আলাপচারিতাটি নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎকার। এটি নেওয়া হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি। তখন হুমায়ূন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে কেবল জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। সেই সময় নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায় এমন এক তরুণ লেখককে, যিনি সপ্রতিভ, রসিক আর আত্মবিশ্বাসী। আর এখানে হুমায়ূন ছাড়াও তাঁকে নিয়ে রয়েছে তাঁর মা আয়েশা ফয়েজ এবং স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের কথা। সব মিলিয়ে তখনকার হুমায়ূন আহমেদকে বুঝে নিতে এ এক অনবদ্য আয়োজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শাকুর মজিদ।
হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত নাটক ‘নির্বাসন’ দেখতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন লেখকের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয়, তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র (১৯৮০)। পরে খোঁজ নিয়ে শুনলাম, এ লেখকের আরও তিনটে উপন্যাস বেরিয়েছে—লেখক শিবির পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ আর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। সহজলভ্যতার সুবাদে বই তিনটি সঙ্গে সঙ্গে পড়ে নিতে আমার খুব একটা সময়ের প্রয়োজন হয়নি। এরপর ঈদসংখ্যা কিংবা আর কোনো কাগজে বেশ কিছুদিন তাঁর কোনো লেখা পড়িনি। বন্ধুরা অনেকে বলত যে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। নিজেও বিশ্বাস করেছি। এরপর হঠাৎ একদিন টেলিভিশনেই সম্ভবত ‘প্রথম প্রহরে’ শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক দেখলাম। কিন্তু তখনো সংশয় কাটেনি। সন্দেহ ছিল, ‘নন্দিত নরকে’রই সেই হুমায়ূন আহমেদ, নাকি অন্য কেউ? এরপর অবশ্য ঈদসংখ্যাগুলো খুলতেই চোখে পড়ত আমার অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত সেই ঔপন্যাসিকের নাম—দীর্ঘ সাত বছর পলিমার রসায়নে পিএইচডি নিয়েও যিনি নিজেকে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের এক অভিনব আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, যেটা কেবল তাঁর একারই। আর প্রকাশকদের অহর্নিশ চাহিদা আর পাঠক-পাঠিকার নিরঙ্কুশ ভালো লাগাই যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হয়, তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ।
‘দিশা’র পক্ষ থেকে ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম আমি আর বাবু তাঁর আজিমপুরের বাসভবনে। ছিমছাম মধ্যবিত্তের সাজানো-গোছানো ড্রয়িংরুম। মেঝের ওপর জলরং করছেন তাঁর ছোট বোন। স্বাগত জানালেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব (হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই)। প্রসন্ন মুখে হুমায়ূন আহমেদ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন ভাই, কী করতে পারি?
বললাম, আপনার ব্যক্তিগত জীবন দিয়েই শুরু করি?
(যেহেতু আগেই যোগাযোগ করে আগমনের উদ্দেশ্য নির্ধারিত ছিল।)
: আপত্তি নেই।
তিনিই জানালেন, ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে (মামার বাড়ি) তাঁর জন্ম। বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ (স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ), মা আয়েশা আক্তার (আয়েশা ফয়েজ)। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বড়। পুলিশ অফিসার বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছোটবেলাতেই অনেক জায়গা ভ্রমণ করেছেন। অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সিলেটের মীরাবাজারের কিশোরীমোহন পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সেরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যথাক্রমে বগুড়া জিলা স্কুল ও ঢাকা কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হন। [তাঁর ছোট ভাই কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের কাছ থেকে জানলাম, মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বোর্ড থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এ কথা অবশ্য না লেখার অনুরোধ করেছিলেন।] উচ্চমাধ্যমিক সেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন রসায়ন বিভাগে। বিজ্ঞান প্রিয় বিষয় বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসিতে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান (তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে জানা) পাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এরপর আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়নে ডক্টরেট করে এসে (১৯৮২ সালে) এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, বিদেশে থেকে না গিয়ে দেশে ফিরলেন কেন?
: ফিরলাম, যাতে আপনাদের জন্য ‘এইসব দিন রাত্রি’ লিখতে পারি। না ফিরলে কে লিখত?
প্রসঙ্গ পাল্টে লেখালেখি–সংক্রান্ত প্রশ্ন শুরু করলাম, লেখালেখির প্রতি অনুরাগ কখন থেকে?
: বানান করে করে প্রথম গল্পটি যেদিন পড়লাম, মনে হয় সেদিন থেকেই। তবে সুদূরে শৈশবের স্মৃতি মনে নেই। আজকে বলছি।
: প্রথম লেখা কীভাবে ছাপা হলো?
: ‘নন্দিত নরকে’ লেখা খাতাটি বন্ধু আনিস সাবেত ‘মুখপত্র’ পত্রিকার সম্পাদককে দিয়ে এলেন। সেটা ছাপা হলো। প্রথম লেখা ছাপানোর পেছনে কোনো মজার গল্প নেই। এরপর আহমদ ছফা প্রথম বইটির জন্য প্রকাশক জোগাড় করলেন। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানী।
: দ্বিতীয়টা (শঙ্খনীল কারাগার)?
: প্রকাশক চেয়ে নেন।
: ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’–এ পাত্র-পাত্রীদের নাম একই কেন?
: নতুন নাম খুঁজে পাইনি।
: ওই দুটোর খোকা চরিত্রের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিজীবনের কী সাদৃশ্য আছে?
: আমি বোধ হয় অত ভালো নই। তবে আমিও মাঝে মাঝে খোকার মতো হতে চাই। তা ছাড়া লেখকও খোকার মতো খানিকটা বোকা।
: এ দুটো উপন্যাসের প্লট কী করে পেয়েছেন?
: মনে নেই। তবে আমি আগে কখনো প্লট ভেবে লিখতে বসি না।
হুমায়ূন আহমেদ জানালেন, কোনো কিছু লেখার আগে কোনো দিনই তিনি প্লট সাজিয়ে লিখতে বসেন না। লিখতে লিখতেই পাত্র–পাত্রীরা এসে যায়, চরিত্র সৃষ্টি হয়, কাহিনি গড়ায়। লেখার জন্য কোনো রকম পরিবেশ কিংবা ‘মুড’-এর জন্য কোনো ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হয় না। চাপের মুখে একটানা সাত-আট ঘণ্টা লেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। তবে সাধারণত অবসর পেলেই লেখেন, আর পড়েন।
: নির্জনে লেখেন না?
: আমার একটা বড় বাড়ি হলে চেষ্টা করে দেখতাম।
: বড় বাড়ির জন্য ইচ্ছা হয় না?
: মাঝে মাঝে হয়।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পের পাত্র–পাত্রীরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাঁর মতে, মধ্যবিত্তদেরই তো ভালো করে দেখেছি। সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতায় এর বাইরে লিখব কীভাবে?
: কেন? উচ্চবিত্ত পরিবারের প্লটেও কিছু কিছু তো লিখলেন—যেমন ‘একা একা’?
: কিছু উচ্চবিত্তকেও দেখেছি।
: গল্প–উপন্যাস ছেড়ে নাটক লিখতে এলেন কখন?
: ১৯৭৪ সালে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটিকে মঞ্চনাটকে রূপ দিই। রেডিওর জন্য ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর বেতার নাট্যরূপ দিই ১৯৭৫-এ। টিভির জন্য প্রথম নাটক লিখি ‘প্রথম প্রহর’ ১৯৮০ সালে।
: কেন এলেন?
: টাকার জন্য।
নতুন লেখকদের জন্য আমার একটাই কথা, পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে, সব লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাতে ভাষার ওপর দখল আসবে। কোন লেখক কীভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে ‘ট্রিট’ করছেন, সেটাও পরিষ্কার হবে। আবার চোখ-কানও খোলা রাখা দরকার। যেমন কোন পেশার লোক কীভাবে কথা বলে, কীভাবে হাঁটে-চলে এসবও দেখতে হবে। তা ছাড়া কবিতা পড়া থাকলে বোধ হয় ভাষার প্রতি দখলটা তাড়াতাড়ি আসে।হুমায়ূন আহমেদ
এরপর কথা হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিন রাত্রি’ নিয়ে। জানালেন যে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের আগ্রহে এ সপ্তাহের একটি নাটককে বড় করে দেওয়া হলো। সিরিজ নাটকে। দর্শক হিসেবেও তাঁর কাছে নাটকটি উপভোগ্য ছিল। তবে মাঝে মাঝে মনে হতো যে রকম চেয়েছিলেন, সে রকম হচ্ছে না।
: এরপর সিরিজ নাটক লেখার ইচ্ছা আছে?
: আর্থিক ঝামেলায় পড়লে হয়তো লিখব।
: সিনেমার জন্য কাহিনি লেখার ইচ্ছা আছে?
: যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভালো ছবি করতে চায়, তাহলে লিখব।
হুমায়ূন আহমেদের একটা বৈশিষ্ট্য (কিংবা দোষ) যে তাঁর বেশির ভাগ কাহিনিতেই বিশেষ কয়েকটি নাম বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। অথচ প্রতিটি চরিত্রই স্বতন্ত্র। এটা কেন হয়, জানতে চাইলেই সহজ উত্তর দেন, ‘নতুন নাম খুঁজে পাই না।’ আমার বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় কোনো একটা কিছুকে লুকোনোর জন্যই এগিয়ে যাওয়ার মতো উত্তর। পাশে বসা তাঁর স্ত্রী (গুলতেকিন) জানালেন, ‘ও উপন্যাস লিখতে বসে আমাকে নাম জিজ্ঞেস করে। আমি সাথে সাথে বলতে না পারলে বলে, আমি তাহলে আগের নামটিই লিখি? এভাবেই একই নাম বারবার আসে, আসলে অন্য কিছু নয়।’
: আচ্ছা, ‘নীলু’কে আপনি চেনেন?
: না।
: এ নামটা কেন বারবার আপনার গল্পে-উপন্যাসে আসে?
: নামটা সুন্দর। [এ জায়গায় তাঁর স্ত্রী জানালেন, তাঁরা যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন পাশের বাসায় এক শ্রীলঙ্কান পরিবার থাকত, ওই বাসায় একটি মেয়ের নাম ছিল নীলু। হুমায়ূন আহমেদ হাত দিয়ে দেখালেন, এতটুকু (চার-পাঁচ বছরের) মেয়ে]।
: নীলগঞ্জই–বা কেন আসে?
: সম্ভবত নীল থেকে।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এমন অনেক উপন্যাসও লিখেছেন, যেগুলোর শিরোনামে গল্প বেরিয়েছিল অনেক আগে। অথচ উপন্যাসকেও যে গল্পের পরিবর্ধিত রূপ বলা যাবে, এমনও হয় না। তবে কেন? হুমায়ূন আহমেদের সেই একই জবাব, নতুন নাম খুঁজে পান না। তাঁর মতে, নাম দেওয়ার জন্যেই দেওয়া। [তাহলে কি নামকরণের সার্থকতার কথা তিনি কখনো ভাবেন না?]
: আচ্ছা, আপনি এত বেশি লেখার সময় কখনো আপনার লেখার মান সম্পর্কে সন্দিহান হন না?
: হ্যাঁ, আমি প্রচুর লিখি। আবার না লিখেও থাকতে পারি। প্রথম চারটি উপন্যাস প্রকাশের পর আমি সাত বছর কিছুই লিখিনি। আবার হয়তো একটা সময় আসবে যখন কিছুই লিখব না।
: একঘেয়ে ঠেকায় একসময় যদি কেউ আপনার লেখা না পড়ে, তখন আপনি কী করবেন?
: কী আর করব? মন খারাপ করা ছাড়া কিছু করার আছে কি?
: আচ্ছা, আপনি লেখেন কেন?
: বলা মুশকিল, তবে লিখতে ভালো লাগে।
: অমরত্ব পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশায়ও কি আপনি লেখেন?
: না। অমরত্ব মহাপুরুষদের জন্য। আমি মহাপুরুষ নই, সাধারণ মানুষ।
: আপনি কি নিজেকে কখনো জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বলে মনে করেন?
: যখন জানলাম আমার একই বইয়ের প্রথম মুদ্রণ এক মাসে বিক্রি হয়ে গেছে। [তবে এটা হালকা ধরনের ভৌতিক উপন্যাস, গর্ব করার মতো কোনো রচনা নয়।]
: নিজের কাছে আপনার পরিচয় একজন লেখক, নাকি শিক্ষক?
: লেখক।
: উপন্যাসের শিরোনামে রবীন্দ্র-জীবনানন্দ থেকে ধার করেন কেন?
: এঁদের কাছ থেকে ধার করতে আমার লজ্জা লাগে না বলেই।
: যদি বলা হয় ‘তোমাকে’ প্রেমের উপন্যাস [কভারে লেখা আছে] হিসেবে সার্থক নয়, আপনি কী বলবেন?
: কিছু বলব না।
: আচ্ছা, একটু অন্য ধরনের প্রশ্ন, প্রেম ছাড়া ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব হতে পারে?
: পারবে না কেন?
: দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ের মধ্যে যে রকম বন্ধুত্ব হয়, একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যেও কি একই রকম বন্ধুত্ব হতে পারে?
: তা অবশ্য নয়। কারণ এখানে ফ্রয়েডীয় কিছু ব্যাপারস্যাপার আছে।
: তাহলে যে বললেন…
: আসলে ব্যাপারটা একটু জটিল। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।
: আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কোনটা?
: তিনটি উপন্যাস লিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়াটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা। না, না, এটা লিখবেন না। তাহলে লোকজন মনে করতে পারে, আমার গর্ব হচ্ছে। লিখুন গুলতেকিন (স্ত্রী)-এর সঙ্গে পরিচয়।
: দুঃখজনক ঘটনা?
: বাবার মৃত্যু।
এরপর কিছুক্ষণ আপ্যায়ন পর্ব সেরে আবার শুরু হলো। সাহিত্যবিষয়ক কিছু কথাবার্তা শুরু হলো।
: বাংলা সাহিত্যে কার কার লেখা আপনার প্রিয়?
: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিমল কর, সতীনাথ ভাদুড়ি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
: শঙ্করকে কেমন লাগে?
: ভালো। ওঁর প্রথম দিকের কিছু উপন্যাস খুবই ভালো।
: বাংলা সাহিত্য ছাড়া বিদেশি কোনো সাহিত্য পড়েন কি? প্রিয় কে?
: একসময় প্রচুর পড়েছি। এখনো পড়ি। প্রিয় হচ্ছেন জন স্টেইন-বেক। রেমাক।
: বড় গল্প আর উপন্যাসের মধ্যে আপনার মতে, পার্থক্য কোথায়?
: জানি না।
বানান করে করে প্রথম গল্পটি যেদিন পড়লাম, মনে হয় সেদিন থেকেই। তবে সুদূরে শৈশবের স্মৃতি মনে নেই। আজকে বলছি।হুমায়ূন আহমেদ
: ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর মুখবন্ধে ‘নন্দিত নরকে’ ‘গল্প’ বলে উল্লেখ করলেন, অথচ এটা ‘উপন্যাস’ হিসেবে বিবেচিত এবং পুরস্কৃত। তাহলে ‘গল্প’ বলেন কেন?
: আমাকে এসব জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। এ–জাতীয় প্রশ্ন করা উচিত সাহিত্যের ছাত্রকে। আমি একবার একটি বইয়ের সমালোচনা লিখেছিলাম ‘রোববার’ পত্রিকায়। পরে সবাই সেটাকে গল্প বলতে লাগল এবং আমিও আমার গল্পগ্রন্থে (‘আনন্দ বেদনার কাব্য’) ঢুকিয়ে দিলাম।
: আপনাকে যদি উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে বলা হয় তাহলে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
: কোনোভাবেই করব না। আমি যদি জানতাম উপন্যাস কী, তাহলে তো নিজেই লিখতাম, যা লিখেছি তার কোনোটিই কি সত্যিকার অর্থে উপন্যাস হয়েছে?
: ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার কোনো পরিকল্পনা আছে?
: হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের ওপর বড় ক্যানভাসে একটা উপন্যাস লিখব; এবং এ জন্য আমি পড়াশোনাও করছি।
: বঙ্কিম, শরৎ থেকে বর্তমান কালের উপন্যাসগুলোর ধারা অনেকখানি পরিবর্তিত। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
: সময়ের প্রভাব। উপন্যাস তো সময়েরই ছবি। সময় বদলালে উপন্যাস বদলাবে।
: উপন্যাস সৃষ্টিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা কতটুকু প্রয়োজনীয় বলে আপনি মনে করেন?
: অনেকখানি।
: একটা সার্থক উপন্যাসে কী কী গুণ থাকা আবশ্যক?
: একটা সার্থক উপন্যাসে সমাজ ও কাল উঠে আসবে। লেখক একটি দর্শন দিতে চেষ্টা করবেন। উপন্যাস মানে তো শুধু গল্প নয়। গল্পের বাইরেও কিছু।
: সুন্দর গল্পের জন্য সুন্দর কাহিনিই কি অত্যাবশ্যকীয়?
: না।
: আচ্ছা, সাহিত্য দিয়ে সমাজ সংস্কার কীভাবে করা যায়?
: জানি না। আমি নিজে সমাজ সংস্কারের কথা ভেবে কিছু লিখি না।
: যখন লেখেন, তখন আপনি কোন শ্রেণির পাঠকের কথা বিবেচনা করেন?
