ইয়ুভাল নোয়া হারারি
ইয়ুভাল নোয়া হারারি

তথ্য, অপতথ্য ও অ্যালগরিদম কীভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে

বছর দশেক আগে টেডটকের এক বক্তৃতায় বর্তমান দুনিয়ার জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী ও স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড বইয়ের লেখক ইয়ুভাল নোয়া হারারি বলেছিলেন, কেন মানবজাতি পৃথিবী শাসন করে। তবে ৫ সেপ্টেম্বরের আগে ‘দ্য ডায়েরি অব আ সিইও’ শিরোনামের এক পডকাস্টের আলাপে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এই অধ্যাপক জানিয়েছেন এক ভয়াবহ অনুমানের কথা, ২০৩৪ সাল নাগাদ নাকি মানবজাতিকে তথা গোটা পৃথিবীকেই নিয়ন্ত্রণ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ বছর বের হওয়া হারারির নতুন বই নেক্সাস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইনফরমেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম দ্য স্টোন এইজ টু এআই–এর সূত্রে এক আলাপচারিতায় নিজের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তিনি। পাশাপাশি বলেছেন তথ্য, অপতথ্য ও অ্যালগরিদম কীভাবে এখন মানুষের মনস্তত্ত্বের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। ভিডিও থেকে তাঁর আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন উম্মে ফারহানা

এখন অবধি মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে হারে উন্নতি করছে, তাতে মানবসভ্যতার সামনে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। এটা হলিউডের ছবির মতো দৃশ্যপট নয়, বরং এটা হচ্ছে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া। ভবিষ্যতে সিদ্ধান্তগুলো এআই নেবে, সেই হিসেবে বলা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আমি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নয়’, বরং ‘এলিয়েন ইন্টেলিজেন্স’ বলতে চাই। এলিয়েন এই অর্থে নয় যে এটি সৌরজগতের বাইরের কোথাও থেকে এসেছে, বরং এই অর্থে যে এটি যেভাবে কাজ করে, তা মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। আজকের যুগের মানুষের জীবন অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে অ্যালগরিদম। এটা মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক। মানুষ জানে না কিসে সে সুখী হয়, কোনটিকে সে সাফল্য বলে ভাবে, জীবনে কী কী সে চায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা কিছু নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়, সেগুলোকেই সে সত্য বলে ধরে নেয় এবং তার সাপেক্ষেই নিজের সাফল্য–ব্যর্থতা বা প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির হিসাব কষতে বসে। কিছুদিন পর এটি হবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। আমার নেক্সাস বইটি এআই নিয়ে নয়, বরং এটি আদিকাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি কীভাবে বিবর্তিত হলো, তা নিয়ে। মানুষ এত দিন যা কিছু ব্যবহার করে এসেছে, সবই ছিল টুল বা উপাদান। ছাপাখানা থেকে অ্যাটম বোমা—কিছুই মানুষের আদেশ ছাড়া নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। একটা প্রিন্টিং মেশিনকে নির্দেশ দিতে হয় কোন বই ছাপাতে হবে, বোমাটাকে ফেলতে হয়, সে নিজে নিজে কোনো শহর ধ্বংস করতে পারে না। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি নয়, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তথ্যের অবাধ সরবরাহকে অনেকটা খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে তুলনা করা যায়। গুহামানবদের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করা। কারণ, তাদের খাদ্যের ঘাটতি ছিল। আপনি আপনার দাদিকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, তিনি অবশ্যই বলবেন, খাদ্য যত বেশি থাকবে তত ভালো। বর্তমান যুগে জাঙ্ক ফুডের প্রচুর জোগান মানুষকে স্থূলকায় আকৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, মানুষ ডায়েট প্ল্যান করতে বাধ্য হচ্ছে। একইভাবে আগে তথ্যের ঘাটতি ছিল বলে মানুষ ভাবে, তথ্য যত বেশি পাওয়া যায়, তত ভালো। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। অবারিত তথ্যের সরবরাহ মানব মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। তার চেয়ে বড় কথা, তথ্য আর জ্ঞান এক জিনিস নয়। জাঙ্ক ফুডের মতো প্রচুর জাঙ্ক তথ্য মানুষের মগজকে ভারাক্রান্ত করে। সব তথ্য সত্যও হয় নয়। কিন্তু সত্য–অসত্য যাচাই করার আগেই জোয়ারের মতো আসতে থাকা তথ্যের প্রবাহ মানুষের মাথায় নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে। আমি নিজে দিনে দুই ঘণ্টা মেডিটেশন করি এবং বছরে ৪৫ থেকে ৬০ দিন সব ধরনের যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকি। এটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সবার দরকার। আর আমার জন্য তো এটা অপরিহার্য। একে আমি বলি ‘ইনফরমেশন ফাস্ট’।

