লালনের গান পরিবেশন করছেন জহুরা ফকিরানী। পাশে বসা অরূপ রাহী
লালনের গান পরিবেশন করছেন জহুরা ফকিরানী। পাশে বসা অরূপ রাহী

লালনের ভাবের সংস্পর্শে

১ কার্তিক ছিল লালন সাঁইয়ের ১৩৪তম তিরোধান দিবস। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী ‘আশাসিন্ধুতীরে’ নামে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনটি এবার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ, অল্পকাল আগেই স্বৈরশাসক দেশ থেকে বিতাড়িত হলেন। বাংলাদেশে এখন নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের চেষ্টা চলছে। এ সময়ে এই আয়োজনে রাজনীতিসচেতন লালনের ভাবনা শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা বাসনাই ব্যক্ত হয়েছে।

লালন সাঁইকে আধুনিক দুনিয়াতেও বড় দার্শনিক ভাবার অনেক কারণ রয়েছে। দুনিয়ার অন্য বহু দার্শনিকের মতোই তিনি ‘মানুষ’ নামে সত্তাটিকে চেনার ও চেনানোর সাধনা করে গেছেন। একে আমরা ‘মানুষ’কে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টাও বলতে পারি। তাঁর গানের বাণীর ভেতরে ভালো করে তাকালে দেখা যায়, তিনি ‘আমি’ সত্তার আড়ালে অনামিকে (অন + আমি) পরমকে খুঁজে ফিরছেন। পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদ ও অন্বয় ছিল তাঁর মূল চিন্তা।

শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান কর্তৃপক্ষ বিপুল প্রয়াসে অনুষ্ঠানটিতে লালনের গানের মাধ্যমে তাঁর দর্শনের সামাজিক–রাজনৈতিক পটভূমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। দুজন লালনসাধক ও গায়ক লালনের গানের নানা পর্যায় থেকে বেশ কয়েকটি গান দর্শক–শ্রোতাদের উপহার দেন।

অরূপ রাহী আধুনিক বাংলাদেশে সুশিক্ষিত লালন–ভাবুক। নিজে তিনি লালনের গান গেয়ে যেমন দর্শক–শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন, তেমনি কোনো গান পরিবেশনের আগে তাঁর তত্ত্ববাণী দর্শকদের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। এটা ছিল উপরি পাওনা। লালনের গান পরিবেশন করেন শিল্পী অরূপ রাহী ও ছেঁউড়িয়ার বিখ্যাত লালনশিল্পী জহুরা ফকিরানী।

লালনের গানের বাণী থেকে নেওয়া ‘আশাসিন্ধুতীরে’ শিরোনামটি ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দর্শক-শ্রোতাদের মনের ভাবের প্রকাশক। লালনের ‘মানুষ’ সত্তার দার্শনিক প্রত্যয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জরুরি প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা আয়োজনটিকে সুন্দর করে তুলেছে। অনুষ্ঠানের ঢোল, করতাল ও দোতারায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ছেঁউড়িয়া থেকে এসে গানের সংগত দিয়েছিলেন বলে লালন আখড়ার উন্মাদনা ছিল নজরকাড়ার মতো।

বাইরের বৃষ্টির সঙ্গে একাকার সাধক, অরূপ রাহী আর জহুরা ফকিরানীর গান মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে। আশা করি, শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর এ রকম আয়োজন অব্যাহত রেখে ঢাকাই মধ্যবিত্তকে আনন্দিত ও শিক্ষিত করে তুলতে পারবে। 

শামসেত তাবরেজী