প্রথম আলোর চরণধ্বনি বাজছে আজও

আগামীকাল ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর রজতজয়ন্তী। শুরু থেকেই সুসাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য–সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পত্রিকাটির ছিল সমান মনোযোগ। শিল্পসংস্কৃতি অঙ্গনের দেশসেরা মানুষেরা ছিলেন এ দৈনিকের সুখ–দুঃখের সাথি। তাঁরাই নির্মাণ করেছেন প্রথম আলোর রুচি ও মূল্যবোধ। ২৫ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রথম আলো সম্পাদক স্মরণ করেছেন তাঁদের।

২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার–১৪১৮’ অনুষ্ঠানে দর্শক সারিতে বাংলাদেশের সেরা লেখক–শিল্পীরা—বাঁ থেকে রফিকুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, বেলাল চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী ও হাসনাত আবদুল হাই

আজ এই দিনে সেই ২৫ বছর আগের, ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বরের কথা মনে পড়ে। সেদিন প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকা ছাপা হওয়ার পর প্রেস থেকে একটি কপি নিয়ে অনেক সকালে ছুটে গিয়েছিলাম সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাসায়।

পত্রিকা হাতে আমাকে দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। খুশিও হয়েছিলেন। বিস্ময় নিয়ে বলেছিলেন, ‘একি! এত সকালে কাগজ নিয়ে চলে এলেন! আগে বসুন, এক কাপ চা খান।’

প্রথম আলোর শুরু থেকেই এ পত্রিকায় লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। অংশ নিয়েছেন আমাদের অনেক আয়োজনে। তিনি সবকিছু করতেন খুবই আনন্দের সঙ্গে। অনন্য এক চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল তাঁর। নিয়মিত প্রথম আলো আর প্রথমা প্রকাশনে আসতেন সদা হাসিখুশি মানুষটি। তাঁর উপস্থিতিতে পুরো পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে যেত। পরম উষ্ণতা আর আন্তরিকতা নিয়ে তিনি ছোট–বড় সবার খোঁজ নিতেন।

২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারির যে শনিবার রাতে তিনি মারা যান, তার দুই দিন আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি নিজে এসে তাঁর নাগরিকদের জানা ভালো বইয়ের ভূমিকা দিয়ে যান। শুধু একজন বিচারপতি কিংবা শুধু লেখক বা গবেষকই ছিলেন না, ছিলেন আমাদের সামগ্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শগুলোর প্রতীক।

দুই

প্রথম আলোর কথা বলতে গেলে যে নামটি সামনে চলে আসে, তিনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কখন, কোথায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সে কথা এখন আর মনে নেই। জীবনের শেষ লেখাটি তিনি লিখেছিলেন প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়, ২০২০ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে। শুরুর সংখ্যায়ও লিখেছিলেন।

আনিসুজ্জামানকে আমি ‘স্যার’ ডাকতাম। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে অনেকের মতো তিনি আমারও শিক্ষক ছিলেন। স্যারের সঙ্গে নানা লেখালেখির ব্যাপার তো ছিলই। তার বাইরেও ছোট-বড় সভা, অনুষ্ঠান বা নানা কাজে তিনি চলে আসতেন প্রথম আলোর অফিসে। আমরাও প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে যেতাম তাঁর কাছে।

আমরা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম ২০০৯ সালে। প্রশ্ন উঠল, এর নাম কী হবে? আবার সেই আনিস স্যার। তিনি এর নাম দিলেন প্রথমা প্রকাশন। প্রথম আলো থেকে প্রথমা।

প্রথম আলোর শুক্রবারের সাময়িকীতে আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথার প্রথম খণ্ড কাল নিরবধি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বিপুলা পৃথিবীও তিনি লেখেন প্রথম আলোতেই। এ ছাড়া প্রথম আলোতে তিনি নানা লেখা লিখেছেন। প্রথম আলোর যেকোনো বিশেষ সংখ্যা মানেই ছিল আনিসুজ্জামান। প্রথমা প্রকাশন থেকে আমরা আনিসুজ্জামানের সাতটি বই প্রকাশ করেছি।

