে কেমন যেন নেতিয়ে আছে গ্রেইস। বেলা পড়ে আসছে। তাই আমরা লেট-লাঞ্চের আয়োজনে ঘাসে তোয়ালে বিছাই। প্লাস্টিকের প্লেটে কেভিন স্মোকড ট্রাউটের টুকরাগুলো সাজান। আমিও ওয়ালনাট ও কিশমিশের ট্রেইলমিক্স প্যাকেটটি খুলি। হানড্রেড পার্সেন্ট ভেজিটারিয়ান গ্রেইস ও তার মোমের প্রলেপের মোড়া চিজ-বলের সঙ্গে শেয়ার করে হৌলগ্রেইন বিস্কিট। একজন পোর্টার মগে করে গরম পানি দিয়ে যান। আমি তাতে নেস-ক্যাফে মেশাই। কেভিন জনে–জনে একটি করে টারমারিকের সাপ্লিমেন্ট ট্যাবলেট বিলিবণ্টন করেন। গুঁড়ো হলুদের বেদনানাশক বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করে বাইফোকালের ওপর দিয়ে তাকালে গ্রেইস জানতে চায়, আইবুপ্রোফেন পিলের সঙ্গে টারমারিক মেশালে নেগেটিভ কোনো প্রতিক্রিয়া হবে কি? সুযোগ পেয়ে গুছিয়ে কেভিন তার ডাক্তারি মতামত পেশ করেন। গ্রেইস যে সাফার করছে মাইগ্রেনে, এবার তা স্পষ্ট হয়।

উঠে পড়ি আমরা। গাইডের বক্তব্য হচ্ছে, এখনো পিছিয়ে আছি, সুতরাং সন্ধ্যার আগে ক্যাম্পিং সাইটে পৌঁছা অসম্ভব। তিনি বিকল্প হিসেবে আদিবাসী কেচোয়াদের গ্রামে রাত কাটানোর প্রস্তাব করেন। আমরা রাজি হই ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে ওখানে পৌঁছানোর। এক সুযোগে আমি উইলিয়ামের মানসিক অবস্থার কথা কেভিনকে রিপোর্ট করি। তার ধারণা, উইলিয়াম হয়তো ডিপ্রেশনের পিল নিতে ভুলে গেছেন। ‘লেট মি টেক কেয়ার অব দিস,’ বলে কেভিন উইলিয়ামের পাশে পাশে হাঁটেন।

সঙ্গী গ্রেইস ঢিমেতালে হাঁটছে। আইবুপ্রোফেনে মাইগ্রেনের মাথা ধরা নিয়ন্ত্রণে আসছে কি না ঠিক বুঝতে পারি না। কম্বোডিয়ায় বসবাসের দিনগুলোতে আমিও নমপেন কিংবা বাটাংবাংয়ের রোদ সইতে পারতাম না। ক্রনিক মাইগ্রেনের সঙ্গে ঘরসংসারের শুরুয়াত তখন থেকে। দাঁড়িয়ে পড়ে ফ্যানি-প্যাক থেকে বের করে আমি তার দিকে এগিয়ে দিই ইউক্যালিপটাস অয়েলের ছোট্ট শিশিটি। ছিপি খুলে সে তা শোঁকে। তখনই খেয়াল করি, গ্রেইসের কবজিতে পরা লাকি চার্মের বলয়টি। মুক্তা ফলানো মাদার অব পার্ল কেটে তৈরি ছোট্ট ছোট্ট বুদ্ধমূর্তির ফিগারিনে সাজানো চার্ম সে যখন আংকর ওয়াটের চত্বর থেকে কিনেছিল, তখন আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে সাফার করছিলাম প্রবল মাইগ্রেনে।

কম্বোডিয়ান ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের বয়স্ক-শিক্ষাবিষয়ক বইটিতে বিষয়বস্তু হিসেবে আংকর ওয়াটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে ব্যবহার করার প্রসঙ্গে ভাবছিলাম, একবার মন্দিরটি দেখতে গেলে চমত্কার হয়। জানতাম যে গ্রেইসের হাজব্যান্ড মার্ক থাইল্যান্ডের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে গেছে সপ্তা–দিনের মোটরবাইক হাঁকানোর এক্সকারশনে। যেহেতু গ্রেইস–প্রস্তাবিত বইটির ইলাস্ট্রেশন করতে রাজি হয়েছে, সুতরাং তাকে ডে-ট্রিপে আমার সঙ্গে প্রকল্পের খরচে সায়াম-রিপ শহরে আংকর ওয়াট দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব করি। পরদিন শনিবারে সায়াম-রিপের আর্লি ফ্লাইটে উঠে গ্রেইস নির্লিপ্তভাবে জানিয়েছিল, সে কপর্দকশূন্য, পকেটমানির সামান্য টাকাপয়সাও তার পার্সে নেই। দিন পনেরো আগে, ব্যাংকে তাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকাপয়সা তুলে মার্ক নাকি পুরোটা খুইয়েছে ক্যাসিনোতে জুয়ার দান ধরে।

আংকর ওয়াটে পৌঁছে গ্রেইস পুরোটা সময় কাটায় পেশাদারি ভঙ্গিতে অসামান্য স্থাপত্যটির প্রেক্ষাপটে মূর্তিরাজির স্কেচ করে। ওই দিন রোদ ছিল প্রবল, আর দুপুরের পর মাইগ্রেনের শিরঃপীড়ায় আমি রীতিমতো কলাপসড হয়ে বসে পড়েছিলাম সুদীর্ঘ বারান্দার দেয়ালজুড়ে রিলিফ পদ্ধতিতে আঁকা মহাভারতের চিত্রকলার ঠিক নিচে। খুব অন্তরঙ্গ হয়ে সে আমার কপাল ও ঘাড়ে মালিশ করে দিয়েছিল টাইগার বাম।

কাঁটায় কাঁটায় পুরো দুঘণ্টা হেঁটে আমরা যখন একটি পাহাড়ি জনপদের কাছে এসে পৌঁছাই, সূর্য তখন ঢলে পড়ছে অরুণিম হয়ে ওঠা আন্দিজের তুষার–ছাওয়া শিখরে। এদিকে জনা-দশেক কেচোয়া নারী রীতিমতো পসরা সাজিয়ে খুলে বসেছেন দোকানপাট। ক্লান্তিতে উইলিয়াম বসে পড়ে ঘাসে। তার পায়ের মাসল টাটিয়ে উঠে কাঁপছে থেকে থেকে প্রবল স্প্যাজমে। বেন-গের টিউব খুলে গ্রেইস মলমটি মালিশ করে দেওয়ার জোগাড়যন্ত্র করছে। আমি ও কেভিন রসদপাতি কিনতে হাত লাগাই। পাওয়া যায় ‘সদিচে’ বলে ধনেপাতা প্রভৃতি ছড়ানো লেবুর রসে জারিত মাছ। পোর্টারদের প্রয়োজন প্রোটিনরিচ খাবার, সুতরাং কেভিন কিনে নেন মাছের পুরো এক হাঁড়ি। হোম–স্টে হিসেবে যে কেচোয়া পরিবারের সঙ্গে আমরা রাত কাটাব, তাদের জন্য আমি কিনি চিচা বা কর্ন বিয়ার।

টিলার ঢালে গড়ে ওঠা কেচোয়া জনগোষ্ঠীর গ্রামে পৌঁছাতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না, কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনা দেখে চমকে ওঠার হালত হয়! মনে হয়, আমরা যে অতিথি হিসেবে আসছি, এ সংবাদটি সম্ভবত দোকানিদের মাধ্যমে এরা আগেভাগে জেনে এথনিক পোশাক-আশাকে বর্ণাঢ্য হয়ে অপেক্ষা করছেন। এদের সবার হাতে আলাপাকার লোমে তাঁতে-বোনা বস্ত্রাদি। বছর দশেক ধরে পর্যটকদের হোম–স্টে হিসেবে আশ্রয় জোগাচ্ছেন, কিন্তু গৃহকর্তা ছাড়া কেউ এক বর্ণ এসপানিওল বলেন না।

ক্যাম্প সাইটের পরিবর্তে একটি গ্রামে আসতে পেরে আমরা যেমন খুশি হই, তেমনি কিঞ্চিৎ খোঁড়ানো উইলিয়ামের মাঠ-অভিজ্ঞতাও চাগিয়ে ওঠে। তিনি ভারি সুন্দর করে হেসে জনে জনে হাত মিলিয়ে ইশারায় নিশ্চিত করেন, আলপাকার লোমে বোনা অন্তত একটি করে পণ্য না কিনে আমরা গ্রাম ছাড়ছি না। সবচেয়ে বড় দোচালা ঘরখানা আমাদের দেওয়া হয়। আমরা পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে রিল্যাক্সড হয়ে বসি চাটাইতে।

কক–অব-দ্য-রক

অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙলেও কিছুক্ষণ স্লিপিংব্যাগে মটকা মেরে পড়ে থাকি। হাই-আলটিচ্যুডের কারণে রাতের পয়লা প্রহরে প্রাদুর্ভাব হয়েছিল হরেক বর্ণ ও নানাবিধ চিত্রের সমাহারে বিস্তারিত স্বপ্নের। তারপর কখন যে ব্যাপক ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেছি, ঠিক বুঝতেও পারিনি। ঘুলঘুলির চালুনিতে ছাঁকা হয়ে ছড়িয়ে পড়লে প্রথম আলোর নকশা, উঠে পড়ে ক্লাউড ফরেস্টের অন্দরমহলে আরেকটি দিনের প্রস্তুতি নিই।

হোম–স্টে হাউসের চিলতে বারান্দায় বাইনোকুলার, বার্ডবুক প্রভৃতি নিয়ে উইলিয়াম যেন ওত পেতে বসেছেন। হ্যামকে আধশোয়া গ্রেইস। কেভিন স্টেথিসস্কোপ দিয়ে শুনছেন তার বুকের শব্দ। তিনি বাইফোকালের ওপর দিয়ে তাকিয়ে মন্তব্য করেন, পালপিটিশন খানিক বেড়েছে। গ্রেইস গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলে, আমি না ভেবে পারি না, তার নাড়ির গতি বৃদ্ধির সঙ্গে পুরোনো দিনের বিবর্ণ ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি? মৃদু হাসিতে ঘুরে দাঁড়ায় সে। বারান্দার খুঁটিতে ভর দিয়ে এবার শরীর বাঁকিয়ে পায়ের মাসল স্ট্রেচ করার চেষ্টা করছে। খেমার কোনো মন্দিরে অপ্সরার মুখে অঙ্কিত অস্পষ্ট হাসির ইমেজটি ঝিক করে আমাকে স্ট্রাইক করে।

উঠানের ক্যাম্পফায়ার থেকে উসকে ওঠা আলোর শিখার সঙ্গে ভেসে আসে কফি ও পোড়া ভুট্টার গন্ধ। গাইড কেটলিতে করে নিয়ে আসেন গরম জল। তত্পর হতে হয় আমাকে। ব্যাকপ্যাক খুঁজে বের করি দার্জিলিং টির প্যাকেট ও ছাঁকনি। কেভিন কলতলায় মাথায় জল ঢালার মতো বিরাট একটি মগে গরম পানি ঢেলে তাতে ড্রপ করেন কয়েকটি টি-ব্যাগ।

