মাধ্যম বা মিডিয়ার ধরন ভাষা পরিবর্তনে প্রভাব রাখে। যখন পুঁথির যুগ ছিল, তখন লোকমুখের গান লিখিত হতো লিপিকর দ্বারা। একেক লিপিকর একেকভাবে একই গান লিখে রাখতেন। পুঁথির পর যখন ছাপাযন্ত্রের সাহায্যে পুস্তক ছাপা হতে শুরু হলো, তখন শুধু সমোচ্চারিত শব্দের বানান নয়, মৌলিক বর্ণ আর বর্ণের রূপেও পরিবর্তন আসতে থাকল। ছাপাখানার নানা পর্যায়ের বিবর্তন পেরিয়ে এল কম্পিউটারকেন্দ্রিক মুদ্রণব্যবস্থা। তখন আরেক প্রকারের পরিবর্তনের মুখ দেখল ভাষা ব্যবস্থা। কিন্তু ভাষা ব্যবহারের ধরন, ধারণার চেয়ে বেশি বদলে গেল যখন ইন্টারনেট ও সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারের বিস্ফোরণ ঘটল। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের অভ্যাসের বয়স দুই দশক না হলেও ডিজিটাল ভাষা প্রযুক্তির চর্চা শুরু হয়েছিল কিন্তু চার দশক আগে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে ভাষা বিচিত্র বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। এর কিছু কারণ প্রযুক্তিগত, আরেকটি কারণ নেটিজেনদের তৈরি ‘কালেকটিভ সাবকালচার’ বা যৌথভাবে নির্মিত উপসংস্কৃতি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা ভাষা যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাকে শুদ্ধতাবাদী দৃষ্টি থেকে দেখা যেতে পারে, কিন্তু তা রক্ষণশীলতার নামান্তর। কোনো বানান বা শব্দের ব্যবহার ঠিক হয়েছে কি না, এমন ‘জাজমেন্টাল’ বা বিচারিক মনোবৃত্তিকে নেট-নাগরিক বা নেটিজেনরা নাম দিয়েছেন ভাষা-দারোগা বা ‘ল্যাঙ্গুয়েজ পোলিসিং’। কিন্তু ভাষাকে ব্যাকরণ বা নীতিপুস্তকের আলোকে যতই দেখা হোক না কেন, জনপরিসরে ব্যবহারের সময় ভাষা বদলাবেই। এটাই ভাষার বেঁচে থাকার মূল কারণ। অপরিবর্তনীয় ধ্রুপদি ভাষা মানুষের মুখ থেকে সরে যায়। ডিজিটাল মাধ্যমের ফলে ভাষা ব্যবহারের নতুন নতুন অভ্যাস তৈরি হয়েছে। কখনো তা প্রচলিত শব্দের মধ্যে নতুন অর্থ আরোপের মাধ্যমে, কখনো একেবারে নতুন শব্দ তৈরির মাধ্যমে, কখনো বিদেশি শব্দকে নিজের মতো আত্মীকরণ করে, কখনো প্রচলিত শব্দকে বানান বা উচ্চারণের আংশিক পরিবর্তন করে ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষার ব্যবহার চলছে।
‘ভাইরাল’, ‘রোস্ট’, ‘পোস্ট’, ‘স্ট্যাটাস’ শব্দগুলোর বহুদিনকার প্রচলিত অর্থ বদলে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে। ‘ভাইরাল’ যতটা না অসুখসংক্রান্ত, তার চেয়ে বেশি মিডিয়া কনটেন্টের প্রচারসংক্রান্ত শব্দ। ঠিক ‘রোস্ট’ খাবার হিসেবে যেমন উচ্চারিত হয়, ইউটিউবে অন্যকে রিভিউ করে ‘পচানি’ দেওয়ায় বেশি উচ্চারিত হয়। ‘পোস্ট’, ‘স্ট্যাটাস’, ‘রিচ’, ‘শেয়ার’ শব্দগুলোয় যুক্ত হয়েছে নতুন ব্যঞ্জনা। পুরাতন অর্থ ছাপিয়ে গেছে এদের নতুন অর্থ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে বাংলা ভাষায় নতুন শব্দও যুক্ত হয়েছে। যেমন, ‘মিম’, ‘ট্রোলিং’, ‘প্র্যাঙ্ক’। ছবির সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে মিমিক্রি করা হলে তাকে ‘মিম’ বলা হয়; গণহারে উপহাস করার বিষয়টি ‘ট্রোল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে; আর মিছে বা নাটকীয় কোনো উপায়ে কাউকে ভয় দেখানো, ঠকানো বা তাক লাগানোর বিষয় ভিডিও করে প্রচার করার প্রক্রিয়াকে ‘প্র্যাঙ্ক’ করা বলা হচ্ছে। এসব শব্দ এখন বাংলা ভাষায় জায়গা করে নিয়েছে। তরুণদের শহুরে ভাষাও গণমাধ্যমে প্রকাশ্য পরিসরে চলে আসছে। ‘প্যারা’, ‘তাফালিং’, ‘কাপঝাপ’ শব্দগুলো নাগরিক কথ্য বা ‘আরবান স্ল্যাং’ হিসেবে উদ্ভূত হলেও এখন এমন শব্দের ব্যবহার নাটকে, আড্ডায় এমনকি ঘরে ও অফিসেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডিজিটাল জগতে যে শুধু শব্দের অর্থের বদলে যাচ্ছে বা নতুন শব্দ যুক্ত হচ্ছে, তা নয়। বাংলা শব্দের বিশিষ্ট