অ্যালগরিদম আমাদের সামনে যেসব তথ্য বা খবর পরিবেশন করে, তার সবই সত্য নয়—এমনকি এগুলো অনেক সময় মানুষের তৈরি ‘কনটেন্ট’ বা আধেয়ও নয়। ইন্টারনেটে মানুষ প্রতিদিন প্রচুর অগুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট তৈরি করে, এটা যেমন সত্য—এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে এসব অনেক কনটেন্টই দেখতে মানুষের সৃষ্টি মনে হলেও, সেগুলো আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা। মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের আর বৈদ্যুতিকভাবে উদ্দীপ্ত করার প্রয়োজন নেই, ভাষা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় মানুষকে।

নেক্সাস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইনফরমেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম দ্য স্টোন এইজ টু এআই—সম্প্রতি বের হয়েছে ইয়ুভাল নোয়া হারারির এই বই।

আদিকাল থেকে ধর্ম ও রাজনীতির নামে, দেশপ্রেম বা আদর্শের নামে ধর্মগুরু আর রাজনৈতিক নেতারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তাঁদের একমাত্র অস্ত্র ছিল বিভিন্ন গল্প—পরলোক বা শত্রুকে হটিয়ে দেশ রক্ষা ইত্যাদি। অন্য কথায়, ভাষা ব্যবহার করেই একদল লোককে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা কিংবা নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করিয়ে নেওয়া, যুদ্ধে পাঠানো যেমন সম্ভব হয়েছে, তেমনি যুগে যুগে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করানো সম্ভব হয়েছে। ভাষা নামের এই অব্যর্থ অস্ত্র এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আয়ত্তে। কাজেই মানুষের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড বা বিশ্বাস–অবিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সবাইকে ধরে ধরে মগজে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের দখল নেওয়ার আর প্রয়োজন নেই। টারমিনেটর ছবির মতো বন্দুক হাতে পৃথিবীর পথে রোবটের ঘুরে ফেরার দরকারও আর পড়বে না। তথ্যের ব্যবহার কিংবা অপব্যবহারের মাধ্যমেই এটি সম্ভব।

মানবসভ্যতার শুরু থেকেই অপরিসীম গুরুত্ব পেয়েছে ভাষা। মানুষের মধ্যে সব ধরনের লেনদেন হয় গল্প আর ভাষা দিয়ে। একটি ব্যাংক নোটের মূল্য নির্ধারিত হয় তার পেছনের গল্প থেকে। যে কারণে মানুষ একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে ডলারের বিনিময়ে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে পারে। কিন্তু শিম্পাঞ্জিদের সমাজে এ রকম বিনিময় সম্ভব নয়। একই ধারাবাহিকতায় এটি সহজেই অনুমেয় যে মানবসভ্যতার মূল চাবিকাঠি অর্থাৎ ভাষার ওপর দখল নিতে পারলে তার সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, এমনকি ধর্মের ওপর দখল নেওয়া খুব সম্ভব, যা কিনা আজকের কৃত্রিম বুদ্ধমত্তা করতে পারছে কিংবা শিগগিরই পারবে। আমরা যতবার চ্যাটজিপিটি কিংবা অন্য কোনো এআই টুল ব্যবহার করি, এর সঙ্গে কথা বলি, প্রতিবারই এটি মানুষের চিন্তাচেতনা, মনস্তত্ত্ব আর ভাবার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে। মানুষকে প্রভাবিত করার দক্ষতাও এর দিনে দিনে বাড়ছে।

