ভাষাসংগ্রামী ও লেখক আহমদ রফিকের ৯১তম জন্মবার্ষিকী ১২ সেপ্টেম্বর। তাঁকে শ্রদ্ধা।
‘মেঘের মাথায় রোদ ঝলসায়, মেঘভাঙা/ রোদের মুখের দিকে চোখ রেখে/ হেঁটে যাই, হেঁটে যেতে চাই/ যেখানে স্বপ্নের শেষ কলকণ্ঠ ভোরের নদীতে।’ সৃষ্টিশীল মানুষের স্বপ্ন গভীর ও বিস্তৃত। স্বপ্নডানায় তিনি যুগযন্ত্রণার আঁধার পেরিয়ে পৌঁছাতে চান সাধনালব্ধ কাঙ্ক্ষিত জগতে, যাকে আমরা ভোর বলি। সেই স্রষ্টা যদি হন ৯১টি বসন্ত পার হয়ে আসা জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাহলে বলাই যায়, জীবনের পরিধির মতো স্বপ্নছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষাও তাঁর দীর্ঘ। তিনি ‘পূর্ণতার শুদ্ধ লক্ষ্যে’ সত্যিকারের সাধনার এক জগৎ গড়ে তুলেছেন। সংগ্রামে-ধ্যানে-সৃজনে এখনো সক্রিয় মানুষটি জীবনভর অতিক্রম করেছেন নিজেরই অর্জনকে। গড়ে তুলেছেন এক নিভৃত জগৎ, যে জগতে কেবল তিনিই স্রষ্টা, তিনিই রাজা। তিনি ত্রিকালদর্শী আহমদ রফিক। আগামীকাল তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর সঙ্গে ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র-গবেষক অভিধাগুলো অভিন্ন সত্তায় উৎকীর্ণ।
স্কুলজীবন থেকেই আহমদ রফিক মননগঠন ও বিশ্বাসে সাম্যবাদী দর্শনে উজ্জীবিত। উপমহাদেশের দুই প্রবাদপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম ও সুভাষচন্দ্র বসুর সৃষ্টি ও রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে মুগ্ধ করে। সাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশবিভাগ তিনি চাননি।
স্বাধীন পাকিস্তান নয়, স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বাংলা ভাগ হোক, চাননি—বাস্তবতা সত্ত্বেও এখনো মানতে পারেন না। কিশোর বয়সেই রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
‘অগ্নি-বীণা’ তখন তাঁর খুব প্রিয়। ফরোয়ার্ড ব্লকের ছাত্ররাজনীতির দেশাত্মবোধ তাঁকে আলোড়িত করে। পার্টির স্থানীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়াকালে আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন বর্ধমানে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে। অত্যন্ত গর্ব করে তিনি বলেন, ‘চল্লিশের দশকে খুব কম মুসলমান ছাত্রই ছিলেন, যাঁরা পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু আমি সেই ব্যতিক্রমী ছাত্রদেরই একজন, যে শুরু থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলাম। ওই সময় বিপ্লববাদী নজরুলের কবিতা ও রাজনীতি এবং সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজনীতি আমাকে আকর্ষণ করে। ব্যক্তি হিসেবেও সুভাষ বসু আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিলেন।’ মার্ক্সবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তখন থেকেই।
১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার শাহবাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে হরগঙ্গা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। তখন থেকেই মার্ক্সবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। মেট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে অবিভিক্ত ভারতে মেধাতালিকায় স্থান লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণকে দায়িত্ব মনে করেন তিনি। নিত্যদিনের সাধনার অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন সংগঠক হিসেবে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনিও শহীদ হতে পারতেন। তাঁর সামনেই ঘটে গুলি চালানোর ঘটনা। সতীর্থরা গুলির আঘাতে তাঁর সামনেই লুটিয়ে পড়েন। শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২৩ ফেব্রুয়ারি সহযাত্রীদের সঙ্গে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে কেবল তাঁর বিরুদ্ধেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। দেড় বছর আত্মগোপনে থাকেন। পড়াশোনা কোনো