ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল কবিতা, গান, র্যাপ, পোস্টার, কার্টুন আর গ্রাফিতি। এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ভাষায় ধরা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে সচিত্র দলিল বিদ্রোহে–বিপ্লবে
ফেসবুকে পুরোনো ছবি বা স্ট্যাটাসে কেউ কমেন্ট করলে ওই ছবি বা স্ট্যাটাস নতুন করে টাইমলাইনে চলে আসে। গত জুনের শেষ দিকে টাইমলাইনে ভেসে উঠল কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুন। শেখ হাসিনা ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে আঁকা কার্টুনটি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে আপলোড হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর। সেখানে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘কেউ বিভ্রান্ত হবেন না, এটা ২০১৩ সালের কার্টুন। এ সময়ে এমন কার্টুন ছাপার সাহস ওদের নেই।’
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ধীরে ধীরে দৈনিক পত্রিকায় তীব্র রাজনৈতিক কার্টুন এক অর্থে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তার পর থেকে পত্রিকায় যেসব রাজনৈতিক কার্টুন ছাপা হয়েছে, সেগুলেকে নির্বিষ ঢোঁড়া সাপই বলা চলে। ফেসবুকে ভেসে ওঠা ওই কার্টুনের নিচে আরেকজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘আচ্ছা, শিশির ভট্টাচার্য্য এখন আর আঁকেন না কেন?’
প্রশ্নটা অনেকেরই। শিশির ভট্টাচার্য্য কেন আঁকেন না? নাকি কেউ তাঁকে আঁকতে বারণ করেছিল? এমন নয় যে তিনি রংতুলি শিকেয় তুলে রেখেছিলেন। এ সময়টায় চিত্রশিল্পের অন্য শাখায় তাঁর উপস্থিতি আমরা ঠিকই লক্ষ করেছি। কাজেই ওই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর অজানা থাকলেও আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না যে রাজনৈতিক চাপই এর অন্যতম কারণ।
শিশির ভট্টাচার্য্য দেশের কার্টুনশিল্পের দিকপালদের একজন। তিনিই যখন হাত গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবে নবীনরাও একটা বার্তা পেয়ে যান। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুন নিষিদ্ধ! এই দীর্ঘ খরার পরে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান রাজনৈতিক কার্টুনের জমিনে বৃষ্টি হয়ে নেমেছে। কার্টুনিস্টরা দিচ্ছেন খরা কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনে এই কার্টুনিস্টরা রেখেছেন বিশেষ অবদান।
কার্টুন মানে সাহস
এবার ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান জোরালো করতে কার্টুন যে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তার একটা ধারণা মেলে এই সময়ে আঁকা কার্টুনের সংখ্যা দেখে। ১৬ আগস্ট ঢাকার পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনে শুরু হয়েছে ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। জুলাই–আগস্টে অনলাইন–অফলাইনে প্রকাশিত কার্টুনগুলো নিয়ে প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, স্যাটায়ার পোর্টাল ‘ইআরকি’ এবং দৃক। আয়োজকদের একজন কার্টুনিস্ট মেহেদী হক বলেন, ‘জুলাই–বিদ্রোহে যে পরিমাণ রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। এসব কার্টুন এঁকেছেন মূলত তরুণ আঁকিয়েরা। যাঁরা আগে কখনো সেভাবে আঁকেননি, তাঁরাও এবার রাজনৈতিক সিরিয়াস বিষয়ে খুব ভালোভাবে কার্টুন এঁকেছেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ শ কার্টুন থেকে বাছাই করে ৮২ জন কার্টুনিস্টের ১৭৫টি কাজ স্থান পেয়েছে এখানে। পুরো ধন্যবাদটাই তরুণ আঁকিয়েদের প্রাপ্য, তাঁদের অভিনন্দন।’
অভিনন্দন মেহেদী হককেও। ২০১৪ সালের পর থেকে রাজনৈতিক কার্টুনের প্রায় অনাবাদি জমিতে যে কজন ফসল ফলিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য। এ কথা অনেকেই বলেছেন, ‘মেহেদী কি ভয় পায় না?’ এ প্রসঙ্গে মেহেদী হকের বক্তব্য, ‘রাজনৈতিক ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে চলেছে অহরহ। কিন্তু এ নিয়ে কার্টুন একেবারেই হাতে গোনা। যাঁরা করে গেছেন, তাঁদেরও মাথায় রাখতে হয়েছে অনেক আশঙ্কা আর ভীতি। কিন্তু সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারের পক্ষ থেকে যতই ভয় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা জয় করে জনতা হয়ে উঠেছে ততই দুর্দমনীয়। আর ভয়কে জয় করলে, মতপ্রকাশে অসংকোচ হয়ে উঠলে কার্টুন কেমন জ্বলে উঠতে পারে, এবারে তা আমরা দেখলাম।’
সাম্প্রতিক কার্টুনগুলো নিয়ে কার্টুনিস্ট ও মাসিক রম্য সাময়িকী উন্মাদ–সম্পাদক আহসান হাবীবের মূল্যায়ন, ‘কার্টুনে স্যাটায়ারের চূড়ান্ত স্তর হচ্ছে ল্যাম্পুন। সাম্প্রতিক কার্টুনগুলো দেখলেই বুঝবেন, আমাদের দেশের তরুণেরা এখন সেটাও স্পর্শ করছে।’
আগুনের স্ফুলিঙ্গ
দেশের রাজনৈতিক কার্টুনে যে এই তীব্র ব্যঙ্গ, তা স্বয়ং নবীন কার্টুনিস্টরাই দেখার সুযোগ পাননি দুই যুগের বেশি সময়। জেন–জি প্রজন্মের এই কার্টুনিস্টরা যখন বেড়ে উঠেছেন, তখন দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক কার্টুন ছিল বিরল। শিশির ভট্টাচার্য্যের উদাহরণটি তো আছেই। আরেক কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরও আরেক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।
সরকার ও সরকারঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে কার্টুন আঁকার অভিযোগে ২০২০ সালের ২ মে থেকে প্রায় এক বছর প্রাক্–বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল কিশোরকে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায়। কিশোরকে আটক ও হেফাজতে নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। পরে হাইকোর্টের বিচারকদের একটি প্যানেল ২০২১ সালের ৩ মার্চ জামিন দিলে কিশোর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন ৫ মার্চ। তবে এর মধ্যে নির্যাতনের ফলে তিনি ভুগছেন নানা শারীরিক ও মানসিক সংকটে। তাঁর কার্টুন আঁকাও থেমে গিয়েছিল।
কিশোরের এভাবে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছিল প্রায় সব কার্টুনিস্টের ওপর। কার্টুনিস্টরা যখন আঁকতে পারছিলেন না, তখন অবধারিতভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একাধিক দৈনিক পত্রিকার রম্য ক্রোড়পত্র। সরকারি চাপ, বিতর্কিত আইন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখরাঙানি আরও অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলেছিল। কার্টুনের প্রতি শাসকের অসহিষ্ণুতা সংক্রমিত হয়েছিল বিভিন্ন পেশাজীবী মহলেও। ফলে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ ও রম্যের অন্যতম ভাষা কার্টুন হয়ে পড়েছিল কোণঠাসা।
তাহলে হঠাৎ করে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে এত কার্টুনিস্ট কোথা থেকে এলেন? এত দিন তাঁরা আসলে উন্মেষ পর্বে ছিলেন। এ সময় কার্টুনিস্টরা কমিকস করেছেন, অলংকরণ চালিয়ে গেছেন, অ্যানিমেশন বানিয়েছেন, গ্রাফিক নভেল করেছেন, কেউ কেউ হাত মকশো করেছেন গ্যাগ বা নিছক হাস্যরসাত্মক কার্টুন এঁকে। এই চর্চা এবং বাক্স্বাধীনতাহীন সময় তাঁদের পরিণত করেছিল লোহার পাতে। গণ–অভ্যুত্থানের সময় ওই লোহারে পাতে শাসক যত জোরে আঘাত করেছেন, তত তীব্র বেগে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে এসেছে শত শত কার্টুন। যেসব কার্টুন মানুষের বুকে সাহসের আগুন জ্বালিয়েছে।
জানালা খোলা থাক
রাজনৈতিক কার্টুন কেবল হাসায় না, মানুষকে সাহসও দেয়। ২০১০ সালের শুরু থেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লব, অর্থাৎ আরব বসন্তে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন মিসরীয় কার্টুনিস্ট শেরিফ আরাফা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো কিছুতে আপনার যে ভয়, তা কাটিয়ে ওঠার একটা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হলো তামাশা করা। কার্টুনে মানুষ তাদের নেতাদের দেখতে পেলে বুঝতে পারে যে তাঁরা ঈশ্বর নন। কার্টুন মানুষের ভয় ভেঙে দেয়।’
ঠিক এ কাজটাই এবার করেছেন আমাদের কার্টুনিস্টরা। টিস্যু পেপারে চোখ মুছতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্টুন এঁকে কার্টুনিস্ট আসিফুর রহমান যেমন লিখেছেন, ‘নাটক কম করো পিও!’ কার্টুনিস্ট অপু এঁকেছেন গদিতে আসীন শেখ হাসিনাকে, যেখানে গদি বলছে, ‘এলা ছাইড়া দেন’। ৩ আগস্ট আহসান হাবীব এঁকেছেন রক্তলাল পটভূমিতে কালো বালুঘড়ি, ওপরে লিখেছেন ‘কাউন্টডাউন’। আর ঠিক ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার পতনের দিন প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘বাসার ভাই’ কমিকসে বাসার চরিত্রটি বলছিল, ‘কী মনে হয়? নামাইতে পারবা?’ বাবু চরিত্রটি বলছিল, ‘অবশ্যই পারব। নামানো এখন জাস্ট সময়ের ব্যাপার।’
ছাত্র–জনতার সঙ্গে শামিল হয়ে কঠিন কাজটা করেছেন কার্টুনিস্টরা। তাই তো ৫ আগস্টের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাজনৈতিক কার্টুনে সয়লাব। এসব কার্টুনে যেমন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে, তেমনি উঠে আসছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক চরিত্র। ফেসবুকে আঁকিয়েদের গ্রুপ আকান্তিসে এক নবীন আঁকিয়ে কার্টুন শেয়ার করে লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক কার্টুন অত ভালো পারি না, তার পরও চেষ্টা করলাম।’
এই যে নবীন এক আঁকিয়ে এখন রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার চেষ্টা করছেন, মাস দুয়েক আগেও কি তা কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলেন?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান কল্পনার সব কটা দরজা–জানালা হাট করে খুলে দিয়েছে। ওই দরজা–জানালা যেন আর বন্ধ না হয়।