চায়ের তাজা সুগন্ধিতে দ্রুত ফিরে পাই উজ্জীবন। দূর পাহাড়ের তুষারঋদ্ধ আরশিতে প্রতিফলিত হয় প্রথম প্রেমের অনিশ্চয়তার মতো মোলায়েম সূর্যরশ্মি, আর আমরাও বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য উরুবাম্বা নদীর পাড়। এদিকে পাখপাখালি অঢেল। গৃহকর্তা ভরসা দেন, লগ্ন অনুকূল হলে হয়তো তালাশ মিলবে বিরল কোনো খেচরের।

ঢালু ট্রেইলে আমাদের হাঁটতে হয় সাবধানে। রোদ এখনো উত্তপ্ত হয়নি, বাতাসে বেশ খানিকটা শীতের আমেজ। তাই গ্রেইস ফুলপাতার মোটিফ আঁকা একখানা শাল গায়ে জড়িয়ে পা টিপে টিপে রক্ষা করছে ভারসাম্য। কেভিন ওয়াইন–ফ্লাস্কের ছিপি খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন, আমি ইশারায় আপত্তি জানাই। ক্র্যাকলিং সাউন্ডে সশব্দ হয়ে ওঠে উইলিয়ামের রেডিও সেট। ইলিয়াসিন পালোমিনোর কল নিতে দাঁড়িয়ে পড়ি আমরা।

সালকানতি পাসের ট্রেইল ধরে ইলিয়াসিনের তদারকিতে পাঁচজন তরুণ ট্র্যাকারের দল ক্যাম্প সাইট ছেড়েছে আধঘণ্টা আগে। আটটা নাগাদ তারা পৌঁছাবে ইনকা ট্রেইলের ফিডার রোডে। তখন বদল হবে চড়নদারের। অর্থাৎ ইলিয়াসিন নিজে দায়িত্ব নেবে আমাদের মতো সিনিয়রদের। আর বর্তমান গাইড আমারু তরুণ ট্র্যাকারের ফাস্ট মুভিং ট্রুপটি নিয়ে জোর কদমে মার্চ করবে ইনকা ট্রেইলের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ ‘ডেড উওম্যানস পাস’–এর দিকে। সাড়ে আটটার মধ্যে সম্পূর্ণ রেডি হতে অনুরোধ করে সে লাইন ছাড়ে। হাইপার অ্যাকটিভ আমারুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার প্রত্যাশায় ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে।

বহতা জলের শব্দ নিশানা করে আমরা ফের ঢালুপথে আগুয়ান হই। প্রত্যাশিত পাখিদের তালাশ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে বিপত্তি বাধায় নাছোড় গোছের দালামানকা প্রজাতির বিরাট একটি হামিংবার্ড। খেচরটি গ্রেইসের শালে উজ্জ্বল রঙে আঁকা ফুলপাতা নিশানা করে ঘুরে ঘুরে কেবলই ঝ…ঝ… করে বাজিং সাউন্ড ছড়াতে থাকে।

আরও খানিকটা নেমে আসতেই পাওয়া যায় উরুবাম্বা নদীর পরিষ্কার ভিউ। ধরাধামে আকাশগঙ্গার প্রতিরূপ স্রোতস্বিনীটির শান্ত সারফেসে প্রতিফলিত হচ্ছে ভাসমান মেঘমালা। কমজোর কোমর নিয়ে আমরা আর নিচে নামতে চাই না। গৃহকর্তা ব্যাখ্যা করেন, তাঁদের কেচোয়া জনপদটি নাকি শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ইনকা ট্রেইল ধরে মাচু পিচ্চুর দিকে তীর্থযাত্রীদের নিশিযাপনের আশ্রয় হিসেবে। প্রাতঃকৃতের পরপরই তারা নেমে আসত পবিত্র এ নদীর পারে, কিন্তু স্পর্শ করত না জল। শুধু ডিভোশন নিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে তাকিয়ে থাকত চলিষ্ণু স্রোতের দিকে, আর চেষ্টা করত যাতে তাদের শরীরের প্রতিবিম্ব ছায়াপথবাহী জলের সঙ্গে মিলেমিশে ধাবিত হয় দূরে–সুদূরে আমাজনের মোহনার পানে। তথ্যটির মর্মার্থ আমাদের মধ্যে প্রতিফলিত হলে ক্রমশ সচেতন হতে থাকি তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আমাদের তফাত সম্পর্কে।

ঠিক তখনই উইলিয়াম স্রোতজলে ইয়োলো-বিল্ড পিনটেইল বলে কয়েক জোড়া হাঁস আবিষ্কার করে পরিচয় দেন পর্যটকসুলভ চঞ্চলতার। হলুদ ঠোঁটের এ বলাকা আচানক কিছু না। আমি আগ্রহ হারাই। অন্যরাও অস্থির হয়ে ওঠেন, যদি–বা ফেরার পথে বলে বেড়ানোর মতো কিছু পর্যবেক্ষণ করা যায়।

কিঞ্চিৎ ঘুরপথে রওনা হন গৃহকর্তা। পথরেখা এবার বেশ খানিকটা খাড়াই, তবে পাহাড়ি ভিউতে বৈচিত্র্য আসে। ঘাসে ছাওয়া মৃত্তিকা এদিকে বিবর্তিত হয়েছে শিলাপাথরের সুউচ্চ বিন্যাসে। আমাদের দাঁড়িয়ে পড়ার ইশারা দিয়ে গৃহকর্তা বলেন, ‘সিনিয়রেস, মিরা এসতে পাখারস টুনকিস’ (তাকিয়ে দেখুন, টুনকি পাখি)। আন্দিয়ান কক-অব-দ্য-রক পাখিকে যে কেচোয়া ভাষায় টুনকি বলা হয়, তা জানিয়ে দিয়ে উইলিয়াম আওয়াজ দেন, ‘ক্লিয়ারলি অ্যান আনমিসটেইকেবল সাইট অব কক-অব-দ্য-রক।’ বাইনোকুলারে চোখ রেখে কেভিনও ধুয়া তোলেন, ‘লুক অ্যাট দিস ব্রিলিয়ান্ট রেড অ্যান্ড অরেঞ্জ প্লুমেজ!’ এবার খালি চোখেও পরিষ্কার দেখতে পাই, রকি-ক্লিফের চিলতে প্লাটোতে তিনটি তীব্র লোহিত পালকের শিরোভূষণে সজ্জিত মেইল কক-অব-দ্য-রক। উইলিয়াম অত্যন্ত আকর্ষণীয় খেচরটির ল্যাটিন নাম ‘রুপিকলা পেরুভিয়ানস’ উচ্চারণ করে ফুস করে ছাড়েন দীর্ঘশ্বাস।

কক-অব-দ্য-রকেরা চুপচাপ বসে নেই। তার নড়েচড়ে। ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে কর্কশ আওয়াজ ছড়িয়ে কোনোটা লালঝুঁটি মস্তকটি কেবল তোলে আর নামায়; অন্যটি ডানা পাখার মতো প্রসারিত করে বাতাস করতে করতে তেড়ে যায়। কেভিন ফের ‘হোয়াট আ ভিভিড কালার’ বলে উচ্ছ্বাস ছড়ালে গ্রেইসও আলোচনায় শামিল হয়ে বলে, ‘গাইজ আর রিয়েলি ডায়ালিং আপ দেয়ার পারফরম্যান্স।’ বুঝতে পারি, পুরুষ পাখিগুলো আসন্ন প্রজনন ঋতুর প্রস্তুতিতে অনুশীলন করে নিচ্ছে কোর্টিং ড্যান্সের কলাকৌশল।

ফিমেল পাখিদের মুগ্ধ করার প্রয়াসে কক-অব-দ্য-রকদের বিপুল অধ্যবসায়ে ইমপ্রেসড হয়ে আমরা আরও মিনিট বিশেক হেঁটে ফিরে আসি জনপদের প্রান্তিকে। দুজন কেচোয়া নারী ইতিমধ্যে খোলামেলা জায়গায় হস্তচালিত তাঁতকলে বুনতে শুরু করেছেন বস্ত্র। হোম–স্টে হাউসেও কেচোয়া-কন্যারা চাটাইয়ে চাদর বিছিয়ে আয়োজন করছে ব্রেকফাস্টের। বিদায় নিতে আসেন গাইড আমারু। কিঞ্চিৎ রূঢ় আচরণের গোনাগারি হিসেবে উইলিয়াম আমাদের হয়ে দরাজ হাতে তাকে টিপস দেন। আমারু ‘আস্তা লা প্রক্সিমা’ বলে পথে নামলে তার বিদায়বাণীর মর্মার্থ, তথা ‘পরে দেখা হবে’ অনুধাবন করতে পেরে আমার আঁতকে ওঠার দশা হয়।

মেয়েরা মাটির সানকিতে করে পরিবেশন করে মিক্সড ভেজিটেবলের সঙ্গে কিনোয়া শস্যবীজ মিশিয়ে তৈরি জাউ, যবদানার স্যুপ ও পোড়া আলু। খেতে বসে উইলিয়াম কক-অব-দ্য-রক পাখির সম্ভাব্য প্রজননী তত্পরতার প্রসঙ্গ তুলে কী যেন মন্তব্য করেন। কেভিন পাল্টি দেন ‘রিভার-ভিউ কুড নট বি বেটার দেন দিস ফর লাভ মেকিং’ বলে। একটি কেচোয়া-কন্যা মাটির খুরিতে করে নিয়ে আসে ইসবগুলের মতো চিয়া-সিড ভেজানো শরবত। অন্য একটি কিশোরী ফাঁপা লাউ থেকে ঢেলে দেয় ক্যাকটাসের নেকটার।

গ্রেইস জানতে চায়, ‘হোয়াই আর ইউ সো কোয়ায়েট?’ আমার হয়ে জবাব দেন কেভিন, ‘হি ইজ থিঙ্কিং অ্যাবাউট হিজ রাইটিং। সুলতান এবার বার্ডস আর মেকিং লাভ ইন আন্দিয়ান রক নামে কিছু লিখবে।’ এবারও কিছু না বলে নেকটার ঢেলে দেওয়া মেয়েটির মুখে ভেষজের রস দিয়ে আঁকা আলপনার নকশাটি স্টাডি করি। পাঁজরে মৃদু খোঁচা লাগে, সঙ্গে সঙ্গে কানের কাছে মুখ এনে গ্রেইস বলে, ‘ডোন্ট গেট অ্যানি ক্রিয়েটিভ আইডিয়া!’ আমার পর্যবেক্ষণের ধার কেটে যায়। ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ভাবি, আমাকে যে পথঘাটে নারী-পুরুষের বর্ণনা লিখে জীবনধারণ করতে হয়, এ বিষয়টা বেগানা এই আওরতকে বোঝাই কীভাবে?

