বর্তমান বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকজন চলচ্চিত্রকারদের একজন অ্যাটম এগোইয়ান। আর্মেনিয়ান গণহত্যার পটভূমিতে নির্মিত আরারাত তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি। এই চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে কানাডার টরন্টোতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল লেখকের। তারপর?
খয়েরিরঙা পুঁচকে একটা কুকুর। কেমন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছু কুকুর পথেঘাটে এ রকম হ্যাংলামি করে। ঘাড়ে হাত বুলিয়ে ওকে বিদায় করব ভাবছিলাম। কিন্তু কুকুরটা গেল না। চারপাশ ঘিরে ঘুরঘুর করতেই থাকল। দূরে পার্কের ও মাথায় ওর মালিক। একটা লিশ (কুকুর বাঁধার দড়ি) হাতে নিয়ে আসছেন। দূর থেকে মানুষটাকে খেয়াল করিনি। মাঝদুপুরে টরন্টোর মিডটাউন এলাকার এ পার্কটি মোটামুটি নির্জন। আমি পার্কের বেঞ্চে বসার জায়গা খুঁজছিলাম। ভদ্রলোক খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কুকুরটাকে একরকম পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেতে লাগলেন। ভদ্রলোকের চোখে চশমা। চেহারাটা খুব চেনা বলে মনে হলো। কোথায় দেখেছি তাঁকে?
হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে গেল সব। দেখেছি লোকটাকে, ২০১৪ সালে, কান চলচ্চিত্র উৎসবে ক্যাপটিভ সিনেমার সংবাদ সম্মেলনে!
‘আপনি কি অ্যাটম এগোইয়ান?’
মানুষটা থমকে গেলেন মুহূর্তের জন্য। খুব সম্ভবত ‘না’ বলে সটকে পড়তে চেয়েছিলেন একবার। তারপর খুব অনিচ্ছার সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি। আমি অ্যাটম এগোইয়ান।’
আহা, এই মানুষটাকেই না কত খুঁজেছি গত পাঁচ বছর, এই টরন্টো শহরে। কানাডার শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তিনি। একাধিক অস্কার মনোনয়ন বা কান চলচ্চিত্র উৎসবের গ্রাঁ প্রি বিজয়ের ইতিহাস দিয়ে পুরোপুরি বোঝানো যাবে না অ্যাটম এগোইয়ান ঠিক কত বড় মাপের চলচ্চিত্র নির্মাতা। বর্তমান বিশ্বের একেবারে প্রথম সারির কয়েকজন চলচ্চিত্রকারের মধ্যে তিনি একজন। মারা যাওয়ার বছর কয়েক আগে ফ্রান্সের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জঁ–লুক গোদার স্বয়ং তাঁর এই সময়ের প্রিয় চলচ্চিত্রকার হিসেবে অ্যাটম এগোইয়ানের নাম করেছিলেন।
থাক, আমরা বরং ফিরে যাই বছর ১৫ আগে।
প্রথম আলোর মিলনায়তনে আমরা সবাই দর্শক। কবি সাজ্জাদ শরিফের বিশেষ পছন্দের চলচ্চিত্র আরারাত চলছে পর্দায়। নির্মাতার নাম অ্যাটম এগোইয়ান। আর্মেনীয় গণহত্যার পটভূমিতে কী অসাধারণ সে সিনেমা। অ্যাটম এগোইয়ানের পূর্বপুরুষ আর্মেনীয়। তুরস্কে স্বজাতির ওপর চালিত গণহত্যার ভয়াবহতা এমনভাবে তুলে আনা যায়? বর্তমানে কি অতীতের পুনর্নির্মাণ সম্ভব? ইতিহাসের বাস্তব কি স্মৃতি আর কল্পনার প্রিজমে অন্যতর রং ধারণ করে? এসব কূট প্রশ্নের সঙ্গে বর্তমান যুগ মিলিয়ে এমন অভাবনীয় মানবিক সংকটের গল্প বলা সম্ভব, আরারাত (২০০২) না দেখলে সেটা কী করে জানতাম।
তখনো এই আর্মেনীয়–কানাডীয় নির্মাতার বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ছবি এগজটিকা বা দ্য সুইট হিয়ারআফটার দেখা হয়নি। ক্লোয়ি তো এসেছে আরও পরে। এক আরারাত দিয়েই অ্যাটম চলে এসেছিলেন সবচেয়ে পছন্দের নির্মাতাদের তালিকায়।
