চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডে ঝরনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি কাজী নজরুল ইসলাম
চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডে ঝরনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি কাজী নজরুল ইসলাম

পাহাড়ে, সৈকতে কবি নজরুল 

হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী (১৯০৬-১৯৬৬) ছিলেন সে আমলের নামী ব্যক্তি। একাধারে একজন কৃতী ফুটবলার, রাজনীতিক ও সাংবাদিক ছিলেন তিনি। তাঁর বোন বেগম শামসুন্নাহার (পরে শামসুন্নাহার মাহমুদ) লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। ভাই-বোনে মিলে প্রকাশ করেছিলেন সাহিত্য পত্রিকা বুলবুল। এই নাম দেখেই বোঝা যায় কাজী নজরুল ইসলাম এই পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। 

 বাহার ও নাহারের আমন্ত্রণে কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম সফরে যান। অন্তত চারবার তাঁর চট্টগ্রাম সফরের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৯২৬ সালের জানুয়ারি (অনেকের মতে জুলাই মাসে) এবং ১৯২৯ সালের গোড়ার দিকে—এই দুই সফরে তাঁর পাহাড়ে, সমুদ্রসৈকতে ও দ্বীপে ভ্রমণের দালিলিক তথ্য আছে। হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর বাড়ি ফেনী হলেও শৈশবে পিতৃহারা হয়ে চট্টগ্রামে নানা খান বাহাদুর আবদুল আজিজের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। নজরুল গিয়ে ওঠেন চট্টগ্রামে তাঁদের বাড়ি আজিজ মঞ্জিলে। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলের জন্মদিনে কবি পরিচয়ের বাইরে ভ্রমণপিপাসু নজরুলের সঙ্গে নতুন করে পাঠকের সামান্য পরিচয় ঘটুক।

নজরুলের চট্টগ্রাম সফরের বর্ণনা পাওয়া যায় বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের নজরুলকে যেমন দেখেছি এবং মুজফ্ফর আহমদের কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা বইয়ে। এ ছাড়া আরও অনেক বইয়েও এ সম্পর্কে আলাপ আছে।

নজরুলের সিন্ধু হিন্দোলচক্রবাক কাব্যগ্রন্থে যে কবিতাগুলো রয়েছে, তার একটি অংশ এই চট্টগ্রাম সফরকালে লেখা। কারও কারও মতে, নজরুল চট্টগ্রামে প্রায় তিন মাস বা আরও বেশি সময় ছিলেন। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

১৯২৬ সালে প্রথমবার চট্টগ্রামে যান নজরুল, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। হবীবুল্লাহ বাহার তখন ওই কলেজ ছাত্র সংসদের নেতা। কলকাতা থেকে এসে কবি উঠলেন জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলোতে। কবিকে একনজর দেখার জন্য অনেক ভক্ত-অনুরাগী আসতে লাগলেন ডাকবাংলোয়। পরে হবীবুল্লাহ বাহার ও তাঁর বোন শামসুন্নাহার মাহমুদ কবিকে তাঁদের বাসভবনে নিয়ে যান। 

হবীবুল্লাহ বাহার ঘোড়ায় করে নজরুলকে চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। কবি সীতাকুণ্ডের ঝরনা দেখে মুগ্ধ হন। একটি ছবি আছে, যাতে দেখা যাচ্ছে কবি বসে আছেন, পেছনে রূপ মেলে ধরেছে ঝরনা। এখানকার বিখ্যাত চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু চার হাজার ফুট উচ্চতার এই মন্দিরে কত দূর তিনি উঠেছিলেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ কেউ দাবি করেন, নজরুল চূড়ায় উঠেছিলেন। চন্দ্রনাথ এমন একটি পাহাড়, যার ওপর দাঁড়ালেই দক্ষিণে হাতছানি দেয় বঙ্গোপসাগর। ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ বিখ্যাত গানটি চন্দ্রনাথের রূপে মুগ্ধ হয়েই লিখেছিলেন নজরুল।

১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বিতীয়বার চট্টগ্রামে যান কবি। ‘চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণ দেন তিনি। এ সফরে কবি সমুদ্রের ডাক উপেক্ষা করতে পারেননি। ছুটে যান পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে। বন্ধুবান্ধব মিলে খুব আনন্দ করেন। 

হবীবুল্লাহ বাহারসহ অন্যদের সঙ্গে কবি গিয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের সদরঘাটের সাম্পান ঘাটে। কবি যে সাম্পানটিতে কর্ণফুলী নদী ভ্রমণের জন্য উঠেছিলেন, সেটি ছিল ভাঙা। নজরুলের সঙ্গে তাঁর অনেক বন্ধু সাম্পানে উঠলে সেটি ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন কবি অন্যদের নামিয়ে দিয়ে একাই কর্ণফুলী ভ্রমণ করেছিলেন, এ রকম তথ্য পাওয়া যায়। 

পাহাড়, সমুদ্রসৈকত ও নদী পরিভ্রমণের পর দ্বীপযাত্রা আর বাকি থাকে কেন! এই সফরেই কবি স্টিমারে করে গিয়েছিলেন সন্দ্বীপ। সঙ্গে ছিলেন কবির জ্যেষ্ঠ বন্ধু ও সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। মুজফ্ফরের বাড়িও এই সন্দ্বীপে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ঘর-সংসারের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন হয়ে ১৯১৩ সাল হতে কলকাতায় বাস ইখতিয়ার করেছি। কিন্তু তবুও নজরুল একদিন সন্দ্বীপে আমাদের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয়েছিল।’ কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা বইয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন, ‘আমাদের ওই দিকে সমুদ্র শীতকালে শান্ত থাকে। তখন চট্টগ্রাম আর বরিশালের মধ্যে স্টিমার যাতায়াত করত। সন্দ্বীপ ছিল তার একটা স্টেশন।’ 

কিন্তু নজরুল কেন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এই দ্বীপে যেতে আগ্রহী হলেন, সফরসঙ্গী হয়েও তা বুঝতে পারেননি মুজফ্ফর আহমদ, ‘জানি না কেন সন্দ্বীপ নজরুলের পসন্দ হয়েছিল। কলকাতায় ফিরে এসে সে আরও একবার সন্দ্বীপে যেতে চেয়েছিল, অবশ্য আমি যদি সঙ্গে যাই।’