প্রতিশ্রুতিমাফিক কেচোয়া–তাঁতশিল্পের নমুনা হিসেবে আলাপাকার আলোয়ান, স্কার্ফ ও মাফলার প্রভৃতি কিনে আরেক পেয়ালা কোকা পাতার তপ্ত নির্যাস পিয়ে ব্যাকপ্যাক কাঁধে হোম–স্টে হোস্টের চমত্কার পরিবারটিকে দরাজ হাতে টিপস দিয়ে ধন্যবাদ জানাই। তারপর এসে দাঁড়াই সড়কের মোড়ে। দেখি, ট্রেইল-হেড ছেড়ে এগিয়ে আসছে আমাদের চেনা গাইড ইলিয়াসিন পালোমিনো। তার পেছন পেছন আসেন তাগড়া জওয়ান গোছের একজন পোর্টার। মানুষটি বয়ে এনেছেন এক্সট্রা কয়েকটি পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার।

মাত্র দুই মিনিটে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ইলিয়াসিন ট্রেইল–হেড দেখিয়ে বলে, ‘লেটস মুভ অ্যালং।’ হাঁটতে হাঁটতে আমি বলি, ‘কে বুয়োনো ভেরতে ইখো’ (তোমাকে দেখতে পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি, পুত্র)। ইলিয়াসিন ‘ইগুয়ালমেন্তে পাপিতো’ (সেম উইথ মি, ফাদার) বলে ঘাড় বাঁকিয়ে ‘লেটস অল ওয়াক ইন আ রিল্যাক্সড ম্যানার, নো রাশ টুডে’ বলে আমাদের আশ্বস্ত করে।

মিনিট তিরিশেক ঢিমেতালে হেঁটে আমরা চলে আসি সবুজাভ গাছপালায় নিবিড় এক উপবনের কাছে। কক-অব-দ্য-রক পক্ষী দেখতে পেয়ে উইলিয়াম বেজায় খোশমেজাজে আছেন। তিনি ঘটনাটি সেলিব্রেট করার জন্য বিতরণ করেন গুর্মে বাটারস্কচ টফি। চুষতে চুষতে আমরা এগিয়ে আসি ইনকাদের আমলে নির্মিত একটি কালভার্টের কাছে। বেলেপাথরের রেলিংয়ে বসে এক তরুণী পান করছে স্পোর্টস ড্রিংকস। উইলিয়াম ‘হাই অ্যামেন্ডা, হাউ আর ডুয়িং’ বলে দাঁড়িয়ে পড়ে জানতে চান, ‘ইউ লুক টায়ার্ড। নিড সাম ফুড?’ মেয়েটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, সে ম্লান হেসে বলে, ‘আই অ্যাম নট হাংরি, উইলিয়াম। অল আই নিড ইজ সাম সুইট টেন্ডার লাভ।’ উইলিয়াম তার কাঁধে হাত রেখে জানতে চান, ‘উড হাগিং অ্যান ওল্ড গাই ডু ইউ অ্যানি গুড?’ হাসি ফোটে অ্যামেন্ডার মুখে। সে উইলিয়ামকে জড়িয়ে ধরে তার শ্মশ্রুমণ্ডিত আননে কুচুত করে চুমো খায়। প্রতিদানে তিনি তাকে ডার্ক চকলেটের আস্ত একটি বার উপহার দিয়ে, ‘সি ইউ অ্যারাউন্ড ইন দ্য ট্রেইল, সুইট গার্ল’ বলে ফের শামিল হন আমাদের পদযাত্রায়।

যেতে যেতে কখন যে আমাদের পায়ের পেশি ওয়ার্ম হয়ে উঠেছে, ঠিক বুঝতেও পারিনি। চলার গতিও যেমন বেড়েছে, তেমনি সহজাতভাবে রক্ষিত হচ্ছে সমবেত ট্র্যাকিংয়ের রিদম। হাঁটতে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, তবে নাক-কান ও মস্তিষ্কের কোষে কোষে যেন কিছু একটার খামতি ঘটছে। বুঝতে পারি ওপরের দিকে উঠছি আমরা। এবার হাঁটতে হয় মনোযোগ দিয়ে। মাথায় ‘লাইট হেডেডনেস’ প্রবল হয়ে উঠছে। তা হোক, বিষয়টা অবজ্ঞা করে আমি পথচলার রিদম মেইনটেইন করি।

দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়ি দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি গিরিপথের কাছাকাছি। ইলিয়াসিন মিনিট কয়েকের বিরতির প্রস্তাব করে। আমরা একটু বসি। কুয়াশাচ্ছন্ন এক পর্বতের দিকে নজর রেখে ওয়ালনাট, কিশমিশ ও চিজ-ক্র্যাকার চিবাই। পান করি ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস্। ফের হাঁটি। পথরেখা সমতল হলেও মনে হয় সিঁড়ি ভেঙে উঠছি এগারোতলা দালানে।

প্রত্যাশিত শ্বাসাঘাত শুরু হয়। কিন্তু যে সড়কে এসে পৌঁছি, বেলেপাথর বিছানো এ ট্রেইলটি জগৎ-সংসারে ইনকা ট্রেইল নামে পরিচিত। সুতরাং পথশ্রমের ক্লেশ সার্থক মনে হয়। উইলিয়ামের চকলেট ভান্ডারে সরবরাহ অঢেল। আমরা চাকলা–চাকলা চকলেট চিবোই আর স্টেপিং স্টোনের মতো পাতা সংকীর্ণ ইনকা ট্রেইল ধরে আগুয়ান হই। যেতে যেতে ভাবি, মাচু পিচ্চুর দিকে ধাবিত এ সড়কটি শত শত মাইল দূর থেকে পাথরের চাকলা ক্যারি করে এনে তৈরি করিয়েছিলেন ইনকা-সম্রাট পাচাকুতি। দৈহিকভাবে যদিও আমাদের প্রচুর স্ট্রেস হচ্ছে, তারপরও না ভেবে পারি না, পনেরো-শতকের দিকে যখন এ রাস্তাটি তৈরি হয়েছিল, তখন অব্দি ইনকাদের চাকা সম্পর্কে যেমন ছিল না তেমন কোনো ধারণা, তেমনি গরু, ঘোড়া, গাধা প্রভৃতি ড্রাফট অ্যানিম্যালও প্রাক্‌-স্প্যানিশ যুগে আন্দিজ তথা সমগ্র আমেরিকার দুটি মহাদেশের সর্বত্র ছিল সম্পূর্ণ দুর্লভ।

একটু দাঁড়াতে বলে ইলিয়াসিন বিতরণ করে স্যান্ডউইচ-ব্যাগ ভর্তি গোছা গোছা কোকা পাতা। আমরা চিবাতে চিবাতে ফেলি ভারি পদক্ষেপ। সে ব্যাকপ্যাকের স্ট্র্যাপ টেনেটুনে অ্যাডজাস্ট করে দিয়ে আওয়াজ দেয়, ‘সিনিয়রেস, পর ফাভর কামিনা লেনতো ই কনসতানতে’ (প্লিজ, আস্তে-ধীরে…স্টেডি হয়ে হাঁটুন)। ধীর লয়ে এগোতে এগোতে আমি ইতিহাসের একটি হিসাব মেলাতে চেষ্টা করি। পানিপথের যুদ্ধে বাদশাহ বাবরের বিজয়ী হওয়ার ষাট-সত্তর বছর আগে পবিত্র উপত্যকায় রাজত্ব করতেন ইনকা সম্রাট পাচাকুতি। তখন দিল্লির সালতানাতে গদিনশিন ছিলেন লোদীরা, নাকি অন্য কেউ? পথপার্শ্বে উইলিয়াম স্পট করেন একটি গ্রিন-জে পাখি। হলুদ ও সবুজে মেশানো পাখিটি দৃশ্যত আকর্ষণীয় হলেও তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য কেউ দাঁড়াতে চায় না।

আমাদের পথচলা কতক্ষণ জারি থাকে ঠিক খেয়াল থাকে না। তবে একসময় মাথার ওপর ঝলমলে সুরুজ নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি ঊষর প্রান্তরে। হাই ডেজার্টে গাছপালা তেমন নেই। উপলব্ধি করি যে বেরিয়ে এসেছি আমরা ক্লাউড ফরেস্টের অন্দরমহল থেকে। এবার এগোচ্ছি আলপাইন ক্লাইমেটিক জোনের প্রান্ত ঘেঁষে। পথের দুপাশে ব্যাপ্ত বিরাট প্রান্তরে ক্যাকটাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটছে অনেকটা ডেইজির মতো শ্বেতশুভ্র ফুলদল।

এসে পড়ি ইনকা-যুগের ভগ্ন এক সামরিক স্থাপনার কাছে। দালানকোঠায় সম্প্রসারিত সৈনিক-ব্যারাকের পাষাণে গড়া কাঠামোর ভেতরে দাঁড়িয়ে ভাবি, আজ থেকে সাড়ে-পাঁচ শ বছর আগে এখানকার মিলিটারি লুকআউটের মিনারে বসে কেচোয়া গোত্রের যেসব সৈনিক নজরদারি করত ইনকা ট্রেইলের, কত দূরে প্রসারিত ছিল তাদের কল্পনা? সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে গাঙ্গেয় বদ্বীপ কিংবা সিন্ধু উপত্যকায় যে আরও হাজার হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা, ভিন্ন মহাদেশগুলোর কোনো সংবাদ কি পেত তারা?

ভগ্ন স্থাপনাটি পাহাড়ি এক নদীর কাছেই। পাথরের গাঁথুনির কৃৎকৌশল পরীক্ষা করতে করতে শুনতে পাই বহতা জলের তুমুল শব্দ। বিরান সেনাছাউনিটি ঘিরে ভুঁইফোড়ের মতো জেগে উঠেছে ত্রিকোণ দুটি পর্বত। ইচ্ছা হয় কিছুক্ষণ এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করি আন্দিজের প্রকৃতিকে। চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো কেভিন। ওয়ালেট বের করে তিনি তাকিয়ে আছেন একটি ছবির দিকে। তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় চোখাচোখি হয়। বলেন, ‘ইয়েস ইটস টিয়া, মাই আনসোশ্যাল ওয়াইফ। আই অ্যাম মিসিং হার। মিসিং টেরিবলি।’ কিছু না বলে সরে আসি ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানের অন্যদিকে।

দেখি, চোখ–মুখ-কান শজারুর কাঁটার মতো উত্কর্ণ করে দাঁড়িয়ে উইলিয়াম। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তিনি আমাকে নিঃশব্দ থাকার ইশারা দিতেই শুনতে পাই একটি বার্ড-কল। এবার এতে এসে মিশ্রিত হয় অন্য একটি পাখির কলকাকলি। তৃতীয় পাখিটি ডেকে উঠতেই ফিসফিসিয়ে বলি, মকিং-বার্ড নানা ধরনের পাখির কাকলি অনুকরণ করছে। মাথা ঝাঁকিয়ে আমার অনুমান বাতিল করে দেন উইলিয়াম। আন্দিজের এত হাই এলিভেশনে মকিং-বার্ড থাকার সম্ভাবনা জিরো।