কানাডার অভিবাসী হওয়ার পর থেকে শুনে এসেছি এই টরন্টোতেই তিনি থাকেন। কানাডার নাগরিকত্ব পরীক্ষার পাঠ্যবই ডিসকভার কানাডায় দুজন কানাডীয় চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যাটম এগোইয়ান তাঁদের একজন। অ্যাটমের জীবনকাহিনি পড়েই ঠিক করেছিলাম, যেভাবে পারি প্রথম সিনেমাটা নিজের জন্মভূমিতেই বানাব।
কুকুর কোলে নিয়ে অ্যাটম চলেই যাচ্ছিলেন। কী বুঝে চোখের মাথা খেয়ে তাঁকে বলেই ফেললাম, ‘আমিও সিনেমা বানাই। আমার প্রথম সিনেমা বলী বুসানে নিউ কারেন্টস অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।’
এবার অবাক করে দিয়ে অ্যাটম বললেন, ‘সিনেমাটা আমারও দেখার ইচ্ছা ছিল। বুসান দুর্দান্ত একটা উৎসব। আমাকে তোমার ফিল্মের স্ক্রিনার লিংকটা দিয়ো তো।’
একই সঙ্গে ইন ফ্লেমস নামে তাঁর ভালো লাগা একটা সিনেমার কথাও বললেন অ্যাটম। ইন ফ্লেমস আমি দেখিনি। তবে আগের বছর কান উৎসবের ডিরেক্টরস ফর্টনাইটে প্রশংসিত কানাডার এই সিনেমার কথা আমি জানতাম।
শুধু চলচ্চিত্র নয়, বাইরের দুনিয়ার খোঁজখবরও অ্যাটম রাখেন। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কথা তিনি আগেই শুনেছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাচ্ছে?
জবাব দেওয়ার আগেই আমার স্ত্রী রুহিনা তাসকিন এসে হাজির। প্রথম আলোর সেই আরারাত প্রদর্শনীতে সেও দর্শকসারিতে ছিল। অকস্মাৎ অ্যাটমকে দেখে তাসকিনও অসম্ভব উচ্ছ্বসিত। অ্যাটমকে বলল, একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে বাংলাদেশেও একদিন আরারাত–এর মতো শক্তিশালী একটি আন্তর্জাতিক সিনেমা তৈরি হবে, এ নিয়ে সে খুব আশাবাদী।
অ্যাটমের সঙ্গে আমরা ছবি তুললাম। নিজ থেকেই অ্যাটম আমাকে তাঁর ই–মেইল ঠিকানা দিয়ে বললেন, আমি যেন অবশ্যই তাঁকে বলীর লিংক পাঠাই। এটাও বললেন, ‘আমার হাতে কিন্তু অনেক কাজ। আমি এবার টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারক। এ কারণে প্রচুর সিনেমা দেখতে হচ্ছে। তোমার সিনেমা দেখতে দেরি হলে কিছু মনে কোরো না।’
কথাবার্তার মাঝখানেই আচমকা অ্যাটমের খেয়াল হলো, তাঁর পোষা কুকুরটা পাশে নেই। ‘কুকুরটা কোথায় গেল, বলো তো!’
সর্বনাশ, ওপাশের খাদের দিকে চলে যায়নি তো! কুকুরটাকে আমরা অনেক দূর অবধি তাকিয়ে খুঁজলাম। পরে দেখি, আমার পায়ের ঠিক নিচে গুটিসুটি মেরে সে আছে চুপচাপ। অ্যাটম হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
আদরের পোষা কুকুরছানা নিয়ে অ্যাটম চলে যাচ্ছেন। পার্কের কাছেই তাঁর বাড়ি।
বড় মানুষদের ভদ্রতা করে বহু কথা বলতে হয়। আসলেই কি উৎসবের ব্যস্ততার মাঝখানে অ্যাটমের আমার সিনেমা দেখার সময় হবে? নিছক কথা রাখার জন্য তাঁকে আমি ছবিটার লিংক আর পাসওয়ার্ড পাঠিয়ে দিলাম।
তিন দিনের মাথায় অ্যাটমের ই–মেইল এল। বলীর আন্তরিক প্রশংসা সেই ই–মেইলে। অ্যাটমের অনুমতি নিয়ে সেই ই–মেইলের খানিক অংশের বাংলা অনুবাদ এখানে রইল।
‘এই গভীর রহস্যময় ও অসাধারণ নির্মাণশৈলীর চলচ্চিত্রটি আমাকে দেখতে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বলী চলচ্চিত্রের প্রতিটি সংলাপ, স্পেসের ব্যবহার ও বিন্যাস একেবারে যথাযথ। সবার অভিনয়ই দারুণ, মনে ধরে রাখার মতো। আমার বুঝতে বাকি নেই কেন এই সিনেমা বুসানের সেরা পুরস্কারটি জিতেছে।’