আমাদের যেকোনো ভালো কাজ বা উদ্যোগে সহজেই তিনি যুক্ত হয়ে যেতেন। প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কার কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন চারবার। তিনিই সভাপতি হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। আমাদের সবচেয়ে বড় জমকালো তারকাখচিত ‘মেরিল-প্রথম আলো তারকা জরিপ’ অনুষ্ঠানের আজীবন সম্মাননা প্রদান কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। এমনকি দেশব্যাপী কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত ‘ভাষা প্রতিযোগ’ কমিটিরও সভাপতি ছিলেন তিনিই। ‘ভাষা প্রতিযোগ’ নাম এবং এর স্লোগান ‘বাংলা ভাষায় কাঁদি-হাসি/ সকল ভাষা ভালোবাসি’ও তাঁর দেওয়া। আসলে নানাভাবেই আনিস স্যার প্রথম আলোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, আমরা তাঁকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম।

করোনাকালে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম স্যারকে। সেদিন অনেক কষ্টের মধ্যেও তাঁর সৌজন্যের অভাব ছিল না। তিনি আর ফিরে এলেন না।

১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রকাশপূর্ব সুধীসম্মেলনে আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ শামসুল হক ও শামসুর রাহমান

তিন

পরদিন প্রথম আলো বাজারে আসবে। আগের রাতে প্রেসে কাগজ ছাপা হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে সেদিন ছিলেন একজন—শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। প্রথম আলো গড়ে তোলার সমস্ত প্রয়াসের সঙ্গী ছিলেন তিনি। সেদিন প্রেসে কী যে ভালোবাসা নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী পত্রিকা ছাপা হওয়া দেখছিলেন—মনে আজও সে দৃশ্য উজ্জ্বল হয়ে আছে!

কত উৎসাহ নিয়েই না তিনি প্রথম আলোর লোগো, বিভিন্ন পৃষ্ঠাসজ্জা, ক্রোড়পত্রের নামলিপি—দিনের পর দিন সব করে দিয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শ ছাড়া পরেও আমরা এসবের কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জনা করিনি। প্রথম আলোতে তিনি অনেক ছড়া, কবিতা ও স্মৃতিকথা লিখেছেন।

কাইয়ুম ভাইয়ের সম্মানে তাঁর হস্তাক্ষর থেকে ‘কাইয়ুম ফন্ট’ নামে আমরা একটা বাংলা টাইপফন্ট তৈরি করেছি। এই ফন্ট ব্যবহার করে প্রায়ই আমাদের পত্রিকার বিশেষ শিরোনামগুলো করি। শুধু প্রথম আলোই নয়, প্রথমা প্রকাশনসহ আমাদের সবকিছুতেই তিনি যুক্ত থাকতেন ঘনিষ্ঠভাবে।

কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের দিনগুলোয়। মৃত্যু অবধি তা অটুট ছিল। শুরু থেকে শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রথম আলোর প্রধান শিল্প উপদেষ্টা। এখনো আমরা তাঁর অভাব বোধ করি প্রতিদিন। তাঁকে মনে করি আমাদের সব কাজে।

চার

২৫ বছর আগে প্রথম আলোর প্রথম দিনের বিশেষ ক্রোড়পত্রে ছাপা হয়েছিল সুফিয়া কামাল, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফারুক চৌধুরী, এবিএম মূসা, আনিসুজ্জামান, আলী যাকের প্রমুখের লেখা। তাঁরা আজ আমাদের মধ্যে নেই। সে ক্রোড়পত্রে আরও লিখেছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সন্জীদা খাতুন, মুহাম্মদ ইউনূস, সাখাওয়াত আলী খান, রফিকুন নবী, আসাদুজ্জামান নূর, সারা যাকের, জুয়েল আইচ, মাহ্ফুজ আনাম, আবুল মোমেন প্রমুখ। এসব সেরা মানুষ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কখনো ভুলতে পারি না। বিগত ২৫ বছর, আমাদের শ্রেষ্ঠ সময়টিতে শুধু লেখক–শিল্পী হিসেবে নয়, আমাদের পত্রিকার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ সমালোচনাও করেছেন।

মনে পড়ে, ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সকালে কবি শামসুর রাহমানের আশেক লেনের বাসায় গিয়েছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের কবিতা সংকলন দিনের রৌদ্রে আবৃত বেদনার জন্য কবিতা আনতে। কবি অপেক্ষা করছিলেন তাঁর ‘আমার স্বরের ডালে’ কবিতাটি নিয়ে। রাত জেগে লিখেছিলেন কবিতাটি। গভীর কণ্ঠে আমাদের কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। সেই কণ্ঠ এখনো কানে বাজে। সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক ভোরের কাগজ কিংবা পরে প্রথম আলোতে নানা উপলক্ষে তাঁর লেখা ছাপানোর সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে আমরা তাঁর ছয়টি বই প্রকাশ করেছি।