ভগ্ন দালান থেকে বেরিয়ে আসার মুখে দেখি, পনিটেইল কেতার চুলওয়ালা এক কেচোয়া পুরুষ জানালার কাঠামোয় বসে বাজাচ্ছেন অত্যন্ত ছোট্টমোট্ট একটি বাঁশরী। আর তা থেকে বেরোচ্ছে একের পর এক হরেক ধরনের পাখির কাকলি। আমাদের দেখতে পেয়ে নেমে এসে তিনি অতিক্ষুদ্র এ বাদ্যযন্ত্র দেখিয়ে জানান, এটিকে আন্দিজে বলা হয় ওকারিনা। জাদুময় বায়ুযন্ত্র বাজানো মানুষটি ঝোলায় করে ক্যারি করছেন গিনিপিগের শুকনা মাংস। পোর্টারদের পরিশ্রমের কথা ভেবে আমি তা খরিদ করি।

বেজে ওঠে ইলিয়াসিনের হুইসল। ট্রেইলে ফিরতে হয় এবার। সবার সঙ্গে মিলেঝুলে ফের হাঁটি; আর মনে লেগে থাকে ভগ্নস্থাপনার নস্টালজিক আবহে আশ্চর্য বাঁশরী ওকারিনায় পাখির কাকলি শোনার স্মৃতি।

ডেড উওমেনস পাস

পর্বত দুটির মাঝবরাবর প্রশস্ত গিরিপথটিতে পাথর বসানো। দুজন দুজন করে টুকটাক কথাবার্তা বলে হাঁটা যায় সহজে। আমার পাশে পাশে তব্দিল হয়ে হাঁটছেন কেভিন। কিছু বলছেন না। তার মধ্যে কখনো–সখনো মিইয়ে আসা লজ্জাবতী লতাটির মতো মুষড়ে পড়ার ধাত আছে। লাওস বসবাসের দিনগুলোতে বিষয়টি আমার নজরে আসে। ডিপ্রেসড হওয়ার পেছনে প্রায়ই জড়িয়ে থাকত সে যুগে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী, কেভিনের জবানিতে ‘মাই আলট্রা-আনসোশ্যাল ওয়াইফ টিয়া’। তখন বেড়ে যেত ড্রিকিংয়ের মাত্রা। কলতলার মগ সাইজের টাম্বলারে ফেনা উপচানো বিয়ার ঢেলে তাতে হুইস্কির শর্টগ্লাস চুবিয়ে একাকী কোনো পাবে বসে পান করতেন। আজও তাঁর হিপ-পকেটে উঁকি দিচ্ছে ওয়াইন-ফ্লাস্ক। আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি।

আমাদের নমপেন-বাসের দিনগুলোতে কেভিন ছিলেন কনফার্মড ব্যাচেলর। বিষয়টির গুণগত পরিবর্তন হয় তিনি যখন চাকরি নিয়ে আসেন লাওসের ভিয়েনচান শহরে। হোম-লিভে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। মাসখানেক পর তার চেয়ে বয়সে বছর-দশেক জুনিয়র টিয়াকে বিয়ে করে সস্ত্রীক ফিরেছিলেন কেভিন। কাউগার্ল কেতার হাইবুট পরা হ্যাট মাথায় টিয়া নাকি বছর দুয়েক আগে নিউইয়র্কের কোনো এক টপলেস বারে নিরাবরণ-বক্ষা হয়ে ড্যান্স করত। মাসখানেকের মধ্যে সে ছাদখোলা জংধরা একটি ফক্সওয়াগন কিনে তা নিজে মেরামত করে একাকী যাতায়াত শুরু করে সর্বত্র। একদিন কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ফক্সওয়াগনটি পার্ক করে বনেটে বসে ক্যানাবিস স্মোক করছিল টিয়া। রোয়াকে গুলতানি মারা এক যুবক তাকে লক্ষ্য করে অশালীন মন্তব্য করলে জবাবে কুংফুর মারপ্যাঁচে জবর ধরনের জখম করে শুধু সেনশনের সৃষ্টি করে না, আমাদের মধ্যেও তৈরি করেছিল নিদারুণ কৌতূহলের।

টিয়ার দেহবল্লরীতে ছিল একধরনের বন্য আকর্ষণ। পূর্ণ-ঠোঁটি এই নারীকে সম্ভবত ভালোবেসেছিলেন কেভিন। বিবাহোত্তর রিসেপশনে টিয়া রাজি হয়নি। কারও বাসায় অনুষ্ঠিত পার্টি-পরবেও তাকে ছাড়া একা আসতেন কেভিন, আর কাছেপিঠে কেউ না থাকলে তার শরীরের প্রশংসা করে বলতেন, ‘লুক, শি হ্যাজ দ্য ফাইনেস্ট লিপ্‌স টু কিস।’

ফক্সওয়াগন চালিয়ে গ্রামে-গঞ্জে একা ঘুরে ঘুরে টিয়া সংগ্রহ করত মৃত পশুর হাড় ও করোটি। এগুলো মেজে–ঘষে কেটেছেঁটে তৈরি করত জুয়েলারি। মেয়েটি অগোছালো কিছু সহ্য করতে পারত না। সম্ভবত ভুগত ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারে’। কদাচিৎ আমাদের ঘরে এলে সম্পূর্ণ চুপচাপ থাকত। তবে নিজে থেকে ঠিক করে দিত কোঁচকানো টেবিল-ক্লথ। কামরায় কামরায় ঘুরে কুড়িয়ে তুলত আমাদের ছোট্ট মেয়ে কাজরির এলোমেলো করে ছড়িয়ে রাখা খেলনাগুলো। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে সব শেলফে তুলে রেখে বলত, ‘কেভিন, হানি, ফিনিশ ইয়োর ড্রিংকস কুইকলি অ্যান্ড লেটস গো ব্যাক টু হোম।’

টিয়ার সঙ্গে কেভিনের সেপারেশন হয়েছে। সে অ্যারিজোনার ডেজার্টে একটি ট্রেইলারে একাকী বসবাস করছে, এ তথ্য আমাকে বিশেষ অবাক করেনি। কিন্তু ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়, বিচ্ছেদ হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়নি। কেভিন ওয়াইন ফ্লাস্কের ছিপি খুলে চুমুক দিলে আমি অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করি, ‘উড ইউ লাইক টু টক?’

তিনি জবাব দেন, ‘নট রিয়েলি…বাট…ইট ইজ অল অ্যাবাউট মাই হেল্‌থ ইস্যুজ।’ জানতে চাই, ‘হোয়াট অ্যাবাউট ইয়োর হেল্‌থ ইস্যুজ, কেভিন?’ প্রচুর ভণিতা করে যা বলেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, রিটায়ারের পর ধরা পড়ে তার একটি কিডনি ড্যামেজের বিষয়টি। প্রয়োজন পড়ে ট্রান্সপ্ল্যান্টের। সেপারেশনে থেকেও টিয়া তাকে নিজের একটি কিডনি ডোনেট করেছে। কেভিনের ভাষায়, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, আই অ্যাম ওয়াকিং উইথ দ্য হেল্প অব টিয়াজ কিডনি রাইট নাও।’ শুনে আমি শিউরে উঠি। তিনি ফের কথা বলেন, ‘মাঝেমাঝে আমি তার ডেজার্ট-ট্রেইলারে যাই, বাট টিয়া রিমেইন্ড সো ক্রুয়েল…সো হার্টলেস…আমার সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, ট্রেইলারের দুয়ারটুকু পর্যন্ত খোলে না।’

আমি কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাই না। হেঁটে যেতে যেতে কেবলই মনে হতে থাকে, যত নিষ্ঠার সঙ্গেই আমার কাছাকাছি কোনো মানুষকে আমি স্টাডি করি না কেন, একপর্যায়ে উপলব্ধি করি, তার সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি খুবই অল্প। মানবচরিত্রকে চিনতে পারা নিয়ে আমার অহংকারের জলবেলুনটি কেভিনের দেওয়া তথ্যের আলপিনে নিমেষে ফুটো হয়। আমি হাত বাড়িয়ে কেভিনের কবজি স্পর্শ করতে চাই। তিনি ওয়াইন ফ্লাস্ক এগিয়ে দিয়ে ম্লান হেসে বলেন, ‘টিয়া আমার দিনযাপনের মেয়াদ আরও বছর-পাঁচেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আই লাইক টু ইউজ দিস টাইম টু ইট ড্রিংক অ্যান্ড বি মেরি।’

গিরিপথের প্রান্তে পাওয়া যায় সুন্দর একটি স্পট। আমরা লাঞ্চের বিরতিতে ইয়োগা-ম্যাট পেতে তাতে খাবারদাবার সাজাই। কেভিনের আনা স্মোকড স্যামনের সঙ্গে আমি যোগ করি পুরো এক প্যাকেট পুষ্টিকর বাদাম ম্যাকাডামিয়া নাটস। উইলিয়ামও প্লাস্টিকের প্লেটে সাজান খেজুর। পোর্টার-সরদারকে গিনিপিগের শুকনো মাংস উপহার দিলে তিনি পেশি ফুলিয়ে চাঙা হয়ে ওঠার ইঙ্গিত করেন। অন্য একজন পোর্টার আমাদের এনে দেন ভাজা আলু। পাতার বাস্কেটে করে আলুগুলো দিয়েছেন আমাদের হোম–স্টে হোস্ট। খাবারের আয়োজন খারাপ না, কিন্তু স্যামন মাছের টুকরো গিলতে গিয়ে অনুভব করি আলটিচিউড সিকনেসজনিত বিবমিষা।

খানিক দূরের বোল্ডারে বসে একটি গ্রিন-জে পাখি কলকাকলিতে ঘাড় বাঁকিয়ে খাবারের দিকে তাকায়। উইলিয়াম ক্যামেরায় ফোকাস করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাঁর হাত কাঁপছে। এক টুকরো স্যামন ছুড়ে দিলে গ্রিন-জে চলে আসে কাছাকাছি। বেপরোয়াভাবে মাছের টুকরো খুঁটে খেয়ে ঠোঁট ফাঁক করে ফের কিছু চায়। আমি ছুড়ে দিই কয়েকটি ম্যাকাডামিয়া বাদাম। পরপর কয়েকটি স্ন্যাপশট নেন উইলিয়াম।

স্পিরিট-স্টোভে পানি ফুটিয়ে ইলিয়াসিন কফি তৈরি করে। সে বিবমিষা-প্রতিষেধক পিল নেওয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। গ্রেইস চকলেটের প্রলেপে মোড়া সুপার-সুইট বিস্কুটির টিন খুললে দৈহিক কষ্টটা সহনীয় হয়ে ওঠে। খেয়াল করি, উইলিয়াম গ্রিন-জের কেবলমাত্র একটি উতরানো ছবি প্রচুর প্রাইড নিয়ে গ্রেইসকে দেখাচ্ছেন। তার হাবভাবে মনে হয়, আলোকচিত্রটি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক–এ ছাপার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।

এবার ভাঙতে হয় খাড়াই। পোর্টাররা বিপুল বোঝা নিয়ে অবলীলায় পাড়ি দিচ্ছেন একের পর এক ধাপ। তাঁদের ভারী পদশব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে। ইলিয়াসিন অনুরোধ করে যাতে তাড়াহুড়া না করে আস্তে-ধীরে আমরা সাবধানে উঠি। চলাচলে শ্বাসাঘাতের ব্যাপারটা প্রকট হয়ে ওঠে। তাই বারবার থেমে আমরা দম নেই। একপর্যায়ে অক্ষত হালতে উঠে আসি সমতল এক প্লাটোতে।

