উইলিয়াম রাদিচে (১৯৫১—১০ নভেম্বর ২০২৪)
উইলিয়াম রাদিচে (১৯৫১—১০ নভেম্বর ২০২৪)

শ্রদ্ধা

এক ইংরেজ বাঙালি উইলিয়াম রাদিচে

১০ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ভিনদেশি গবেষক উইলিয়াম রাদিচে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে মৌলিক গবেষণা রয়েছে তাঁর। এই বাংলাপ্রেমীকে শ্রদ্ধা

উইলিয়াম রাদিচের (১৯৫১-২০২৪) সঙ্গে পরিচয় ১৯৯০ সালের দিকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামানের আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। ক্যাম্পাসে মনিরুজ্জামান স্যারের বাসায়ই ছিলেন তিনি। সেখানে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, বাংলা বিভাগ ও শহরের নানা জায়গায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। আমার মতো একজন তরুণ প্রভাষককেও তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এটা ভেবে এতকাল পরে এসে আজও তাঁর এই প্রয়াণের পরে মনের গহিনে বেদনা বোধ করি। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা-সাহিত্য যে কেবল এক পরম সুহৃদকে হারাল, তা-ই নয়, বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও পাশ্চাত্য জগতের মধ্যকার এক মজবুত সেতুবন্ধ মিলিয়ে গেল তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।

প্রথমবারের সেই অবস্থানে তিনি বিভাগে বক্তব্য দেন রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্রাকৃতি কবিতা বিষয়ে, বিশেষত কণিকা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সম্পর্কে। তাঁর পরিচিতি উপস্থাপন করেন আমাদের প্রায় সবার শিক্ষক ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান। জানতে পারি, রাদিচে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যবিষয়ক গবেষকই শুধু নন, তাঁদের সাহিত্যের এক অসাধারণ অনুবাদকও। পরেও আসেন তিনি আমাদের বিভাগে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বক্তৃতা দেন, যেটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ মিলনায়তনে। বিভাগে এলে অনেক সময় তিনি দুপুরের খাবার খেতেন আমাদের শিক্ষক লাউঞ্জে। এক টেবিলে সবার সঙ্গে খাদ্য গ্রহণের সামাজিকতায় তাঁকে কাঁটাচামচের ব্যবহার বর্জন করতে দেখি। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পরিসর কালক্রমে বাড়ে এবং ১৯৯১ সালের নভেম্বর থেকে পরবর্তী বছর পাঁচেক আমার ইংল্যান্ডে অবস্থানের সুযোগে সেটি পারস্পরিক জানাশোনার দিকে এগোয়। আমার পক্ষে এই নিবেদিতপ্রাণ মানুষ, তাঁর কর্ম ও তাঁর অনন্যসমৃদ্ধ পারিবারিক ঐতিহ্য-ইতিহাস সম্পর্কে জানার অবকাশ সৃষ্টি হয়।

ইতালো দ্য লিল রাদিচে ও বেটি রাদিচের পাঁচ সন্তানের মধ্যে উইলিয়াম চতুর্থ। ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় থেরেসার মৃত্যু হয় শৈশবে। দ্বিতীয় ক্যাথরিন মারা যান তাঁর কৈশোরের শেষ দিকে। সবার বড় থমাস ছিলেন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা। সবার ছোটজন সম্পর্কে জানতে পারিনি। রাদিচের জ্ঞান-ঔদার্য-সূক্ষ্মতার শিকড়ের সন্ধান করতে গেলে যেতে হবে তাঁর জন্মদাত্রী মা বেটি রাদিচের (১৯১২-১৯৮৫) কাছে। এই মহীয়সী নারীর ঋণ স্বয়ং রাদিচে স্বীকার করেন অকুণ্ঠভাবে। ইংল্যান্ডে তাঁদের প্রাথমিক বসবাস ইয়র্কশায়ার অঞ্চলে, যদিও তাঁদের বংশের আদি পুরুষেরা ছিলেন ইতালিয়। ধ্রুপদি ভাষা-সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বেটি ছিলেন লাতিন ভাষায় পারদর্শী এবং ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে লাতিন ভাষা-সাহিত্যের নামকরা অনুবাদক। রাদিচের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, অনুবাদের শৈল্পিক পারদর্শিতা এবং অনুবাদে মূলের সূক্ষ্মতা কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা তিনি অল্প বয়সেই মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন। অক্সফোর্ডে শিক্ষালাভকারী বেটির পারঙ্গমতা ছিল ইংরেজি, লাতিন, ধ্রুপদি সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রে। বিখ্যাত ‘পেঙ্গুইন ক্ল্যাসিকস’-এর যুগ্ম সম্পাদক, সম্পাদক এবং ‘ক্ল্যাসিকস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সহসভাপতি বেটির অসাধারণ সব রচনা আজও স্মরণীয়। রোমক ঐতিহাসিক প্লিনির চিঠিপত্র, টেরেন্স এবং ইরাসমাসের রচনা এবং ‘হুজ হু ইন দ্য অ্যানশিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড’ ইত্যাদি মূল্যবান রচনার তিনি অনুবাদক। তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর পুত্র উইলিয়াম ও বারবারা রেনল্ডসের সম্পাদনায় পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত ফেস্টস্খ্রিফ্ট (এসেজ ইন অনার অব বেটি রাদিচে) দ্য ট্রান্সলের্টস্ আর্ট শীর্ষক গ্রন্থটি বলা যায় বেটির অমরত্বের পরিধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অনন্য এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোয় মুদ্রিত সুসম্পাদনার ছাপ।

লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার স্কুল এবং অক্সফোর্ডের ম্যাডালেন কলেজের শিক্ষার্থী উইলিয়াম রাদিচের সাহিত্যপ্রতিভার প্রকৃত স্ফূরণ ঘটে তাঁর ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়নের সময়ই। ১৯৭০ সালে কবিতা রচনার স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন নিউডিগেট পুরস্কার। পেশাগত জীবনে সাইকিয়াট্রিক নার্স ও স্কুলশিক্ষকতার চাকরি করেন কয়েক বছর। অনেকের ধারণা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা রাদিচেকে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা-সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে আকৃষ্ট করে এবং তিনি অক্সফোর্ডে বাংলা সাহিত্য নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। অক্সফোর্ড থেকে তিনি ডি.ফিল ডিগ্রি নেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য বিষয়ে। তবে বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র বিষয়ে বিশেষত রবীন্দ্রসাহিত্যের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয় তাঁর সামনে; এবং তিনি সেই থেকে রবীন্দ্রনিমগ্ন এক বিরামহীন পথিক; যে পথে যতি পড়ে তাঁর পরলোকগমনের মধ্য দিয়ে। এখানে স্মরণযোগ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশে তাঁর রবীন্দ্রচর্চা ও অনুবাদসত্তার পরিচিতি যতটা ব্যাপক, তাঁর মৌলিক বা সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার প্রচার ততটা নয়। ১৯৭৪ থেকে ২০০৪ সালের ব্যবধানে তাঁর যে ছয়টি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ (এইট সেকশনস, স্টাইভিংস, লোরিং স্কাইস, দ্য রিট্রিট, গিফটস: পোয়েমস, দিসথিয়েটার রয়্যাল) প্রকাশিত হয়, তাতেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসেও নির্ধারিত আসন পেয়ে যান। এ ছাড়া ১০১টি সনেট অবলম্বনে রচিত ২০০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রিন, রেড, গোল্ড উপন্যাসটি যথেষ্ট প্রশংসিত হয় সাহিত্য-সমালোচক মহলে। সমালোচক এ এন উইলসন ইংল্যান্ডের ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ এটির প্রশংসাসূচক পর্যালোচনা করেছিলেন।

আমার দৃষ্টিতে উইলিয়াম রাদিচে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখা আরেক মহান ব্যক্তিত্ব; তাঁরই স্বদেশি জেমস ড্রমন্ড এন্ডারসনের (১৮৫২-১৯২০) যথার্থ উত্তরসূরি। আবার উভয়েরই রয়েছে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বাঙালিসংলগ্নতা। এন্ডারসনের মৃত্যুর অর্ধশতাব্দীকাল পরে তাঁরই জন্মভূমিতে সূচনা ঘটে এককালের ব্রিটিশ উপনিবেশ বাংলার জীবন ও সমাজের ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ আরেক মহান ব্যক্তিত্বের সৃজন-মননশীল কর্মের। ১৯৯০ সালে রাদিচে লন্ডনস্থ সেন্টার অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-সোয়াসে বাংলা বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁরই শিক্ষক বিশিষ্ট গবেষক-প্রাবন্ধিক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে পদটি শূন্য হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের নভেম্বরে আমাকে ইংল্যান্ডে যেতে হয় এবং রাদিচের চট্টগ্রামে অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে খানিকটা যোগাযোগের সূত্রে আমি তাঁকে টেলিফোন করি কেমব্রিজ থেকে। ফোনে তাঁকে প্রসন্ন ও উচ্ছ্বসিত মনে হলে আমি এক চমৎকার সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করি সোয়াসে তাঁর কর্মস্থলে। সেখানে ও ক্যাফেটেরিয়ায় চলে আমাদের আলাপ। অতি ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি যথেষ্ট মনোযোগে আমার কথা শোনেন।

সাহিত্যচর্চা, অনুবাদ, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়। প্রসঙ্গত তিনি জানান, কিছুদিন পরই তাঁর কেমব্রিজে যাওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কেমব্রিজের সাউথ এশিয়ান সেন্টারে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করবেন, যেখানে আলোচক হিসেবে থাকবেন তিনি। এসেছিলেন তিনি কেমব্রিজে। সেখানে আরও ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসের অনুবাদক চেক বংশোদ্ভূত জুলিয়াস লিপনার, যাঁর স্ত্রী অনিন্দিতা বাঙালি। প্রবন্ধপাঠ শেষে প্রশ্ন করেছিলাম, ইউরোপ বর্ষাহীন চার ঋতুর দেশ। রবীন্দ্র ছোটগল্পের অনুবাদক পাঠককে তাঁর গল্পের এই বর্ষা, বর্ষার নানামাত্রিকতা, ছায়া-ছায়ান্তর, রহস্যময়তা...এসব কীভাবে যথার্থরূপে পৌঁছে দেবেন? বুদ্ধদেব বসুর রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যবিষয়ক রচনার প্রসঙ্গ এনে তখন রাদিচে বলেছিলেন, রবীন্দ্রগল্পের বর্ষা-প্রতিক্রিয়ার ভাষিক রূপান্তর সম্ভবত ইউরোপীয় ভাষায় ধরা সম্ভব নয়। এ-ও তিনি বলেন, বাংলা ভাষায় আবেগ ও প্রতিক্রিয়া যতটা উচ্ছ্বাস ও অতিশয়োক্তিতে ভরা, ইংরেজিতে সেটা নেই। রাদিচে মধ্যযুগের গীতিকবিতা ও বৈষ্ণব পদাবলির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, রবীন্দ্রকাব্যের অনুবাদে এসব বিষয় তাঁকে যথেষ্ট ভাবিত করেছিল। তা ছাড়া বাংলা ভাষায় একটা সাংগীতিক সুরেলা ব্যাপার অন্তঃসলিলা থাকে যেটা ইংরেজিতে নেই, জার্মান ভাষায় নেই; হয়তো ফরাসি কিংবা ইতালীয় ভাষায় আছে। বাংলা ভাষার শক্তি ও মাধুর্যসম্পর্কিত তাঁর বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করে। আমি নিজে কখনো এমনটা ভেবে দেখিনি কিন্তু রাদিচে বলেন, বাংলা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এর শ্রেষ্ঠত্ব আরও সহজে বোঝা যেত যদি বাঙালির থাকত আরব দেশীয়দের মতো তেলসম্পদ কিংবা জাপানিদের ধনসমৃদ্ধি। থাকলে পৃথিবীর লোকেরা হুমড়ি খেয়ে বাংলাই শিখত, যেমনটা তারা শেখে আরবি কিংবা জাপানি। কিন্তু বাংলা ভাষা যাঁরা শিখতে চান, তাঁরা শিখবেন ভাষাটার মাধুর্য ও সুষমার প্রেমে পড়ে। আমি আবু সয়ীদ আইয়ুবের কথা বলি। রাদিচের অন্যতম প্রিয় রবীন্দ্রসমালোচক আইয়ুব।

বস্তুত শিক্ষক হিসেবে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতকে পাওয়াটা ছিল রাদিচের জন্য পরম সৌভাগ্যের। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। এখানে বলা যাবে, যুবক বয়স থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ জন্মে তাঁর। আর অক্সফোর্ডে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁর চেয়ে এক বছরের বড় বিখ্যাত সুকান্ত চৌধুরীর সঙ্গে। সুকান্ত ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সুপ্রিয়া দুজনই কলকাতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক। এই পরিবারের সংস্পর্শ তাঁর জীবনের এক বিরাট পাথেয় ছিল। সুকান্ত চৌধুরীর বাবা কান্তিপ্রসাদ চৌধুরী আর মা সুজাতা চৌধুরীর জীবনটাও ছিল উল্লেখ করার মতন। সুজাতাও ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সুকান্তর কলকাতার সল্টলেকের বাড়িতে বেড়াতে এলে বাড়ির সবাই-ই তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেন এবং অনেকটা বাধ্যতই তিনিও বাংলা বলার চেষ্টা করতে থাকেন। এভাবেই বাংলার সাহচর্য হয়ে যায় তাঁর পরিণতি। আবার বাংলাদেশে মনিরুজ্জামান পরিবারের সাহচর্য রাদিচেকে বাংলার পূর্ব দিককার মেজাজ ও আবহকে বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রকাব্য কিংবা রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ, ডাকঘর নাটক অনুবাদের পাশাপাশি তাঁর ছোটগল্পের অনুবাদের বিষয়টা ভাবনায় রেখে বিচার করলে রাদিচের এই দুই বাংলার অভিজ্ঞতার প্রায়োগিকতাকে বুঝতে পারা যায়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ১০–১২ ছোটগল্পে রয়েছে পূর্ববঙ্গের জীবন, সমাজ, প্রকৃতি ও লোকাচারের পটভূমি। মনে পড়ে তাঁর চট্টগ্রামে থাকাকালীন একটি ঘটনার কথা। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদে ‘জোহরা ম্যারেজ হল’-এ (পরবর্তীকালে ‘মিষ্টিমুখ’-এর বিক্রয়কেন্দ্র) আমরা তাঁকে নিয়ে যাই বাংলা বিভাগের প্রবীণতম কর্মকর্তা আবদুর রশীদের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। ‘আমি কখনো বাঙালি ললনার বিবাহ দেখিনি’ বলেই অনুষ্ঠানস্থলে সোৎসাহে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন বিবিধ উপলক্ষ এবং তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করে চলেন একের পর এক ছবি।

পরবাস নামক পত্রিকায় প্রকাশিত উইলিয়াম রাদিচের একটি রচনার খানিকটা (মদীয় অনুবাদে) লক্ষ করি, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমার দারুণ সৌভাগ্য, শেখা এবং অধ্যয়নের জন্য আমি বাংলাকে বেছে নিয়েছিলাম। বাঙালিরা সর্বোচ্চ বিবেচনায় খুবই চমৎকার মানুষ। পৃথিবীতে তারা কোনো ক্ষতিসাধনের কাজ করেনি। আর আধুনিককালে তাদের সংস্কৃতি বেশ কয়েকজন অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে।’ যতবার তাঁকে দেখেছি ও তাঁর সঙ্গে সময় কাটিয়েছি আলাপচারিতায়, কখনো তাঁকে চড়া গলায় কথা বলতে শুনিনি। মনে হয়েছে কণ্ঠস্বরকে উচ্চগ্রামে তোলার ব্যাপারটাই তাঁর ধাতে ছিল না। এ-ও কি তাঁর দীর্ঘকালীন মার্জিত বাঙালি মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা ও অভ্যাসের ফল! হতে পারে। তবে রাদিচে তাঁর সারা জীবনে সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে গেছেন এক পরিশীলিত রবিরেখা। এমনকি তাঁর স্বরচিত কবিতা যেখানে তিনি তাঁর স্বকীয় ভাষা-সংস্কৃতিতে অবারিত, সেখানেও পরশ বুলিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। স্বয়ং রাদিচে সে কথা কবুল করে তাঁরই দ্য রিট্রিট কাব্যগ্রন্থের কবিতাকে উপস্থাপন করেন তাঁর সেই রবিঋণ বোঝানোর জন্য।

উইলিয়াম রাদিচে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়ে বাংলাকে ভালোবেসে পরিচালনা করেছিলেন তাঁর কর্মজীবন। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বাংলা ভাষা শিক্ষার গ্রন্থ টিচ্ ইয়োরসেলফ বেঙ্গলি লক্ষ করলে বোঝা যায়, বাংলা ভাষাকে তিনি কতটা গ্রহণ ও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১০ বছরের কিছু কম সময়ের মধ্যে রাদিচের এ বইয়ের ১৭টি মুদ্রণ হয়েছে, সামনের দিনে হয়তো আরও হবে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত দিয়ে শুরু রাদিচের যাত্রা রবীন্দ্রবাহিত হয়ে বহুমাত্রায় রূপ নিয়েছিল। একজন বিভাষী-বিদেশি মানুষের এমন সাফল্য অনুপ্রেরণামূলক তো বটেই, অনুসরণযোগ্যও।