মানুষের সমাজ নানা বিভাজনে পূর্ণ—ধর্ম, জাতীয়তা ও মতাদর্শের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য সেটি সত্য নয়। মানুষ বিশ্রাম নেয়, কিন্তু এআই টুলগুলো অবিরাম কাজ করে যায়। ইতিহাস বলে, মানুষ কখনোই তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করেনি। ছাপাখানা আবিষ্কারের পর যেসব বই খুব বেশি বিক্রি হয়েছিল, সেগুলো প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের লেখা দর্শনের বই নয়, বরং জার্মান ক্যাথলিক ধর্মগুরু হেইনরিখ ক্র্যামারের দ্য হ্যামার অব উইচেস নামের বই, যা আসলে ‘ডাইনি’ বলে নারীদের হত্যাকে জায়েজ করার পক্ষে লেখা এক গ্রন্থ। একইভাবে এই সময়ে ইন্টারনেট সবার হাতের নাগালে আসার পর মানুষ যতটা জ্ঞান–বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য তাকে ব্যবহার করেছে, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে ভয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে। যেহেতু মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া যাবে না, তাই জেনোফোবিক, হোমোফোবিক কিংবা বর্ণবাদী বক্তব্য যে বা যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের ব্লক বা নিষিদ্ধ করার আগে এ ধরনের বক্তব্যগুলো কেন ছড়াচ্ছেন কিংবা কী উদ্দেশ্যে অ্যালগরিদম এসব কনটেন্টকেই সামনে আনে, সেটি বুঝতে হবে। লক্ষ করুন, অ্যালগরিদমের কিন্তু বাক্‌স্বাধীনতা নেই, তার তা দরকারও নেই। এটি কাজ করে মানুষের আগ্রহের বিষয় বিশ্লেষণ করে। অ্যালগরিদম জেনে গেছে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার মূল তরিকা কী। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নানা রকম ভয়ভীতি দিয়ে তাড়িত ছিল। নিজস্ব চিন্তাভাবনার ক্ষমতা না থাকলেও মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে যেহেতু এআইয়ের সম্যক ধারণা আছে, তাই এটি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও ভয় ছড়াতেই বেশি ব্যস্ত, এতে বেশি মনোযোগও পাওয়া যায়। আবার মানুষের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হয়ে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তাদের আবেগ ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলা করার জন্য, তাদের বিশ্বাস–অবিশ্বাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য যেটুকু বুদ্ধিমত্তা থাকা দরকার, সেটুকু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতিমধ্যে অর্জন করেছে।

ডিপফেক দিয়ে যেহেতু এখন মানুষের ছবি, কণ্ঠস্বর, এমনকি কথা বলার ভঙ্গি নকল করা যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার নিয়ে আমাদের মনে আর কোনো সন্দেহই থাকার কথা নয়। আমাদের ব্যাংক হিসাব, গোপন নথি, ব্যক্তিগত নথি কিংবা সম্পত্তির দলিল ইত্যাদি নিরাপত্তাঝুঁকির মুখে পড়তেই পারে। আপনি যখন আপনার ব্যাংকে ফোন করেন, ব্যক্তি হিসেবে তারা আপনাকে চেনে আপনার কণ্ঠস্বর দিয়ে। একইভাবে আপনার সম্পত্তির ওপর অধিকার, যা আসলে একটি দলিল বা নথির ওপর নির্ভরশীল, সেটি যদি কোনোমতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে আপনার জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেহেতু ভাষা তৈরি করতে পারছে, নতুন ব্যাংকিং প্রযুক্তি, এমনকি নতুনভাবে আইন তৈরিও তারা করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু এমন আইনও আছে, যা বলে, আইনজ্ঞ হওয়ার জন্য কাউকে মানুষই হতে হবে, এমন কোনো শর্ত নেই।

অনেকেই মানবসভ্যতার ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান। তাঁদের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিজস্ব জ্ঞান বা চেতনা নেই, নেই কোনো ইচ্ছা–অনিচ্ছা, সুখ–দুঃখের বোধ। দাবা খেলায় মানুষকে হারাতে পারলে সে খুশি হয় না, কোনো পাজল সমাধান করতে না পারলে কষ্ট পায় না। ন্যূনতম চেতনা না থাকলে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে পৃথিবীর সব এআই টুল মিলেও এতগুলো মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইবেই–বা কেন?

আসলে মানবসভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘চেতনা’ থাকার প্রয়োজনই নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে হারে বিবর্তিত হচ্ছে এবং যে গতিতে এটি নিজেকে চরম উৎকর্ষের শিখরে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে এমনকি এই প্রযুক্তি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন (ডেভেলপার), তাঁরাও তাল মেলাতে পারছেন না। আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে, এআই টুলগুলো এখন মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ শঙ্কা থেকে যাচ্ছে যে আগামীর দুনিয়া হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা শাসিত হবে।