সামনের গাছপালাহীন বাদামি ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে কেভিন বলে ওঠেন, ‘হোয়াট আ রিওয়ার্ডিং মাউন্টেইনস্কেপ।’ তারপর গলার স্বর নামিয়ে ফের বলেন, ‘এ মাঠে নিশ্চয়ই মরা পশুর হাড়গোড় রোদে শুকিয়ে ব্লিচ হতে হতে খটখটে সাদা হয়ে উঠেছে। টিয়া রিয়েলি লাভ দিস কাইন্ড অব ওয়াইড ওপেন মিডো। সঙ্গে থাকলে সে এখনই মাঠে খুঁজতে শুরু করত পশুর কঙ্কাল। তার বানানো হাড়ের জুয়েলারি আজকাল অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে।’

কেভিনের কথা শুনি। একটু আগে আমি উইলিয়ামের গ্রিন-জে পাখিতে আগ্রহ হারিয়েছি। এবার কেভিনের টিয়াবিষয়ক বাতচিতে উত্সাহ হারাই। আমার মনোযোগে প্রধান হয়ে ওঠে বাদামি ঘাসে ছাওয়া আদিগন্ত একটি প্রান্তর, যার আকাশজুড়ে এ মুহূর্তে উড়ছে ‘আন্দিয়ান কনডর’ বা বিশাল ডানার শকুন। কল্পনাপ্রবণ হয়ে ওঠে মন। ইচ্ছা হয়, এখানে তাঁবু খাটিয়ে বাস করি দুটি দিন। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে দেখি হাই-ডেজার্টের পতঙ্গ। জার্নালে লিপিবদ্ধ করি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর ডানার বর্ণবৈচিত্র্যের বিবরণ।

খানিক দূরে প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কেচোয়া গোত্রের একজন আদিবাসী নারী গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। আমি হাত নাড়ি, আর চলতে চলতে ভাবি, কী যে ভালো হতো যদি–বা ইনার সংসারে একরাতের জন্য মেহমান হতে পারতাম। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যটি পেছন ফেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হয় সামনে। বাঁকে এসে তাঁকে আর দেখতে পাই না, কিন্তু অজানা এই মহিলার ইমেজটি স্টিক করে থাকে স্মৃতিতে।

প্রান্তরে পাড়ি দিতে দিতে ভাবছিলাম, যাক, ওপরে ওঠার দৈহিক জিল্লতি থেকে বাঁচা গেল। দেখি, মন্দ অদৃষ্টের মতো আরেকটি চড়াই ঠিক নাকের ডগায় ঝুলে আছে। বিরতি নেওয়ার সুযোগ ঘটে না। শুধু ইলেকট্রোলাইট পান করে ফের সোপান ভাঙার উদ্যোগ করি। ধীর লয়ে আগে বাড়তে বাড়তে অনুভব করি, আলটিচিউড-জনিত লাইট-হেডেডনেসের সঙ্গে চাগিয়ে উঠছে প্রবল খিদা। আমি সচেতন যে লাঞ্চে প্রোটিন কিংবা কার্বোহাইড্রেট পাকস্থলীতে পুরিনি তেমন, কিন্তু সবাই একের পর এক দাঁড়িয়ে ট্রেকিং-স্টিকে ঠেকা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এখনই লাইন ভেঙে খাবার খোঁজাখুঁজি করাটা অসমীচীন। তাই অগ্রযাত্রার অব্যাহত রাখি।

মিনিট বিশেক পাহাড় ভাঙার পর দম ফেলার ফুরসত হয়। গ্রেইস জানতে চায়, ‘হোয়াই আর লুকিং সো পেইল?’ আন্দাজ করি, হয়তো হাইপোগ্লাইসিমিয়ার কারণে ব্লাড-সুগারে গড়বড় হচ্ছে, ব্যাকপ্যাক খুলে খাবার বের করে এখনই কিছু মুখে দেওয়া উচিত, কিন্তু জয় করতে পারি না অনীহাকে। বিস্কিট বা বাদাম কোনো কিছু খোঁজাখুঁজি করতে একদম ইচ্ছা হয় না। ইলিয়াসিন ফের আগ বাড়ার ইশারা দেয়। গ্রেইস আমার মুঠোয় পুরে দেয় একটি চকলেট-কোটেড গ্র্যানোলা বার। আমাদের থমকে দঁড়ানো ইলিয়াসিনেরও নজরে পড়েছে, সে সোপান ভেঙে নেমে এসে জানতে চায়, ‘হোয়াট ইজ গোয়িং অন, পাপিতো?’

গ্রোনলা-বারটি চিবাতে-চিবাতে অনুভব করি, আমার কনফিডেন্স উপে গিয়ে মনপ্রাণ ভরে উঠছে তুমুল দ্বিধাদ্বন্দ্বে। নার্ভাসভাবে পা ফেলি আর জানতে চাই, ‘ইফ আই কলাপ্স অ্যান্ড ক্যান্ট ক্লাইম্ব?’ আমার উদ্বেগকে আমলে আনে না ইলিয়াসিন। উত্সাহ দিয়ে বলে, ‘পাপিতো, তুমি সিয়েরা লিওনের মাউন্ট বিনতুমানির চূড়ায় উঠে ক্যাম্প করেছ। ইনকা ট্রেইল ইজ নথিং ফর ইউ। জাস্ট কিপ গোয়িং।’

কায়ক্লেশে পাথরের সোপান ফের ভাঙতে ভাঙতে ভাবি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত্সামান্য ওপরে বিনতুমানি পাহাড়ে গরু-রাখালেরা বকনা-বাছুর সামলাতে সামলাতে কঞ্চি দুলিয়ে উঠে পড়তে পারে। ইনকা ট্রেইল ইজ আ লট মোর চ্যালেঞ্জিং বিজনেস। মনে হয়, আমরা হাজার ফিটের ওপর দিয়ে চেষ্টা করছি এবড়োখেবড়ো সিঁড়ি ভাঙার। একপর্যায়ে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে ওঠার পালা শেষ হয়ে সুযোগ আসে বিরতির। পাওয়া যায় বোল্ডারে হেলান দিয়ে বসার মতো একচিলতে সমতল।

উইলিয়ামের শ্বাসাঘাত তুমুল হয়ে উঠেছে। ইলিয়াসিন পোর্টেবল সিলিন্ডারে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে দিয়ে জানায়, আমরা উঠে এসেছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফিট ওপরে। শ্বাসকষ্ট একটু হবে, তবে সমস্যা কিছু নেই, পোর্টাররা ক্যারি করছে এক্সট্রা অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর দুর্গম ‘ডেড উওমেনস পাস’ ক্রস করতে না পারলে না হয় হাই-আলটিচিউডে আমরা ক্যাম্প করব। সঙ্গে খাবারদাবারও যথেষ্ট। না হয় গন্তব্যে দুদিন পরে পৌঁছালাম। তার বিনীত অনুরোধ, ‘সিনিয়রেস, কাম ডাউন। কিপ ইয়োর কুল। উই উইল ওভারকাম দিস।’

গ্রেইস জানতে চায়, ‘ক্যান উই মেডিটেট ফর ফিফটিন মিনিটস?’ হাসিমুখে ইলিয়াসিন সম্মতি দেয়। বলে, ‘ফিফটিন কেন, পুরো তিরিশ মিনিট মেডিটেট করুন। ইট ইজ ইমপরট্যান্ট দ্যাট ইউ গাইজ আর টোটালি রিল্যাক্সড।’

এক যুগে ইন্দোচীনে কাজ করা বান্দাদের কাছে মেডিটেশন নতুন কিছু না। গ্রেইসের তদারকিতে আমরা ইয়োগা ম্যাটে আসন পেতে বসি। তাপমাত্রা নেমে এসেছে। তাই পরে নিই আলপাকার সোয়েটার। গ্রেইস সবাইকে নিশ্বাস-প্রশ্বাসে ক্রমশ শান্ত হয়ে ওঠার অনুরোধ করে বলে, কারও মনোযোগ নিবদ্ধ করতে অসুবিধা হলে ধ্রুপদি সংগীত ‘বি স্টিল মাই সৌল’–এর ঝংকারকে মনে করতে।

ফিনল্যান্ডের মিউজিক কম্পোজার জিন সিবেলিয়াসের (১৮৬৫-১৯৫৭) অধ্যাত্ম-অঙ্গের মূর্ছনাটি স্মরণ করতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। মনোযোগী নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মনমেজাজও শান্ত হয়ে আসে, কিন্তু নার্ভাসনেস ঠিক কাটে না। চেষ্টা করি, প্রস্তাবিত সংগীতের প্রতিটি নোটেশন আলাদাভাবে স্মরণ করার। ক্রমশ মেঘাচ্ছন্ন এক অনুভূতিতে ছেয়ে যায় দেহ–মন; আর মনে হয় আমার অবচেতনের সায়রে ক্রমশ দ্রবীভূত হচ্ছে আন্দিজের তুষারময় শিখর। সমগ্র সত্তা যেন পরিপার্শ্বের নিসর্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠছে।

সিঙ্গিং বৌলের ঘণ্টাধ্বনিতে চোখ খুলি। আশ্চর্য লাগে সামনের বোল্ডারে গোটা সাতেক পতঙ্গ দেখতে পেয়ে। এদের বর্ণবহুল শরীরের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তবে কি আন্দিজের অদৃশ্য দেবতা সাড়া দিয়েছেন আমার স্বপ্নে? পেছন থেকে ভরাট গলায় কে যেন বলে ওঠেন, ‘হোয়াট আ বিউটিফুল ইরিডিসেন্ট লিটল ক্রিয়েচারস!’ চমকে ঘাড় ঘোরাই।

দেখি, আমার ঠিক পেছনে বসে আছেন কারাগারে ৯ বছরের মেয়াদ খেটে বেকসুর খালাস পাওয়া কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ উইন্ডস্ফিয়ার জোনস। তিনি উঠে গিয়ে নাটকীয়ভাবে গ্রেইসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলেন, ‘ডার্লিং, ইউ লুক সো কাম অ্যান্ড বিউটিফুল। উইল ইউ প্লিজ ব্লেস দিস ব্ল্যাকম্যান?’

মৃদু হেসে গ্রেইস তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দিলে তিনি তাতে চুমো খেয়ে জানান, কারাগারে ৯ বছর তাঁর খুব খারাপ কাটেনি। অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে একটি ছোটখাটো ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। তবে ওই একটি জিনিস—নারী—৯ বছরে যার মুখ তিনি একবারও দেখেননি।

উইন্ডস্ফিয়ার জোনস বিদায় নিয়ে ফের শক্ত পায়ে সোপান ভাঙেন। উঠতে উঠতে তিনি গুনগুনিয়ে কিছু গাইছেন। আমরা অবাক হয়ে সুদর্শন মানুষটির ঊর্ধ্ব উঠে যাওয়া দেখি। ক্রমশ তার সুরভাঁজা চমত্কার সংগীতের ছন্দলয়ে বিস্ফোরিত হয়, আর পাহাড়-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে ব্যারিটোন ভয়েসে, ‘হয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন…লং টাইম পাসিং…’

উঠে দাঁড়াতে হয় ফের আমাদের। উইলিয়ামের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাই, ‘ওয়ানা হিট দ্য ট্রেইল, ওল্ড চ্যাপ?’ দাঁড়িয়ে পড়ে অক্সিজেন–মাস্ক সরিয়ে উইলিয়াম আওয়াজ দেন, ‘উড দেয়ার বি আ সেকেন্ড চান্স, সুলতান?’ পা চালাতে চালাতে বলি, ‘হেল, নো। গেট গোয়িং।’ খুব ধীর লয়ে এগোচ্ছি আমরা। তবে কোনো এক জাদুবলে সহনীয় হয়ে এসেছে পথশ্রম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বারো হাজার ফুট ওপরের মার্কার অতিক্রম করতেই বিবমিষার ব্যাপারটা ফের মাথাচাড়া দেয়। ইলিয়াসিন জনে জনে জিনজার-লজেন্স বিতরণ করে দিয়ে ইশারা দেয়, ‘কিপ গোয়িং, সিনিয়রেস। আই প্রমিজ দ্য বেস্ট ভিউ। ইনকা মাউন্টেন স্পিরিট আপুস আর উইথ ইউ।’

চোখে পড়ে, দূর পাহাড়ের খাড়াই ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আগুয়ান হচ্ছেন একজন আদিবাসী মানুষ। চলাচলের তোড়ে ঝান্ডার মতো উড়ছে তাঁর কবজিতে বাঁধা চাকসি-প্রতীক। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ে হ্যাট খুলে অ্যাথলিট রানার–সুলভ আদিবাসী মানুষটির দৈহিক সক্ষমতার প্রশংসা করি। এক জমানায় চাকসিরা ছিলেন ইনকা সাম্রাজ্যের বার্তাবাহক। অনেকটা আমাদের ডাকহরকরার মতো এঁরা পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে পৌঁছে দিতেন জরুরি-সংবাদ। ইনকা ট্রেইলে সে যুগে ছিল পরপর অনেকগুলো ‘তামবো’ বা ‘পথসরাই’, যেখানে মজুত থাকত চাকসিদের জন্য খাবার ও পানীয়। ‘কোয়াপাক নান’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত ইনকা ট্রেইল–সংলগ্ন গ্রামগুলো এখনো আসেনি সেলফোনের আওতায়। তাই কতিপয় চাকসি আজও বহন করে চলছেন জনপদের জরুরি খবর।

আমাদের ট্রেইল এবার বেঁকে যায় এবং চোখের সামনে ভেসে ওঠে তুষার-ছাওয়া পর্বতের প্রতিশ্রুত ভিউ পয়েন্ট। বিরতি নিই আমরা। জানতে পারি যে গভীর ডিভোশন নিয়ে সুনির্দিষ্ট তিথিলগ্নে ওই পর্বতের দিকে তাকালে কখনো দৃশ্যমান হন কেচোয়া সম্প্রদায়ের সদাপ্রভু ভেরাকোচা। তাঁকে চাক্ষুষের ভাগ্য হয় না আমাদের, তবে দেখতে পাই, আন্দিজের আশ্চর্য পবর্তটির দিকে তাকিয়ে আছে নিঃসঙ্গ এক নারী ট্র্যাকার।

ফের পা চালাই। এবার কেভিনও অক্সিজেন নিচ্ছেন। তিনি দুহাতের মুঠোতে দুটি স্ট্রেস-প্রতিষেধক ধাতব-গোলক কচলাতে কচলাতে আগে বাড়ছেন। আমাদের ডান পাশে শ্বেতশুভ্র পর্বত–শ্রেণির তলায় আন্দিয়ান কনডরে ভাসা এক উপত্যকা। ওদিকে ঘোড়ায় চড়ে ট্র্যাকারদের অগ্রসর হতে দেখে অবাক হই। বছর কয়েক আগেও ইনকা ট্রেইলে মালমাত্তা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো লামা, কিন্তু সড়কটির পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনা কী? ইলিয়াসিনের বাচনিকে বুঝতে পারি, অশ্বারোহী ট্র্যাকাররা ‘কোয়ারি ট্রেইল’ নামে পরিচিত ভিন্ন একটি পথরেখা ধরে আগুয়ান হচ্ছেন আন্দিজ পর্বতশ্রেণির সর্বোচ্চ শিখর মাউন্ট ভেরোনিকার দিকে।

ভেরোনিকা শব্দটিতে বোধ করি প্রচ্ছন্ন আছে সম্মোহন। নিমেষে তা আমাকে করে তোলে স্বপ্নিল। হর্স রাইডিং ট্র্যাকের সম্ভাবনা আন্দিজের পাষাণে লুকায়িত পেরুভিয়ান অপাল পাথরটির মতো চেতনায় ছড়ায় নীলাভ দ্যুতি। ইলিয়াসিন বিনীতভাবে বলে, ‘ডু মি আ ফেভার, পাপিতো। ইউ আর হ্যাভিং অ্যাড্রেনালিন রাশ। প্লিজ টেইক অক্সিজেন নাও।’ নীরবে মুখে পরে নিই অম্লজানের মাস্ক, কন্তু ল্যাপটপবাহী ব্যাকপ্যাকটি হাতছাড়া করতে চাই না। ইলিয়াসিন তা খুলে নিতে নিতে বলে, ‘ট্রাস্ট ইয়োর সন। আই উইল ক্যারি দিস সুপার কেয়ারফুলি।’

নির্ভার হয়ে জোর কদমে হাঁটি। কী এক জাদুবলে রাজ্যের সব ফিজিক্যাল পেইন যেন উবে গেছে। জনান্তিকে বলি, ‘ইট ইজ নট হার্ড অ্যাট অল টু কিপ গোয়িং।’ ইলিয়াসিন হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘ত্রাংকিলো…ত্রাংকিলো…ইউ নিড টু স্লো ডাউন, পাপিতো। নেসেসিতা দিসফ্রুতার। ইউ নিড টু এনজয়…নট ওয়াক সো ফাস্ট।’

বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওপরের দিকে উঠছি আমরা। অতিক্রম করেছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফুটের মার্কার। জোরালো পদক্ষেপের আওয়াজে থমকে সরে দাঁড়াই। পাশ দিয়ে দ্রুত চালে ওভারটেক করে যায় অল্পবয়সী সম্ভবত টিনএজার চারটি ছেলেমেয়ে। অবলীলায় পাষাণের সোপান বেয়ে উঠতে উঠতে র‍্যাপের মতো এরা জপছে, ‘উই উইল/ রক অ্যান্ড রোল… উই উইল/ রক অ্যান্ড রোল…।’ দুষ্ট গরুর পেছন পেছন কঞ্চি হাতে রাখালের মতো আগাতে থাকা গাইড আমাদের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ মুখে বলেন, ‘দিসকুল্পে সিনিয়রেস’ (মাফ করুন)। অতীতে আমি ট্র্যাকারদের ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ জপে ‘দুর্গম-গিরি কান্তার মরু’ পাড়ি দিতে দেখেছি, তাই ‘রক অ্যান্ড রোলের’ আওয়াজে বিস্মিত হই না তেমন। কবি দিল্‌ওয়ারের কবিতার একটি পঙ্‌ক্তি ফিরে আসে করোটিতে, ‘তুমি যৌবন—তুষারে গঠিত নও…’

খাড়াই সত্যিই-সত্যিই দুর্গম হয়ে ওঠে। ইলিয়াসিন হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম। ফাইনাল পুশ সিনিয়রেস।’ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নেমে এসে জড়িয়ে ধরছে আমাদের। ঠিক সামনে এক পা–এক পা করে যেন পর্বতচূড়ায় বৌদ্ধ মন্দিরটি নিশানা করে এগোচ্ছে গ্রেইস। একবার ফিরে তাকায়। চ্যান্টিংয়ের মৃদু উচ্চারণে ঠোঁট নড়ছে তার, আর মোমের আভায় আলোকিত দেয়ালগিরির মতো চোখমুখ থেকে ছড়াচ্ছে দিব্য আভা। কাঠখোদাইয়ের কারিগর যেভাবে বৃক্ষের আস্ত কাণ্ড কুঁদে তৈরি করেন বেদির সিঁড়ি, ঠিক সে রকম নিষ্ঠায় প্রতিটি স্টেপ নিগোশিয়েট করে অতিক্রম করি ১৩ হাজার ৮২৮ ফিটের হার্ডল।

বেলা শেষের ম্লান আলোয় কখন যে নামতে শুরু করেছি নিচের দিকে, ঠিক খেয়াল থাকে না। একপর্যায়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাসও সহজ হয়ে আসে। অক্সিজেন মাস্ক খুলে আমরা সহজাতভাবে সোপানশ্রেণি ডিঙিয়ে নেমে যাচ্ছি নিচের লেয়ারে। ইলিয়াসিনের ইশারায় দাঁড়িয়ে পড়ি। কে যেন বলে ওঠে, ‘টাইম টু সেলিব্রেট।’ কেভিন খুঁজেপেতে বের করেন প্লাস্টিকের পাঁচটি শট-গ্লাস। তাতে জ্যামাইকান রাম ঢেলে পুরো বোতলটি পাচার করে দেন পোর্টার-সরদারের হাতে।

মেঘে মেঘে জমে উঠছে বর্ণিল গোধূলি। প্রচুর প্রণোদনার ভেতর এসে পৌঁছি ক্যাম্পিং সাইটে। এক সারি তাঁবুর সামনে বসে জাবর কাটছে নির্লিপ্ত একটি লামা। হাই-পয়েন্টে দিগন্তে শুয়ে থাকা মৃত এক নারীমূর্তি দর্শন করার কথা, কিন্তু কিছু তো নজরে পড়েনি! কী আর করা যাবে? কেমন যেন বিভ্রান্ত লাগে। উইলিয়াম জনান্তিকে প্রশ্ন করেন, ‘দেন হোয়াট?’ আমিও ঠিক বুঝতে পারি না, এর পরে আমাদের করণীয় কী?

