আগামীকাল ১২ সেপ্টেম্বর সাধক শিল্পী শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। সেই অনালোচিত অধ্যায়ের উন্মোচন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) ও বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের (১৯১৬-২০০৯) ঘনিষ্ঠতার কথা সর্বজনবিদিত। সিলেট তথা হাওরাঞ্চলে শেখ মুজিবুর রহমান যতবারই নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা জনসভায় অংশ নিয়েছিলেন, ততবারই অবধারিতভাবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন শাহ আবদুল করিম। কখনো মুজিবের বক্তৃতার আগে, আবার কখনো বক্তৃতার পরে আবদুল করিম গণসংগীত পরিবেশন করে জনসভায় আগত ব্যক্তিদের চাঙা করতেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে গণভোটের সময় তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব দলবল নিয়ে সিলেটে এসেছিলেন। তবে সুনামগঞ্জে তিনি প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর। সে সময় তিনি দুর্নীতি দমন, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প, পল্লি কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন, সমাজ কল্যাণ এবং সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী। ওই দিন বিকেলে শেখ মুজিব সুনামগঞ্জে আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। সে সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন শাহ আবদুল করিমও। করিম সে সভায় শেখ মুজিবকে নিয়ে স্বরচিত একটি গান পরিবেশন করেন। গানটি এমন:
‘পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা
চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগ রে জাগ রে মজুর-কৃষাণ॥’
এ গানই মুজিবকে নিয়ে লেখা প্রথম কোনো গান। ১৯৫৪ সালের দিকে রচিত এ গানের স্থায়ী অংশ পাওয়া গেলেও অন্তরার সন্ধান আর মেলে না। সেদিনের সমাবেশের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম তাঁর আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন:
‘গণসংগীত পরিবেশন করলাম যখন।
এক শত টাকা উপহার দিলেন তখন॥
শেখ মুজিব বলেছিলেন সৎ-আনন্দমনে:
“আমরা আছি, করিম ভাই আছেন যেখানে॥”’
শেখ মুজিব ওই সফরকালে সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেন। সে কমিটিতে সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান আবদুল করিম। এরপর মুজিবের সঙ্গে করিমের হৃদ্যতা দিনে দিনে বেড়েই চলে। ১৯৫৭ সালে এই নেতার আহ্বানেই আবদুল করিম টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাগমারী সম্মেলনে অংশ নেন এবং সেখানে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে এক মঞ্চে গান পরিবেশন করেন।
বৃহত্তর সিলেট তথা হাওরাঞ্চলে শেখ মুজিবুর রহমান যতবারই এসেছেন, ততবারই তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন আবদুল করিম। শেখ মুজিবও করিমকে নিয়ে বিভিন্ন জনসভায় তাঁর উচ্ছ্বাস ও ভালো লাগা প্রকাশ করেছিলেন। সেসব জনসভায় সবার সামনে প্রায়ই আবদুল করিমকে উদ্দেশ করে তিনি বলতেন, ‘মুজিব ভাই বেঁচে থাকলে করিম ভাই বেঁচে থাকবে, ইনশা আল্লাহ।’
শেখ মুজিবুর রহমান তখনো ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হননি, আবদুল করিমের নামের আগেও তখন ‘শাহ’ শব্দটি বসেনি। সেই পঞ্চাশের দশকে শেখ মুজিব আর আবদুল করিমের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা আমৃত্যু বজায় ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার শিকার হলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন শাহ আবদুল করিম। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এ দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা কঠিন ছিল, সে সময়েই শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শাহ করিম যেকোনো গানের আসরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে তাঁর পরিবেশনা শুরু করতেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতি করিমের এই ভালোবাসা অমলিন ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ চলছে, আর আগামীকাল ১২ সেপ্টেম্বর শাহ আবদুল করিমের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী। বাঙালির রাজনীতি আর গানের ভুবনের এই দুই কিংবদন্তির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।