কোলাজ: ৈসয়দ লতিফ হোসাইন
কোলাজ: ৈসয়দ লতিফ হোসাইন

নজরুলের ‘লৌহ-কবাট’ ও সুরাসুরের যুদ্ধ

কাজী নজরুল ইসলামের বহুশ্রুত গান ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’–এ নতুন করে সুর বসিয়েছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। পিপ্পা চলচ্চিত্রে গানটি প্রকাশিত হওয়ার পর বেজায় চটেছেন দুই বাংলার শ্রোতারা। কপিরাইট প্রসঙ্গের পাশাপাশি নজরুলের গান নতুন সুরে গাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বিষয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ ‘কারার ঐ লোহ–কবাট’ গানটিতে অস্কারজয়ী ভারতীয় সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান নতুনভাবে সুরারোপ করেছেন। এটি ব্যবহার করা হয়েছে পিপ্পা নামের একটি হিন্দি চলচ্চিত্রে। এ আর রাহমানের এরকম কাণ্ডে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কেননা, এই গান নজরুলের নিজের সুরারোপিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের সব বিপ্লব–বিদ্রোহ তথা আন্দোলন–সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’।

যেভাবে লেখা হলো ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’

গানটির রচনার ইতিহাস বিচার করলে আমরা দেখি, একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গানটি রচিত হয়েছিল। বলা ভালো, গত শতকে এই উপমহাদেশের অনেক উত্থান–পতনের সাক্ষী এই গান। ইংরেজ শাসনের বিরোধিতার কারণে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২১ সালে আটক হন। সে সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় বাঙলার কথা নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। দেশবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পর পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। তিনি ওই পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের কাছে লেখা চান এবং লেখা সংগ্রহের জন্য নজরুলের কাছে যান চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে সুকুমার রঞ্জন দাশ। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের স্মৃতিকথায় আছে, চিত্তরঞ্জনপুত্র লেখা চাইতে এলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই কবিতাটি লিখে দেন নজরুল। হুগলি জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় এই কবিতায় সুর বসিয়ে নজরুল সৃষ্টি করেন অমর গানটি। ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি ভাঙার গান বইয়ে প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। প্রকাশের পরপর ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার ভাঙার গান নিষিদ্ধ করে। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কবিতাটি ফের প্রকাশিত হয়।

গানটি লেখার শতবর্ষ পরে এ আর রাহমান যখন এই গানে নিজের মতো করে সুর দিয়েছেন, তখন গানের মূল আবেদনই ধ্বংস হয়েছে।

এ সময় কারাগারে প্রতিবাদের ভাষা ওঠে এই গান। ১৯৪৯ সালে কলাম্বিয়া রেকর্ড এবং ১৯৫০ সালে এইচএমভিতে গিরিন চক্রবর্তীর কণ্ঠে গানটি বাণীবদ্ধ হয়। ১৯৪৯ সালে নির্মল চৌধুরী পরিচালিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সিনেমায় গিরিন চক্রবর্তী ও তাঁর সহশিল্পীদের নিয়ে গানটি রেকর্ড করেন সংগীত পরিচালক কালীপদ সেন। এরপর ১৯৬৯-৭০ সালে জহির রায়হান তাঁর কালজয়ী চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া সিনেমায়ও গানটি ব্যবহার করেছেন। ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কবির সুস্থাবস্থায় গানটি রেকর্ড হতে পারেনি। এই হলো গানটির মোটামুটি ইতিহাস। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত গানটি মোটামুটি একই সুরে প্রচলিত।

এভাবে পরিবর্তন করা যায় কি?

এখন এ আর রাহমান ভারতে নির্মিত একটি সিনেমায় গানটিতে যখন সম্পূর্ণ নতুন সুর বসিয়ে সামনে এনেছেন, বিতর্ক চাগাড় দিয়ে উঠেছে তখনই। গানের বাণীর চরিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলার কারণে দুই বাংলার মানুষেরা এ আর রাহমান সুরারোপিত গানটি গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে এ কারণে যে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ নামের জাগরণের গানকে এ আর রাহমান ঘুমপাড়ানি গানে রূপান্তরিত করে একটি ঐতিহাসিক গানের অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন। একই সঙ্গে এ কথাও সামনে এসেছে, নজরুলের সৃষ্টিকর্ম এভাবে পরিবর্তন করা যায় কি? কবি কি সে স্বাধীনতা কাউকে দিয়েছেন?

নবশক্তি পত্রিকায় এ বিষয়ে নিজেই লিখেছেন নজরুল। নিজের গানে শিল্পীদের স্বাধীনতার বিষয়ে বলতে গিয়ে তাঁর গানের বাণী ও সুরের বিকৃতি প্রসঙ্গে নবশক্তির ২৩ আগস্ট ১৯২৯ সংখ্যায় সম্পাদককে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার নিজের দিক থেকে কিন্তু স্পষ্ট গোটা কতক কথা বলবার আছে এ নিয়ে। তার কারণ, আমার গান প্রায় প্রত্যহই কোনো না কোনো আর্টিস্ট রেডিওতে গেয়ে থাকেন। এবং আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত তা শুনেও ফেলি। এক উমাপদ ভট্টাচার্য্য মহাশয় এবং ক্কচিৎ দু’একজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক বা মহিলাই আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে তার পিণ্ডি এমনি করেই চটকান, যে মনে হয়, ওর গয়া লাভ ঐখানেই হয়ে গেল। সে একটা রীতিমতো সুরাসুরের যুদ্ধ। একদিন শুনলাম, কোনো এক ভদ্রলোক আমার ঠুংরি (ঠুমরি) চালের “দুর্গা” সুরের “নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল” গানটি ধ্রুপদের ইমন-কল্যাণ সুরে গাচ্ছেন এবং তা শুনে গানের “আঁখিজল” আমার চোখে এসে দেখা দিল। অবশ্য অনুরাগে নয়, রাগে এবং দুঃখে! ভাগ্যিস গান এবং গাইয়ে দুই-ই ছিল নাগালের বাইরে, নইলে সেদিন ভালো করেই সুরাসুরের যুদ্ধ বেধে যেত। আর একদিন একজন রেডিও স্টার (নারী) আমার “আমারে চোখ ইশারায়” গানটার ন্যাজা–মুড়ো–হাত–পা নিয়ে এমন করে তাল পাকিয়ে দিলেন যে তা দেখে মনে হলো, বুঝিবা গানটার ওপরে একটা মোটর লরি চলে গেছে। মোটর অ্যাকসিডেন্ট না হলে ও রকম কন্ধকাটা নুলো খোড়া ক্ষতবিক্ষত অবস্থা কারুর হয় না। এ রকম প্রায় প্রত্যহই হয় এবং হয়-বেতারের গাইয়ে-গুণীজন যাঁরা আমার গান দয়া করে গেয়ে থাকেন, তাঁরা আরেকটু দয়া করে গানগুলোর মোটামুটি সুর ও গানের কথা জানবার কষ্ট স্বীকার করেন না।’

এ থেকেই বোঝা যায়, নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মের বিকৃতি পছন্দ করেননি। তবে নজরুলের গানকে বারবারই বিপন্ন হতে দেখি আমরা। নজরুলের গানকে প্রধাণত দুইভাবে বিপন্ন করা হচ্ছে—একটি বাণীর বিকৃতি, অন্যটি সুরের বিকৃতি। কাজী নজরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে অনেকেই তাঁর গানের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। কেউ বা নজরুলকৃত সুরকে চালিয়ে দিয়েছেন নিজের সুর বলে, কেউ আবার তাঁর ইচ্ছেমতো সুরের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, আবার কেউ বাণীতে করেছেন কিছু পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে’ গানটিতে একটি জায়গায় হবে, ‘তোমারে বুঝি গো বুঝেছিনু আমি’। কিন্তু পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী গেয়েছেন, ‘তোমায় না বুঝে বুঝেছিনু আমি ভুল’। আবার ‘তুমি কি আসিবে না’ গানটিতে এক জায়গায় ‘পথ চেয়ে আছি তোমারি আশায়’–এর স্থলে ইন্দ্রাণী সেন গেয়েছেন, ‘বসে আছি তোমার আসার আশায়’—এ রকম বহু দৃষ্টান্তই দেওয়া যাবে। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড এবং আদি স্বরলিপি অনুসরণ না করা এবং গানের বাণীর শুদ্ধতা যাচাই না করে গাওয়ার কারণেই এসব ভুল অহরহ ঘটেছে বা ঘটছে।

শুধু নজরুল কেন, গানের সুরের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথেরও আছে নিজস্ব অবস্থান। এ প্রসঙ্গে দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষ্য হলো, ‘...আমার গান যার যেমন ইচ্ছা, সে তেমনিভাবে গাইবে? আমি তো নিজের রচনাকে সে রকমভাবে খণ্ড–বিখণ্ড করতে অনুমতি দিই নি।’ (সংগীত চিন্তা, পৃ.৯৬) তিনি আরও বলেন, ‘আমার গানে তো আমি কোথাও ফাঁক রাখিনি, যা অন্য কেউ ভরিয়ে দিলে তার ওপর কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।’ কাজেই আমরা দেখি যে রবীন্দ্রনাথও তাঁর সৃষ্টিতে কেউ হাত দিক, সে স্বাধীনতা একেবারেই দেননি।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনই তাঁদের সৃষ্টিতে অন্য কারও হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ রাখেননি। বলা দরকার, হস্তক্ষেপের প্রয়োজনও নেই। এ বিষয়ে নজরুল যথার্থই বলেছেন, ‘আমার সুর যদি পছন্দ না হয় তবে তোমরা আমার গান গেয়ো না।’ (শতবর্ষে নজরুল, পৃ.২৯৬)