মাচু পিচ্চু

ইনকা ট্রেইলে আজ আমাদের ষষ্ঠ দিন। মাচু পিচ্চুর কাছাকাছি একটি ক্যাম্পিং সাইটে ভোর–বিহানে শুরু হয়েছে আর্লি ট্র্যাকিংয়ের ক্রেইজি তুলতবিল। আমরা ওসব অবজ্ঞা করে, আস্তে-ধীরে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিয়েছি। পায়দলে আসা ট্র্যাকারদের তরুণ ট্রুপগুলো ছাড়াও ভোরের ট্রেনে কমসে কম হাজার দুয়েক পর্যটক এসে সারি বেঁধে ভাঙবেন মাচু পিচ্চুর সংক্ষিপ্ত তবে চ্যালেঞ্জিং পাথরের সোপানশ্রেণি। সূর্যতোরণে সুবেহ সাদেক থেকে ভোরের প্রথম আলোয় ইনকা সাম্রাজ্যের নিখোঁজ শহরটি পয়লা চাক্ষুষ করার প্রেরণায় তৈরি হবে পুলসেরাত পাড়ি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি।

ওসব ধুন্ধুমারে কমজোর শরীর নিয়ে শরিক হওয়ার পরিবর্তে আমরা পরিকল্পনা করছি দুপুরের পর ওখানে হাজির হওয়ার। বেশ খানিকটা হেঁটে এসে আমরা ট্রেইল থেকে সরে উঠে এসেছি হাই গ্রাউন্ডে। এখান থেকে মাচু পিচ্চুর পুরো সিটাডেলটি দৃশ্যমান হওয়ার কথা থাকলেও সমগ্র পরিসর ছেয়ে আছে গাঢ় কুয়াশায়। ইলিয়াসিন এয়ার ম্যাট্রেস পেতে দিয়েছে। তাতে বোল্ডারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়েছেন উইলিয়াম। তার অ্যাজমার টান প্রবল হয়েছে। কেভিন নেবুলাইজার দিয়ে তাকে ভেনটোলিন দিচ্ছেন। গ্রেইস পোর্টেবল স্টোভে তৈরি করছে ওলং টি।

আমি তরুণ ট্র্যাকারদের হন্যে হয়ে ফাইনাল ডেসটিনেশনের দিকে ধাবিত হওয়ার দৃশ্য দেখে উদ্বুদ্ধ হতে চাই। তাই বেশ কয়েকটি পাথর ডিঙিয়ে উঠে আসি পোচিংয়ে মৃত হস্তীর শরীরের মতো বিরাট এক বোল্ডারের ওপর। এখানে বেশ খানিকটা রোদে কবোষ্ণ হতে হতে তুমুল প্রত্যাশা নিয়ে ডিঙাই আরেকটি উত্তুঙ্গ পাষাণ। হতাশ হওয়ার মতো কিছু ঘটে না। টাকায় ইমারতের জলছাপের মতো কুয়াশার ঘেরাটোপে প্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে মন্দির-প্রাসাদ ও কৃষি-টেরাসের সামাহারে সৃষ্ট মাচু পিচ্চুর ভগ্ন স্ট্রাকচার।

আমি নিজ মনে পর্যটন-পুঁথি থেকে পাওয়া কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য রিভিউ করে নিই। কেচোয়া সম্প্রদায়ের প্রণম্য এ স্থাপনার মর্মার্থ, তাদের ভাষায়, ‘প্রাচীন পর্বত’। যদিও পাশ্চাত্যের পয়লা দিককার পুরাতত্ত্ববিদেরা এ ভগ্ন স্থাপনাকে অভিহিত করে থাকেন, ‘লস্ট সিটি অব ইনকা’ অভিধায়, আদিবাসী কেচোয়া শামানরা যে এ শৈলশহর সম্পর্কে বিশদভাবে অবগত ছিলেন, তা নিয়ে হালফিল সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে ১৫০টি ইমারতের ভগ্ন কাঠামো। ১৪৫০ সালের দিকে নির্মাণকাজের শুরুয়াত হয়েছিল, এবং তা জারি ছিল কমবেশি এক শ বছর। শহরটি কী কারণে তৈরি হয়েছিল, পণ্ডিতেরা এ বাবদে এখনো কোনো কনক্লুশনে আসতে পারেননি।

নেমে আসার সময় নজর করি, পাহাড়ের ডান দিকে শিলাপাথর গলে-লেপ্টে সম্প্রসারিত হয়ে তৈরি হয়েছে প্রায় সমতলমতো ছোট্ট একটি প্লাটো। ও দিকটা ঝলসে যাচ্ছে সূর্যকিরণে। দৃশ্যমান হচ্ছে উরুবাম্বা ভ্যালি। নদীর স্রোতোধারা দেখতে পাই না বটে, তবে বহতা জলের শব্দ শুনি আর এরিয়াল ভিউপয়েন্ট থেকে দেখি দুই পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা পর্যটকপ্রিয় রিসোর্ট-শহর আহুয়াস কালিয়েন্তেস। যেহেতু আমরা ওখানে গেস্টহাউস প্রভৃতি রিজার্ভ করে এসেছি এবং আমি দিন কয়েক কাটানোর পরিকল্পনা করছি, সুতরাং এখনই আহুয়াস কালিয়েন্তেসের হদিস করার প্রয়োজন বোধ করি না।

ফেরার পথে ইনকা সাম্রাজ্যের নিখোঁজ শহর মাচু পিচ্চুর তথাকথিত আবিষ্কারের প্রসঙ্গ ফিরে আসে মাথায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিরাম বিংহাম ১৯১১ সালে স্থানীয় এক কেচোয়া কৃষকের সহায়তায় স্থাপনাটির তালাশ পান। মাচু পিচ্চুকে গেল শতকে পরিচিত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান স্বীকার করে নিয়েও একটি তথ্য উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি যেমন পুরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আর্কিওলজিক্যাল এ সাইটের অসীম গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, তেমনি বাড়ি ফেরার সময় কারও অনুমতির তোয়াক্কা না করে নিয়ে গিয়েছিলেন খননে প্রাপ্ত মমি, সিরামিকের বাসনকোসন, নানাবিধ হাতিয়ারপত্র ও মহার্ঘ্য পাথরের অলংকারাদি। সাম্প্রতিক কালে পেরুতে প্রত্নসম্পদ ট্রান্সফারের বিষয়ে বিস্তর দেনদরবার হয়। অবশেষে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১২ সালে ‘অপহৃত’ দ্রব্যসম্ভার পেরুর একটি জাদুঘরকে ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

ফিরে এসে দেখি, উইলিয়াম বেশ খানিকটা চাঙা হয়ে উঠে কোমরে কষে বাঁধছেন ব্রেইস। চায়ের সঙ্গে গ্রেইস লাইট লাঞ্চ হিসেবে রাস্ক বলে কিশমিশ-বাদাম দেওয়া খটখটে টোস্টে মাখাচ্ছে কাজুবাদামের পেস্ট। পিরিচে রাখা ড্রাই অ্যাপ্রিকটের ওপর উপগ্রহের মতো চক্রাকারে উড়ছে একটি ডুমো মাছি। খাবারে আমার হিস্যা হিসেবে খুলি ব্রাজিল-নাটের বটুয়া। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি সুরভিত ওলং চা, কিন্তু গ্রেইসের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।

গেল রাতে তাঁবুতে তাঁবুতে তাবৎ কিছু নিঝুম হয়ে এলে ক্যাম্পফায়ারের পাশে অঙ্গারের আঁচে চুপচাপ বসেছিলাম। তখন গ্রেইস সংবাদটি দেয়। তার হাজব্যান্ড মার্ক হান্টিং ট্রিপে গিয়ে হরিণের পরিবর্তে গুলি করে নিজেকে হত্যা করলে তার পক্ষে টেক্সাসের রিমোট লোকেশনে একাকী বসবাস করা কঠিন হয়ে ওঠে। বছর দুয়েক নানা বিষয় বিবেচনা করে গ্রেইস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জেন মার্গের এক বৌদ্ধ মনাস্টারিতে দীক্ষা নেওয়ার। মাচু পিচ্চু ট্রিপটি শেষ হওয়ার পর, ঘরে ফিরে সে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্বাশ্রম বা সংসার ছেড়ে শরীরে ধারণ করবে বৌদ্ধ নান বা ভিক্ষুণীর গৈরিক বসন।

তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়নি প্রায় আড়াই দশকের মতো। গড়পড়তা বছর পাঁচেকে একবার করে যদিও আমাদের মধ্যে ই–মেইল মারফত যোগাযোগ জারি থেকেছে, তারপরও গ্রেইসের দিনযাপনের স্ট্রাগল নিয়ে আমি কখনো ভাবিত হয়েছি, এমনটা বলা যায় না। সুতরাং আমার ইমোশনাল রিঅ্যাকশনে আমি শুধু বিস্মিত নই, বিব্রতও হই! চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গ্রেইস নির্লিপ্তি বজায় রেখে খুঁটিয়ে ঘাঁটছে গ্রহ–নক্ষত্র পরিক্রমার নকশাওয়ালা একটি আকাশ-মানচিত্র।

অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ আর হাঁটতে হয় না তেমন। কিন্তু নিচের দিকে নেমে যাওয়া পাথরের ক্ষয়িষ্ণু সোপানরাজি এমন এবড়োখেবড়ো ও খাড়াই যে নামতে হয় অতি সাবধানে। বেশ কতজন লেট রাইজার গোছের ট্র্যাকার খোশগল্পে মেতে নামছেন জোরেশোরে। তাদের মধ্যে খেলা করছে কিছু একটা অর্জন, কিছু একটা উদ্‌যাপনের মুড। একজন প্রক্ষালন করে ফেরার পথে পা মচকে আর্তনাদ করে ওঠেন। বুঝতে পারি সোপানগুলোকে কেন ‘গ্রিংগো কিলার’ বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ পর্যটকের ‘মৃত্যুফাঁদ’ ডাকনামে অভিহিত করা হয়। একজন কেচোয়া শামান বিক্রি করছেন রোমান হরফে লেখা ইনকাদের সূর্য-চন্দ্র-পৃথিবী সংক্রান্ত বন্দনামন্ত্র।

একে অপরের কাঁধে হাত রেখে, কায়ক্লেশে ভারসাম্য রক্ষা করে নেমে আসি আরও কয়েকটি ধাপ। এখানে কুয়াশার শুভ্র মসলিনে মোড়া মাচু পিচ্চুর দুর্দান্ত এক ভিউপয়েন্ট পাওয়া যায়। একজন গ্রিংগো পর্যটক জোরেশোরে পাঠ করছেন বন্দনামন্ত্র। কেচোয়া ভাষায় উচ্চারণের কসরতে তার ঠোঁটে দেখা দিচ্ছে ফেনা। আমি কাণ্ডটি বর্ণনা করার উপায় নিয়ে ভাবি। ঘটনাটা জগন্নাথের মন্দির দেখে সাহেব-সন্তানদের ব্যতিক্রমী অ্যাকসেন্টে গায়ত্রী-মন্ত্র আবৃত্তি করার মতো।

সাক্ষাৎ হয় ইসতেনজায় পা-মচকে কাতরানো আরেক বান্দার সঙ্গে। রেডক্রস আঁকা সফেদ কোটপরা এক স্বেচ্ছাসেবক তাঁকে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন। ফের দেখা হয় যত্রতত্র প্রক্ষালনের ক্যাজুয়ালটি আরও তিনজনের সঙ্গে। ইনকা ট্রেইলে অতীতে বহুমূত্রের ভুক্তভোগীরা ইস্তেমাল করতেন লামার পাকস্থলীতে নির্মিত থলি। তথ্যটি ইনাদের জানা থাকলে এ মসিবত এড়ানো যেত।

কে যেন চিত্কার করে ওঠে, ‘লর্ড অলমাইটি, উই রিচ দ্য সানগেইট!’ সমবেত কণ্ঠে ধুয়া ওঠে, ‘যিশাস দ্য ক্রাইস্ট…হালেলুইয়া…।’ পাদরির পেছন পেছন অগ্রসর হচ্ছেন খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের আস্ত একটি ট্রুপ। একজন সন্ন্যাসিনী হাঁটু গেড়ে শিলাপাথরে নতজানু হয়ে ঊর্ধ্বে ক্রুশকাষ্ঠ তুলে ধরলে ভাবি, ইনারা কি দেবদেউল শনাক্ত করতে ভুল করলেন? ঘটনাটি ইনকা তথা কেচোয়া সম্প্রদায়ের পবিত্র শ্রাইনে না ঘটে ভ্যাটিকান-সম্পৃক্ত কোনো গির্জায় ঘটলে আচরণটিকে অনায়াসে প্রাসঙ্গিক বলা যেত। খুব আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ান অল্পবয়সী সন্ন্যাসিনী। বর্ণনার প্রয়োজনে ইনাকে অবলোকন করা প্রয়োজন হলেও পথের শিষ্ঠাচার আমলে এনে দৃষ্টিকে অন্যদিকে ফেরাই।

