২৩ অক্টোবর ছিল প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদের জন্মদিন। জীবদ্দশায় নানান বিষয়–আশয় নিয়ে প্রবচনধর্মী লেখা লেখার অভ্যাস ছিল তাঁর। এই লেখককে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই প্রবচনগুচ্ছ থেকে কয়েকটি
একজন পূর্ণ মানুষ আধখানা হয়ে যায় তখন, যখন সে স্বাধীন চিন্তা করার শক্তি হারায়; সে সিকি মানুষ হয়ে যায় তখন, যখন সে অন্যের চিন্তার দাসত্ব করে।
নিজের দীর্ঘস্থায়ী সুখ, শান্তি ও কল্যাণের জন্য মানুষকে কিছুটা ঝুঁকি নিতেই হয়। বিপদ হতে পারে জেনেও নতুন জিনিসে হাত দেয় মানুষ। আদিম মানুষকেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। মাছে কাঁটা আছে জেনেও মানুষ মাছ খেতে শুরু করেছে এবং মাছ খাওয়া আর বাদ দেয়নি। কারণ, মাছ খাওয়া তার স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর ও আবশ্যক। মাছের কাঁটা মানুষের মাছ খাওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধক হতে পারেনি। তা যদি হতো, তাহলে সে এক বিরাট প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতো। বড় কাজ করতে চাইলে কাঁটার মতো কিছু সমস্যার ঝুঁকি থাকেই, মাছের কাঁটা সরিয়ে রেখে মানুষ মাছ খেয়ে উপকৃত হয়েছে। সমস্যাও সরিয়ে রেখে মানুষকে বড় ও কল্যাণকর কাজ চালিয়ে
যেতে হয়।
আবেগের একটা বেগ আছে, বেগের একটা ধাক্কা আছে, সেই ধাক্কায় পাঁচিলের মতো শক্ত জিনিসও ধসে পড়তে পারে। আবেগকে নিয়ন্ত্রণে না রাখলে, একটি জাতিও ভেঙে পড়ে।
সব দ্রব্য প্রয়োজন অনুযায়ী মিশ্রিত হলেই একটা ভালো কিছু তৈরি হয়। খুব ভালো জিনিসকেও যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়, তাহলে গোটা আয়োজনটাই নষ্ট হয়ে যায়। যেমন রান্নায় এলাচি, লবঙ্গ প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্যে দিলে তা সুঘ্রাণ ও সুস্বাদু হয়। এক কেজি চালের পোলাওয়ে বা ফিরনিতে ৫/৭টি এলাচি আর ১০–১২টি লবঙ্গ দিলে বেশ হয়। কিন্তু যদি উল্টোটা করা হয়, অর্থাৎ ৫০০ গ্রাম এলাচি আর ৫০০ গ্রাম লবঙ্গের সঙ্গে অল্প একটু ‘কালিজিরা’ চাল মিশিয়ে অন্যান্য তেল, মসলাসহ কিছু একটা রান্না করা হয়, তা কোনো খাদ্যসামগ্রী হবে না। সন্তানপ্রেম, দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রেম প্রভৃতির মতো ভালো ভালো বিষয়ের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে মঙ্গলের পরিবর্তে বিপদই ডেকে আনা হয়।
বহু জায়গায় অনেকগুলো মানুষ থাকলে তাঁদের প্রত্যেকের জন্য একেকটি প্রদীপের প্রয়োজন হয় না। তা ছাড়া প্রদীপের কোনো পক্ষপাত নেই। কোনো প্রদীপ বলতে পারে না যে আমি প্রজ্বলিত আছি শুধু অমুকের জন্য, সে ছাড়া আমার আলো আর সবার জন্য নিষিদ্ধ এবং আমার আলো আর কারও ওপর ছড়িয়ে পড়তে পারে না, আমি আর কাউকে আলোকিত করব না। গুণীজন ও মনীষীরাও প্রদীপের মতো, তাঁরা কোনো রকম পক্ষপাত ছাড়াই দল, মত–নির্বিশেষে শত্রু–মিত্র সবাইকে আলোকিত করেন, জ্ঞান ও সেবা দান করেন। কোনো প্রাজ্ঞ পুরুষের সাধনালব্ধ জ্ঞান একবার সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর তার ওপর আর তাঁর নিজের কোনো হাত থাকে না—তা তখন হয়ে পড়ে সবার সম্পত্তি।
সমাজের যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক যখন একজন সৎ, সেবাপরায়ণ ও প্রতিভাবান মানুষের আবির্ভাব হয়, তখন মনে করতে হবে, সেখানে একটি প্রদীপ প্রজ্বলিত হলো। সেই স্থানবিশেষের মানুষের উচিত হবে, তাঁকে তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে সাধ্যমতো সহযোগিতা করা, যেমন অন্ধকারে বা প্রয়োজনের সময় আলো জ্বালিয়ে রাখে মানুষ।
গৌণ লেখকের এমনি নিয়তি যে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখাটিও হারিয়ে যায়। অপর দিকে প্রধান লেখকের গৌণ লেখাটিও টিকে থাকে। বাংলা সাহিত্যের অনেক গৌণ লেখকের বহু উৎকৃষ্ট লেখা মানুষ ভুলে গেছে, কিন্তু অনেক প্রধান লেখকের সামান্য রচনাও মানুষের মুখস্থ।
বাঙালি হিন্দু বা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একটি ক্ষেত্রে শতভাগ মিল; প্রত্যেকেই চায়, অন্য পক্ষ উদার ও অসাম্প্রদায়িক হোক। নিজের উদারতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন উঠলে সে রেগে যায়।
বাঙালির সংস্কৃতি দোতারার মতো। একটি তারে বাজে হিন্দু সংস্কৃতি, অন্যটিতে মুসলমানের।
একটি বৃক্ষের পুরো আয়ুর খুব অল্প অংশই সে ফুল ফোটাতে বা ফল ফলাতে ব্যয় করে। তাতেই তার জীবন ধন্য হয়। মানবজীবনের একটি অতি সামান্য অংশও যদি মঙ্গলকাজে ব্যয় হয়, তাতেই তার জীবন সার্থক।
পরাজয় হবে জেনেও যে মানুষ অন্যায়কারী পরাক্রান্ত শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, সে–ই সত্যিকারের বিদ্রোহী ও বিপ্লবী।
ইতিহাসের খুব বড় বড় ঘটনা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো। তা রোধ করা যায় না। কিন্তু ঘটে যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া ধ্বংসলীলা মেরামত বা পুনর্গঠনের চেষ্টা করা যায়। আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না, কিন্তু খুব ভালোমতো পুনর্গঠনের কাজ চালালে জলোচ্ছ্বাসপূর্ব অবস্থার চেয়ে ভালো অবস্থার সৃষ্টি করা যায়।
চার বোতল মধুর সঙ্গে এক বোতল বিষ মেশালে বিষ মধুতে রূপান্তরিত হয়ে পাঁচ বোতল মধু হয় না। বরং মধুও বিষ হয়ে যায়। ভালোকে মন্দে পরিণত করার ক্ষমতা মন্দের সর্বোচ্চ। ভালো যদি মন্দ থেকে নিজেকে দূরে না রাখে, তারও মন্দ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা।