বাকার বকুলের রচনা ও নির্দেশনায় আদম সুরত নাটকের দৃশ্য। এ নাটকের রচনা ও উপস্থাপনারীতিতে বেশ নতুনত্ব রয়েছে
বাকার বকুলের রচনা ও নির্দেশনায় আদম সুরত নাটকের দৃশ্য। এ নাটকের রচনা ও উপস্থাপনারীতিতে বেশ নতুনত্ব রয়েছে

২০২৩ শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতি কেমন গেল

থিয়েটারের সালতামামি

এ বছর ঢাকার মঞ্চে এসেছে ৩০টির বেশি নতুন নাটক। এবার এমনও দেখা গেছে, কোনো নতুন নাটকের দুদিন, চার দিন বা সপ্তাহব্যাপী একাধিক প্রদর্শনীতে হলভর্তি দর্শক এসেছেন। সৈয়দ জামিল আহমদের নির্দেশনায় আমি বীরাঙ্গনা বলছি (নীলিমা ইব্রাহিমের গল্প, স্পর্ধার প্রযোজনা), সাইফ সুমনের নাজুক মানুষের সংলাপ (শাহাদুজ্জামানের লেখা থিয়েটারওয়ালার প্রযোজনা), মোহাম্মদ বারীর নির্দেশনায় হার্মাসিস ও ক্লিওপেট্রা (রচনা: রাহমান চৌধুরী, প্রযোজনা: অনুস্বর), রেজা আরিফের সিদ্ধার্থ (হারমান হেসের উপন্যাস থেকে আরশীনগরের প্রযোজনা) নাটকসহ আরও কিছু নাটকের প্রদর্শনীতে দর্শকের আগমন ছিল চোখে পড়ার মতো।

এ বছরের নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল ‘ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার’ বিতরণের মাধ্যমে। ‘দেশ নাটক’-এর আয়োজনে নাটকের আটটি বিভাগে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারের আয়োজক দেশ নাটক হলেও এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন দেশের খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে একটি ব্যবস্থাপনা পর্ষদ। এর পরপরই শুরু হয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘আলী যাকের নতুনের উৎসব’। এ উৎসবের বিশেষত্ব হলো প্রদর্শিত পাঁচটি নাটকই ছিল নতুন এবং অপেক্ষাকৃত তরুণদের নির্দেশনায়। প্রতিটি নাটকই ছিল নাগরিক ও মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন থেকে প্রণোদনাপ্রাপ্ত। আজাদ আবুল কালাম রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন ভেঙে নতুনভাবে অচলায়তন তৈরি করেছেন এ উৎসবে। রিমান্ড ছিল উৎসবের আরেকটি নতুন নাটক। শুভাশিস সিনহার লেখা এ নাটকের নির্দেশকও তিনি। প্রতিভাবান নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার উৎসবের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন সখী রঙ্গমালা। শাহীন আখতারের উপন্যাস থেকে বটতলার এ নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছেন সামিনা লুৎফা ও সৌম্য সরকার। বাকার বকুল নিজস্ব রচনায় আদম সুরত নির্দেশনা দিয়েছেন তাড়ুয়া নাট্যসংগঠন থেকে। এ নাটকের রচনা ও উপস্থাপনারীতিতে বেশ নতুনত্ব রয়েছে। একই উৎসবের আরেকটা আলোচিত নাটক অলোক বসুর রেসপেক্টফুল প্রস্টিটিউট। থিয়েটার ফ্যাক্টরি প্রযোজিত নাটকটিতে সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক ক্ষতকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

এ উৎসব ছাড়াও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় বছরের শেষ ভাগে সারা যাকেরের নির্দেশনায় মঞ্চে এনেছে অন্তরে বাহিরে চিত্রাঙ্গদা। ফেব্রুয়ারিতে আরণ্যক নাট্যদল তাদের ৫০ বছর পূর্তিতে ‘ক্রান্তির মাদল’ শিরোনামে আয়োজন করেছিল নাট্যোৎসব। সফল এ আয়োজনে আরণ্যক তাদের সাড়াজাগানো নাটকগুলোর পুনর্নির্মাণ করে দর্শকদের সামনে আসে। নাটকের দল ব্যতিক্রম বরাবরের মতো থিয়েটারে যুক্ত যুগলকে সংবর্ধিত করেছে। ইসরাফিল শাহীনকে দিয়েছেন সম্মাননা। পদাতিক নাট্য সংসদ আয়োজন করেছে ‘সৈয়দ বদরুউদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব’।

নাট্যমঞ্চে ২০২৩ সালে আরও একটি ভালো ঘটনা ঘটেছে। ত্রপা মজুমদারের নির্দেশনায় নতুন নাটকের মধ্য দিয়ে আবার নতুনভাবে মঞ্চে ফিরেছেন ফেরদৌসী মজুমদার। বছরের মধ্যভাগে দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল থিয়েটার প্রযোজিত লাভ লেটার্স-এ অভিনয় করেন নাট্যযুগল ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার। আর আব্দুস সেলিমের অনুবাদে এ নাটকের মধ্য দিয়ে দর্শক আবারও প্রত্যক্ষ করেন মঞ্চের জ্যেষ্ঠ শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদারের মনোলোভা অভিনয়।

এ বছর নাট্যকেন্দ্র দর্শকদের সামনে এনেছে নতুন প্রযোজনা তীর্থযাত্রী। হুমায়ুন কবিরের লেখা এ রচনার মাধ্যমে নির্দেশক তৌকির আহমেদ জীবনের নানা দিক ও দর্শন তুলে ধরেছেন। মুক্তনীল মঞ্চের তরুণতম নির্দেশক ও নাট্যকার। বাতিঘরের জন্য তার এ বছরের নতুন নাটক ভগবান পালিয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ নিয়ে লেখা নাটক যে রাতে নেতা নিহত হলেন। নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন রেজানুর রহমান। ইমদাদুল হক মিলনের গল্প থেকে নির্মিত প্রযোজনাটি মঞ্চে এনেছে এথিক থিয়েটার। বছরের তৃতীয় ভাগে মঞ্চে এসেছে উত্তরণ। বিবেকানন্দ থিয়েটার প্রযোজিত নাটকটি লিখেছেন অপূর্ব কুমার কুণ্ডু, নির্দেশনায় শুভাশিস দত্ত তন্ময়। আগস্টে মঞ্চে এসেছে সুন্দর। কামরুন নূর চৌধুরীর নির্দেশিত ও লোকনাট্য দলের প্রযোজিত এ নাটকের রচয়িতা মোহিত চট্টোপাধ্যায়।

প্রথাগত নাট্যদলের বাইরে অনেক নতুন নতুন রেপার্টরির কাজ দেখা গেছে এ বছর। সলিটারি কনফাইনমেন্ট নিয়ে মঞ্চে এসেছে নাট্যম রেপার্টরি। শাকিল আহমেদের লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন আইরিন পারভীন লোপা। অন্তর্যাত্রা প্রযোজিত নাটক হিড়িম্বা। রুবাইয়াৎ আহমেদের লেখা নাটকটির নির্দেশক হাবিব মাসুদ। অ্যাক্টোমেনিয়ার নাটক হ্যামলেট মেশিন। হাইনার মুলারের লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন নওরীন সাজ্জাদ। ম্যাড থেটারের রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিজয়া নাটকটির মঞ্চায়ন হয়েছে বছরের মে মাসে। রচয়িতা ও নির্দেশক আসাদুল ইসলাম। একগুচ্ছ গল্প শিরোনামে আগন্তুক রেপার্টরি ছয়টি ছোটগল্পের মঞ্চায়ন করেছে অক্টোবরে। সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল মঞ্চে এনেছে থিয়েটারেক্স। একই নাটকের মঞ্চায়ন দেখা গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পরিবেশনাতেও, যার নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক। বছরের একদম শেষভাগে নতুন দল কনটেম্পরারি থিয়েটারে নিজের লেখা নতুন নাটক অন্তসঙ্গ নির্দেশনা দিয়েছেন মাহবুব আলম।

মীর বরকতের নির্দেশনায় জুন মাসের প্রথম ভাগে কণ্ঠশীলন তাজমহলের টেন্ডার নাটক নিয়ে মঞ্চে ফিরেছে। জুলফিকার চঞ্চলের রচনা ও নির্দেশনায় নৃ–প্রাঙ্গণের একক অভিনয়ের নাটক অদ্ভুত ভাস্কর্য। ২০২৩-এর ৩০টি নতুন নাটকের সারিতে আরও আছে কণ্ঠশীলনের তাজমহলের টেন্ডার। অন্য যে নাটকগুলোর কথা বলা যায়, তা হলো সোনাবিবি, তালাশ, গিলগামেশ, গুণিন। এ বছরের শেষ নতুন নাটক হিসেবে মঞ্চে এসেছে সুরেন্দ্র কুমারী। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের এ প্রযোজনার রচয়িতা আনন জামান, নির্দেশনা শামীম সাগরের। এর আগে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে এনেছে ইউরিপিডিসের মেডিয়া। নির্দেশক হুমায়ূন কবীর হিমু।

 বছরের সব কটি নতুন নাটক নিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হবে ‘ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার’। নাটকপাড়ায় চলছে তারই আয়োজন।

বছরের নতুন নাটকগুলো দেখে থিয়েটারের কিছু নতুন প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বিখ্যাত উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু নাটকে। দলের নিজস্ব নাট্যকারের লেখা নাটক নিয়েও মঞ্চে এসেছে অনেক দল। বিদেশি নাটকের অনুবাদও মঞ্চায়িত করেছে অনেকগুলো দল। বিশেষভাবে যা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা হলো, প্রায় সব কটি নাটকই গভীর কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা। এসেছে নারীর অবস্থান নিয়ে নাটক, সাম্প্রদায়িকতাকে কটাক্ষ করেও হয়েছে বেশ কিছু নাটক। হয়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশকেন্দ্রিক নাটক।

লাভ লেটার্স নাটকের মধ্য দিয়ে এ বছর আবার নতুনভাবে মঞ্চে ফিরেছেন ফেরদৌসী মজুমদার

এবার একটা প্রবণতা একেবারেই লক্ষ করা যায়নি, তা হলো ‘হাসির নাটক’ বলে নাটকের যে একটা মোড়ক দেওয়া হয়েছিল, সেই মোড়কের নাটক এবার কেবল দু-একটি দেখা গেছে। বেশ কিছু নতুন নাট্যকার নাটক লেখায় নাম লিখিয়েছেন। তবে নতুন নির্দেশক তেমনভাবে আসেনি। বাইরের নির্দেশককে আমন্ত্রণ জানিয়ে দলের নাটক নির্মাণের যে প্রবণতা ছিল, তা এবারও আগের মতো দেখা গেছে, যা গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সাধারণ সূত্রের সঙ্গে মেলে না। নতুন দল এসেছে গোটা চারেক। এবার খুব ভালোভাবে লক্ষ করা গেছে যে নির্দেশকেরা নিজেদের নির্দেশনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। মঞ্চ, আলো, পোশাক, সংগীত—সব বিভাগে নিরীক্ষা ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক শিল্পী, যাঁরা অন্য মিডিয়ার ব্যস্ততার কারণে মঞ্চে কাজ করতে পারতেন না, তাঁদের অনেকেই এবার মঞ্চে ফিরেছেন। প্রায় প্রতিটি দলেই এই প্রত্যাবর্তন লক্ষ করা গেছে। এক বছরের ৩০টি নাটক মঞ্চায়নও একটা উল্লম্ফন বলে মানতে হবে। তবে এ বছর ঢাকার নাট্যমঞ্চে দর্শক বেড়েছে, যা শুরুতেই বলেছিলাম। ছুটির দিন ছাড়াও কর্মদিবসগুলোতে দর্শকেরা এসেছেন নাটক দেখতে। থিয়েটার উদ্‌যাপনের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।


মাসুম রেজা: নাট্যকার ও নির্দেশক