আজ ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস। চিঠি লেখার মধ্যে যে শিল্পিত ব্যাপার ছিল, যুগের হাওয়ার বদলে এখন তা হারিয়ে যেতে বসেছে।
চিঠির মূল্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নতুন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরও একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি।’
সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চিঠি মানুষের নানামুখী অভিব্যক্তি যেভাবে আদান-প্রদান করতে পেরেছে, অন্য কোনো মাধ্যম তা পারেনি। একটি চিঠির জন্য কী ব্যাকুলতা, কী তৃষ্ণা! প্রিয়জনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে যতক্ষণ না উত্তর মিলছে, ততক্ষণ যেন মনের মেঘ কাটছেই না! রাজা লিখছেন রাজাকে, কবি লিখছেন কবিকে, প্রেমিক লিখছেন প্রেমিকাকে, সন্তান লিখছেন পিতামাতাকে—চিঠি ছাড়া যেন আর কোথাও ভাষার কোনো মুখরতা নেই! নেই প্রাণের স্পন্দন! রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল—কে চিঠি লেখেননি। চিঠির ভাষা ভাবগম্ভীর হয়েও কতটা সাবলীল ও মিষ্টি হতে পারে, তাঁদের চিঠি না পড়লে তা বোঝার উপায় নেই।
রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোতে কল্পনার আধিপত্য, মননের গাঢ়তার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে তাঁর সৃষ্টিপ্রাচুর্যের বিচিত্র ক্ষণ। তিনি চিঠি লিখেছেন বিস্তর। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, ছিন্নপত্র, জাভা-যাত্রীর পত্র, ভানুসিংহের পত্রাবলি, রাশিয়ার চিঠি, পথে ও পথের প্রান্তে প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর চিঠিপত্র সংকলিত হয়েছে, বিশ্বভারতী বের করেছে ১৯ খণ্ড চিঠিপত্র। এর বাইরে আরও কত চিঠি যে পড়ে আছে, তার হদিস মেলেনি। কবির পত্রসংকলনগুলোর মধ্যে ছিন্নপত্র সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যের নিদর্শন। ছিন্নপত্রাবলিতে উন্মোচিত হয়েছে দুর্লভ এক রবীন্দ্রনাথ। এই রবীন্দ্রনাথের গতিবিধি রহস্যময়। কবির অনেক গান, গল্প আর কবিতার সুর যেন ছিন্নপত্র-এর চিঠিগুলোতে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের এক নিভৃত কোণে বসে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে জীবনের বহুমুখী চালচিত্র ছিন্নপত্র-এর পটে পূর্ণ করে এঁকেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়।
রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলের চিঠিপত্রের কথাও আলাদা করে বলতে হয়। নজরুল চিঠি লিখতে পেরেছেন খুবই কম। তা সত্ত্বেও তাঁর চিঠিগুলো শিল্পীসত্তার পরিচয়ে উদ্ভাসিত, অসামান্য রচনা হিসেবে সাহিত্যের সম্পদে পরিণত। নজরুল তাঁর আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাচেতনা ও সুখ–দুঃখ এমনভাবে চিঠিপত্রে ব্যক্ত করেছেন যে ব্যক্তিগত বিষয়াদিও সর্বজনীন আবেদনের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের চিঠিগুলোতে থরথর কম্পমান যে প্রেমিক নজরুলকে পাওয়া যায়, তা আর কোথাও পাওয়ার উপায় নেই। মিস ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের রহস্যময় প্রেমের সংবাদ আর গোপন থাকেনি এসব চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর। ফ্যানি ব্রাউনকে লেখা জন কিটসের চিঠিতে যে রকম ব্যাকুলতা আছে, ফজিলাতুন্নেসাকে লেখা চিঠিতেও আছে সে রকম হৃদয় হু হু করা অনুভূতি!
যে চিঠি মানবসভ্যতার মঙ্গলদূত হিসেবে চিহ্নিত, যে চিঠি চিন্তাচর্চার জিয়নকাঠি হিসেবে বিবেচিত, সেই চিঠিই এখন আর কাউকেই লিখতে দেখা যায় না! ডাকপিয়নের ডাক আর শোনা যায় না পথে পথে। পোস্ট অফিসের সেই লালরঙা চিঠির বাক্সগুলোও এখন আর দেখা যায় না।
প্রযুক্তির অভাবনীয় পালাবদলের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে চিঠি একরকম ‘নাই’ হয়ে গেছে। ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খুদে বার্তার ভেতর তলিয়ে গেছে চিঠির আবেদন। ছোট ছোট বাক্যে, কাটছাঁটকৃত শব্দে বিন্যস্ত এই যোগাযোগব্যবস্থাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘টেক্সটস্পিক’। কারও সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন, চট করেই বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ইনবক্সে পাঠানো যায়: ‘হাই ব্রো, what’s up?’ কিংবা ইংরেজিতে—‘how r u?’ চিঠিযুগ শেষে যে টেক্সটস্পিক এসেছে, তা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক ভাষার জন্ম দিয়েছে। এ ভাষা প্রচলিত ব্যাকরণ মানে না, এর নেই কোনো রীতি। শব্দকে যেভাবে খুশি সেভাবেই গড়েপিটে নেওয়া যায় এখানে। যেমন ‘Are you okay?’—এই বাক্যকে টেক্সটস্পিকের ভাষায় লেখা হয়—‘R u ok?’। আবার ‘Oh My God’ বাক্যটিকে সংক্ষেপে লেখা হয়—‘OMG’। এর মধ্যেই এই টেক্সটস্পিক সাহিত্যেও জায়গা করে নিয়েছে। আমেরিকান লেখক লরেন মিরাকল টেক্সটস্পিক ব্যবহার করে লিখেছেন উপন্যাস ttyl (talk to you later), ttfn (Ta Ta For Now), l8r, g8r ( later, alligator)। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এসব উপন্যাস নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলারের তালিকায়ও উঠে এসেছে। শুধু তা–ই নয়, টেক্সটস্পিকে রূপান্তরিত ওএমজি শেক্সপিয়ার নামে শেক্সপিয়ারের কয়েকটি সিরিজ নাটকও পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এমনকি আমাদের দেশেও টেক্সটস্পিক ব্যবহার করে উপন্যাস লেখা হয়েছে। মেসেঞ্জারে আলাপ নামে তরুণ ঔপন্যাসিক সালমা মোস্তফা নুসরাতের এ উপন্যাস বের হয়েছে বছর দুই আগে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুকে আমরা যেভাবে কথাবার্তা বলি, সেই শৈলী মেনেই লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। এককালে যেমন পত্র-উপন্যাসের চল ছিল, দিনবদলের পালায় এখন মানুষের হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারের কথোপকথনও ঠাঁই নিচ্ছে গল্প-উপন্যাসে, সাহিত্যে।
প্রযুক্তিস্রোত এসে মানুষের জীবনধারা আমূল পাল্টে দিয়েছে। বইয়ের পাতা উল্টানো আঙুলগুলো এখন স্মার্টফোনের রূপালি পর্দায় অবিরাম স্ক্রলিংয়ে ব্যতিব্যস্ত। এ সময়ের বাস্তবতায় পড়াশোনা হয়ে গেছে দেখাশোনা, লেখালেখি হয়ে গেছে দেখাদেখি, ভাবনা হয়ে উঠেছে দূরভাবনা! মোটকথা, মানুষের মন ও মগজ—দুটিই নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে নতুন নতুন ডিভাইস। ফলে চিঠি, পত্র, পত্রসাহিত্য—যা-ই বলা হোক না কেন, সবই পরাভবের মুখে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘লাঠি তোমার দিন গিয়াছে।’ হ্যাঁ, লাঠির দিন তো বহুকাল আগেই গিয়েছে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছুরই দিন হয়তো চলে গিয়েছে। চিঠি এখন হয়ে উঠেছে ‘টেক্সট’। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের কথা ধার করেই বলা যায়, চিঠি তোমারও দিন গিয়েছে!