বিষাদ-সিন্ধুর লেখক নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম হয়েছিল জমিদার পরিবারে। তাই জীবনের শুরুটা তাঁর ভোগবিলাস ও আয়েশের হলেও সে জীবনে বিষাদের ছোঁয়া কম ছিল না। তাঁর বিয়েতে কনে–বদলের যে ঘটনা ঘটেছিল, তার পেছনেও রয়েছে প্রগাঢ় এক বিষাদ আর বিরহের স্পর্শ।
বাবা মোয়াজ্জেম হোসেনের বেখেয়ালি স্বভাবের কারণে মীর মশাররফ হোসেনের কৈশোরটা কেটেছে খুবই উচ্ছৃঙ্খলভাবে। কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ার বাড়িতে দাসী-বাঁদী পরিবৃত বয়ঃসন্ধিকালের এক কিশোর নিজেকে তেমনভাবে শৃঙ্খলায় রাখতে পারেননি।
তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘দাসী–বান্দী কর্তৃকই আমার চরিত্র প্রথম কলঙ্করেখায় কলঙ্কিত হয়।’ তদুপরি বাবার অবহেলায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে মরতে দেখেন। কাছাকাছি সময়ে তাঁর সদ্য বিবাহিত বোনেরও অকালমৃত্যু ঘটে। একজন কিশোরের জন্য এসব ঘটনা ছিল বিষাদ–সিন্ধুর কাহিনির মতোই করুণ।
লেখাপড়ায়ও স্থির হতে পারেননি মীর মশাররফ। তাঁর বাবার ইংরেজ বন্ধু কেনি সাহেব চেয়েছিলেন, তাঁর মেয়েদের সঙ্গে মশাররফকে বিলেত পাঠাবেন পড়াশোনার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে ‘খ্রিষ্টান’ মেয়ে বিয়ে করে ফেলতে পারেন—এই ভয়ে তাঁকে আর গোরাদের দেশে পাঠানো হয়নি। পরে কুষ্টিয়া, পদমদী কি কৃষ্ণনগর—কোথাও পড়াশোনায় স্থিত হতে পারেননি এ লেখক।
১৭ বছর বয়সে কলকাতায় পিতৃবন্ধুর জমিদার নাদের হোসেনের বাড়িতে ওঠেন মশাররফ। দিনকয়েক যেতে না যেতেই নাদের সাহেবের বড় মেয়ে লতিফনের প্রেমে পড়েন। পত্রালাপে গভীর হতে থাকে তাঁদের প্রেম। অতঃপর তিনি মনস্থির করেন, লতিফনকেই বিয়ে করবেন। এর মধ্যে নাদের সাহেব মশাররফকে চাকরির প্রস্তাবও দেন। তাঁর বাবার তখন পড়ন্ত সময়। তাই এই প্রস্তাবকে মোক্ষম সুযোগ হিসেবেই ধরে নিলেন মশাররফ।
লতিফনের সঙ্গে তিন মাস প্রেমের পর হলো তাঁদের বিয়ের সিদ্ধান্ত। তবে বিপত্তি বাধল বিয়ের সময় ঘনিয়ে এলে। পনিসরার পীরও জমিদার লতিফনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন নাদের হোসের বাড়িতে। এ সময় প্রভাবশালী পীরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি নাদের হোসেনের পরিবার। তখন তাঁরা নিলেন অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত, বড় মেয়ে লতিফনকে বিয়ে দেবেন পীর সাহেবের কাছে আর ছোট মেয়ে আজিজনের বিয়ে হবে ১৮ বছর বয়সী মীর মশাররফ হোসেনের সঙ্গে।
তবে নিজের বিয়ের আসরেই ভেঙে পড়লেন মশাররফ। এদিকে এই বিয়ে আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারছিলেন না তিনি। চাকরি, বাবার বন্ধুত্ব ও নানা দিক বিবেচনায় অবশেষে আজিজনকেই বিয়ে করতে হলো তাঁকে।
কিন্তু আজিজনকে বিয়ে করলেও মীর মশাররফের মনে সব সময় বসবাস ছিল লতিফনের। লতিফনও তাঁর বিরহ কোনোভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাই অন্যত্র বিয়ের পরপরই নিজেই নিজের মৃত্যুকে স্বাগত জানালেন।
স্বাভাবিকভাবেই আজিজনের সঙ্গে মীর মশাররফ হোসেনের দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। বিভিন্ন লেখায় আজিজন সম্বন্ধে নানা কুৎসা করতেন মশাররফ। প্রথম বিয়ের ৯ বছর পর ‘কালী’ নামের আরেক কিশোরীকে তিনি বিয়ে করেন। এরপর কালীর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘কুলসুম’। তাঁর নামানুসারেই আমার জীবনী ও জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম বইটি লিখেছিলেন মীর মশাররফ হোসেন।
সূত্র: মীর মশাররফ হোসেনের আমার জীবনী ও শান্তনু কায়সারের মীর মশাররফ হোসেন।
গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন