রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁকে নিয়ে বাঙালির অনিঃশেষ আবেগ। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণে, প্রত্যেক স্তরে নানাভাবে আমরা তাঁর স্পর্শ পাই, তাঁর মুখোমুখি হই। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে মিশে আছেন আমাদের অনুভবে, খুব ব্যক্তিক অনুভূতির মধ্য দিয়ে এ লেখায় ধরা পড়েছে সেই ছবি।
মোটামুটি আলাপ হলেই আমার চরিত্রের যে দিকটা লোকে টের পেয়ে যায়, তাকে বলা যায় ‘রবীন্দ্রফেনাটিজম’।
আজন্ম সম্পর্কের টান ছাড়া কঠিন। আক্ষরিক অর্থেই আমার অস্তিস্ত্বের সঙ্গে ঠাকুরমশাই মিশে আছেন। আমার ডাকনাম তরী। তিনিই রেখেছেন নামখানা—এমনটা ভাবতে আমার ভালো লাগে।
ওহ! রবিঠাকুরের খেয়াতরী!—আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতিতে এই কথাই আছে। দুই বোনের নাম জানতে চাওয়ার পর উত্তর শুনে, অনেকেই এমনটাই বলতেন। নামের সূত্রেই রবিকে বোধ হয় প্রথম চিনেছিলাম।
তারপর একদিন পারিবারিক গানের আসরে, সেজ মামার হারমোনিয়ামে, ‘রবি ঠাকুরের গানের’ অনুরোধে ‘আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে’–এর সুর উঠলে ভেবেছি, তিনি নিশ্চয়ই গায়ক হবেন কোনো। তাঁর গান থেকেই নাম দুটো রাখা হয়েছে তাহলে!
তারও কিছুকাল পর টিভিতে ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখেছি। যদিও মিনিকে চিনি আগে থেকেই। ‘টকেটিভ’ আমাকে মা প্রায়ই মিনি ডাকেন। মা বা বাবা কেউ একজন বলেছিলেন, এটা রবীন্দ্রনাথের সিনেমা।
আচ্ছা! উনি তাহলে সিনেমাও বানান!
তারপর স্কুলে ভর্তি হলাম। বাঁকে বাঁকে চলা ‘ছোট নদী’ ছিল ছড়ার বইতে। ‘চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা’ হলো প্রিয় লাইন। এ ঘর-ও ঘর ছুটতে ছুটতে সারা দিন আওড়াই। আমার কাছে এই প্রথম রবি ঠাকুর কবি হয়ে এলেন।
আলাপে আলাপে অনেকেই জানতে চান, রবির জন্য এত যে উতলা থাকি, তো শান্তিনিকেতনে বছরে কয়বার যাই? এই প্রশ্ন দমিয়ে দেয়। কী উত্তর দেব? একবারও যাইনি? নাকি প্রতিদিনই মনে মনে ওই লাল মাটির রাস্তাগুলো ধরে হেঁটে যাই, সেই কসুর স্বীকার করে নেব?
তারপর ‘শিশু ভোলানাথ’ হাতে এল। আরেকটু পর ‘গল্পগুচ্ছ’। গান গাওয়া বা সিনেমা বানানোর আগে সেটা যে লিখতে হয়, তা-ও জানলাম। লোডশেডিংয়ে বাগানে বসে বাড়ির ছোটরা সুরে-বেসুরে ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গাওয়া শিখলাম। রবি রয়েই গেলেন ছায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গে।
ঠাকুরের হয়ে ঝগড়াও তো কম করিনি! এখনো করছি। স্কুলে সহপাঠীর দল বহুবার তেড়ে এসে বলেছে, ‘ওই হিঁদুর ব্যাটা, দাড়িওয়ালা ঠাকুরই সাদাদের সাথে “ষড়যন্ত্র” করে নজরুলের নোবেল বাগিয়েছে!’ এমন শুনে কি আর চুপ করে বসে থাকা যায়?
আবার কখনো আমার নাম বলার পর প্রশ্নও শুনেছি, ‘তোমরা কি হিন্দু!’ সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি পরিচয়ের ক্ষেত্রেও রবিই অনুঘটক ছিলেন।
আলাপে আলাপে অনেকেই জানতে চান, রবির জন্য এত যে উতলা থাকি, তো শান্তিনিকেতনে বছরে কয়বার যাই? এই প্রশ্ন দমিয়ে দেয়। কী উত্তর দেব? একবারও যাইনি? নাকি প্রতিদিনই মনে মনে ওই লাল মাটির রাস্তাগুলো ধরে হেঁটে যাই, সেই কসুর স্বীকার করে নেব?
বহুবার সুযোগ পেয়েও, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চড়ে বসার কাজটা করা হয়নি আমার। আসলে মনকে তৈরি করতে পারিনি। তীর্থে যাওয়ার আগে স্থিতি আসতে হয় যে!
তবে র্যাডক্লিফ লাইনের ওপারে গেলে জোড়াসাঁকো অবধি যাওয়া হয়। কেঁদেকেটে ‘সিনক্রিয়েট’ করা হয় ওই দালানের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারি, আরও দূরে যেতে তৈরি হইনি এখনো; অথবা আরও কাছে যেতে।
তবে ‘অবসেসড’ প্রেমিকের মতো ও পাড়ার সব খবর রাখা চাই। কোন দিন শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে কী গান হলো, উত্তরায়ণে পারিজাত ফুটল কবে, কোপাইয়ের জল কতটুকুতে দাঁড়াল—সব খবরই মাথার ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে গুঁজে রাখি।
আমার দিনকার সব হট্টগোলের মধ্যে এভাবেই রবি ঠাকুর দাঁড়িয়েই থাকেন, ‘গানের ওপারে’; সুরে-বেসুরে।