প্রায় তিন–চারজন নাটকের দৃশ্য
প্রায় তিন–চারজন নাটকের দৃশ্য

সহস্রের আর্তনাদ

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে অপস্রিয়মাণ গোধূলির শেষ আভা। নিরাভরণ মঞ্চের পেছনে দেয়াললিখন—‘গুলি করি, একটাই মরে, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না’। জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের চিত্রটি বাক্যটিতে মূর্ত হয়ে আছে। সেটিকেও মঞ্চের অংশ বলে ভ্রম হয়। প্রচণ্ড কালেক্টিভের নতুন প্রযোজনাতেও যেন তারই গভীর স্পর্শ। জাহিদ সোহাগের রচনা ও সরওয়ার জাহানের নির্দেশনায় প্রায় তিন–চারজন নাটকটি গত ২৭–২৮ সেপ্টেম্বরে এ মঞ্চে প্রদর্শিত হলো চারবার। 

অভ্যুত্থান–উত্তর ঢাকার মঞ্চে এটি নতুনতম প্রযোজনা। নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ বা নিজেকে হারিয়ে ফেলার এক অদ্ভুতুড়ে বয়ান নিয়ে এই নাটক। ব্যক্তির বেদনার স্মারক হয়েও এই বয়ান সমষ্টির।

নাটকের চরিত্রগুলোকে নাম দিয়ে শনাক্ত করা দুষ্কর। তাদের পরিচয় প্রকাশিত হতে হতেও মিলিয়ে যায়। গুম হয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে ছুটে বেড়ানো এক মায়ের জবানিতে দানা বাঁধে নানা টুকরো দৃশ্যপট। আবার তা বিচূর্ণও হয়ে পড়ে। সেই বিচূর্ণ আরশিতে আমরা দেখি গুম, মৃত্যু, আহত মানুষের নানামুখী বয়ান; আর তার মধ্য দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন যাপনের অনিশ্চয়তা ও হাহাকারের পাঠ। রাষ্ট্র, সমাজ ও জীবনকে ঘিরে নিখোঁজ আজাদ বা আজাদি–বিষয়ক বহুস্তর ও অসরল বয়ান মনে নানা অস্বস্তি গুঁজে দেয়। সে বয়ান পরম্পরাহীন, অ্যাবসার্ড দৃশ্যকল্পে গড়া, কখনো–বা পরাবাস্তবের ইঙ্গিতবাহী। গুম-খুন-ধর্ষণসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের নানা সমীকরণ উল্টেপাল্টে দেখার বাসনা সেখানে প্রকট। গল্পগুলো তাই নাটকের শিরোনামের মতোই অনেকান্ত ইশারা দেয়। তার ভাব বিস্ফোরণোন্মুখ।

প্রচণ্ড কালেক্টিভের আত্মপ্রকাশের প্রস্তাবনা জটিল ভাষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও বিপ্লবী ভাবধারার সুর তুলে ধরেছে। গণপরিসরে এই নাটক মঞ্চায়নের সদিচ্ছা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী। কেননা, মুক্ত পরিসরে পরিবেশন করা হলেও নাটকটির সংলাপ জনকোলাহলের মধ্যে সহজে বোধগম্য নয়, যদিও এটি সংলাপপ্রধান। জনমানুষের নিকটে যাওয়ার প্রয়াসী এই নাটকে ভাষগত নৈকট্য রচনার প্রয়াস ছিল কম।

তারপরও প্রায় ৪০ মিনিটের এই মঞ্চায়ন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, গণমুখী নাট্যপ্রয়াসের পরিসর ক্রমে সংকুচিত হতে হতে এখন প্রায় বিলীন। অভ্যুত্থান–উত্তর নৈরাজ্যের জটিল আবহাওয়ায় বহিরাঙ্গনের এই উপস্থাপনকে যথেষ্ট সাহসী বলতে হবে। মবোক্রেসির নয়া উৎপাতের বিপরীতে তারুণ্যমুখর এই শিল্প আয়োজনটি অভিনন্দনযোগ্য।

এ প্রযোজনায় তারুণ্যের স্পর্ধাময় বিষয় ও মেজাজটিও দারুণ। প্রসেনিয়াম মঞ্চের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিখাদ উপস্থাপনা মুক্তমঞ্চে প্রত্যাশিত নয়। তবু বিমূর্ততার ঝোঁক কাটিয়ে দর্শকের সঙ্গে আলাপের অবকাশ তৈরির সুযোগ এই প্রযোজনায় আছে।

‘আব্বু, তুমি কান্না করতেছো যে’ বা ‘হামার বেটাক মারলু ক্যানে’র মতো দুয়েকটি সংলাপের সহজ অথচ সুতীব্র দ্যোতনা পুরো নাটকে ফুটিয়ে তোলা গেলে প্রায় তিন–চারজন সহস্রজনের চিন্তাকে তা স্পর্শ করতে পারবে।

হুমায়ূন আজম