সুর ঠিক রেখে আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহার করা যেতেই পারে। কিন্তু মূল সুরের পরিবর্তন কোনোভাবেই কাম্য নয়। চাইলেই কি আমরা বিটোফেনের কোনো কম্পোজিশন বদলাতে পারব? কোনো কবির কোনো কবিতার শব্দ পরিবর্তন করতে পারব? এ আর রাহমানের কোনো গান অন্য সুরে অথবা বিকৃত করে গাইলে তিনি কি মেনে নেবেন? যদি তা না হয়, তাহলে কেন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের গানে হাত দেব?

কী করলেন এ আর রাহমান?

এ পর্যায়ে প্রশ্ন হলো, কিসের ভিত্তিতে এ কাজ করলেন এ আর রাহমান? কবির নাতি অনির্বাণ কাজীর স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর কাছ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম (কবিতা) আত্মীকরণ করে একটি রচিত সুরের অংশ হিসেবে পুনর্নির্মাণ বা রিক্রিয়েট এবং শব্দ গ্রহণের অনুমতি নিয়েছিলেন পিপ্পা সিনেমার প্রযোজক রয় কাপুর ফিল্মস কর্তৃপক্ষ। কল্যাণী কাজীর সঙ্গে প্রযোজকদের দুই লাখ টাকার বিনিময়ে চুক্তি হয়েছিল বলে জানা যায়। চুক্তিতে বারবার নজরুলের সাহিত্যকর্ম সম্পাদনা, পুনর্বিন্যাস ও সংক্ষিপ্তকরণের অনুমতি নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাকে খোলাসা করেছেন অনির্বাণ কাজী, ‘প্রথমে মাকে ওরা ফোন করে। তারপর আমার সাথে কথা হয়। পুরো বিষয়টা জানার পর মা খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। কারণ, এই ছবির সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান।’ অনির্বাণ আরও জানান, ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি ছবিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গানের সুর বা কথা পরিবর্তনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। মা কিন্তু ওদের কাছে গানের চূড়ান্ত সংস্করণটি শুনতে চেয়েছিলেন।’

নজরুলের মৃত্যুর এখনো ৬০ বছর পেরোয়নি। কাজেই এখানে কপিরাইটের বিষয়টিও বিদ্যমান। একটি বিষয় লক্ষণীয়, রয় কাপুর ফিল্মস কর্তৃপক্ষ কেবল কল্যাণী কাজী এবং তাঁর বড় ছেলে অনির্বাণ কাজীকে নজরুলের একমাত্র উত্তরাধিকার ধরে চুক্তি করেছেন। এই চুক্তি কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। বলা ভালো, কবি পরিবারের সবাই এই চুক্তির বিষয়ে অবগত নন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে থাকা কবির নাতনি খিলখিল কাজী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চুক্তির কথা প্রয়াত কল্যাণী কাজী এবং তাঁর বড় ছেলে অনির্বাণ ছাড়া কেউ জানতেন না। মনে হচ্ছে, আমাদের পরিবারের গাফিলতিতেই “কারার ঐ লৌহ–কবাট”–এর মতো গানের এমন বিকৃতি ঘটল।’ এদিকে কলকাতায় থাকা কবির অন্য দুই নাতি–নাতনি কাজী অরিন্দম আর অনিন্দিতা কাজী চুক্তির কপি উন্মোচনের দাবি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে খিলখিল কাজীর বক্তব্য, ‘আমি জানি না কোথা থেকে এ পারমিশন পেয়েছে। আর এ পারমিশনে এটা লেখা ছিল কি না, এর টিউনটা চেঞ্জ করতে পারবে কি না। এ আর রাহমান মিউজিক ডিরেক্টর। তিনি “কারার ঐ লৌহ–কবাট”–এর মতো বিখ্যাত একটি গানকে খেমটা করে ফেলেছেন। উনি চেঞ্জ করে নিজেই সুর দিয়েছেন। আমরা এটাকে কেউ মেনে নিতে পারছি না।’