প্রথম আলোর ২৫ বছর শুধু নয়, ষাটের দশক থেকে সেই ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সাংবাদিক–জীবনের শুরু থেকে কত কবি–লেখক, শিল্পী–সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক সংগঠকদের সঙ্গে যে পথ চলেছি, তার হিসাব মেলানো কঠিন। শুধু লেখালেখি আর আঁকাআঁকি নয়, ছোট–বড় নানা কাজে প্রথম আলোর শুরু থেকেও তাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেসব মানুষের কথা মনে হলে আজ শ্রদ্ধায়–কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে আসে।

পাঁচ

শুরুর সংখ্যা থেকেই প্রথম আলোতে বাংলাদেশের সেরা মানুষগুলো নিয়মিত লিখতেন, পরামর্শ দিতেন। যোগ দিতেন আমাদের অনুষ্ঠানগুলোয়। তাঁদের অনেকে এখনো লিখছেন।

শুধু দৈনিক পত্রিকাতেই নয়, পয়লা বৈশাখ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে তাঁরা লিখেছেন। ঈদসংখ্যায়ও ছিল তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। দেশের নানা প্রজন্মের সেরা লেখকদের কেউ বাদ যাননি। লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, বেলাল চৌধুরী, গোলাম মুরশিদ, শামসুজ্জামান খান, মাহবুব তালুকদার, আকবর আলি খান, আবুল আহসান চৌধুরী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, মফিদুল হক, ফারুক মঈনউদ্দীন, শাহাদুজ্জামান, শাহীন আখতার, মঈনুস সুলতান, হরিশংকর জলদাস, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ওয়াসি আহমেদ, মশিউল আলম, শাহনাজ মুন্নী, সুমন রহমান, মোহাম্মদ আজম, রায়হান রাইন, আফসানা বেগম, সাগুফতা শারমীন তানিয়া, পিয়াস মজিদ প্রমুখ লেখক। এখনো লিখছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবীন সব লেখক, কবি, শিল্পী যুক্ত হচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। তাঁদের নিয়ে প্রথম আলো সামনে এগোতে থাকবে।

ছয়

আমাদের কাজ অষ্টপ্রহরের সাংবাদিকতা। আমাদের যুদ্ধ আছে, চাপ–ভয় আছে, ভুল আছে, ভালো আছে, সুনামও হয়েছে। তবে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সমান্তরাল ধারায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আমরা আধুনিক রুচি ও জীবনবোধ তৈরির প্রচেষ্টা করেছি অব্যাহতভাবে। সে জন্য যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিজগতের সবাইকে আমরা যুক্ত করতে চেয়েছি। এই অভিপ্রায় থেকেই প্রথম আলোর হয়ে আমরা বহু লেখক–শিল্পীর সাক্ষাৎকার ছেপেছি। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, রেহমান সোবহান, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, আকবর আলি খান, রুনা লায়লা, কবরীসহ অনেকের। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন এবং আছেন আমাদের বিশেষ শুভানুধ্যায়ী হয়ে।

তাঁদের বাইরে কলকাতার যেসব কবি–লেখক–শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি, সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাঁদের মধ্যে আছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, শিল্পী পরিতোষ সেন, গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখ। কীভাবে কীভাবে যেন তাঁদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

আমরা সব সময় মনে করি, মানুষ, বিশেষ করে লেখক, শিল্পী, গবেষক ও অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলে, আলোচনা করে আরও নতুন বহু কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। এখনো আমরা অপেক্ষায় থাকি, কার সঙ্গে পরিচয় করা যায়, কখন কার সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়।

‘কাইয়ুম ফন্ট’ ব্যবহার করে প্রায়ই প্রথম আলোর বিশেষ শিরোনামগুলো করা হয়

সাত

প্রথম আলোর এই দীর্ঘ ২৫ বছরের জীবনে লেখালেখিসহ নানা কাজের মধ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আরও অনেকে। তাঁদের মধ্যে আছেন সরদার ফজলুল করিম, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, ফেরদৌসী মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রমুখ। দূর থেকে এখনো নিয়মিত লেখেন হাসান ফেরদৌস ও মনজুরুল হক। মনে পড়ে আমাদের তিন প্রধান কবি মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহাসহ আরও কতজনের কথা। তাঁদের অনেকে না থেকেও এখনো আছেন।

