ভ্রমণ

খালপাড়ের গোলকাননে

গোলকাননের অযান্ত্রিক নৌকা
ছবি: লেখক

তীব্র ফটফট শব্দের ধাক্কায় দেশীয় জলযানটি আমাদের নিয়ে মোংলা ঘাট ছেড়ে পশুর নদের তীর ঘেঁষে উজানের দিকে চলতে থাকে। ভাটার সময় নদী আড়াআড়ি পাড়ি দিতে হলে তীব্র স্রোতের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য প্রথমে উজানে যেতে হয়। তারপর স্রোতকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই একসময় ঘুরে জলের টানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেতে হয় ভাটির দিকে, এটাই নিয়ম। সেই উল্টো যাত্রার একপর্যায়ে নদীতীরের বাঁধের ওপর গোলপাতায় ছাওয়া ঘরের দীর্ঘ সারি, সেখানে স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহে নানান বয়সী শিথিলবেশ মেয়েদের মদিরতামাখা ভঙ্গিতে অলস দুপুরের রোদ যেন ক্ষণেক থমকে দাঁড়ায়, বাঁধ যেভাবে থামিয়ে দেয় নদীর উচ্ছ্বাসকে। সেখান থেকে পশুরের তীব্র স্রোতের গায়ে ঢলে পড়ার ভাব দেখিয়ে আমাদের জলযানটি একসময় যেন পশুরকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাংমারি খালে। ভাটির দিকের খালও যে এত প্রশস্ত হয়, সেটা উজানের শীর্ণ মৃতপ্রায় নদীগুলোকে দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। খালপাড়ের জীবন যেন নাগরিক কোলাহলের মতো বড় নদীর চেয়ে নিস্তরঙ্গ ও সমাহিত। সেখানে কয়েক কাঁদি ডাব নিয়ে ডিঙি বেয়ে চলেছে আঁটসাঁট এক যুবতী, ডিঙির অন্য প্রান্তে আরেক নারীর হাতেও বইঠা। এ রকম ডাববাহী নৌকার কোনোটিকে কখনো দেখা যায় মোংলা জেটিতে নোঙর করা বিদেশি জাহাজের গা ঘেঁষে নেমে আসা পানি ছুঁই ছুঁই গ্যাংওয়ের সঙ্গে বাঁধা। নৌকায় বসা মেয়েটির চুলে মোরগঝুঁটির মতো লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা। ওপরে ডেকের রেলিংয়ে ভর দেওয়া বিদেশি নাবিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডাকছে, হেই সার, গ্রিন কোকোনাট।

আরও কিছু দূর গেলে দেখা যায় শান্তশ্রী খালপাড়ের গেরস্তবাড়ির সামনে গাঁদা ফুলের উজ্জ্বল উদ্ভাস, ঘরের চালের ওপর বেগুনি ফুলে ছাওয়া লতানো শিমের ঝাড়, ঘাটে বাঁধা নৌকা। ঘরের সামনে রোদে শুকোতে দেওয়া কাপড় তুলতে তুলতে গেরস্ত–বউ উৎসুক চোখে তাকায় আমাদের জলযানটির দিকে। খালঘেঁষা লোকালয় যেখানে শেষ, সেখানে জলের ওপর জেগে থাকা ন্যাড়া ডালের ওপর ট্রলারের তীব্র চিৎকারে ভ্রুক্ষেপহীন ধ্যানমগ্ন মাছরাঙা। জঙ্গলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা গোটা দুই বানর জলের প্রান্তঘেঁষা লেপা উঠোনের মতো কাদার মধ্যে নিবিষ্টমনে খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু। এভাবে ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রার তীব্র শব্দ আচমকা পাল্টে গিয়ে মৃদু হতে হতে একসময় থেমে গেলে পুরো চরাচর কিছুক্ষণের জন্য যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তখনই চোখে পড়ে খালের পাড়ে কাদামাখা খুঁটির ওপর নানান রঙের নকশায় চিত্রিত সাদামাটা একটা গোলপাতার ঘর, সেটা থেকে সিঁড়ি নেমে এসেছে জলের ওপর।

বোট থেকে নেমে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলে বৈঠকখানা বা বারান্দার মতো ঘরটির অর্ধেক বাঁশের ঘেরা দেওয়া, ওপরের অর্ধাংশ খোলা। বেড়া ঘেঁষে বাঁশের বেঞ্চির মতো বসার জায়গা। সেই ঘরে কয়েকজন কিশোর-কিশোরী কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানায়। বড় হোটেলে পৌঁছালে যেমন সুবেশী তরুণীরা ওয়েলকাম ড্রিংক নিয়ে আসেন, সে তুলনায় এখানে কাঁচা হাতে গাঁথা জবা ফুলের মালার অভ্যর্থনাই অনেক বেশি আন্তরিক মনে হয়। ভেতরবাড়িতে ঢুকলে হাতের ডানে কাঠের পাটাতনের ওপর বারান্দাওয়ালা বিচ্ছিন্ন একটা ঘর ছোট সেতু দিয়ে এ পাশের সঙ্গে যুক্ত। এ পাশের মূল অংশে দুটো পাশাপাশি ঘর, দুটোই বাঁশের বেড়া আর গোলপাতায় ছাওয়া, মাঝখানে ঝকঝকে আধুনিক টয়লেট। সাপ্লাইয়ের বিদ্যুৎ নয়, সৌরবিদ্যুতে চলে বাতি, পাখা ইত্যাদি। বারান্দায় লম্বা ডাইনিং টেবিল। নিখুঁত গ্রামের বাড়ির পরিবেশ। বেলা পড়ে এসেছিল বলে দ্রুতই আমাদের দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। স্থানীয় ভাইটেল চালের ভাত, ভর্তা, ভাজি, মাছ, মুরগি দিয়ে নির্ভেজাল দেশীয় খাবার।

খাওয়ার টেবিলে বসে রিসোর্টের মালিক শ্রীপতি বাছাড়ের সঙ্গে আলাপ হলো। নামের প্রথমাংশটা পরিচিত হলেও বাছাড় পদবিটা জীবনে প্রথমবার শুনি। রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল নামের এনজিওর মাধ্যমে গোলকানন নামের এই ইকো রিসোর্ট তৈরি করার জন্য অর্থায়ন এবং ট্যুরিজমের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য শ্রীপতিকে নেপালে পাঠানোর খরচও বহন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গোলকানন আসলে গোলাকার কিছুই নয়। এখানকার ঘরগুলো গোলপাতায় ছাওয়া বলেই এমন নামকরণ। গোলপাতাও কিন্তু গোল নয়, বরং হুবহু নারকেলপাতার মতো ক্ষীণাঙ্গী, শণের বিকল্প হিসেবে কাঁচা ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।

শীতবিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল, ঢাংমারি খালের পূর্ব পাড়ের ঘন বনের মাথায় ঈষৎ উজ্জ্বল আলো এপাড়ে পাঠাচ্ছিল তার প্রতিফলন। রিসোর্টের পশ্চিমে সরু পথের দুধারে মৌসুমি ফুলের ঘন ঝাড় পেরিয়ে কাঁচা রাস্তার ওপারেই শ্রীপতিদের পৈতৃক বাড়ি। নাতিপ্রশস্ত পুকুর, বড় খড়ের গাদা, আর মাটির নিকোনো পৈঠার গায়ে জলে গোলা চালের গুঁড়ার আলপনা। রান্নাঘরের ভেতরে চলছে পিঠা তৈরির ব্যাপক আয়োজন। শ্রীপতি গিন্নিকে সহায়তা করছেন ফুলছাপা শাড়ি পরা কয়েকজন। তাঁদের নিটোল কালো হাতে শুভ্র শাঁখা আর চালের গুঁড়া তৈরি করেছে গ্রামীণ এক মায়াবী কনট্রাস্ট।

ঢাংমারি খাল সাঁতরে পার হয়ে বাঘেরা কখনো এই লোকালয়ে হানা দেয়, সে সময় একটা বাঘকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল এখানে। শ্রীপতি গিন্নিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনারা ভয় পাবেন, তাই বলতি চাচ্ছিলাম না। ভয় পাবে না তো?’ তারপর বাড়ির পেছনের গোয়ালঘরের দিকে দেখিয়ে জানালেন, ‘ওহানে দাঁইড়েছিল বাঘডা।’ এত কাছে বাঘ এসেছিল জেনে সমাগত সেই সন্ধ্যার গাঢ় ছায়ায় একধরনের অজানা ভয় চেপে বসে বুকের ভেতর।

ছিনাথ বহুরূপীর মতো বাঘের সাজে এই অভিনেতার অভিনয় ছিল খাসা

কয়েক ধরনের পিঠা দিয়ে জলখাবার যখন শেষ হয়, ততক্ষণে রিসোর্ট থেকে বের হওয়ার পায়ে চলা পথটির দুধারে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে দুই সারি মঙ্গলপ্রদীপ। বাছাড়দের বাড়ির সামনে নিচের অর্ধেক বাঁশের খোপ খোপ বেড়া দেওয়া ঘরে গানের আসরের আয়োজন করা হয়েছে আমাদের জন্য। ইউনিফর্মের মতো উজ্জ্বল কমলা রঙের পোশাক পরা কয়েকজন বাজিয়ে আর গাইয়ে আসেন, সঙ্গে জনা তিনেক নাচিয়ে কিশোরী। সবাই আশপাশের গাঁয়ের গানের দলের সদস্য। গান আর নাচের পর বাঘের পোশাক পরা এক মূর্তি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে আসরে। শ্রীকান্ত উপন্যাসের ছিনাথ বহুরূপীর মতো বাঘটির অভিনয় ছিল খাসা। সেই বাঘকে মেরে না ফেলে কৌশলে বশ করার প্রতীকী অভিনয় দিয়ে বোঝানো হয় সুন্দরবনের লড়াকু মানুষের সংগ্রামের কাহিনি।

পরদিন সকালে সূর্যোদয়েরও আগে কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির ঘুম না ভাঙানোর জন্য ইঞ্জিনবিহীন নৌকা নিয়ে যখন বের হই, ততক্ষণে কাজে নেমে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষেরা। আমাদের নিঃশব্দ অভিযানের মৃদু আলোড়নেই বোধ করি পড়িমরি করে জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকে ভোঁদড়ের দল, সাতসকালে এমন উৎপাতে বেশ বিরক্ত। কাঁকড়াশিকারিরা দক্ষ হাতে তুলে এনেছে হাতের তালুর সাইজের কাঁকড়া, মালার মতো জ্যান্ত ঝোলানো সেগুলোর কয়েকটা কিনে নেওয়া হলো দুপুরের রান্নার জন্য। এ সময় সূর্যের সদ্যোত্থিত কিরণে জেলেডিঙির বইঠার ঘায়ে কুয়াশার ভেতরও ছলকে ওঠে রুপালি জলের খণ্ড। ফেরার পথে ভোরের সাবালক আলোয় দেখা হয় খালের ধারে একচিলতে তৃণভূমিতে এক নিঃসঙ্গ হরিণীর সঙ্গে। ভাটায় জেগে ওঠা বনপালংয়ের নাশতা খেতে আসা বেচারি এত সকালে আমাদের দেখে ত্রস্ত ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কী আশ্চর্য! সেদিন দুপুরে খাবারের সঙ্গে আমাদেরও পরিবেশন করা হয় বনপালংয়ের শাক।

বিকেলে ফের বের হলে খালের উল্টো দিকে বনের প্রান্তে বনবিবির থানে দেখা হয় টুপি মাথায় কালো দাড়ি, পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা আলী মাধব, শিশু দুখে, লক্ষ্মী প্রতিমার মতো চেহারার বনবিবি আর তাঁর ভাই কালো দশাসই গোঁফওয়ালা উদোম গায়ের শাহ জঙ্গলীর সঙ্গে। পাশে একটা বাঘের মূর্তিও আছে। ভালো করে ছবি তোলার জন্য যত দূর সম্ভব ওদের কাছে গেলে পেছনে ও দুপাশে ঘন গাছের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে অন্ধকার, বনবিবির সদল উপস্থিতিতেও ভরসা না পেয়ে বোট নিয়ে দ্রুত সরে পড়ি।

সেখান থেকে বন বিভাগের ঘাগড়ামারী টহল ফাঁড়ি ঘুরে ফেরার পথে দেখা হয় দেবেন মণ্ডলের সঙ্গে, একটা ডিঙিতে স্ত্রীকে নিয়ে কাঁকড়া ধরছিলেন খালের জলে। বাঘের আক্রমণে মারাত্মক আহতাবস্থা থেকে বেঁচে ফেরার পর এ তল্লাটে মোটামুটি বিখ্যাত এই লোক। আমাদের নৌকাটা ওদেরটার গা ঘেঁষে দাঁড়ালে তাঁর কাছ থেকে শুনি বাঘের আক্রমণের বৃত্তান্ত। বললেন, ‘যহন বাঘ লাফায়ে পড়িল, সাতের দুজন গাছে উইঠে গেল। আমার ভায়রার ছাওয়াল ছেলো সাতে, সে কুড়োল দে বাঘের পিঠে এমোন বাড়ি মারিল, বাঘ পলায়ে যায়।’ মাথায় গামছা এবং গলায় মাফলার বাঁধা ছিল বলে সেসব জায়গায় নখের আঘাত বেশি লাগেনি বলে রক্ষা। তবে ঊরু ও শরীরের অন্য কয়েক জায়গায় চিরস্থায়ী ক্ষতের অগভীর গর্ত রয়ে গেছে। সেখান থেকে খুলনার হাসপাতালে সতেরো দিন, তারপর তিন মাস বিছানায়।

শেক্​সপিয়ারের মতো সামনের দিকে কেশহীন মাথার পেছনে লম্বা চুলের দেবেন মণ্ডল নিজের বাঁধা গান করেন। দ্বিতীয় রাতের সান্ধ্য গানের আসরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সারা দিন কাঁকড়া ধরে সন্ধ্যায় কয়েক মাইল নৌকা বেয়ে এসেছেন গানের টানে। প্রথম দিকে খোল বাজিয়ে অন্যের গানে ঠেকা দিচ্ছিলেন। তারপর একসময় মন্দিরা বাজিয়ে শোনালেন নিজের বাঁধা গান, ‘হায় রে সুন্দরবন/ সে যে মায়ের মতন, / বিধাতা করেছে নিজেই সৃষ্টি/ বাঁকে বাঁকে চলে নদী তার নাইকো শেষ/ এই নদীতে আছে যত মাছের সমাবেশ।’ বাইরে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে চারপাশ খোলা এই ঘরে এত আলো আর মানুষের সশব্দ উপস্থিতিতে পুরোটা সময় একবারের জন্যও বাঘের ভয় মনে আসেনি।