সাম্প্রতিক

ওটিটি যেভাবে বদলে দিচ্ছে চিত্রনাট্যকারদের

আমেরিকায় রাইটার বা চিত্রনাট্যকারেরা লম্বা ধর্মঘটে গেছেন। তাঁদের এই ধর্মঘটের ডামাডোলে আমরা অনেকে খেয়াল করতে ভুলে যাচ্ছি, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম বা ওটিটি শুধু সিনেমা ও টিভি শোর বিপণনব্যবস্থাতেই বদল ঘটায়নি, এটি আসলে পাল্টে দিয়েছে পর্দায় গল্প বলার ধরনটিও। বদলে দিয়েছে পর্দার লেখকদেরও।

সাম্প্রতিককালে আমেরিকায় চিত্রনাট্যকারদের বিক্ষোভের ছবির সঙ্গে মোটরগাড়ি ও ওটিটি ছবি মিলিয়ে কোলাজ
সাম্প্রতিককালে আমেরিকায় চিত্রনাট্যকারদের বিক্ষোভের ছবির সঙ্গে মোটরগাড়ি ও ওটিটি ছবি মিলিয়ে কোলাজ

টেলিভিশনের পর্দায় গল্প বলার যে ধরন বা ছাঁচ গড়ে উঠেছে গত ৭০ বছরে, সেটার মূলে আছে মোটরগাড়ি। যেমনটা গ্রামবাংলায় যাত্রাশিল্পের গল্পকাঠামোর পেছনে লুকিয়ে আছে আমন ধান।

আমেরিকায় এ মুহূর্তে রাইটাররা ধর্মঘট করছেন। বেশ কিছুদিন ধরে। ‘রাইটার’ বলতে এ ক্ষেত্রে পেশাদার চিত্রনাট্যকার বুঝতে হবে—বইয়ের লেখক বা ‘অথর’ নন। ধর্মঘটে গেছেন ‘রাইটারস গিল্ড অব আমেরিকা’ নামে চিত্রনাট্যকারদের সবচেয়ে বড় সমিতির সদস্যরা। তাদের ১১ হাজারের বেশি সদস্য হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। একটা লাইনও তাঁরা লিখছেন না। তাতে সেখানকার টিভি ও চলচ্চিত্রশিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আমেরিকার চিত্রনাট্যকারেরা যে কারণে ধর্মঘট করছেন, সেটা এ দেশের চিত্রনাট্যকারদের একটু অবাকই করবে। তাঁরা বলছেন, স্ট্রিমিং বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোই যত নষ্টের গোড়া। এত দিন তাঁরা টেলিভিশনের জন্য সিরিজ লিখে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো এসে তাঁদের পেটে লাথি মেরেছে, তাঁদের রুটিরুজিতে টান পড়েছে, সংসার চলছে না।

আমাদের দেশে, যত দূর জানি, ওটিটি এসেছে অডিও-ভিজ্যুয়ালশিল্পের পেশাদার কর্মী, অর্থাৎ নির্মাতা, কলাকুশলী, অভিনয়শিল্পী এবং সর্বোপরি চিত্রনাট্যকারদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে। প্রথমত, ওটিটিঅলারা বেশি বাজেট দিচ্ছে; আর দ্বিতীয়ত, গল্প বলায় একধরনের স্বাধীনতা ভোগ করছেন নির্মাতারা। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝুলে থাকা নৈশাহার-উত্তর পারিবারিক রুচিনির্ভরতা থেকে মুক্তি পেয়ে কাহিনি তার নিজস্ব প্রকৃতির কোল পেয়ে গেছে অর্গানিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য। এখন পুরো দৃশ্যশিল্পে ধীরে ধীরে একটি পেশাদারি ‘ডিসিপ্লিন’ বা শৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু আমেরিকার অভিজ্ঞতা উল্টো হলো কী করে? টিভির যুগই ভালো ছিল—এ কথা কেন বলছেন চিত্রনাট্যকারেরা?

সে দেশের অতি নামকরা চিত্রনাট্যকার ও শো-রানার ওয়ারেন লেইট দেখলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘গত ১০-১৫ বছরে রাইটারদের এবং কিছু পরিমাণে অভিনয়শিল্পীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর সেটা হয়েছে স্ট্রিমিংয়ের আগমনের কারণে।’

এটা ঠিক যে নেটফ্লিক্স, প্রাইম ভিডিও, ডিজনি প্লাস আর হুলুর পথ ধরে একের পর এক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম এসে টিভি শোর প্রোডাকশনে একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। আগে যেখানে আমেরিকায় সব টিভি মিলিয়ে বছরে ৮০টির মতো টিভি সিরিজ বা শো তৈরি হতো, এখন সেখানে ৫০০-এর বেশি শো তৈরি হচ্ছে। এতে সারা দেশ থেকে তরুণ লেখকেরা ছুটে আসছেন ইন্ডাস্ট্রির তীর্থস্থান ক্যালিফোর্নিয়ায় বা নিউইয়র্কে। গ্রামের লেখকেরা ব্যয়বহুল শহরে এসে সংসার পাতছেন।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সমস্যাটা অন্যখানে। এটার গোড়ায় আছে টিভি বা নেটওয়ার্ক শো এবং স্ট্রিমিং বা ওটিটি শোর সিজন গণনার তফাতের মধ্যে।