: সায়েন্স ফিকশনগুলো কম বয়সী পাঠক-পাঠিকাদের জন্য লেখা। অন্য সব যখন লিখি তখন কোন শ্রেণির পাঠকদের জন্য লিখছি, তা মনে থাকে না। যাদের ইচ্ছা হয় পড়বে।
: আপনার লেখায় রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য দেখা যায় না কেন?
: এখন থেকে দেখতে পারবেন।
: তার মানে রাজনীতি আসবে?
: হুঁ।
মাথা নাড়েন হুমায়ূন আহমেদ।
: এটা কী ধরনের হতে পারে?
: আগেভাগে কিছু বলতে চাই না।
: এত দিন না আসার কারণ?
: এত দিন আমার ঝোঁক ছিল গল্প বলার দিকে। যে সমাজ, যে কাল এই গল্প তৈরি করেছে, তাকে অবহেলা করেছি। মনে হয়েছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখই সব।
: আপনি কি মনে করেন যে প্রতিটি মানুষেরই রাজনীতি করা উচিত?
: অফ কোর্স। ইটস এ পার্ট অব আওয়ার লাইফ।
: ব্যক্তিগতভাবে আপনি কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী?
: আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান।
: ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দবিষয়ক কথাও হলো কিছুটা।
: বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের মধ্যে কে আপনার প্রিয়?
: ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার।
: প্রিয় ঔপন্যাসিক?
: সৈয়দ হক, শওকত ওসমান, শওকত আলী।
: কবি?
: শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ।
: নাট্যকার?
: হুমায়ূন আহমেদ।
: কবিতা?
: জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে একদিন’।
: নাটক?
: ‘নৃপতি’ (নিজের লেখা, ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মঞ্চস্থ হবে)।
: বাবা আপনার উপন্যাসে আসেনি?
: বাবা আমার গল্প-উপন্যাসে অনেকবার, অনেকভাবে এসেছেন (শঙ্খনীল কারাগার)।
: সে হিসাবে মা কিন্তু কম আসেন…
: সম্ভবত আপনার কথা সত্যি নয়।
সবশেষে হুমায়ূন আহমেদকে প্রশ্ন করেছিলাম, নতুন লেখকদের জন্য আপনি কিছু বলুন।
: নতুন লেখকদের জন্য আমার একটাই কথা, পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে, সব লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাতে ভাষার ওপর দখল আসবে। কোন লেখক কীভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে ‘ট্রিট’ করছেন, সেটাও পরিষ্কার হবে। আবার চোখ-কানও খোলা রাখা দরকার। যেমন কোন পেশার লোক কীভাবে কথা বলে, কীভাবে হাঁটে-চলে, এসবও দেখতে হবে। তা ছাড়া কবিতা পড়া থাকলে বোধ হয় ভাষার প্রতি দখলটা তাড়াতাড়ি আসে।
আমরা হুমায়ূন আহমেদকে ছেড়ে তাঁর মার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। মাকে পাঠিয়ে নিজে ভেতরে গেলেন। তাঁর মা মহিলা সাদা কাপড়ের লাল ডোরার শাড়ি পরে আমাদের পাশে এসে বসেন। গল্প শুরু করলাম মিসেস আয়েশা আক্তারের (আয়েশা ফয়েজ) সঙ্গে।
: আপনার ছেলেমেয়েরা কে কী করেন?
: বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ। মেজ ছেলে জাফর ইকবাল, আমেরিকায় পোস্টডক্টরেট করছে, সে বাচ্চাদের জন্য লেখে, তিনটা বই বেরিয়েছে। ছোট আহসান হাবীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে এমএসসি পাস করেছে এবার। সে আবার ভালো কার্টুন আঁকে, ‘উন্মাদ’ না কী যে কার্টুন পত্রিকা, এটার সহকারী সম্পাদক সে। বড় মেয়ে সুফিয়া হায়দার, পিরোজপুর মহিলা কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা, ওর হাজব্যান্ড উকিল। মেজ মেয়ে বিএসসি পাস করে ঢাকায় আছে, ওর হাজব্যান্ড মেজর। ছোট মেয়ে রোকসানা আহমেদও খুব ভালো ছবি আঁকে, শংকর পুরস্কার পেয়েছে। ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে, ডিফ অ্যান্ড ডাম্প স্কুলে, ও আবার বোবা, কথা বলতে পারে না।
: আপনার সব ছেলেমেয়েই প্রতিভাবান এবং সমাজে সুপরিচিত। এ জন্য আপনার কি গর্ব হয়?
: অবশ্যই।
: এঁদের এ সাফল্যের পেছনে আপনার কী অবদান আছে বলে মনে করেন?
: না, আমার কোনো অবদান নেই। ওরাই ওদের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে।
: আচ্ছা, আপনার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ ছোটবেলায় কেমন ছিলেন?
: ও খুব চালাক ছিল। কথা বলত বুড়ো লোকের মতো এবং সে বুঝতও অনেক বেশি। তা ছাড়া লেখাপড়ায় ও অত্যন্ত ভালো ছিল। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছিল, ম্যাট্রিকে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছিল। ওর বাবা (শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ) ওর সব কাগজপত্র জমিয়ে রাখতেন ফাইলের ভেতর। যে কাগজগুলোতে ওর ছবি উঠেছিল, ওর নাম উঠেছিল সে কাগজগুলো আমার কাছে এখনো আছে। ওর বাবা বলতেন, ওগুলো আলমারির মধ্যে যত্ন করে রেখো, তোমার ছেলে একদিন খুব বিখ্যাত হবে, তখন কাগজের লোকরা এসব খুঁজতে আসবে।
এক রাতে সবাই যখন শুয়ে পড়েছে, তখন তার বাবা তাকে ডাকলেন। খুব ভয়ে ভয়ে সে গেল। আমিও তখন ছিলাম। তার বাপ পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা যত্ন করে রেখে দিস। তুই একদিন খুব নামকরা লেখক হবি।’হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ
: হুমায়ূন আহমেদ যে একদিন লেখকই হবেন, এটা আপনারা বুঝতে পেরেছিলেন?
: ওর বাবা বুঝেছিলেন।
: কীভাবে?
: ও তখন ঢাকায় চলে এসেছে। মহসীন হলের ছাত্র। একবার একটা উপন্যাস লিখে আনল। সম্ভবত ‘শঙ্খনীল কারাগার’। বাসার সবাই আমরা পড়লাম। কিন্তু তার বাবাকে পড়ানোর সাহস তার ছিল না। একদিন আমাকে দিয়ে সে লেখাটি তার বাবার কাছে পাঠাল। তারপর আমার পাশ দিয়ে শুধু ঘুরঘুর করে অর্থাৎ জানতে চায়, তার বাপ এটা পড়ে কী বললেন। এ রকম দু-এক দিন যাবার পর এক রাতে সবাই যখন শুয়ে পড়েছে, তখন তার বাবা তাকে ডাকলেন। খুব ভয়ে ভয়ে সে গেল। আমিও তখন ছিলাম। তার বাপ পাণ্ডুলিপিটা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা যত্ন করে রেখে দিস। তুই একদিন খুব নামকরা লেখক হবি।’
: তাঁর বাবা কি তাঁর প্রকাশিত কোনো লেখা পড়েছেন?
: না, উনি তো একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হলেন।
: হুমায়ূন আহমেদের লেখা আপনার কেমন লাগে?
: খুব ভালো। মনেই হয় না যে এটা ও লিখেছে। মনে হয় অন্য কেউ সম্ভবত।
: কোনোটা খারাপ লাগেনি?
: না।
: আচ্ছা, তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটকের ‘মা’–এর চরিত্রে আপনার চরিত্র কিংবা তার খণ্ডাংশ এসেছে বলে আপনার মনে হয়?
: কী জানি (হেসে)। আমার চরিত্র তো আমি বুঝতে পারি না, তবে ‘এইসব দিন রাত্রি’র সেই মা নাকি আমি—তো এটা অনেকেই বলেন। আমার তো মনে হয় না।
: আপনার চোখে হুমায়ূন আহমেদকে কী মনে হয়, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নাকি লেখক?
: লেখকটাই বেশি।
: তাঁর চরিত্রে একটা দোষের কথা বলুন।
: সে রাগে খুব বেশি। আবার রাগ থাকেও না বেশি সময়।
: তাঁর ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলুন।
: আমরা তখন সিলেট মীরাবাজারে ছিলাম। আমাদের বাসার পাশেই ছিল গরুর ঘর। একদিন রাতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে কি, মা, শুনে যাও, গরুরা কথা বলে। সে কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে বলে যে গরুর কথা সে শোনে, এটা ওর পাগলামি, না অন্য কিছু, কিছুই বোঝা যায় না।
: আপনার সব ছেলেমেয়ের ওপর কি আপনি সন্তুষ্ট?
: অবশ্যই।
স্ত্রীর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদই সুযোগ দিলেন কথা বলার। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন আহমেদ (এখন গুলতেকিন খান)। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ার পর ক্লাস এইটের ছাত্রী গুলতেকিন আহমেদ একটা চিঠি লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ প্রভাষক হুমায়ূন আহমেদের কাছে। এরপর দেখা হয়। যোগাযোগ বাড়ে। ঘনিষ্ঠতার পরিণতিতে গুলতেকিন ১৯৭৬ সালে এসএসসি পাস করার পর হুমায়ূন আহমেদের ঘরনি হয়ে আসেন। তিন মেয়ে নোভা, শিলা আর বিপাশার মা—নিজেই মেয়েদের দায়িত্ব নেন। এদের নিয়ে তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। যে যা হতে পারে হবে।
তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা, আপনি বিয়ের আগে যখন হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরক’ কিংবা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়লেন, তখন কি এই দুই উপন্যাসকে লেখকের আত্মজীবনীমূলক কিছু বলে মনে করতেন?
: কিছুটা মনে হতো।
: নন্দিত নরকের খোকা নিভৃতভাবে একটা মেয়েকে ভালোবাসত। সেই ভালোবাসা সে কোনো দিন মেয়েটিকে জানানোর সাহস পায়নি। তার ভালোবাসা আজীবন নিভৃতেই থেকে গেল। আচ্ছা, সেই খোকার জন্য কি আপনার দুঃখ হতো? (হুমায়ূন আহমেদ তখন মিটমিট করে হাসছেন)
: তা তো হতো।
: বিয়ের পরও যদি কোনো নায়িকার প্রতি লেখকের অতিরিক্ত অনুভূতি দেখা দিত, আপনি কী করতেন?
: ওটা তো গল্পই। আর সত্যি সত্যি সে কিছু করলে তো খারাপ লাগতই।
: আচ্ছা, তাঁর (হুমায়ূন আহমেদের) কোনো এক গল্প-উপন্যাসে আপনার কোনো চরিত্র এসেছিল?
: খণ্ড খণ্ড এসেছে, পুরোপুরিভাবে নয়। [হুমায়ূন আহমেদ জবাব দিলেন, ‘এইসব দিন রাত্রি’তে নীলুর চরিত্রের সঙ্গে ওর অনেক মিল ছিল]
: আচ্ছা, লেখালেখির ব্যাপারে আপনি হুমায়ূন আহমেদকে কীভাবে সহযোগিতা করেন?
: কখনো চা বানিয়ে দিই। তা ছাড়া ও লেখার সময় প্রচুর বানান ভুল করে, সেগুলোও ঠিক করে দিই।
: তাঁকে নিয়ে আপনার গর্ব হয়?
: কিছুটা তো হয়ই।
: আচ্ছা, মনে করুন একদিন এমন হলো যে তাঁর লেখা কেউ আর পড়ছে না, তখন আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে?
: তখন যদি ও লেখা ছেড়ে সংসারের দিকে কিছুটা মন দেয়, তাহলে ভালোই হবে।
: একজন পাঠক হিসেবে তাঁর লেখা আপনার কেমন লাগে?
: ওর লেখা আমার সব সময়ই ভালো লাগে।
হুমায়ূন আহমেদ প্রচুর চা খান। দুবার চা খাওয়ালেন আমাদের। বিদায় নিয়ে আসার সময় বাবুকে আর আমাকে তাঁর দুটো সর্বশেষ প্রকাশিত বই (‘প্রথম প্রহরে’) উপহার দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেও কথা হলো কিছুটা। বললেন, উপন্যাস লেখার ব্যাপারে তিনি যেসব এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন, এর সব কটিই সার্থক। এই টেকনিক আবার সবাই ধরতে পারবেন না। যাঁরা উপন্যাস লেখেন, কেবল তাঁরাই পারবেন।
হুমায়ূন আহমেদ এখন ‘এইসব দিন রাত্রি’ নিয়ে উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত। প্রতিদিন ২০ পৃষ্ঠা লেখেন আর ২০ পৃষ্ঠা প্রেসে দেন।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা রাস্তা দুদিকে চলে গেল। অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে আমাদের বিদায় দিয়ে অনিন্দ্য প্রকাশনীর পথ ধরলেন তিনি। আমরাও রিকশা খুঁজতে ব্যস্ত হলাম। চোখের আড়াল হতে হতে হুমায়ূন আহমেদকে ভালো করে আবার দেখে নিলাম। আমার ভেতরে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বাজছে, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী?’
এতক্ষণে লেখক শিবির পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার আর ওসমানী স্মৃতি পদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় (বর্তমানে) ঔপন্যাসিক অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার ঘটনাটা আমার এবং হুমায়ূন—দুজনের জীবনের প্রধান দুই বড় ঘটনা। আমার জন্য বড় ঘটনা এই ছিল যে মাত্র তিনটি বই (‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’) পড়ে আমি এই লেখকের অনুরাগী পাঠক হয়ে যাই। লেখক সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়ি। পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর লেখা ‘প্রথম প্রহরে’ একক নাটক এবং ‘এইসব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিক দেখে আমি আরও আপ্লুত হই। তখন আমি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র।
কলেজ থেকে বেরিয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হই বুয়েটে এবং এক অখ্যাত মাসিক পত্রিকায় আমার লেখা একটি গল্পের বিল নিতে গিয়ে সম্পাদকের কাছে শুনি যে তাঁরা নতুন লেখকের গল্প–কবিতার জন্য কোনো বিল দেন না, ফিচার বা সাক্ষাৎকারের জন্য বিল দেন।
তখন সে পত্রিকার সম্পাদককে আমি বলি, আমি কি হুমায়ূন আহমেদের একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারি?
বলার কথা হলো, তখনো ওই পত্রিকার সম্পাদক সাহেব হুমায়ূন আহমেদকে চিনতেন না, তিনি কেবল জানতেন, ‘এইসব দিন রাত্রি’ নাটকটির কথা। এটা বলাতে তিনি রাজি হলেন।
অতঃপর আমি ওই পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের কাছে হাজির হলাম, মূলত এই লেখক সম্পর্কে আমার কৌতূহল মেটানোর জন্য।
দুই দিন কথা বলে ১৮ পাতার ফুলস্কেপ কাগজে লিখে সাক্ষাৎকারটি যখন পত্রিকা অফিসে নিয়ে গেলাম, সম্পাদক তা ছোট করে মুদ্রিত দুই পাতার উপযোগী করে নিয়ে আসতে বললেন আমাকে।
সাক্ষাৎকারটি আমি ফেরত নিয়ে এলাম। এর মধ্যে পল্টনের ফুটপাতে সাজানো পত্রিকার স্টলে আরেকটি নতুন সাহিত্যধর্মী পত্রিকার দেখা পেলাম। ৫ টাকায় ম্যাগাজিনটি কিনে সেই পত্রিকার সম্পাদকের কাছে এই লেখা নিয়ে গেলাম।
তার পরের ঘটনা হলো, ১৯৮৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পাক্ষিক ‘দিশা’ পত্রিকায় এটি প্রচ্ছদ কাহিনি হিসেবে ছাপা হলো। আমি ৬০০ টাকা বিল পেলাম।
এ ঘটনার পর থেকে এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে লিখতে একসময় আমি ‘সাংবাদিক’ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে থাকলাম। এরপর বুয়েটে পড়াকালে আমি নানা রকমের সাংবাদিকতা করে জীবন ধারণ করতাম।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর খোঁজাখুঁজি করে জানা গেল যে এটাই এই লেখকের প্রথম সাক্ষাৎকার, যেখানে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছিলেন। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন হুমায়ূন আহমেদের টেলিভিশন নাটক নিয়ে কেবল টুকরো টুকরো প্রতিবেদন হতে শুরু করেছে। কিন্তু তাঁর স্বতন্ত্র সাক্ষাৎকার হিসেবে এটিই প্রথম। তখন আমি শুধু যে হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, এমন নয়, বরং তাঁর মা আয়েশা ফয়েজ ও সেই সময়কার স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের (এখন খান) চোখে হুমায়ূন আহমেদ কেমন, তা–ও ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম।
প্রথম আলোর পাঠকের জন্য আজ সেই পুরো সাক্ষাৎকারটি এখানে উন্মুক্ত করলাম। বলা ভালো যে সাক্ষাৎকারটি আমার ২১ বছর বয়সে নেওয়া। তবে এখানে আবার প্রকাশের সময় লেখাটির মৌলিকত্ব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বড় কোনো সম্পাদনা না করে এটি আগের রূপেই রাখা হলো। অবশ্য বানানের ক্ষেত্রে সমকালীন বানানরীতি অনুসৃত হয়েছে।