৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল থেকেই রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল থেকেই রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

বইয়ের সংখ্যা ১০ থেকে এখন ১০ লাখ

একটি ভালো উদ্যোগ ভবিষ্যতে শত শত শুভসূচনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশে এমনই উদাহরণ তৈরি করা এক প্রতিষ্ঠানের নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে বই পৌঁছে দিয়েছে তারা। বই পড়ে তা নিয়ে আলোচনা ও প্রতিযোগিতার চর্চা তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বসাহিত্যের গুণগত অনুবাদ প্রকাশনা এনে কিশোর–তরুণদের আগ্রহী করেছে জ্ঞান বিকাশে। আজ উদ্​যাপিত হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। উদ্​যাপনেও প্রতিষ্ঠানটি এনেছে তাদের স্বভাবসুলভ স্বকীয়তা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ যে শোভাযাত্রা হবে, তা সাজানো হয়েছে লোকশিল্প ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের লোক–ঐতিহ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে এ আয়োজন। আজ সকালে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে বের হয়ে শোভাযাত্রাটি পৌঁছাবে বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। এরপর দিনভর চলবে নানা উৎসব। তবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বর্তমান অর্জনের দিকে দৃষ্টি রাখলে বোঝার উপায় নেই কত সীমিত সাধ্য নিয়ে একদিন শুরু হয়েছিল এই উদ্যোগ। আজকের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের পেছনে রয়েছে একদিন দশ তরুণের বই পড়ার আগ্রহের এক গল্প।

যেভাবে গড়ে উঠেছিল 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

সেই গল্প প্রথম আলোকে বললেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেন, ‘১৯৭৮ সালে মাত্র ১০ জন মিলে বই পড়ার যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে আজ দেশজুড়ে ছড়িয়েছে বই পড়ার আন্দোলন। পাঠচক্রের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি। আশির দশকের মাঝামাঝিতে ৭ থেকে ৮টি বই নিয়ে শুরু হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশনা। এখন বইয়ের সংখ্যা আট শতাধিক। কিন্তু এই কেন্দ্রকে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার কাজ আমাদের এখনো চলছে।’

৪৫ বছর আগের একদিন। ১০ তরুণ ঠিক করেছিলেন, তাঁরা পল্লিকবি জসীমউদ্​দীনের নক্সীকাঁথার মাঠ পড়বে। তখন এ বইয়ের দাম ছিল সাড়ে ৩ টাকা। কিন্তু তারপরও কেনার সংগতি ছিল না তাঁদের। কিনে দিয়েছিলেন অন্য একজন। ঢাকা কলেজের পাশে এখন যেটিকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি বা নায়েম নামে ডাকা হয়, ওখানে ছিল ‘এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টার’। তাদের ছিল একটি ছোট্ট মিলনায়তন। সেখানে প্রতি শুক্রবার শুরু হয় বই পড়ার আসর। এরপর ইন্দিরা রোড হয়ে বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত হয় আশির দশকের মাঝামাঝিতে। সেখানে তখন ছিল মাঠের মধ্যে একতলা বাড়ি। সে বাড়ির ইটগুলো গাঁথা ছিল সিমেন্টের পরিবর্তে কাদামাটি দিয়ে।

নানান বইয়ের সমাহার

সময়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বয়স বেড়েছে। একটু একটু করে যুক্ত হয়েছে অর্জনের পালক। আশির দশকে প্রথম বইমেলায় অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গুটিকয় বই প্রকাশ করে। সে বইগুলো ছাপা হওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা নিয়ে কেন্দ্রের তখনকার সদস্যদের রয়েছে এক হিরণ্ময় অভিজ্ঞতা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক (বাস্তবায়ন) মো. কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন কেন্দ্রের পাঠাগারে আছে আড়াই লাখের বেশি বই। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে আছে সাড়ে ছয় লাখের বেশি বই। ‘আলোর স্কুল’ কর্মসূচির বইসহ কেন্দ্রের বইয়ের সংখ্যা এখন প্রায় ১০ লাখের মতো হবে।’

এবং ‘বাঙালির চিন্তা প্রকল্প’

সম্প্রতি বাংলাদেশে আরেকটি উদাহরণ তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০ বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষীদের নির্বাচিত রচনা নিয়ে প্রকাশ করেছে বাঙালির চিন্তামূলক রচনা সংগ্রহ। বিপুল এই আয়োজন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গত দুই যুগের প্রয়াসের ফল। এখন পর্যন্ত এই রচনাসংগ্রহের ৫৪টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, আরও খণ্ডের কাজ চলছে। 

‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগান নিয়ে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ানো যে বইয়ের গাড়িগুলো আমরা দেখি; নব্বইয়ের দশকে শুরুর সময় এ গাড়ির সংখ্যা ছিল মাত্র ৬। এখন সারা দেশে ৭৬টি গাড়ি বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায় শিক্ষার্থীদের দুয়ারে দুয়ারে। বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বর্তমান ভবনটির মতো আরও একটি ভবন বানানো হবে বলে জানালেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রতি পাঁচ বছর পরপর করা হয়। শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে। তবে সবার অংশগ্রহণের সুবিধাজনক সময় বিবেচনা করে বছরের যেকোনো সময়েই হতে পারে। আশা করি, এবার ৪৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আয়োজনে হাজারখানেক মানুষের সমাগম হবে। সবার সঙ্গে দেখা হয় বলে দিনটি আমাদের জন্য খুবই আনন্দের।’