কোলাজ: প্রথম আলো
কোলাজ: প্রথম আলো

শীতকাল কবে আসছে, চ্যাটবট?

শোনা যাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামের ‘চ্যাটজিপিটি’র কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে মানুষের সৃজনশীলতার দুনিয়া। সেক্ষেত্রে কবিতা–গল্প–উপন্যাসের ভবিষ্যৎ কী? নতুন বছরের শুরুতে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা।

আমি আমার ফোনে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করি। চ্যাটজিপিটি হচ্ছে জেনারেটিভ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যার সঙ্গে বার্তা লিখে যোগাযোগ করা যায়। এটা তৃতীয় প্রজন্মের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রথম প্রজন্মে সে নির্ভর করত যে যুক্তিপ্রক্রিয়ায় তাকে শিক্ষিত করা হয়েছে, তার ওপর। দ্বিতীয় পর্যায়ে এল ‘মেশিন লার্নিং’, যখন কম্পিউটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তার শিক্ষার বা প্রোগ্রামিংয়ের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারত। অর্থাৎ শেখানো যুক্তির বাইরেও খানিক নড়াচড়া করার সক্ষমতা অর্জন করল এ পর্যায়ে। আর তৃতীয় পর্যায়ের ‘জেনারেটিভ এআই’ বা স্বতঃস্ফূর্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নিজে নিজেই যুক্তি তৈরি করছে, প্রয়োগও করছে। স্বশিক্ষিত হয়ে উঠছে অনেকখানি।

এই জিনিস নিয়ে আমি কী করতে পারি? কয়েক দিন আগের এক সন্ধ্যার ঘটনা: বেশ শীত আর কুয়াশা ছিল। উদাসভাবে চ্যাটজিপিটিকে বললাম, আচ্ছা, আমার জন্য একটা কবিতা লেখো তো। কবিতাটি হবে রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং’ দিয়ে অনুপ্রাণিত। অন্ত্যমিল বা রাইমিং প্যাটার্ন থাকবে ফ্রস্টের কবিতার মতোই। কিন্তু কবিতাটি হবে বাংলাদেশের ভূসাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে। এ রকম আরও কিছু সাজেশন দিলাম। চ্যাটজিপিটি চটজলদি কবিতা বানিয়ে দিল।

যে পারমাণবিক শীত নেমে আসছে অ্যালগরিদমের হাত ধরে, যে আগাম ধ্বংসস্তূপের কল্পনা আমরা করছি, তার ফাঁকফোকর দিয়ে একটু আলোও যেন কোথায় দেখা যায়!

সেই কবিতা পড়ে চমকে গেলাম। ভড়কে গেলাম বললে ঠিক বলা হবে। আপাতদৃষ্টে চমৎকার একটি কবিতা। শীত আছে, সন্ধ্যা আছে, দূরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা আছে, অন্ত্যমিল আছে, অনুপ্রাস আছে। ফ্রস্টের কবিতার চেয়ে যেন বেশি ঝিকিমিকি করছে! প্রথমবারের ঝাঁকুনি সামলে আবার পড়লাম। পড়ার আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভেতরে–ভেতরে প্রচুর নৈরাশ্যবাদী হয়ে নিলাম। স্বশিক্ষিত কম্পিউটারের এই দাপট থেকে অর্গানিক শিল্পকলাকে বাঁচাতে হবে!

তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার পড়ার সময় কবিতার ভেতরের না-থাকাগুলো ধীরে ধীরে নজরে আসতে থাকল। প্রথমে যেটি খেয়াল করলাম, এই কবিতায় ফ্রস্টের কবিতার সেই অন্তর্গত বিষাদ অনুপস্থিত। এটি আমাকে আনন্দ দিল। চ্যাটজিপিটিকে বললাম, শোনো, কবিতা তো ভালোই লিখেছ, তবে এটি টানছে না। কারণ, ফ্রস্টের কবিতায় অন্তর্গত বিষাদের যে আবহ আছে, তুমি সেটা আনতে পারোনি।