সরদার ফজলুল করিমের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করি। এমন আদর্শস্থানীয় মানুষ সব সময়ের জন্যই বিশেষ অনুপ্রেরণার। সেই ষাটের দশক থেকে তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। তাঁর অনেক লেখা ছেপেছি। এখন প্রকাশ করছি তাঁর বই।

২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’র প্রচ্ছদকাহিনি করেছিলাম সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে। বাংলাদেশের আরেক বিশিষ্টজন মোজাফ্ফর আহমদ সেটি লিখেছিলেন ‘একজন সরদার ভাই’ শিরোনামে। সরদার ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। সকালবেলায় ফোন করে বলেছিলেন, ‘মতি, মরা মানুষকে আবার জিন্দা বানায়া দিলা তুমি!’

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ষাটের দশকের শেষের দিকে হলেও সত্তরের শেষে কিছু সময় সচিত্র সন্ধানীতে কাজের সূত্রে, পরে আশির দশকে ঘনিষ্ঠ হই। পরের দুই–তিন দশকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। যত দিন, যত সময় গেছে, ততই বিস্ময়কর মনে হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের উচ্চারিত প্রতিটি কথা, প্রতিটি পঙ্ক্তিকে। অবাক হয়ে শুনেছি আর ভেবেছি, একজন কত কিছু করতে পারে!

সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত ‘আমার শহর’ নিয়ে একটা আলাদা বই করার কথা বহুদিন বহুবার ভেবেছিলাম। পরে সেটা আমরা প্রথমা থেকে প্রকাশ করি। তাঁর মোট ১৬টি বই প্রকাশ করেছি আমরা। আজ তিনি নেই। তবে এখনো আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক।

ভোরের কাগজ-এ থাকতে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। প্রথম আলোতে শহীদজননী জাহানারা ইমামকে নিয়ে ‘তিনি’ শিরোনামে অসম্ভব আবেদনময় ও মর্মস্পর্শী একটা লেখা লিখেছিলেন। তাঁর অনেক গল্প ও অন্যান্য লেখা ছেপেছি আমরা।

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কে চিকিত্সাধীন অবস্থায়ও হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে বেশি লিখেছেন প্রথম আলোতে। তাঁর সেসব লেখা নিয়ে আমরা প্রথমা থেকে বসন্ত বিলাপ বইটি প্রকাশ করেছি।

প্রথম আলোর শুরু থেকেই দেশের সেরা সাংবাদিকদের মধ্যে আমাদের সঙ্গে ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এবিএম মূসা, আতাউস সামাদ, সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমুখ। তাঁদের কথাও খুব মনে পড়ে। গাফফার ভাই কয়েক বছর পরে আর লেখেননি। সমালোচনা করেছেন অনেক। তাঁকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

আট

এভাবেই প্রথম আলো ও প্রথমা প্রকাশনের যাত্রার শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে সব সময় যুক্ত থেকেছেন দেশের সেরা লেখক, কবি–সাহিত্যিক ও শিল্পীরা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁরা লিখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমরা যে ১৬ বছর বর্ষসেরা বই পুরস্কার দিয়েছি, সে সময়গুলোতে বিচারক হিসেবেও আমরা কাছে পেয়েছি এই সেরা মানুষদের। বিচারক হিসেবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন আনিসুজ্জামান, আহমদ রফিক, সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, হায়াৎ মামুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বশীর আল হেলাল, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, ভীষ্মদেব চৌধুরী প্রমুখ। পরে শাহীন আখতার, মোহাম্মদ আজম, সুমন রহমানদের মতো নতুন অনেকেও যুক্ত হয়েছেন আমাদের সঙ্গে।

এই মানুষগুলোই জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ভিত্তিমূলের সঙ্গে। প্রথম আলোর সব অগ্রগতি ও সফলতার পেছনেও তাঁদের উপস্থিতি ছিল। আসলে তাঁরাই দিনে দিনে প্রথম আলো ও প্রথমা প্রকাশনের রুচি, আদর্শ বা নন্দনতত্ত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন।

নয়

প্রথম আলো প্রকাশের এক মাস আগে ৩ অক্টোবর সিএ ভবনের মিলনায়তনে আমরা একটি সুধীসমাবেশ করেছিলাম। সেই দিনটির কথা মনে হলে এখনো আমাদের বিস্ময় কাটে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে’ গান দিয়ে শুরু হওয়া সেই সমাবেশে বাংলাদেশের সে সময়ের সেরা কোন মানুষটি যোগ দেননি? মঞ্চে উঠেছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, আবুল মাল আবদুল মুহিত, ফারুক চৌধুরী, মুজিবুল হক, রাশেদা কে চৌধূরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, জাকারিয়া পিন্টু ও আলী যাকের। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত গান শোনান আনিসুর রহমান, নিলুফার ইয়াসমিন, আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদুল হক, ডলি সায়ন্তনী ও রবি চৌধুরী। জাদু না দেখালেও জুয়েল আইচ চমৎকার কথা বলেছিলেন। সবাইকে হাসিয়েছিলেন হানিফ সংকেত। আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে নূরলদীনের সারা জীবন–এর ভূমিকাংশের পাঠ এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।

১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রকাশপূর্ব সুধীসম্মেলনে বাঁ থেকে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কাজী ফজলুর রহমান,আতহার আলী খান ও সৈয়দ আলী কবির

সুধীসমাবেশে মঞ্চে না উঠলেও দর্শকসারিতে থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, কাজী ফজলুর রহমান, সৈয়দ আলী কবির, সৈয়দ শামসুল হক, আতাউস সামাদ, ফয়েজ আহমেদ, শাহাদত চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, শেখ নিয়ামত আলী, মোরশেদুল ইসলাম, দেবাশীষ রায়, আতিউর রহমান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিনায়ক সেন, মহাদেব সাহা, মালেকা বেগম, শিরিন হক, আতহার আলী খানসহ আরও অনেকে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল তারকা রাজ্জাক, চম্পা, পূর্ণিমা, পপি, ফেরদৌস, বিজরী বরকতউল্লাহসহ অনেক চলচ্চিত্র তারকা এসেছিলেন সেদিন। কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে আরও ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী ও এসডি রুবেল। সবাই এসেছিলেন আমাদের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানাতে।

২৫ বছর আগে প্রথম আলোর প্রীতিসম্মেলনের সেই সুধীসমাবেশে কি আমরা জানতাম, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোই হয়ে উঠবেন প্রথম আলো? তাঁদের চরণধ্বনিই হয়ে উঠবে আমাদের চরণধ্বনি?

দশ

প্রথম আলোর যেকোনো সফলতায় এই সেরা মানুষেরা আনন্দিত হয়েছেন, উৎসাহিত হয়েছেন; আবার আমাদের প্রতি কোনো অন্যায়–অনিয়ম হতে দেখলে ব্যথিত হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁদের পাশে পেয়েছি। তাঁদের এই বন্ধুত্বই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাঁদের সবাইকে নিয়েই হয়েছে আমাদের সবার প্রথম আলো।

পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের ঐতিহাসিক দশকগুলো পেরিয়ে আজ আমরা নতুন শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আছি। এখনো আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন বাংলাদেশের এই সময়ের সেরা সব লেখক–শিল্পী ও সাংবাদিক। ছাপা কাগজ হিসেবে এখনো আমরা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় কাগজ। অনলাইনে সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাংলা পোর্টাল প্রথম আলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আমাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে।

আজকের বাংলাদেশে আমাদের সাংবাদিকতা, প্রথম আলো, বই ও বিভিন্ন ম্যাগাজিন প্রকাশনা, এত প্রতিযোগিতা আর মানুষের দুঃখ–দুর্দশায় পাশে দাঁড়ানো—এত কিছু তো আমাদের করার কথা ছিল না। তবু আমরা এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি প্রাণের তাগিদে।

প্রথম আলোর এক অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসে ছিলেন দেশসেরা মানুষগুলো। তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলাম, ‘আপনাদের সম্মিলিত আদর্শ ও লক্ষ্য যা, আমরা সেটাই অনুসরণ করব। আপনারা যে কাজ করতে বলবেন, আমরা সেটাই করব।’ সেই আদর্শ ও মূল্যবোধ ধরে রাখার চেষ্টা করে চলছি নিরন্তর। কারণ, আমরা স্বপ্ন দেখি একটি মানবিক সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার।