এ মাসেই প্রকাশিত হয়েছে লাতিন আমেরিকার নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শেষ প্রকাশিত উপন্যাস আনটিল অগাস্ট। এ লেখকের অন্য উপন্যাসের সাপেক্ষে এ উপন্যাসটি কেমন, এর বিষয়বস্তুইবা কী?
আনটিল অগাস্ট বইটা পড়া শুরু করতেই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সেই চিরচেনা ‘সিগনেচার স্টাইল’ চোখে পড়ল। দীর্ঘ দীর্ঘ সব বাক্য, আর প্রতিটা বাক্যেই অনেক অনেক সব তথ্য। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই ফেলনা বা অতিরিক্ত মনে হয় না এবং সেই একই রকম করে বলার ভঙ্গিতে কোনো আড়ষ্টতা নেই, যেনবা গল্প বলছেন না তিনি, বরং সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকার প্রতিবেদন লিখছেন। উদাহরণ হিসেবে এই বাক্যটিকে ধরা যাক, ‘গ্রামের মানুষদের দারিদ্র্য দেখে তার হতাশ লাগল, দুটো পামগাছের মধ্যে একটা হ্যামক ঝুলিয়ে তারা সেখানে ঘুমায়; যদিও এই গ্রামটি এই দেশের এক কবি ও গালভারী সিনেটরের জন্মভূমি, যে কিনা দেশের প্রায় রাষ্ট্রপতিই হয়ে বসেছিল।’ অথবা এই বাক্য, ‘তার ছেচল্লিশ বছর জীবৎকালের সাতাশ বছরই সে এই পুরুষের সঙ্গে একটি সুখী বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছে; যাকে সে ভালোবাসে এবং পুরুষটিও তাকে, যাকে সে বিয়ে করেছিল নিজের আর্টস অ্যান্ড লেটারস ডিগ্রি শেষ করার আগেই, তখনো সে কুমারী ছিল এবং বিয়ের আগে সে কোনো সম্পর্কেও জড়ায়নি।’
২০২৪ সালে এসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘সদ্য প্রকাশিত’ একটা বই পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে বসেছি। ব্যাপারটা আসলে চমকপ্রদ একটা ঘটনাই বটে। আরও বছরখানেক পেছনে ফিরে গিয়ে যদি তাকাই, তখন এ রকম কেউ বললে সেটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। অথচ তাঁর মৃত্যুর প্রায় আট বছর বাদে সত্যিই প্রকাশিত হলো আনটিল অগাস্ট নামের এই বই; তাঁর শেষ প্রকাশিত উপন্যাস। এখন পর্যন্ত অবশ্যই; যদি না আবার কোনো এক জাদু(বাস্তবতা)র বলে নতুন কিছু চলে আসে আমাদের সামনে! অবশ্য তাঁর সন্তানদের ভাষ্যমতে, সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কারণ, তাঁদের কাছে গ্যাবোর আর কোনো অপ্রকাশিত লেখা জমা নেই।
মার্কেসের এর আগের কোনো বই আমাকে ‘প্রি-অর্ডার’ করে কিনতে হয়নি, অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে এটাও পাঠক হিসেবে আমার জন্য নতুন ঘটনাই। আর অপেক্ষাটাও বেশ উত্তেজনাকর ছিল। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে বইটা হাতে পেয়েই তাই পড়তে শুরু করে দিলাম। আনটিল অগাস্ট–এর প্রচ্ছদে একে বলা হয়েছে ‘দ্য লস্ট নভেল’। আমি কেন যেন সেটিকে পড়লাম ‘দ্য লাস্ট নভেল’! তবে ‘উপন্যাস’ হিসেবে বইটি বিজ্ঞাপিত হলেও এর শব্দসংখ্যা ২৫ হাজারের আশপাশে হবে বলেই মনে হলো। সেই হিসাবে এটাকে ‘নভেলা’ বলাই সংগত, ‘নভেল’ নয়। আর পুরোপুরি ‘হারানো’ বলাটাও কি সঠিক দাবি করা হলো? বরং ‘পরিত্যক্ত’ বললেই হয়তো বেশি ভালো হয়। কারণ, গ্যাবো এটা প্রকাশ করতে চাননি। সে রকমই নির্দেশ ছিল তাঁর, কিন্তু সন্তানদের ইচ্ছায় অবশেষে আলোর মুখ দেখল এই উপন্যাসিকা। বাবার ইচ্ছার সঙ্গে এটা বিশ্বাসঘাতকতা হলো কি না, তা নিয়ে হয়তো আরও বহুদিন তর্ক চলবে সাহিত্যের দুনিয়ায়। তবে পাঠক হিসেবে গার্সিয়া মার্কেসের নতুন একটা বই হাতে নেওয়ার সুযোগ কতজনই–বা হারাতে চাইবেন!
কিন্তু সত্যি কথা যদি বলি, বইয়ের প্রথম দুই পরিচ্ছেদ পড়া শেষে বেশ অনেকটা হতাশই হলাম। মনে হলো, একটা বেশ সুলিখিত ও উচ্চমানের কোনো ‘ইরোটিকা’ পড়ছি। অবাক হয়ে খুঁজতে লাগলাম, এর কারণ কী? ভাবতে গিয়ে টের পেলাম, সম্ভবত এর পেছনে বড় একটা কারণ হলো, এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র একটিই। এমনকি এই লেখকের ছোট্ট আরেকটি বই নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল–এর প্রটাগনিস্ট একজন হলেও সেখানে গুরুত্বসহকারে আরও কিছু চরিত্রের উপস্থিতি ছিল। চট করে মনে পড়ছে, কর্নেলের স্ত্রী, তাদের মৃত সন্তান এবং পাড়া-প্রতিবেশী কয়েকজনের কথা। আর দ্বিতীয় ‘প্রটাগনিস্ট’ মোরগটার কথাও। কিন্তু আনটিল অগাস্ট–এ সে রকম কোনো ভিড় নেই চরিত্রদের। প্রটাগনিস্ট হিসেবে অ্যানা মাগডালেনা বাখ একাই সর্বেসর্বা। তার স্বামী ও পরিবারের কথা এসেছে, তার মৃত মায়ের কথাও, তবে তাদের উপস্থিতি যেন অনেকটাই সেই গ্রামের পামগাছগুলোর ছায়ার মতো, যারা ঠিক গাঢ় কোনো রেখাপাত করে না; না বইয়ের পাতায়, না পাঠকের মনে।
তবে বইয়ের শেষে এসে হতাশা কেটে গেছে সহজেই। টের পাচ্ছিলাম, মায়েস্ত্রো তাঁর মাস্টার-স্ট্রোক দিতে চলেছেন শিগগিরই। আর শেষ যখন করি, আয়নায় না তাকিয়েও নিজের হাসিমুখ যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি।
বইয়ের শুরুতে মার্কেসের দুই সন্তানের একটা ভূমিকা আছে। আর শেষে রয়েছে সেই সম্পাদকের বক্তব্য, যাঁর হাত ধরে এই পরিত্যক্ত উপন্যাস জীবন পেল। এ দুটোই বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সেই সঙ্গে উপরি হিসেবে ছিল উপন্যাসের মূল পাণ্ডুলিপির চারটি পাতার ছবি।
কোনো ‘স্পয়লার’ না দিয়ে তবু সচেতন পাঠকদের বলে রাখতে চাই, নতুন আরেকটা ‘মাস্টারপিস’ পড়ার আশায় এই উপন্যাস খুলে বসলে সেই আশা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খানিকটা কমই থাকবে বলে মনে হয়। কারণ, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের অন্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে যে বিপুল আয়োজন, তা এখানে অনুপস্থিত। পাশাপাশি এটাও বলতে হবে যে মার্কেসকে খুঁজলে এই ক্ষীণকায় উপন্যাসেও তাঁকে খুব ভালোমতোই পাওয়া যাবে। আর পাঠক হিসেবে শেষমেশ এটাই হয়তো আমার সান্ত্বনা।