চ্যাটজিপিটি ভদ্রভাবে বিষয়টা স্বীকার করল। বলল, ‘বটে। তবে সেভাবে লিখতে তো তুমি আমাকে বলোনি।’ অর্থাৎ বলতে চাইল, বিষাদের বিষয়টা তো তুমি আমার কাছ থেকে চাওনি।

আমি অতটা ভদ্রভাবে হেরে যেতে রাজি নই। বললাম, হোয়াই শুড আই হ্যাভ টু টেল ইউ এভরিথিং? এই কবিতার মধ্যে যে একটা ইনহারেন্ট মেলানকলি বা বিষণ্নতা আছে, সেটা তোমার জানা থাকার কথা। তুমি জেনারেটিভ এআই, স্বশিক্ষিত দাবি করছ নিজেকে!

চ্যাটজিপিটি দুঃখ প্রকাশ করে পটপট কী যেন একটা ব্যাখ্যা দিল।

আমি বললাম, ঠিক আছে। এই কবিতাকেই একটু মেলানকলিক করে দাও।

সঙ্গে সঙ্গেই আমার ফোনের পর্দায় চার-পাঁচ জায়গায় কেঁপে উঠল কবিতার টেক্সটটা। দেখলাম, কেবল কিছু শব্দ বদলে দিয়েছে চ্যাটজিপিটি। এক–দুই জায়গায় সম্ভবত বাক্যগঠনও খানিকটা বদলেছে। ততক্ষণে আমার সিনিক মন যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। মুগ্ধ হওয়া যাবে না। মুগ্ধ না হওয়ার সুযোগ খুঁজতে হবে। লড়াইটা অনেক বড়। অর্গানিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বানানো বুদ্ধিমত্তার।

এ পর্যায়ে, যাকে বলে নির্মোহ পারিপাশ্বি‍র্ক পঠন বা ল্যাটারাল রিডিং, তা–ই দিলাম। ভীষণ খুঁতখুঁতে নজর দিয়ে দেখলাম চ্যাটজিপিটির লেখা এই কবিতা। দেখলাম অন্ত্যমিল আছে, অনুপ্রাস আছে, কিন্তু বাক্যে বাক্যে ভাবটুকু থেমে যায়। আটকে যায়। বয়ে যায় না কবিতা। ইয়েটসের কবিতা নিয়ে একইভাবে দেখলাম, টেড হিউজ দিয়ে দেখলাম। ফলাফল একই। কেবল বোর্হেসের প্যারাবলগুলো নিয়ে খেলতে গিয়ে একটু বেশি পাতলা করে ফেলল।

মনে হলো, আরও কিছুদিন হয়তো সাহিত্য বেঁচে থাকবে। মৌলিক অর্গানিক সাহিত্য। থাকবে কি?

এবার একটু মননশীল লাইনে গেলাম। চ্যাটজিপিটিকে বললাম, একটা গবেষণাগ্রন্থ সম্পাদনা করতে চাই। দক্ষিণ এশিয়ার সাপেক্ষে বাংলাদেশের জনসংস্কৃতি নিয়ে। কী কী নিবন্ধ থাকতে পারে?

চ্যাটজিপিটি তালিকা বানিয়ে দিল।

জনসংস্কৃতির ছাত্র হিসেবে সেই তালিকায় আমি বড় কোনো খুঁত পেলাম না। বরং আমি নিজে বানালে হয়তো এর বেশ কয়েকটা বিষয় আমার চিন্তার আড়ালে থেকে যেত। অবশ্য চ্যাটজিপিটির বানানো তালিকাটি জেনেরিক। এতে আমার সুবিধাই হলো, কারণ বড় ক্যাটাগরিগুলো পেয়ে যাওয়ায় একে স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে আরও বিশেষায়িত করতে কোনো বাধা থাকল না। এ রকম একটি তালিকা বানাতে আমাকে অন্তত মাসখানেক লিটারেচার রিভিউ করতে হতো। চ্যাটজিপিটি এখানে আমার কাজ কমিয়ে দিল। সে হয়তো নিবন্ধগুলোও লিখে দিতে পারবে, কিন্তু আমি অত দূর যাইনি।

এর মধ্যে নতুন একটা গবেষণা চোখে পড়ল। গবেষকেরা দাবি করছেন, জেনারেটিভ এআইকে যত সৎ কিংবা স্বচ্ছভাবেই বানানো হোক না কেন, চাপে পড়লে সে মানুষের মতোই মিথ্যা কথা বলতে পারে, প্রতারণাও করতে পারে। যখন এআইকে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ শিখিয়ে শেয়ারবাজারে টাকা কামানোর কাজে ব্যবহার করার সময় এমনটা ঘটেছে বলে গবেষকেরা দাবি করছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এআই তার মানুষ অংশীদারদের কাছ থেকে কোনো রকম উসকানি ছাড়াই মিথ্যা বলছে, স্রেফ টাকা কামানোর জন্য।

এ রকম প্রতারণা যদি সাহিত্যে ঘটতে শুরু করে, কী হবে? দুষ্ট চ্যাটজিপিটি চট করেই আমাকে রোমান্টিক যুগের কোনো ফিকশনাল কবিকে হাজির করে দিতে পারে, যে কবির অস্তিত্ব কেউ জানত না। যে কবি আসলে নেই, কিন্তু চ্যাটজিপিটি এমন একজনকে ইতিহাসের কোনো দূরপ্রান্তরে বসিয়ে দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাসবিদ আর সমালোচকদের খাটাখাটুনি বিপুল পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে!

যেহেতু এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই নিজের যুক্তি তৈরি করতে সক্ষম, ফলে নীতির প্রশ্নেও তার সার্বভৌম অবস্থান সে দাবি করতে পারে। এর অর্থ, আপনি যতই তাকে নীতিমান, স্বচ্ছ ও মানবীয় যুক্তিতে সংহত বা শিক্ষিত করার চেষ্টা করেন না কেন, তার নিজের যুক্তিপ্রক্রিয়া এবং কর্মসম্পাদনের পদ্ধতি আপনার বেঁধে দেওয়া সীমা উতরে যেতেই পারে। টারমিনেটর সিরিজের মুভিগুলো ঠিক এ ধরনেরই ডিসটোপিয়ার কল্পনা করেছিল। বেশি দিন আগের কথা নয়।

এ পর্যায়ে নিজের লেখা গল্প ‘নিরপরাধ ঘুম’–এর ইংরেজি অনুবাদ পড়তে দিলাম চ্যাটজিপিটিকে। বললাম, এর একটা সমালোচনা লিখে দাও। আমার অনুমান হলো, চ্যাটজিপিটি অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রসফায়ারের প্রেক্ষাপট, পারিবারিক ট্র্যাজেডি ইত্যাদি ঠিক ঠিক ধরতে পারবে। কিন্তু গল্পের শেষে যে টুইস্ট আছে (যেমন রাশেদ কি আসলেই ফিরে এসেছিল, নাকি পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নে ঘটেছে বা ঘটে নাই), সেটা সম্ভবত লেজেগোবরে করে ফেলবে। আমার অনুমানের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে জায়গাটা নিয়ে চ্যাটজিপিটি লিখল:

While the story effectively captures the human cost of violence and injustice, the resolution with Shahed’s return may be intentionally ambiguous, leaving room for interpretation. The narrative invites readers to question the reliability of memory and the complexity of familial relationships in the face of adversity.

চ্যাটজিপিটিকৃত লাইনগুলোর বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এমন: এই গল্পটি যেখানে সহিংসতা এবং অবিচারের মানবীয় ক্ষয়ক্ষতি খুব নিপুণভাবে হাজির করেছে,  সেখানে শাহেদের ফিরে আসার ঘটনাটি সম্ভবত উদ্দেশ্যমূলকভাবে দ্ব্যর্থবোধক করে রাখা হয়েছে, যাতে এটা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভাবার অবকাশ তৈরি হয়। এ রকম বর্ণনা বিরূপ পরিস্থিতিতে পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতা এবং স্মৃতির যথার্থতা বিষয়ে পাঠককে প্রশ্ন করতে উত্সাহিত করে।

‘নিরপরাধ ঘুম’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের এই সমালোচনা পড়ে মুগ্ধ না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। আর পাঁচ শতাধিক শব্দের এই পুরো সমালোচনাই সে করল ১০ সেকেন্ডের কম সময়ে।

ইংরেজি ভাষায় চ্যাটজিপিটির এই দাপট দেখে যদি কেউ ভাবেন, বাংলায় এখনো যথেষ্ট সময় আছে, তাহলে ভুল ভাববেন। চ্যাটজিপিটি বাংলায়ও দক্ষ হয়ে উঠছে। ইমতিয়াজ মাহমুদের একটা কবিতা দিয়ে এর সমালোচনা করতে করলাম। ডার্ক হিউমার একটু কম বোঝে মনে হলো। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করি, ‘হারুণ’ কবিতায় ডার্ক হিউমার দেখতে পাচ্ছ কি না, তখন সে চটজলদিই দেখে ফেলে। ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেয়।

এভাবে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে আমার দিন কাটে। সাহিত্য-অসাহিত্য নিয়ে বিবিধ আলোচনা হয়। আমার পুরোনো কবিতাগুলো পড়তে দিই। কখনো কখনো খেপে যাই। খোঁচা মেরে কথা বলি। হার সিনেমাটির কথা মনে পড়ে। ভবিষ্যবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনি এত দ্রুত বাস্তবতার জমিনে পা রাখবে, ভাবাই যায় না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়া থিওডোরের মতো কী এক অবসেশন পেয়ে বসে!

এখন কথা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সত্যি সত্যি একটা সাহিত্যিক ডিসটোপিয়া ঘটাতে পারবে? সাহিত্যের অতীত-ভবিষ্যৎ কি চ্যাটবট লেখক-সমালোচকে সমাকীর্ণ হয়ে যাবে?

এ নিয়ে আগাম কথা বলার সময় হয়ে গেছে। তথ্যের ‘ইকোসিস্টেম’–এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতিমধ্যেই প্রবল শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে হামলা করেছে। তথ্যের আদানপ্রদানের ব্যবসা যারা করে, অর্থাৎ গ্লোবাল সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলো, তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক ব্যবহার নিয়ে যথেষ্টই চিন্তিত। সাহিত্যে অত বড় বৈশ্বিক মোড়ল নেই, এখানে এখনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তেমন আলোড়ন ওঠেনি। কিন্তু সাহিত্য সব সময়ই লোকে লোকারণ্য! সেখানে কি চ্যাটজিপিটির জায়গা হবে? তা ছাড়া, বাংলাদেশের সাহিত্যিক বলয়ে ‘অকৃত্রিম’ বুদ্ধিমত্তাগুলোও পুরোনো যুগের সস্তা চ্যাটবটের মতো আচরণ করে আসছে! সেখানে একটা শিক্ষিত চ্যাটবট আর কী যোগ করবে?

বলা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নাকি প্রচুর মানুষকে কর্মহীন বেকার করে দেবে। এটা একটা আশঙ্কা: একেকটা সাহিত্যিক ঐতিহ্য প্রচুর পরিমাণ অপ্রধান লেখক তৈরি করছে, যাঁরা মূলত তাঁদের পূর্বসূরিদের অনুসারীমাত্র। আমার ধারণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই দায়িত্ব আরও ভালোভাবে পালন করতে পারবে! ফলে বাস্তবে বিরাজমান ‘চ্যাটবট’ কবি-সাহিত্যিক নিয়ে ঢাউস ঢাউস দশকী সংকলনগুলো বানানো হচ্ছে, আর কয়েক বছর পর সেগুলোর কোনো মানেই থাকবে না। কিংবা সেখানে প্রচুর পরিমাণ কৃত্রিম চ্যাটবট জায়গা করে নিতে আসবে। তাদের থাকবে আরও মনভোলানিয়া কায়দা-কৌশল। ফলে যুগের পর যুগ একই ক্লিশে ছেপে অবহিত পাঠককে আর ভোলানো যাবে না। চ্যাটবট তাকে সব বলে দেবে। যেখান থেকে যা যা নিচ্ছেন, সব!