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমা চাওয়া, অতঃপর

এই বাস্তবতায় রয় কাপুর ফিল্মস কর্তৃপক্ষের কথা হলো, ‘আমরা আইনগত সব দিক রক্ষা করেই যা করার করেছি।’ গত ১৩ নভেম্বর খুদে ব্লগ লেখার ওয়েবসাইট এক্সে দেওয়া পোস্টে প্রয়োজনা প্রতিষ্ঠান রয় কাপুর ফিল্মসের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলা হয়েছে, ‘কাজী নজরুল ইসলামের আসল সুরের প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতজগৎ, সমাজ ও রাজনীতিতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য।’

তারা বলেছে, ‘আমরা প্রয়াত কল্যাণী কাজীর (কবির পুত্রবধূ) কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম এই গানের কথা ও স্পিরিট অক্ষুণ্ন রেখে বিশ্বস্তভাবে সেটি নির্মাণ করার জন্য। তাঁর সঙ্গে আমাদের চুক্তিও হয়েছিল। সাক্ষী ছিলেন কল্যাণী কাজীর ছেলে অনির্বাণ কাজী।’

নজরুল ইসলামের সুরারোপিত গানের প্রতি বাংলাভাষী মানুষের যে আত্মিক টান রয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি লিখেছে, ‘অরিজিনাল কম্পোজিশনের প্রতি দর্শকদের যে আত্মিক টান রয়েছে, সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি, তবে শিল্প সর্বদাই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার বিষয়। তারপরও আমাদের কাজ যদি কারও ভাবাবেগে আঘাত দেয় কিংবা কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে তাহলে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’

তবে রয় কাপুর ফিল্মস ক্ষমা চাইলেও কেউ কেউ এমন ধারণা করেছেন েয আইনের মারপ্যাঁচে কবি পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে চুক্তিটি সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এখনো নজরুলের সব সৃষ্টিকর্মের আইনত দাবিদার নজরুলের পরিবার, সেহেতু এই পরিবারের কোনো একক ব্যক্তি চুক্তিটি করলে সেটি যথাযথভাবে আইনসিদ্ধ হবে কি না, তা নিয়েও কথা থাকে বলে মনে করেন অনেকেই।

এই গান নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালি সংগীতশিল্পীরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল এক ভিডিও বার্তায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

এদিকে ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই গানটিকে বিকৃত করায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সবার দাবি, বিতর্কিত সুরে বাণীবদ্ধ গানটি পিপ্পা চলচ্চিত্র থেকে প্রত্যাহার করে মূল সুরে গেয়ে সিনেমায় অর্ন্তভুক্ত করা হোক।

‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ বাঙালির জাগরণ ও বিপ্লবের প্রতীক। একটি বিপ্লবী বাস্তবতায় এই গান রচিত হয়েছিল। কিন্তু গানটি লেখার শতবর্ষ পরে এ আর রাহমান যখন এই গানে নিজের মতো করে সুর দিয়েছেন, তখন গানের মূল আবেদনই ধ্বংস হয়েছে। নজরুলের গান যে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্যকে আঘাত করা হয়েছে। উপরন্তু এ আর রাহমান সুরারোপিত গানটি যে মূল গানের চেয়ে ভালো ও অনন্য হয়েছে, এমনও নয়। সব মিলিয়েই ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’–এ ভাংচুর করে দ্রোহমূলক গানটিকে যেন কয়েদই করা হয়েছে।

মাহমুদুল হাসান: নজরুলসংগীতশিল্পী; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহকারী অধ৵াপক

অভিমত

‘গান বিকৃত করার মধ্য দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্যকে আঘাত করা হয়েছে’

খায়রুল আনাম শাকিল

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থা; নজরুলসংগীতশিল্পী

কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’–এর নতুন সুর দিয়েছেন ভারতের প্রসিদ্ধ সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান। পিপ্পা চলচ্চিত্রের জন্য সম্পূর্ণ মনগড়া সুরে গানটিতে সুরারোপ করেছেন তিনি। তাঁর এই কাজ যেমন স্বেচ্ছাচারী হয়েছে, তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অপমানকর। ফলে গত কয়েক দিনে নজরুলসংগীতশিল্পী, নজরুলপ্রেমী এবং দুই বাংলার বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন।

স্বদেশি অন্দোলন থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ—সব ক্ষেত্রেই ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ আমাদের প্রেরণা দিয়েছে, বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই সূত্রে বলতে পারি, গানটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। তো এই গানের সুর বিকৃত করার মধ্য দিয়ে আদতে বাঙালি ঐতিহ্যকেই আঘাত করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

এ আর রাহমানের এই নতুন সুর ভালো না খারাপ—এই আলাপে আমি যাব না। আমার কথা হলো, আপনি তো ঐতিহ্যকে নষ্ট করতে পারেন না, ঠিক যেমনভাবে আপনি পারেন না মোৎসার্টের কোনো সুর বিকৃত করতে বা

বদলে দিতে।