আমার মেয়ে এক অদ্ভুত স্বার্থপর সময়ে আমার জীবনে এসেছে। যখন পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা মানেই নিরাপদ—কোভিডমুক্ত! আমার আব্বা সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিসে যেতেন বলে আমি নিজের মা–বাবার বাড়িতে না গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতাম হয় বাড়ির নিচে গেটের সামনে অথবা সংসদ ভবনের সামনে খোলা জায়গায়! এ রকম ভয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর একাকিত্বের সময় আমার ভেতরের একটা প্রাণ কেমন করে যেন একান্ত নিজের এক অজানা শক্তি হয়ে উঠল! বিষয়টি টের পেলাম যেদিন আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো, সেদিন।
ওই দিন একই হাসপাতালে আব্বার ডায়ালাইসিস শুরু, ভোরবেলায় আম্মা–আব্বা আমাকে কেবিনের দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন, আমার সবচেয়ে আপন দুজন মানুষকে জড়িয়ে ধরে আমার এবং আমার অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া চাওয়া তো দূর, তাঁদের চেহারাটাই দেখতে পারলাম না মাস্কের কারণে! অজানা শক্তিতে হাত তুলে আশ্বস্ত করলাম, আমি ঠিক আছি, তোমরা যাও। ওটিতে যাওয়ার সময় দেখি মাস্ক পরা আমার মেয়ের বাবা, ফারজানা, শুভ্রা আর আম্মা লবিতে দাঁড়ানো, আব্বাকে দেখলাম না। তাঁর ডায়ালাইসিস ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।
আবার সেই অজানা শক্তি আমাকে বাধ্য করল ভয় ও কষ্টকে ছাপিয়ে হাসিমুখে ওটিতে ঢুকতে! এরপর আমাকে যখন আমার সদ্য–আগত মেয়েসহ কেবিনে ফেরত নিয়ে যাওয়া হবে, সে সময় নার্স ডাকছেন আমার নাম ধরে, ‘...এই পেশেন্টের কেউ আছেন?’
না। কেউ তখন ছিল না। তখনই আমি বুঝলাম আমার অজানা শক্তির রহস্য! আমি আমার শক্তিকে, আমার মেয়েকে বুকে নিয়ে হাসিমুখে নার্সকে বললাম, ‘চলুন! একাই যেতে হবে!’
যা হোক, মাত্র দুই কেজি ওজনের একটি বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হলো হুবহু তার দাদির চেহারা নিয়ে। ওটি থেকে পাঠানো ছবি দেখে তার চাচা আমাকে লিখলেন, ‘তুমি তো আমার মাকে নিয়ে এলে!’ ধীরে ধীরে দাদি, বাবা আর ফুফুর মিশ্রণ একচেহারায় নিয়ে একটু একটু করে বড় হতে লাগল আমাদের মেয়ে।
ওকে দেখে সবাই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘আপনার মতো টোল পড়ে না?’
: না রে ভাই, পড়ে না!
: হায় হায় আপনার মতন কিছুই পায়নি?
: জি না, পিতৃমুখী কন্যা সুখী।
মেয়ের বাবা ওর নাম রাখলেন রশ্মি। প্রথম দিকে অনেকেই ওর নাম উচ্চারণ করতে পারতেন না, বলতেন, রোশনি! এতে খেপে দিয়ে ওর বাবা মেয়ের নামের ব্যাখ্যা দিতেন; তাঁর সঙ্গে সঙ্গে একই কাজ করতাম আমিও! তা শুনতে শুনতে এখন নাম জিজ্ঞেস করলে মেয়ে আমার নিজেই বলে, রশ্মি, আলোকরশ্মি!
২৫ মার্চ বাঙালির জীবনের এক কালরাত। ২৫ মার্চ আমার জীবনেও কালো হয়ে থাকল। ২০২১ সালে রশ্মির বয়স যেদিন ২ মাস ২৭ দিন, ওই দিন রাত সাড়ে তিনটায় আম্মা আমাকে ফোনে জানালেন, আব্বা নেই! আম্মারও ওই সময় কোভিড পজিটিভ! দুই রাস্তা পরে তাঁদের বাসা। নাহ, যেতে পারিনি। মেয়েকে বুকে চেপে খবরটা সবাইকে ফোনে জানালাম, ফোনে ফোনেই সব ব্যবস্থা করলাম। লাইভে দেখলাম আব্বাকে শুইয়ে দিল! আবার ফোন, কোথাও কোনো জায়গা নেই হাসপাতালে। আম্মাকে ওই রাতেই ভর্তি করানো প্রয়োজন। একটা পেলাম কোনোরকম, কিন্তু আম্মার সঙ্গে যেতে পারলাম না! আম্মা আমাকে বোঝালেন। তারপরও নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছিল!
তবে আমার অজানা শক্তি আমাকে ঠিক বোঝাল, এটাই বাস্তবতা! দুধের শিশুর জন্য এই মুহূর্তে মায়ের সুস্থ থাকাটা জরুরি।
রশ্মির বয়স এখন আড়াই, যে বয়সে আমি অভিনয় শুরু করি! আগে ভীষণ অবাক হতাম আম্মার কথা শুনে, কীভাবে ওই বয়সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতাম! কিন্তু এখন রশ্মিকে দেখলে মনে হয়, নাহ, আম্মা–আব্বা বানিয়ে বলতেন না।
রশ্মির সব কাণ্ডকারখানা এখনো বাসার ভেতরেই, সামনে ক্যামেরা নিলেই হাত গুটিয়ে বসে পড়ে। মানুষের সামনে, বাড়ির বাইরে সে একেবারে শান্ত শিশু, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে! কিন্তু বাসার ভেতর থাকলেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বা তার ছোট্ট গিটারটা নিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে যাচ্ছে, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে...’ কি ‘বাগিচায় বুলবুলি...’। চোখে–মুখে দুষ্টুমি! অন্য সব শিশুর মতোই তার আচার–আচরণ। দেয়ালে আঁকিবুঁকি করছে; আর খাবারের বেলায় তার সরাসরি জবাব, ‘খাব না’!
গত আড়াই বছর সব কাজকর্ম বন্ধ করে মেয়েকে পুরো সময় দিয়েছি আমি। আর আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যতখানি সম্ভব মুঠোফোন থেকে দূরে রাখতে পারি ওকে। মেয়ের বাবা মেয়েকে তাই স্কেটিংয়ে নিয়ে যান, সাঁতারে নিয়ে যান। আর ওর নানি বাংলায় ছড়া শোনান, দোয়া–দরুদ শোনান!
নাহ, আমি বা আমরা মেয়েকে কিছু শেখাই না। ও নিজ থেকে যতটুকু আনন্দ নিয়ে করে, ততটাই। তারপরও সবার মধ্যে কৌতূহল, কখনো কখনো চলে তুলনা, ‘রশ্মি কার মতো হচ্ছে? আপনার মতো নাচ শিখবে? নাকি গান? নাকি বাবার মতো হবে? স্থপতি হবে? অভিনেতা নাকি নির্মাতা?’
আমি জানি না। আমার এখন শুধু একটাই প্রার্থনা, রশ্মি যেন ভালো মানুষ হয়, মানবিক হয়; আর যা–ই করুক, কাউকে যেন সে কষ্ট না দেয়। আর যা–ই করিস মা, নিজেকে ভালোবাসিস!
সেদিন এক দাওয়াতে আমার প্রিয় মানুষ শ্রদ্ধেয় আফজাল হোসেন আমার মেয়েকে নানা কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কার মতো?’
একবাক্যে মেয়ে বলল, ‘আম্মুর মতো!’
কাজল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে চোখের পানিকে প্রশ্রয় দিলাম না! তুই তোর মতো হোস, মা।