রকমে শেষ করতে পারলেও ইন্টার্নের সুযোগ না পাওয়ায় চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। তবে রাজনীতি আর লেখালেখির পথ ছিল খোলা। তিনি লেখালেখিকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। সেখানেও তিনি ব্যতিক্রম। যখন তাঁর সমবয়সী বন্ধুরা কবিতা লিখতে উন্মুখ, বিভিন্ন সংকলনে বেরোচ্ছে তাঁদের কবিতা, তিনি নিজেকে মগ্ন রাখলেন মননশীল রচনায়। ১৯৫৬ সালেই লিখে শেষ করেন তাঁর প্রথম বই ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। সেই যে শুরু করেছিলেন মননশীল গ্রন্থ রচনা, আজও তা অব্যাহত রয়েছে। প্রকাশিত শতাধিক বইয়ের মধ্যে বেশির ভাগই মননশীল গ্রন্থ। বায়ান্ন থেকে বাংলা সাহিত্য নতুন যে পথে যাত্রা শুরু করে, তিনি তার অন্যতম কান্ডারি। সাতচল্লিশ থেকে একান্ন পর্যন্ত ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’কে আদর্শ ধরে যে পাকিস্তানবাদী বাংলা সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল, তার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় ২১ ফেব্রুয়ারি। তিনি একে বলেন বাঁকফেরা পরিবর্তন। এ বাঁক পরিবর্তনের তিনিও এক পথিকৃৎ।
অথচ পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের বাংলা কবিতার ধারাটি একঝাঁক তরুণ কবির আবির্ভাবে সমৃদ্ধ হলেও মননশীল ধারায় এককভাবে আহমদ রফিক ছাড়া তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মননশীল সাহিত্যের সেই ধারাটি এখনো তিনি সমৃদ্ধ করে চলেছেন।
লেখালেখির ক্ষেত্রে বরাবরই নৈর্ব্যক্তিক থাকতে পছন্দ করেন আহমদ রফিক। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক তিনি। প্রণয়ন করেছেন ২২টি গ্রন্থ। সংগঠক হয়েও গ্রন্থগুলোতে নিজেকে রেখেছেন অনুপস্থিত। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রথম এক যুগে রবীন্দ্র-সাহিত্য বিষয়ে কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। নিজেই রবীন্দ্রসাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। তাঁর রচিত ‘আরেক কালান্তরে’ (১৯৭৭) বাংলা একাডেমির রবীন্দ্রসাহিত্যবিষয়ক প্রথম বই। দেশে রবীন্দ্রসাহিত্যচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯৮৯ সালে একক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট। অনুরোধ করা সত্ত্বেও সাহিত্যের কোনো জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে এ কাজে তিনি পাশে পাননি। বাংলাদেশ-ভারতের তৎকালীন রবীন্দ্র-অনুরাগী তরুণদের নিয়ে তিনি দুই বাংলাতেই রবীন্দ্র-সাহিত্যের সম্মেলন করেন। এ প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্যবিষয়ক দুর্লভ গ্রন্থের এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। দেশ-বিদেশের দুর্লভ গ্রন্থ ও সাময়িকী সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এরশাদের আমলেই তিনি ট্রাস্ট পরিচালনার জন্য পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস পেয়েছিলেন। কিন্তু স্বৈরশাসকের কাছ থেকে তা গ্রহণ করেননি। যত দিন শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য ছিল, এর কার্যক্রম চালিয়েছেন বীরদর্পে। নব্বইয়ের দশকে দেশের বড় দুই দলের গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে তিনি সরকারি এক টুকরো স্থাপনা চেয়েছিলেন রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্রের অবকাঠামোগত স্থায়ী রূপ দেবেন বলে। বিমুখ হয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ২০০৪ সালের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্র। গ্রন্থাগারেরও একই দশা। কিন্তু তিনি থামেননি, রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে প্রণয়ন করেছেন ২৪টি গ্রন্থ। এককভাবে রবীন্দ্রসাহিত্যের ওপর আর কোনো গবেষক-প্রাবন্ধিক এতসংখ্যক গ্রন্থ প্রণয়ন করেননি। উপার্জনের সীমাবদ্ধতা প্রকট। তবু তিনি অবৈষয়িক ও নিভৃতচারী। সঞ্চয় ভেঙে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য-গবেষণাকে উদ্বুদ্ধ করতে রবীন্দ্র-গবেষণা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দিয়েছেন। প্রচারটুকুও চাননি। উচ্চশিক্ষার এ প্রতিষ্ঠান দুটিও উদাসীন তাঁর প্রতি।
কেবল রবীন্দ্র–সাহিত্য কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে নয়, আহমদ রফিক লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম নিয়েও লিখেছেন তিনটি গ্রন্থ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঘটনাক্রম নিয়ে নির্মোহভাবে রচনা করেছেন ‘একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য’, ‘বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ’, ‘ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো’ প্রভৃতি গ্রন্থ। বাংলাদেশের বাংলা কবিতা নিয়ে তিনি যা লিখেছেন, এতটা নির্মোহভাবে লেখেননি আর কেউ। ‘কবিতা, আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা’, ‘বাংলাদেশের কবিতা: দশকভাঙা বিচার’, ‘কবিতার বিচিত্র ভাষ্য’ এবং ত্রিশের দশকের প্রধান দুই কবিকে নিয়ে লেখা ‘বিষ্ণু দে: কবি ও কবিতা’, ‘জীবনানন্দ: কবি প্রেমিক ও গৃহী’ প্রভৃতি গ্রন্থ তারই সাক্ষ্য বহন করে। বইগুলো পড়লে অনায়াসেই মনে হয়, এ দেশের একাডেমিশিয়ানদের কাজগুলোকে তিনি নিজ দায়িত্বে সহজ করে দিয়েছেন।
‘দেশবিভাগ: ফিরে দেখা’ নামের বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন নির্মোহ ইতিহাসবিদের মুনশিয়ানা। দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশে এমন গবেষণালব্ধ পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ দুর্লভ বটে। তিনি বই লিখেছেন বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে নিয়ে, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়েও। রচনা করেছেন গল্প-উপন্যাস; লিখেছেন রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থও।
কদিন আগে আফসোস করলেন ভাষাশহীদদের ওপর গুলি চালানোর স্থানটিকে সংরক্ষণ করা যায়নি বলে। পুরান ঢাকার করোনেশন পার্কে বক্তৃতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ বসুর মতো ব্যক্তিরা। আহমদ রফিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে। ক্ষমতাপ্রাপ্তদের অনুরোধ করেও সাড়া পাননি। নিউ ইস্কাটন-মগবাজার সড়কে তাঁর নামে একটি ফলক আছে। সড়কটি যে তাঁরই নামে। তবে কেউ চেনে বলে মনে হয় না। নামফলকটির জীর্ণদশা আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলোর ভগ্নদশাকেই যেন ইঙ্গিত করে। অবশ্য জীবনভর তিনি কেবল চেয়েছেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়,/ এই হোক শেষ পরিচয়।’
সম্প্রতি আহমদ রফিক শেষ করেছেন রুশ বিপ্লবের ওপর সমৃদ্ধ এক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কাজ। খানিকটা ধরা গলায় বললেন, ‘এটিই হয়তো আমার শেষ গ্রন্থ।’
বয়সজনিত চক্ষুপীড়ার পাশাপাশি ভুল চিকিৎসার খেসারতও এখন আহমদ রফিককে দিতে হচ্ছে। চোখের সুস্থতা ছাড়া তাঁর লেখকজীবন যে থেমে যাবে! তাঁর এই অন্তঃক্রন্দন সত্যি না হোক। আলাপচারিতায় একদিন জানালেন, স্ত্রীবিয়োগের পর শয়নকক্ষের বিছানার অর্ধেকজুড়ে বড় মমতায় থাকে প্রিয় সব বই আর খাতা-কলম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন আহমদ রফিক। বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে এক জনমে এক ব্যক্তি আর কতটা দিতে পারেন! সরকারের উচিত স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা। এখনো তিনি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এখনো তিনি প্রগতিশীল ও বিপ্লবী চেতনা লালন করেন। এ দেশের তরুণদের ওপর ভরসা রেখে যেন বলতে চান, ‘আপাতত বিপ্লব ফেরারী, তবু এ মাটির একক সুপণ্য/ বেনামী বন্দরে একা জেগে আছে/ প্রত্যাশার বিনিদ্র আশ্রয়ে।’
আহমদ রফিক সুস্থ ও সক্রিয় থেকে শতায়ু লাভ করুন, সেটাই প্রত্যাশা।