যেতে যেতে গ্রেইসের চোখমুখে ফুটে ওঠে আর্ট টিচারসুলভ অভিব্যক্তি। মৃদুস্বরে সে বলে, ‘প্লিজ, বি রেসপেক্টফুল টু দ্য গ্রাভিটাস, দ্য স্পিরিচুয়াল সিগনিফিকেন্স অব দিস প্লেস।’ সিঁড়ি থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে আমরা দাঁড়াই নিরিবিলিতে। কবজিতে ঘড়ি দেখে নেয় গ্রেইস। তুমুল চঞ্চলতায় অধীর হওয়া মনকে প্রবল কনসেনট্রেশনে শূন্য এক বিন্দুতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। মিনিট দশেক পর সূর্য যখন বৃষ রাশি ত্যাগ করে প্রবেশ করেন মিথুনে, ঠিক সে সময়ে ইনতিপুনকু নামের ইনকাদের আরাধ্য সূর্যতোরণ অতিক্রম করি আমরা ।

এসে পড়ি সৈকতে তিমি মাছের মৃতদেহের মতো বিশাল একটি বোল্ডারের কাছে। পাশ থেকে এক পর্যটক মন্তব্য করেন, ‘ঠিক এই পাথরের তলা থেকে প্রফেসর হিরাম বিংগাম তুলে নিয়েছিলেন মমি।’

ফের ভাঙতে হয় সোপান। উঠে আসি প্রহরীদের জন্য তৈরি ছনে-ছাওয়া চৌকি-কুটিরের কাছাকাছি। পোর্টাররা পারিতোষিক নিয়ে বিদায় নেন। মালমাত্তা তারা গেস্টহাউসে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরবেন। গ্রেইস ও আমি যেহেতু নিজেদের ইচ্ছামাফিক ঘোরাফেরা করতে চাই, ইলিয়াসিন দায়িত্ব নেয় উইলিয়াম ও কেভিনের।

মাচু পিচ্চুর খাসমহলের দিকে যাওয়ার পথে আমরা একটু দাঁড়াই। আমাদের চোখের সামনে জগদ্দল এক প্রাচীরের মতো উঠে গেছে চৌকি-কুটিরের পাথুরে ভিত। চুন-সুরকি-সিমেন্টের ব্যবহার ছাড়া ভূমিকম্প-প্রতিষেধক এ দেয়ালে পাথরের ঠাসবুনট প্রত্যক্ষ করি অবাক বিস্ময়ে!

ফের ভাঙতে হয় দুর্গম এক সিঁড়িপথ। কাছেই টেরাস-ওয়ালের শিথানে দাঁড়িয়ে তরুণ-পর্যটকেরা চেক করে নিচ্ছেন সেলফোন। ট্রেইলে আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ ইন্টারনেট-বর্জিত। মাচু পিচ্চু দুর্গম হলেও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা মাত্র ৭ হাজার ৯৭২ ফুট। বাতাসে ওড়া শিমুল তুলার মতো হালফিল এখানে ভেসে বেড়ায় ইন্টারনেটের সিগন্যাল। ভাবি, থাকি না আরও ঘণ্টা কয়েক অন্তর্জাল–পরিধির বাইরে।

ভিজ্যুয়াল আর্টবিষয়ক পুস্তকের পৃষ্ঠা ওলটালে যেমন দেখা যায় নকশা, বর্ণ ও পরিমিতির সমন্বয়ে সৃষ্ট ফাইন আর্টের দৃষ্টান্ত, ঠিক তেমনি আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মাচু পিচ্চুর প্রায় পূর্ণাঙ্গ পোর্ট্রেট। মন্দিররাজির ভগ্ন কাঠামোর প্রেক্ষাপটে হুয়াইনা পিচ্চু পর্বতের লম্বালম্বি অবয়বে লেপটে আছে কুয়াশাময় মসলিনের আবরণ।

আইফোন তাক করে গ্রেইস বলে, ‘ইউ লুক চিয়ারফুল অ্যান্ড হ্যাপি। লেট মি টেক ইয়োর পিকচার।’ আমি ফিরে তাকাই তার দিকে। ফিসফিসিয়ে সে বলে, ‘পারহ্যাপ্স লাস্ট টাইম আই অ্যাম টেকিং ইয়োর পিকচার।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি নির্লিপ্ত থাকি এবং চেষ্টা করি এ ভিউপয়েন্ট থেকে মাচু পিচ্চুর একটি স্ন্যাপশট নিতে।

মানমন্দিরের ত্রিকোণ স্ট্রাকচারের কাছে এসে গ্রেইস ‘সি ইউ অ্যারাউন্ড’ বলে ভিন্ন পথ ধরে। আমি সচেতন যে সে হয়তো ওয়াকিং মেডিটেশনের মাইন্ডফুল পদক্ষেপে হাঁটবে, কিংবা নিরিবিলিতে ধ্যানস্থ হবে। আমার আগ্রহের ক্ষেত্র ভিন্ন, সুতরাং চেষ্টা করি নিবিড়ভাবে প্রতিটি ডিটেল পর্যবেক্ষণের। পুঁথিগত সূত্র থেকে জানি যে ইনকা মানমন্দিরের দেয়ালে শত-সহস্র মহার্ঘ্য পাথর দিয়ে তৈরি করা হতো ছায়াপথের অনুকৃতি। ছয় শতাব্দীর ব্যবধানে চোখের সামনে শুধু প্লাস্টারহীন নিরাবরণ পাথরের আকৃতি ছাড়া আর তেমন কিছু দেখতে পাই না।

সিঁড়ি ধরে নেমে আসি খানিকটা নিচের লেয়ারে। ইজেল পেতে প্রেক্ষাপটের দৃষ্টিনন্দন পাহাড় হুয়াইনা পিচ্চুর চিত্র আঁকছেন এক শিল্পী। পাশে মডেলপ্রতিম শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর বান্ধবী। তুলির আঁচড় কাটতে কাটতে চিত্রকর কথা বলেন, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, হানি, দ্য ভিঞ্চি যখন মোনালিসার ছবি আঁকছিলেন, ঠিক ওই সময় ইনকারা এখানে গড়ে তুলছিল মাচু পিচ্চুর মন্দিররাজি ও আকাশ পর্যবেক্ষণাগার।’

সুরুজ হেলে যাচ্ছে। পর্যটকেরাও বোধ করি ফিরে গেছেন আহুয়াস কালিয়েন্তেস শহরের দিকে। নিরিবিলি হয়ে আসছে মাচু পিচ্চুর পরিসর। আমি এসে দাঁড়া ‘টেম্পল অব দ্য থ্রি উইন্ডোজ’ নামে পরিচিত একটি একটি ভগ্ন স্ট্রাকচারের কাছে। একটি রুখাসুখা গাছে ঝেঁপে এসেছে অর্কিড। তাতে পালা করে মধু চুষছে একাধিক হামিংবার্ড। এ মন্দিরের অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও অবিকৃত আছে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের প্রতীক তিনটি জানালা। একটির পাশে দাঁড়িয়ে আমি তাকাই ভেতরবাগে। পাথরের খাঁজে খাঁজে বর্ণালি ছড়িয়ে হাঁটছে ইরিডিসেন্ট পতঙ্গ। কী যেন এক উপলব্ধিতে আমার সমগ্র সত্তা আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। চাপ চাপ মৃত্তিকার অন্তরালে তীব্র তাপে যেমন কাঠকয়লা হয়ে ওঠে কোমল হিরে, ঠিক তেমনি স্বচ্ছ এ আশ্চর্য সেনসেশন! করোটির অভ্যন্তরে অজানা কিছু যেন অতি ধীরে ঘুরছে চক্রাকারে।

পর্বত-শিখরে কালেভদ্রে পাওয়া ইন্টারনেট-সিগন্যালের মতো মুহূর্তে তিরোহিত হয় অপ্রত্যাশিত এ অনুভব। হাঁটি গ্রহণ-মন্দির নিশানা করে। মাথায় একটি ভাবনা খেলে যায়, আধ্যাত্মিক বিষয়ে আগ্রহী পর্যটকেরা মাচু পিচ্চুতে ‘ভরটেক্স’ বা ‘সেন্টার অব এনার্জি’ বলে সদা পরিবর্তনশীল একটি ‘স্পেশাল স্পট’–এর কথা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু নিমেষে ঘটা এ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি না।

ঢুকে পড়ি গ্রহণ-মন্দিরের গৃহে। এখানেও এক সারি বাতায়ন। মেঝেতে গমপেষার চাকতির আকৃতিতে নির্মিত দুটি চৌবাচ্চা, যাতে আজও প্রতিফলিত হয় রাহুগ্রস্ত চন্দ্র-সূর্য।

বেলা পড়ে আসছে, কিন্তু কোথাও গ্রেইসের তালাশ পাই না। ইলিয়াসিনের কাছ থেকে টেক্সট আসে। সে ক্লান্ত উইলিয়াম ও কেভিনকে বাসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে গেস্টহাউসে। যেহেতু সন্ধ্যা অবধি শাটল-বাস আহুয়াস কালিয়েন্তেস শহরে পর্যটক আনা-নেওয়া করবে, আমি তাকে নিষেধ করি আমাদের পিক করার জন্য ফিরে আসতে।

সূর্যমন্দিরের আঙিনার তলদেশ দিয়ে ঝিরিঝিরি বইছে ঝরনাজল। আমি ইনকাদের পয়ঃপ্রণালির জলধারা অনুসরণ করে ধাপে ধাপে নেমে আসি কৃত্রিম এক জলাশয়ের কাছে, যার শিথানে প্রস্রবণটি এখনো সক্রিয় আছে। দেখি, ওদিক থেকে হেঁটে আসছে গ্রেইস। কিছুক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়াই। পাড় ধরে কয়েকটি লামা জাবর কাটতে কাটতে হাঁটছে। মেগাফোনে মাচু পিচ্চুর মেইন গেট মিনিট পনেরোর মধ্যে বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

নীরবে বেরিয়ে আসি আমরা। আহুয়াস কালিয়েন্তেসগামী একটি ট্যুর বাস চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইনকাদের বিলুপ্ত নগরীর স্তরে স্তরে বর্ণালি হয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে বেলা শেষের আলো। দ্রুত ম্লান হচ্ছে রোদ। আমরা ফিরে তাকাই। প্রাসাদ-মন্দির ও কৃষি–টেরাসের ধাপগুলো থেকে আমাদের তারুণ্যের হারানো দিনগুলোর মতো ক্রমান্বয়ে রোদ সরে ভরে উঠছে স্মৃতিময় শ্যামল ছায়া।