আমেরিকায় টিভি শোগুলো সিজননির্ভর। সিজন কী? সেখানে নতুন শোগুলো চালু হয় বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০-২২ পর্বের শো চলে মে মাস পর্যন্ত। এটাই একেকটা শোর সিজন। এবিসি, এনবিসি আর সিবিএস—এই তিন জায়ান্ট টিভি স্টেশনের জঠরে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক থেকে এভাবেই গড়ে উঠেছে টিভি শোর মৌসুম।

কিন্তু সেপ্টেম্বরেই কেন? এটার সঙ্গে আমেরিকার মোটরগাড়ি বিক্রির বাজারের যোগ আছে। ও দেশে মোটরগাড়ির নতুন মডেল বাজারে আসত ওই সময়ে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এ রকম বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন মূলত কর্মসংস্থানের বণ্টন বিবেচনায় রেখে। আর নতুন গাড়ির বিজ্ঞাপনের ঝুলিও খোলে ‘ফল সিজন’ বা সেপ্টেম্বর থেকে। তার লেজ ধরে আসে নতুন নতুন টিভি শো। অনেকটা আমাদের দেশে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা আর মেলা বসার মতো।

এভাবে মৌসুমের খোপ মেপে চিত্রনাট্যকারেরা আট মাসের জন্য চাকরিতে ঢুকে যেতেন। বসে পড়তেন রাইটারস রুমে। ২০-২২ পর্বের জন্য তাঁরা পেতেন মোটা মাইনে। কেউ সপ্তাহ হিসাবে, কেউ এপিসোড হিসাবে। ওয়ারেন লেইটের কথাই ধরা যাক। তিনি ল অ্যান্ড অর্ডার: ক্রিমিনাল ইনটেন্ট সিরিজের প্রতি পর্বের জন্য পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ডলার। সেটা এখন চিত্রনাট্যকারদের কল্পনারও বাইরে। কারণ কী?

কারণ, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম এসে সিজনের পুরোনো হিসাব উঠে গেছে। যদিও এখনো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে লম্বা সিরিজগুলোয় ‘সিজন’ কথাটা চালু রাখা হয়েছে, সেটা আসলে কথার কথা। সেই মোটরগাড়ির মৌসুমও আর নেই, নেই সেই অযোধ্যাও।

মূল ব্যাপার হলো নতুন জমানার স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ‘সিজনের’ দৈর্ঘ্য অনেক কম। একেকটা সিজন বা কিস্তি ছয় থেকে আট পর্বের। লিমিটেড সিরিজ হলে তো ওখানেই শেষ। ফলে লেখকেরা আগে টিভি শোতে যেখানে ৪০ সপ্তাহের জন্য চাকরি পেতেন, এখন তাঁরা চাকরি পাচ্ছেন অনেক কম সময়ের জন্য। বড় জোর ২০ সপ্তাহ। ওদিকে সম্মানী আগের মতোই। ফলে লেখকদের মাইনে গেছে কমে। তাঁরা হিসাব কষছেন, এখন সিজনের অর্ধেকটাজুড়ে তাঁরা বেকার থাকছেন। ফলে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁদের দুই বা ততোধিক শোর চাকরি করতে হচ্ছে। সেখানেও ‘গ্রামের নবাগতদের’ ভিড়।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘রেসিডিউ’ আয়ের হিসাব। সেটা কী? আগে টিভি শোর চিত্রনাট্য লিখে সম্মানীর সঙ্গে ‘উপরি’ জুটত। ডিভিডি রাইটস থেকে শুরু করে শোর পুনঃপ্রচারের আয়ে ভাগ পেতেন লেখকেরা। এটাই রেসিডিউ আয়। এই বন্দোবস্ত অবশ্য গোড়া থেকে ছিল না। বছর পনেরো আগে রীতিমতো আন্দোলন-ধর্মঘট করে এই রেসিডিউ আয় তাঁরা অর্জন করেছেন। এখন স্ট্রিমিং বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে পুনঃপ্রচারের বালাই নেই। ডিভিডিও তৈরি হয় না। ফলে সব দিক থেকেই লেখকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হলো এখন টিভির যুগেও আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। টিভিওয়ালারা নিজেদের পাল্টে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের আদল নিতে শুরু করেছে। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মই বাজার নিয়ন্ত্রক। পুরো প্রোডাকশন কাঠামো গড়ে উঠছে সেই আদলে।

ব্যাপার আরও জটিল করে তুলেছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের ব্যবসার অনিশ্চয়তা। নেটফ্লিক্সের পথ বেয়ে দুনিয়াজুড়ে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক যে প্রদর্শন ব্যবসা গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে বিজ্ঞাপনজগতের যোগ প্রত্যক্ষ নয়। সাবস্ক্রাইবারদের কাছ থেকে টাকা তুলে এই প্রদর্শন ব্যবসা কতটা দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে পারবে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা এখনো হয়নি। এটা এখনো এক পরীক্ষামূলক, জায়মান ইন্ডাস্ট্রি। অথচ পর্দার জগতের খোলনলচে এরই মধ্যে পাল্টে দিয়ে এটি ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে।

লেখকদের এই ধর্মঘটের ডামাডোলে আমরা অনেকে লক্ষ করতে ভুলে যাচ্ছি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় ‘ডিসরাপশনের’ জায়গাটি। এ ব্যবস্থা শুধু সিনেমা ও টিভি শোর বিপণনব্যবস্থাতেই বদল ঘটায়নি, এটি বদলে দিয়েছে পর্দায় গল্প বলার ধরনটিও। বদলে দিয়েছে পর্দার লেখকদের।

এত দিন যখন লেখকেরা টিভির পর্দার জন্য লিখতেন, তাঁদের এক ঘণ্টার চাংকে চার থেকে পাঁচটি বিজ্ঞাপন বিরতির কাঠামো মেপে গল্প ফাঁদতে হতো। বানাতে হতো প্রতিটি বিজ্ঞাপন বিরতির আগমুহূর্তে একটি করে ক্লিফহ্যাঙ্গার বা স্নায়ুটান মুহূর্ত। ফলে পর্দায় একজন ভ্রমণকারী কখনোই একবারে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছাতেন না। পথিমধ্যে তাঁকে অন্তত চারবার বিপাকে পড়তে হতো। প্রেমিককে তাঁর প্রেমিকার হৃদয় পেতে হতো প্রেমিকার বন্ধু, শ্যালক ও বসের প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে।

স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন বিরতি নেই। ফলে গল্প বলার ধ্রুপদি কাঠামো তিন অঙ্কের আদি বিন্যাসে ফিরে যাচ্ছে কাহিনি। গল্পের কারিগরদের জন্য এটা মুক্তিদায়ক পরিস্থিতি।

তবে সিনেমার ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। প্রেক্ষাগৃহ বা সিনেমা হলে যেসব ছবি মুক্তি পায়, সেগুলোর সঙ্গে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের জন্য বানানো সিনেমার কাঠামোগত তফাত ঘটে মূলত ‘দর্শককে শুরুতেই আটকে ফেলা’ বা ‘হুক করার’ তাগিদের কারণে। এ কারণে ‘স্লো বার্ন’ কথাটা এখন এত বেশি বেশি শোনা যায়।

একজন দর্শক যখন শহরের যানজট পেরিয়ে টিকিট কেটে, পপকর্নের ঠোঙা হাতে সিনেমা হলের স্বল্পালোকিত আসনে বসেন, তখন তিনি একটা সিনেমার জন্য ঘণ্টা দুয়েকের পূর্ণ সময় বরাদ্দ করেই বসেন। একজন নির্মাতা ওই দর্শকের জন্য ধীরেসুস্থে একটি গল্প উন্মোচন করার সুযোগ পান।

স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মওয়ালারা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে এই আয়েশ দিতে রাজি হবেন না। তাঁরা চাইবেন, নির্মাতা শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দর্শককে ‘গেঁথে’ ফেলুক। ফলে ওটিটিতে একজন নির্মাতা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর গল্পটি শুরু করবেন উল্টো দিক থেকে—ক্লাইমেক্স বা উত্তুঙ্গ মুহূর্ত থেকে। বা ভিন্ন কোনো বিন্যাস তিনি মাথা খাটিয়ে বের করবেন।

মানুষের ইতিহাসে গল্প বলার ধরন চিরকালই শাসিত হয়েছে গল্প শোনার লোকগুলো দিয়ে। ‘আরব্য রজনী’র গল্পগুলোর যে এপিসোডিক কাঠামো বা স্টোরি আর্ক, সেটা গড়ে উঠেছে সিল্করুটের বণিকদের কাফেলার তাঁবু ফেলার সঙ্গে মিল রেখে। পুঁজি ও প্রযুক্তিনির্ভরতার যুগে গল্পের আদলের সঙ্গে শ্রোতার অভ্যাসের চিরকালীন যোগসূত্রে ছেদ পড়েছে। এখানে গল্পের আদল গড়ে উঠছে ডিস্ট্রিবিউশন বা বিপণনব্যবস্থার ছাঁচে। আর এটা সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে।

আমেরিকায় লেখকেরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন রুটিরুজির প্রশ্নে। তাঁরা ন্যায্য সম্মানী চান। কিন্তু তাঁরা আসলে টিভি যুগের সুদিনের প্রেক্ষাপটে হিসাব কষছেন। প্রশ্নটা সম্মানীর পথ ধরে এসেছে বটে, কিন্তু এর পেছনে বড় ছবিটি পরিষ্কার দেখা দিতে শুরু করেছে। টিভি যুগেরও আগে পেশাদার গল্পকথকদের জন্য ছিল মঞ্চ যুগ, ছিল পত্রিকার পাতায় ধারাবাহিক উপন্যাসের যুগ। তখনকার বিপণনকাঠামোই তাঁদের সম্মানী বেঁধে দিত। এবারও তা–ই ঘটবে।

ধানের গোলার আকারই বলে দেবে সঙের পোশাক কী হবে।