বানানও ব্যবহার করে থাকেন অনেকে; যেমন ‘ওপরে’ বা ‘উপরে’ না লিখে ‘উপ্রে’; ‘ভেতরে’ বা ‘ভিতরে’ না লিখে ‘ভিত্রে’; ‘কী একটা অবস্থা’ না লিখে ‘কীয়েক্টাবস্থা’ লেখার চল বা ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। এগুলো বাংলা ভাষার ডিজিটাল শব্দভান্ডার বা করপাসে ঢুকে যাচ্ছে। সামাজিক গণমাধ্যম বা ফেসবুকে নেতিবাচক বা আপত্তিকর শব্দের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার ফলে অনেক শব্দকে অ্যাস্টেরিস্ক (*), হাইফেন (-), স্ল্যাশ (/) বা শুধু ফাঁকা রেখে শব্দ লিখছেন। যেমন, ‘ইজ-রাইল’, ‘চুরি/চা/মারি’, ‘মারা*মারি’ ইত্যাদি। আগে কোনো অশ্রাব্য শব্দকে প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে প্রকাশ করতে একটা বর্ণ লোপ করা হতো অ্যাস্টেরিস্ক চিহ্ন দিয়ে; কিন্তু এখন ফেসবুকের অ্যালগরিদম থেকে নিজেদের শব্দ আড়াল করার জন্য এমন রীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় এমন বৈশিষ্ট্যের শব্দ আসলে নতুন রীতি তৈরি করেছে।
বাংলা লেখার ক্ষেত্রে আরেকটি রীতি ডিজিটাল যুগে জনপ্রিয় হয়েছে। তা হলো, রোমানকরণ বা রোমান লিপিতে বর্ণান্তর বা ট্রান্সলিটারেশন। অর্থাৎ ইংরেজি বর্ণে বাংলা লেখার রীতি। শত বছর আগে থেকেই পরিভাষা বা নামের রোমানকরণ করা হতো একাডেমি বা গবেষণার জগতে। কিন্তু ডিজিটাল জগতে বাংলার বদলে ইংরেজি কি–বোর্ড ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় লিখে অনেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করা, পোস্ট, ক্ষুদ্র মত বা মাইক্রোব্লগ লেখার ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ণাশ্রিত বাংলা ভাষা বেশি দেখা যায়। সাধারণত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহারকারীরা ইংরেজি বর্ণে বাংলা লিখতে একই রকম প্রমিত মান অনুসরণ করেন না। বাস্তবতা হলো, এ ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। কখনো কখনো ইংরেজি বর্ণের বাংলা অনেকের কাছে বিকৃতি বা হাস্যকর মনে হয়। এ ধরনের রীতির মধ্যে ‘মুরাদ টাকলা’ নামে একটি রীতি রয়েছে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, ‘ভাই’ শব্দটি বাংলা ভাষার ব্যবহারকারীরা ইংরেজি বর্ণ ব্যবহার করে সাতভাবে লিখে থাকেন। ‘নাইস’ শব্দটি লেখেন চারভাবে।
এসব তো হলো প্রকাশ্য পরিসরে মন্তব্যের ধরন। চ্যাটবক্সে যখন বাংলা লেখা হয়, তখন আবার অন্য রকম নতুন শব্দ দেখা যায়। ইংরেজিতে আইডিকে বা এএফআইকে দিয়ে যেমন ‘আই ডোন্ট নো’ এবং ‘অ্যাজ ফার আই নো’ বোঝানো হয়, তেমনি দ্রুত লেখার জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখালোখিতে বাংলাভাষী তরুণেরা কিছু নতুন শব্দ ব্যবহার করছেন। যেমন, ‘রাইট’ লিখতে ‘r8 ’, ‘পেয়েছি’ লিখতে ‘peye 6i’, ‘একটু’ লিখতে ‘ek2’ ইত্যাদি। ভাষার এমন অবস্থাকে অনেকে বিকৃতি বলতে চাইবেন। তবে কম্পিউটশেনাল ভাষাবিজ্ঞানে সবই মানুষের ভাষা ব্যবহারের নমুনা, শুধুই ডেটা। ভাষা কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, তার জন্য দরকার ভাষা পরিকল্পনা, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের জন্য।
তবে এ কথা বলা যায় যে অন্তর্জালের ভাষার দায় কেবল ব্যবহারকারীর নয়। এর পেছনে প্রযুক্তিজগৎ আর ভাষাসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ বা কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। অন্তর্জালে বাংলার অনেক অসামঞ্জস্য সাদা চোখে ধরা পড়ে না। আমরা ডিজিটাল জগতের ভোক্তা হয়েছি ঠিকই, কিন্তু নিজেদের ভাষার মানগুলো নিয়ে এখনো মতভেদ দূর করতে পারিনি। যেমন, বাংলা ভাষার তিনটি অপরিহার্য বর্ণ ড়, ঢ়, য় দুইভাবে ওয়েবে জমা হচ্ছে। এগুলোকে একদল স্বতন্ত্র বর্ণ স্বীকার করতে নারাজ। এই মতে ড, ঢ, য এর সঙ্গে নোকতা নামক সহযোগী চিহ্ন যোগ করে বর্ণ তিনটি লিখতে হয়। এই নিয়ে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোয় বিশেষ করে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে এখনো আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