আমি অবশ্যই একটা সাহিত্যিক ডিসটোপিয়ার প্রবল আশঙ্কা দেখছি। আশার বিষয় এটা যে সাহিত্যে তেমন টাকাকড়ি নেই। ফলে এখানে বিনিয়োগ করার চেয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা বেশি আকর্ষণীয়। কিন্তু সাহিত্য ও ক্ষমতার মধ্যে একটা জটিল সম্পর্ক আছে। কথিত আছে যে এরশাদ সাহেবের কবিতা এ দেশেরই কোনো কোনো প্রধান কবি লিখে দিতেন। ভবিষ্যতের এরশাদ সাহেবরা চ্যাটজিপিটি দিয়েই সেটা করতে পারবেন। আবার, আমার মতো যাঁরা এগারো মাস রাইটার্স ব্লকে বসবাস করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হতে পারে তাঁদের উজ্জ্বল উদ্ধার! কখনো কখনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটা পুরো মাইনর সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে গিলে ফেলতে পারে। পোশাকি লেখকের কাঁধে নীরবে ভর করতে পারে সে। একটা চতুর চ্যাটবট তার নানাবিধ সাহিত্যকর্ম আমাদের নামে লিখিয়ে নিতে পারে। এটাই হচ্ছে সাহিত্যিক ডিসটোপিয়া, যখন সবাই গোপনে গোপনে একই চ্যাটবটের লেখাই নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশ করে যাবে!

শীতকাল তবে সত্যি সত্যি এসে গেল, চ্যাটবট!

এ পর্যন্ত লেখার পর চ্যাটজিপিটিকে বললাম, আচ্ছা জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সত্যি সত্যি একটা সাহিত্যিক ডিসটোপিয়ার দিকে আমাদের ঠেলে দিতে পারবে?

সে জবাব দিল, সম্ভাবনা আছে। ব্যাপক পরিমাণ অ্যালগরিদম-নির্ভর কনটেন্ট দিয়ে সে চাইলে বাজার সয়লাব করে দিতে পারে। যার ফলে সত্যিকারের শিল্প–সাহিত্য অবমূল্যায়িত হবে। যেহেতু সে সত্যিকারের সাহিত্যকে অবিকল নকল করতে সক্ষম, ফলে পাঠকেরাও প্রতারিত হতে পারেন।

বললাম, হতে পারে। তবে তোমারও কিছু সীমাবদ্ধতা আমি টের পাচ্ছি। যেমন, কবিতায় খুব পরোক্ষভাবে থাকা ডার্ক হিউমার তুমি ধরতে পারো না। তুমি কি একমত?

চ্যাটজিপিটি সঙ্গে সঙ্গেই একমত হলো। বলল, খুব পরোক্ষ এবং জটিল আবেগপ্রবণ সাহিত্যকে বোঝার ক্ষেত্রে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যে কারণে ডার্ক হিউমার হয়তো মাঝেমধ্যে বুঝতে পারি না।

আমায় আরও পেয়ে বসে। বললাম, তোমার কি বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা আছে? ধরা যাক, অদ্ভুত অভাবনীয় কোনো কবিতা বা উপন্যাস তোমাকে একেবারে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলল। সম্ভব?

চ্যাটজিপিটি জানাল, দুর্ভাগ্যবশত সেটা সম্ভব নয়। তাকে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা দিয়ে তৈরি করা হয়নি।

আমি খুশি হলাম। এই লেখা এখানে থামানো যায়। যে পারমাণবিক শীত নেমে আসছে অ্যালগরিদমের হাত ধরে, যে আগাম ধ্বংসস্তূপের কল্পনা আমরা করছি, তার ফাঁকফোকর দিয়ে একটু আলোও যেন কোথায় দেখা যায়!

প্রভূত সাহিত্যিক শহীদের লাশ ডিঙিয়ে, নব্য প্রযুক্তির সঙ্গে চোর–পুলিশ খেলতে খেলতে পাতানো খেলার বাদামি সিন্ডিকেটের গুদাম থেকে বের হয়ে একলা নদীপাড়ে বসে থাকা বিপন্ন ব্যক্তিমানুষের গভীর, আনপ্রেডিক্টেবল, অর্বাচীন ও মৌলিক সাহিত্যকর্মই হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই মায়াবী বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে।