বর্তমানে জনপ্রিয় আর আলোচিত লেখক পাওলো কোয়েলহো মনে করেন, জেমস জয়েসের মহাকাব্যিক উপন্যাস ইউলিসিস সাহিত্যের জন্য ‘ক্ষতিকর’। কারণ, আধুনিকতার নামে জয়েস এতে শুধু ‘ফর্ম’ নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছেন, সারবস্তু তেমন কিছুই নেই। এমন কথা বলেছেন আরও অনেকেই। ইউলিসিস হলো সেই ‘মাস্টারপিস’, যা নিয়ে মানুষজন কথা বলেছে বেশি কিন্তু পড়েছে কম। সে জন্য সাধারণ পাঠককে হয়তো তেমন দোষও দেওয়া যায় না। আড়াই লাখ শব্দের উপন্যাস পড়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ‘গল্প’ না পেয়ে কেনই–বা পৌরাণিক এক চরিত্রের নামে এর শিরোনাম দেওয়া হলো, তা বোঝার সামর্থ সাধারণ পাঠকের না-ই থাকতে পারে। সাহিত্যের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’, সেই কৌশলে লেখা এই উপন্যাসকে অনেকেই বলেছিলেন ‘আনফিল্মেবল’ বা অচিত্রণযোগ্য। কিন্তু তবু এই ‘চিত্রায়ণ–অযোগ্য’ উপন্যাসটি সিনেমার পর্দায় চিত্রায়িত হয়েছে, তা–ও অনেক আগে—১৯৬৭ সালে। মার্কিন নির্মাতা জোসেফ স্ট্রিক যে ছবিটি শুধু নির্মাণ করেছেন, তা–ই নয়, ফ্রেড হাইনসের সঙ্গে যৌথভাবে মনোনীত হয়েছিলেন সেরা চিত্রনাট্যের জন্যও।
১৯২২ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে লিওপোল্ড ব্লুমকে পাওয়া যায় ১৯০৪ সালে, কিন্তু জোসেফ স্ট্রিকের ছবিতে দেখানো হয়েছে ১৯৬০ সালের ডাবলিন শহর। আধুনিক জীবনের প্রায় সব অনুষঙ্গই চিত্রায়িত হয়েছে এখানে, উপন্যাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা মিলে তৈরি করেছেন এমন এক চিত্ররূপ, যাতে সংলাপের চেয়ে নেপথ্য চিন্তাই অনুপাতে বেশি। দুই ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় চেষ্টা করা হয়েছে যেন দর্শক উপন্যাসের মূল ভাবটি আস্বাদন করতে পারেন।
বইটা তো পড়তে খানিকটা কঠিন, তবে সিনেমা হিসেবে ইউলিসিস কেমন?
না, অতটা কঠিন নয়। এ জন্য নয় যে চলচ্চিত্রে অনেক সময়ই সংলাপ বা নেপথ্য কথনের বদলে ভিন্ন তরিকা ব্যবহার করা হয়—বিভিন্ন মন্তাজ, মিজো সিন দিয়ে, আবহ সংগীত ব্যবহার করে কোনো রকম কথাবার্তা ছাড়াই। তাই চলচ্চিত্রের দর্শকেরাও জানেন যে এসব ছবিই এখানে কথা বলছে, আলাদা করে কথার প্রয়োজন নেই। এই চলচ্চিত্রে তেমন নিঃশব্দ মুহূর্ত খুব বেশি নেই, কোনো না কোনো চরিত্রের মনের ভেতর চলতে থাকা কথাগুলো শোনা যেতে থাকে।
ইউলিসিস ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার সময় এ রকম কিছু ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’ ধরনের নেপথ্য কথন মুছে দেওয়া হয়েছিল। আর এতে খেপে গিয়েছিলেন নির্মাতা জোসেফ স্ট্রিক, ছবি প্রদর্শনের অনুমতি তুলে নিয়েছিলেন। মূলত লিওপোল্ড ব্লুমের স্ত্রী মলি ব্লুমের শেষ দিককার সলিলোকি বা স্বগতোক্তি নিয়েই ছিল আপত্তি। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় সেন্সরের কাচি চালানো এড়াতে মুছে দিতে হয়েছিল কখনো কখনো নেপথ্য সংলাপও, যাতে করে সেই দৃশ্যের মর্মার্থ বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়ে।
স্ট্রিম অব কনশাসনেসের ব্যাপারটি চমৎকারভাবে চিত্রায়িত হয়েছে ইউলিসিস ছবিতে। যেহেতু কোনো এক চরিত্রের মনের ভাবনা আর কল্পনা মিলেমিশে যাচ্ছে বর্ণনায়, তাই হুট করে চরিত্রদের কোনো রাজা–রানির পোশাকে দেখা বা ডিডালাসের মাথার চুলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কয়েক পদের উইগ পাল্টে যাওয়ার কারণ বুঝতে খুব বেশি সমস্যা হয় না।
মূল চরিত্র লিওপোল্ড ব্লুমের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, সেই অভিনেতা মিলো ও’শেয়াকে শুরুতে সিরিয়াস মনে হলেও বেশ কিছু দৃশ্যে দেখতে লাগে অনেকটা কমেডিয়ানের মতো। স্টিফেন ডিডালাসের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা জন মরিস রোয়েভেসের অভিব্যক্তি কখনো কখনো মনে হয়েছে অত্যন্ত রূঢ়, অনেকটা যেন খলনায়কের মতো। যদিও পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত এই অভিনেতা তাঁর প্রথম ‘ব্রেকথ্রু’ পান এই ছবিতে অভিনয় করেই।
দুই আইরিশ নায়কের তুলনায় ছবিতে ব্রিটিশ নায়িকা বারবারা জেফোর্ড বরং বেশি সুন্দর আর সাবলীল ছিলেন, মলি ব্লুমের ভূমিকায়। তাঁর সৌন্দর্য আর অভিব্যক্তি—দুটোই খুব স্বতস্ফূর্তভাবে মানিয়ে গেছে ‘মলি’ চরিত্রের সঙ্গে।
জেমস জয়েসের একনিষ্ঠ ভক্ত পরিচালক জোসেফ স্ট্রিক। এই লেখকের আরেক মাস্টারপিস দ্য পোর্ট্রেট অব অ্যান আর্টিস্ট অ্যাজ আ ইয়াং ম্যান উপন্যাসকেও চলচ্চিত্রায়িত করেছেন তিনি। ডাবলিন শহরের প্রতি জয়েসের অনুরাগকে সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তোলার জন্য ইউলিসিস সিনেমার চিত্রগ্রহণ তিনি করেছিলেন সত্যিকারের লোকেশনে। তাই ছবিটি দেখার সময় দর্শক আয়ারল্যান্ডের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাহাড়–সাগরতীরের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাবেন সত্যিকারের ডাবলিন শহরকেও। তবে চমকপ্রদ কথা হলো, যে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরের দৃশ্য ভাসে ছবিটিতে, সেখানে খোদ আয়ারল্যান্ডেই এটি বহু বছর প্রদর্শিত হতে পারেনি। মলি ব্লুমের স্বগতোক্তিতে একজন নারীর একান্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা আর ইচ্ছার বর্ণনা এখন পর্যন্ত অনেক দর্শকের কাছেই আপত্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতিকে প্রগাঢ় করে তুলতে এর বিকল্প উপায়ও বোধ করি তেমন নেই। ফলে ছবির শেষ অংশে প্রায় বিশ মিনিটের ওপর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে চলতে থাকে মলি ব্লুমের বিখ্যাত সেই স্বগতোক্তি।
ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচক পিটার ব্র্যাডশ মনে করেন, চূড়ান্ত রকম চিত্রায়ণ–অযোগ্য একটি বই থেকে যে এমন একটি চলচ্চিত্র বানানোর সাহস করেছেন নির্মাতা, সে জন্যই তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া উচিত।
উপন্যাস আর চলচ্চিত্র দুটো দুই মাধ্যম হলেও যখন একটি উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, তখন এই দুই শিল্পমাধ্যমের তুলনা এসেই যায়। কিন্তু ইউলিসিস ছবির ক্ষেত্রে এমন তুলনা করার মতো পাঠক-দর্শকের সংখ্যা আসলেই খুব কম। কেননা, ইউলিসিস উপন্যাসটি পড়ে শেষ করতে পারাই তো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে আপনি যদি ধৈর্য নিয়ে ছবিটি দেখেন, মলি ব্লুমরূপী বারবারা জেফোর্ডের অভিব্যক্তি ও অভিনয় আপনার মনকে আর্দ্র করবে বলেই মনে হয়।
১৯৬৭
নির্মাতা: জোসেফ স্ট্রিক
চিত্রনাট্য: ফ্রেড হেইনস, জোসেফ স্ট্রিক
চিত্রগ্রহণ: উলফগ্যাং সাসজিটস্কি
সম্পাদনা: রেজিনাল্ড মিলস
সংগীত: স্ট্যানলি মায়ারস
অভিনয়: মিলো ও’শেয়া (লিওপোল্ড ব্লুম), বারবারা জেফোর্ড (মলি ব্লুম), জন মরিস রোয়েভেস (স্টিফেন ডিডালাস), অ্যানা মানাহান (বেলা কোহেন), টি পি ম্যাককেনা (বাক মুলিগান)