ব্রিটিশ আমল থেকেই পূর্ব বাংলার হজযাত্রীদের প্রাণকেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। সেকালের মানুষেরা যেমন এখান থেকে জাহাজে চেপে পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশে আরবে যেতেন, তেমনি আবার হজ শেষে ফিরেও আসতেন এখানে। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত পুণ্যপথের যাত্রীরা: হজ হজযাত্রী ও পথ বইয়ে সেকালের হজযাত্রার মনোরম বর্ণনা রয়েছে। সেই বই থেকে অংশবিশেষ।
ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল রাজত্বের বা ব্রিটিশ রাজত্বের সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হজযাত্রীরা জেদ্দায় যাওয়া-আসা করলেও তার লিখিত ইতিহাস পাওয়া দুষ্কর। তবে ব্রিটিশ রাজত্বের সময় থেকেই আরব উপদ্বীপ থেকে মুয়াল্লেমরা প্রতিবছর হজের তারিখের কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামে এসে স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান করতেন। তাঁদের এই আগমন মূলত হেজাজে তাঁদের হজ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত তথ্য প্রচারের জন্য। এটাই ছিল তাঁদের জীবিকা। তাঁরা জেদ্দা ও মক্কায় হাজিদের যাওয়া-আসা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এ ছাড়া মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ও মদিনায় অবস্থানেরও ব্যবস্থা করতেন। হজ কাফেলাও তাঁদের মাধ্যমে গঠিত হতো। স্থানীয় লোকজনের মধ্য থেকে তাঁদের প্রতিনিধিও নির্বাচন করতেন মুয়াল্লেমরা।
সে সময়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হজযাত্রীরা চট্টগ্রামে এসে হজযাত্রার প্রস্তুতি নিতেন। প্রায় ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যদিও একই সময়ে বা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই ব্রিটিশ প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় বোম্বে বা মুম্বাই থেকে হজযাত্রীরা জাহাজে উঠতেন। সম্ভবত ব্রিটিশ প্রশাসনের হজ ব্যবস্থাপনার বাইরে ছিল চট্টগ্রামে আরবের মুয়াল্লেমদের এই ব্যবস্থাপনা।
ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের পর পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে হজ ক্যাম্প স্থাপন করে। চট্টগ্রাম তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের হজযাত্রীদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সে সময় বিমান পরিবহন থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে ভ্রমণ তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী ছিল। বিমানে যাতায়াত করতেন খুব কম হজযাত্রী। ‘সাফিনা-ই-আরব’ ও ‘সারধানা’ নামের দুটি জাহাজের প্রতিটি দুই ট্রিপে হজযাত্রীদের জেদ্দায় নিয়ে যেত। প্রথম জাহাজটি ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ পর ছেড়ে যেত চট্টগ্রাম বন্দর। প্রথম ট্রিপে যাওয়ার জন্য হজযাত্রীদের অনেকেই ঈদুল ফিতরের পরপরই পাহাড়তলীর হজ ক্যাম্পে চলে আসতেন। জাহাজপ্রতি প্রায় ৬৫০ জন করে দুটি জাহাজের প্রথম ট্রিপে প্রায় ১ হাজার ৩০০ হজযাত্রী জেদ্দায় যেতে পারতেন। সরকারি ব্যবস্থাপনার প্রথম বছর, অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জেদ্দায় গিয়েছিলেন মোট ৩ হাজার ৮৯৫ জন হজযাত্রী। দূরদূরান্তের হজযাত্রীদের চট্টগ্রামে আসার সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের টিকিট ইস্যু করা হতো। হজ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হজযাত্রী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের ভিড়ে উৎসবের নগরী হয়ে উঠত চট্টগ্রাম।
প্রথম দিকে ব্রিটিশ মালিকানাধীন ‘এম্পায়ার অরওয়েল’, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘সারধানা’, বোম্বেভিত্তিক মোগল শিপিং লাইনসের ‘ইসলামি’ ও ‘মুহাম্মদি’ জাহাজগুলোকে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য ভাড়া করা হতো। চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দর থেকে হজযাত্রী নিয়ে জেদ্দায় আসা-যাওয়া করত জাহাজগুলো। পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সাল থেকে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের প্রতিষ্ঠান প্যান ইসলামিক স্টিম শিপ কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন সাফিনা-ই-আরব ১ ও ২, সাফিনা-ই-মুরাদ, সাফিনা-ই-হাজ্জাজ, সাফিনা-ই-আবিদ নামের জাহাজগুলো হজযাত্রী পরিবহন করত। এ ছাড়া এমভি শামস নামের আরেকটি জাহাজ নিয়মিত চলাচল করত চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দরে। সাফিনা-ই-হাজ্জাজ জাহাজটি বেশ বড় ছিল, যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল প্রায় চার হাজার। হজ-পরবর্তী সময়ে জাহাজগুলোতে মালামাল পরিবহন করা হতো।
জাহাজের তৃতীয় শ্রেণি বা ডেকে ভ্রমণ করে হজ পালনে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ১ হাজার ৯১৯ টাকা ব্যয় ধার্য ছিল। এর মধ্যে জাহাজের তৃতীয় শ্রেণির ভাড়া ছিল ৯১৯ টাকা, অবশিষ্ট ১০০০ টাকা মক্কায় থাকা-খাওয়া, পরিবহন ও অন্যান্য ব্যয়। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণকারী হজযাত্রীদের নির্ধারিত ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা, প্রথম শ্রেণির হজযাত্রীদের জন্য ৭ হাজার টাকা। করাচি থেকে বিমানে হজযাত্রীদের ব্যয় ছিল ৬ হাজার টাকার বেশি।
বাংলার হজযাত্রীদের একটি বেশ পুরোনো বর্ণনা পাওয়া যায় আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত আইরিশ টাইমস পত্রিকায়। লেখক নরম্যান ফ্রিম্যান। প্রবন্ধের নাম ‘অ্যান আইরিশম্যানস ডায়েরি অন আ পিলগ্রিম শিপ টু জেদ্দা’। ফ্রিম্যানের লিখিত কাহিনিটি সম্ভবত ১৯৫৪ সালের। তখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ ‘সারধানা’য় চাকরি করতেন তিনি। তাঁরা সদ্য হজ পালন করা ১ হাজার ৫০০ হাজিকে জেদ্দা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার একটি কন্ট্র্যাক্ট পেয়েছিলেন।
তাঁদের কোম্পানির অন্যান্য জাহাজ আগে নিয়মিত হজযাত্রী পরিবহন করত। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে বিমান চলাচলের বিস্তৃতির কারণে জাহাজে হজযাত্রী পরিবহন একেবারেই কমে গিয়েছিল। এই কন্ট্র্যাক্ট পাওয়ার পর প্রথম তাঁরা জাহাজে একজন চিকিৎসক, তিনজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও তিনজন নার্সকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কারণ, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে হজ পালন করা, সেখানকার তীব্র গরম আবহাওয়া ও প্রচণ্ড ভিড়ে অনেক হাজি খুব দুর্বল ও অসুস্থ অবস্থায় থাকতে পারেন।
ভারতীয় ক্রুরা জাহাজের লোয়ার ডেকে হাজিদের মধ্যে যাঁরা দরিদ্র, তাঁদের থাকার জন্য বাংক, দড়ির ঝুলন্ত বিছানা ও কাঠের মেঝেতে ম্যাটের ব্যবস্থা করেছিলেন। হাজিদের আনার জন্য প্রস্তুত হয়ে করাচি থেকে জেদ্দা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল খালি জাহাজ।
জাহাজের আপার ডেকের সামনের অংশে ইউরোপীয় ক্রুরা টেবিল টেনিস খেলতেন। ভারত মহাসাগর পার হয়ে আরব সাগরে আসার পর জাহাজে কিছুটা রোলিং হতো, যেটা সামলানোর জন্য ক্যাপ্টেন ও ক্রুদের বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হতো। টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ক্রুরা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ ও খ্রিষ্টান। তাঁরা জাহাজে রোলিং হলে খেলাচ্ছলে যিশুখ্রিষ্টের নাম নিয়ে চিৎকার করে কথাবার্তা বলতেন, হাসাহাসি করতেন। বিষয়টি লক্ষ করে জেদ্দার কাছাকাছি পৌঁছে একদিন ক্যাপ্টেন ক্রুদের তাঁর কেবিনে ডেকে সভা করলেন। অভিভাবকের সুরে ক্রুদের জাহাজে হাজিরা ওঠার পর বাক্সংযমী হতে বলেছিলেন তিনি। তিনি তাঁদের জানিয়েছিলেন, মুসলিমরা যিশুখ্রিষ্টকে একজন নবী হিসেবে সম্মান করেন। সুতরাং হাজিদের সামনে কোনো রকমেই যিশুখ্রিষ্টের নাম নিয়ে কোনো ধরনের বাজে কথা বা শপথ উচ্চারণ করা যাবে না। ক্যাপ্টেনের উপদেশ মেনে নিয়েছিলেন ক্রুরা। তাঁরা জানতেন, এই হাজিরা পৃথিবীর দরিদ্রতম এলাকাগুলোর একটির বাসিন্দা। তাঁদের অনেক কষ্ট করে, এমনকি সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে হজের ব্যয় বহন করতে হয়েছে। আর একনিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাস ছাড়া কারও পক্ষে এই কষ্ট ও ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। এ জন্য হাজিদের প্রতি ক্রুদের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধাবোধ জেগেছিল।
কিন্তু জেদ্দা বন্দরে পৌঁছানোর পর তাঁরা দেখেছিলেন,সৌদি পুলিশের সদস্যরা সাদা কাপড় পরা হাজিদের বন্দরের এক স্থানে খোলা আকাশের নিচে তীব্র গরমের মধ্যে খোঁয়াড়ের পশুর মতো গাদাগাদি করে রেখেছেন। কিছুসংখ্যক হাজিকে অনেক দুর্বল, এমনকি কঙ্কালসার দেখাচ্ছিল। জাহাজের ক্রুদের ব্যথিত করেছিল এ দৃশ্য।
একসময় হাজিদের জাহাজে ওঠার জন্য গ্যাংওয়ে বা সিঁড়ি নামানো হলো। হাজিরা খুব ধীরে ধীরে জাহাজে উঠে আসছিলেন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে সাহায্যও করতে হয়েছিল অনেক হাজিকে। সবার জাহাজে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল। হাজিরা জাহাজে ওঠার কিছুক্ষণ পর গ্যাংওয়ে উঠিয়ে দীর্ঘ হর্ন বাজিয়ে সাদা রং করা জাহাজটি চট্টগ্রামের উদ্দেশে জেদ্দা বন্দর ত্যাগ করেছিল।
হাজিদের একজন ইমাম ছিলেন। প্রতিদিন নামাজের সময়ে তিনি জাহাজের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের লাউড স্পিকারে আজান দিতেন। জাহাজের সামনের দিকের ডেকে নামাজ পড়তেন তাঁরা। ডেকের ওই অংশে কাঠের মেঝের ওপর নামাজ পড়ার জন্য লাইন ধরে ম্যাট বা জায়নামাজ বিছানো থাকত। একটা কাঠের সাইন পোস্টে কাবার দিকনির্দেশ করা ছিল। জাহাজের সেকেন্ড অফিসারের দায়িত্ব ছিল জাহাজের দিক পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে সাইন পোস্টটি সঠিক দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। একদিন সেই সেকেন্ড অফিসার দিক ঠিক করতে ভুলে যাওয়ায় হাজিরা মক্কার পরিবর্তে সোমালিল্যান্ডের মোগাদিসুর দিকে ফিরে নামাজ পড়েছিলেন। অবশ্য সেকেন্ড অফিসার তাঁর এই ভুলের কথা পরে লেখক নরম্যানকে জানিয়েছিলেন, আর কাউকে বলেননি।
অপুষ্টিজনিত দুর্বলতা ও এর ফলে সৃষ্ট অসুখ হাজিদের কাবু করে ফেলেছিল। জাহাজের মেডিকেল স্টাফরা তাঁদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন হাজিদের। কিন্তু এরপরও চারজন হাজি মারা গিয়েছিলেন। তবে অন্যান্য নিয়মিত জাহাজের তুলনায় সংখ্যাটি অনেক কম। আরব সাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ তখন ভারত মহাসাগরে। ইমামের নেতৃত্বে জানাজা পড়ার পর মৃত হাজিদের তাঁদের ইহরামের কাপড়ের কাফন পরিয়ে এবং ক্যানভাসে মুড়ে তাতে ভারী সিসা লাগিয়ে ভারত মহাসাগরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার শেষে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর ক্লান্ত হাজিরা তাঁদের যৎসামান্য মালপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে নেমেছিলেন দেশের মাটিতে। যে কঠিন ও কষ্টকর পরিশ্রম তাঁরা করেছেন হজ পালন করতে গিয়ে, তা তাঁদের লেখক ও জাহাজের ক্রুদের কাছে এক অনন্য মর্যাদার আসনে বসিয়েছিল।
মুহাম্মদ সাঈদ হাসান শিকদারের পুণ্যপথের যাত্রীরা: হজ হজযাত্রী ও পথ বইটি কিনতে ভিজিট করুন: prothoma.com। দাম: ৬৫০ টাকা।