বাংলা টাইপোগ্রাফি নিয়েও বেশ জটিলতা রয়ে গেছে। চন্দ্রবিন্দু কোথায় বসবে, এ নিয়ে পণ্ডিতেরা একমত হতে পারেননি। দাঁড়ি, প্রশ্নবোধক বাক্যের আগে ফাঁকা স্থানের পরিমাণ, দুই লাইনের মাঝখানে ফাঁকা স্থানের পরিমাণ, বাংলার সঙ্গে ইংরেজি বর্ণের আকৃতিগত সমতাবিধানসহ বহু বিষয় অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। এসব কারণে পুরোনো রীতির ফন্টকেন্দ্রিক মুদ্রণব্যবস্থা থেকে ইউনিকোডনির্ভর মুদ্রণব্যবস্থায় আসা খুব জরুরি। এতে মুদ্রিত মাধ্যমের মতো ওয়েবেও বাংলা বর্ণ একইভাবে দেখা যাবে। এ জন্য আমাদের দেশের গণমাধ্যম, প্রকাশনী ও সরকারি সংস্থাগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন।
প্রভাব এড়াতে পারবে না বাংলা সাহিত্যও। ইতিমধ্যে ডিজিটাল পরিসর আমাদের সাহিত্যভাবনাকে প্রভাবিত করে ফেলেছে। ক্ষুদ্র নিবন্ধ বা মাইক্রোব্লগের জনপ্রিয়তা আমাদের দীর্ঘ টেক্সটের প্রতি উৎসাহ কমাচ্ছে। ফেসবুক রিল বা ইউটিউব শর্টস প্রমাণ করে যে লেখায় বা কনটেন্টে ভোক্তার মনোযোগের সীমা কমে এসেছে। একটি কনটেন্ট শেষ না করে আরেকটিতে যাওয়ার যে অভ্যাস, তা অ্যানালগ সময়ের দীর্ঘ সময় নিয়ে আয়েশ করে সাহিত্যপাঠের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আরও পরিবর্তন করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি। ইতিমধ্যে চ্যাটজিপিটি বা গ্রামারলি মতো অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে আমরা ইংরেজি ভাষায় এআইয়ের ক্ষমতা জেনেছি। সামনের দিনগুলোয় টাইপ করে লেখার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। কণ্ঠের মাধ্যমে লেখার রীতি ইতিমধ্যে জিবোর্ডে রয়েছে। এ ছাড়া ‘সঠিক’–এর মতো বানান ভুল সংশোধনের সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়ছে বাংলা ভাষায়। বলা হয়, এখন সঞ্জননী বা জেনারেটিভ এআইয়ের যুগ। অর্থাৎ ব্যবহারকারী একটি বাক্য লিখলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরবর্তী বাক্য অনুমান করে লিখে দেয়। অর্থাৎ কোনো কিছু লেখার আদেশ দিলে প্রায় ঠিকঠাক অনুচ্ছেদ মুহূর্তেই লিখে দেয় যন্ত্র। বাংলা ভাষায়ও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আসছি আসছি করছে। কম্পিউটার এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা শনাক্ত করতে পারে। কম্পিউটারকে আদেশ দিলে সে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় একটি অনুচ্ছেদ লিখে দিতে পারে। যদিও এ নিয়ে গবেষণা চলমান। ইংরেজিতে যেমন এআইয়ের মাধ্যমে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে, সেটা বাংলা সাহিত্যে ঘটবে শিগগিরই।
প্রশ্ন হলো, ডিজিটাল প্রযুক্তি কি আমাদের ভাষার ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে বা করতে পারে? এর সহজ উত্তর হলো, হ্যাঁ, পারে। সম্প্রতি ‘সার্চবক্সে বন্দী’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে যে সার্চ ইঞ্জিন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহাকারীর অবস্থান অনুযায়ী পক্ষপাতিত্ব করে। মানে হলো, ব্যবহারকারী সার্চ ইঞ্জিন সাজেশনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে থাকে। সেটা ভাষা ব্যবহার আর তথ্য খোঁজার ক্ষেত্রেও ঘটে। বাংলা ভাষার ব্যবহারকেও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে। এর মানে হলো, আমরা ব্যবহারকারীরা সেই বাংলাই ব্যবহার করব, যেটাতে তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের উত্সাহিত করে। অবচেতনে আমরা সেদিকে অনেক ছুটে গিয়েছি।