আজ ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস। তবে এখন কেউ কি কাউকে সেভাবে চিঠি লেখে? চিঠি লেখার চল উঠে যাওয়ায় আমরা কি অতীত হারিয়ে ফেলছি না?
‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই…’
—‘চিঠি দিও’, মহাদেব সাহা
কবির মতো অলংকরণে না হলেও চিঠির জন্য এমন ব্যাকুলতা অনেক হৃদয়েই কত কত কাল ধরে যে মথিত হয়েছে! চিঠি মানেই এক টুকরো আপন। যে গোপনের দ্বার খুলে যায় শুধু আপনারই তরে। আঙুলের মিহিন সেলাইয়ে যে বয়ানের বুনন, তা যেন স্মৃতির নকশিকাঁথা। আর আঙুলের ছাপের মতোই হাতের লেখায় যে চিঠির জন্ম, তা বহন করে মানুষের স্বকীয়তার চিহ্ন, যা অন্য কোনো কিছুতেই মেলে না।
ফরাসি তাত্ত্বিক জাঁক দেরিদার বিখ্যাত উক্তি, ‘টেক্সটের বাইরে বলে কিছু নেই।’ এখানে ‘টেক্সট’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন বয়ানকে। তাঁর মতে, যেকোনো বয়ান অর্থবহ হয় স্মৃতি ও পারস্পরিক পার্থক্যের মিথস্ক্রিয়ায়। বৈপরীত্যের ভিত্তিতে ভাষায় অর্থ খোঁজার প্রক্রিয়াটি অবশ্য সুইস ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ ডি সসুরের অবদান। তাঁর মতে, মানুষের কাছে একটি বস্তুর অর্থ হলো যা অন্য কোনো বস্তুর মতো নয়। উদাহরণ দিয়ে বললে, একটি গাছ হলো এমন কিছু, যা মুরগি নয়। তবে সেখান থেকে কিছুটা হটে গিয়ে দেরিদা যা আছে তার ওপর যেমন জোর দিয়েছেন, সেই সঙ্গে যা নেই তার ওপরও দিয়েছেন সমান জোর। দেরিদার মতে, ভাষা স্থির এবং আবদ্ধ নয়, বরং বহমান ও পরিবর্তনশীল। ফলে কোনো কিছুর অর্থও স্থির নয়। একটি শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দ, চিহ্ন এমনকি তার মাঝখানের ব্যবধানের সম্পর্কেও অর্থ বদলে যেতে পারে। এখানে বুদ্ধিবৃত্তি ও অনুভব—দুটিকেই কাজে লাগানোর কথা বলছেন তিনি। যা লেখা আছে বা বলা হচ্ছে তার বাইরেও বাস্তবতা থাকতে পারে—এই সম্ভাবনাকে আমলে নেওয়ার কথা বলছেন দেরিদা।
যা উপস্থিত বা বর্তমান, তা–ই কেবল অর্থ নয়। অর্থের পরিধি অনুপস্থিতিতেও প্রসারিত। যা নেই, তা কখনো ছিল নিশ্চয়ই! এই না থাকার বোধ বয়ানের সঙ্গে অর্থের সম্পর্কের নীরব এক সমীকরণ আঁকে। তখন স্মৃতি তার হয়ে ওঠে মূল উপাদান। এই প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে লেখা আপনার চিঠি আপনার জীবনবোধ, সময় এবং আপনারই স্মৃতির বাহক হয়ে ওঠে। আপনার অস্তিত্বের ছাপ নিয়ে তা বয়ে চলে প্রজন্মান্তরে। আর এভাবেই ইতিহাস ও কালের ধারার একটি ক্ষুদ্র নথি হয়ে ওঠে চিঠি।
‘প্রিয়, তোমাকে…ইতি আমি’র দিন ফুরিয়েছে ম্যালা দিন হলো। আজকের চিঠিহীন প্রজন্ম অত্যাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধাভোগী। তারা সহজ ও দ্রুত যোগাযোগে বিশ্বাসী হয়েই বেড়ে উঠেছে। এখন কেবলই দেখি টুং টাং বেজে ওঠা টেক্সট/ মেসেজিং। টেলিগ্রাম, টেলিফোন, ই–মেইল পেরিয়ে আমরা এখন মেসেঞ্জার, ডিএম, হোয়াটসঅ্যাপ—আরও কত শত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অগণিত জানালায় উঁকি দিতে থাকি। আমাদের পড়ারও ফুরসত নেই। আমাদের যোগাযোগ বাক্য, শব্দ ছাড়িয়ে এখন নানা ধরনের চিহ্ন বা ইমোজিতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু সেই স্বকীয়তার চিহ্ন থাকছে কোথায়?
আগে ঠিঠি লেখা হতো। যাকে লেখা হয়েছিল, তিনি যদি বহুদিন পরে সেই চিঠি পড়তেন, তার মধ্যে জেগে উঠত কান্না–হাসির দোলা, এন্তার স্মৃতি। মোদ্দাকথা হলো, চিঠির মারফত স্মৃতি তৈরি হতো আমাদের। আজ চিঠি নেই, হলুদ খাম আসে না। ফলে চিঠিজনিত স্মৃতিও উছলে ওঠে না আর। তবে বিরামহীন টেক্সট/ মেসেজিংয়ের এই যুগে বর্তমান প্রজন্ম কি ক্রমশও স্মৃতি হারিয়ে বর্তমানের বাসিন্দা হয়েই থাকছে?—এটাও এক প্রশ্ন বটে, যার উত্তর জানতে আরও কিছুকাল হয়তো অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। অন্যদিকে টেক্সট বা মেসেজিংয়ের এই কালে অনেক ক্ষেত্রে ভাষাকেও আমরা যেভাবে সংকুচিত করে তুলেছি, সেই সংকোচনে ভাষার অর্থও হারাচ্ছে গতিশীলতা। সেই সঙ্গে হারাচ্ছে ব্যক্তি, স্থান ও কালের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও। আবারও বলি, কেবল যা উপস্থিত ও বর্তমান, তার ওপর তুমুল নির্ভরশীলতায় আমরা যা এখন নেই, তা হারাচ্ছি, অর্থাৎ ফেলে আসা অতীতের সঙ্গে আমাদের আর কোনো সংযোগ থাকছে না সেভাবে।
‘প্রিয়, তোমাকে…ইতি আমি’র দিন ফুরিয়েছে ম্যালা দিন হলো। আজকের চিঠিহীন প্রজন্ম অত্যাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধাভোগী। তারা সহজ ও দ্রুত যোগাযোগে বিশ্বাসী হয়েই বেড়ে উঠেছে। এখন কেবলই দেখি টুং টাং বেজে ওঠা টেক্সট/ মেসেজিং। টেলিগ্রাম, টেলিফোন, ই–মেইল পেরিয়ে আমরা এখন মেসেঞ্জার, ডিএম, হোয়াটসঅ্যাপ—আরও কত শত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অগণিত জানালায় উঁকি দিতে থাকি। আমাদের পড়ারও ফুরসত নেই। আমাদের যোগাযোগ বাক্য, শব্দ ছাড়িয়ে এখন নানা ধরনের চিহ্ন বা ইমোজিতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু সেই স্বকীয়তার চিহ্ন থাকছে কোথায়?
এই অতীতহীনতা ধীরে ধীরে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। আমরা একের পর এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক ভাইরাল ট্রেন্ড অনুসরণ করে ক্রমাগতই অন্যের মতো হয়ে যাচ্ছি, হতে চাচ্ছি। ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে সবাই একই খাবার বানাচ্ছেন, একই কাপড় পরছেন, একই সাজে সেজে উঠছেন। পড়াশোনা থেকে শিশুপালন—সবকিছুরই ধরন ঠিক করে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর লাইক, শেয়ার, কমেন্টের প্রলোভনে আমরাও নিজেদের কেটেছেঁটে একই মাপে আঁটাতে ব্যস্ত। অতীতহীন এই বর্তমানে আমরা সবাই বিশুদ্ধ ভোক্তা হয়ে ওঠার ইঁদুরদৌড়ে মগ্ন এখন।
তারপরও মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে:
‘আজও তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে…
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!’
কবি মহাদেব সাহার এই ‘চিঠি দিও’ কবিতার মতো করে এখন যদি কেউ চিঠি লেখে আমাদের এবং পরম দরদে জানতে চাই কুশল, তবে কি আমাদের অতীত ফিরে আসে না? স্মৃতি ফিরে আসে না?
হ্যাঁ, চিঠি যেমন অতীত ফিরিয়ে আনে, স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, তেমনি বর্তমানের আমাকেও আপন আয়নায় দেখতে উদ্বুদ্ধ করে। দেরিদা যেভাবে বলেছিলেন, যা লেখা আছে বা বলা হচ্ছে, তার বাইরেও বাস্তবতা থাকতে পারে, সেই বাস্তবতার কাছে আমাদের নিয়ে যেতে পারে শুধু চিঠিই। যে চিঠিতে লেখা থাকে চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প এবং না–বলা আরও অনেক কিছু। কথাগুলো কবির ভাষায় বললে বলতে হবে:
‘টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেই সব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো...’