গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম, বইমেলা, পুরস্কার, গবেষণাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
বাংলা একাডেমিকে আগে আপনি বাইরে থেকে দেখতেন। আর গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক হিসেবে এখন দেখছেন ভেতর থেকে। দুই দেখার মধ্যে ফারাক কোথায়?
মোহাম্মদ আজম: প্রথমে একটা মিলের কথা বলি। আমি বহুদিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব একটা উৎপাদনশীল না হওয়ায়, বিশেষত বাংলা ভাষায় বিদ্যাচর্চার ধারাটা শুকিয়ে আসায় কোনো একাডেমির পক্ষে মানসম্মত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। এখানে কাজ শুরু করার পরও আমার সে ধারণায় কোনো বদল ঘটেনি।
এবার পার্থক্যের কথা বলি। বাইরে থেকে আমি যতটা মনে করতাম, ভেতরে এসে দেখতে পাচ্ছি, বাংলা একাডেমি তার চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম প্রতিষ্ঠান। জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখার সম্ভাবনা এখানে যথেষ্ট আছে। বিগত বছরগুলোয় সে কাজ যে হয়নি, তা নয়। তবে আরও অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ আছে।
রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই মানুষ এখন একধরনের সংস্কার প্রত্যাশা করছে। বাংলা একাডেমিতেও কিছু বনিয়াদ সংস্কার প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করছেন। এ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আজম: কিছু প্রশাসনিক সংস্কার দরকার। বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে সমন্বয় ও পার্থক্যের ব্যাপারগুলোয় নতুন ব্যবস্থাপনার সুযোগ আছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য, অর্থাৎ পূর্বতন আইন সংশোধনের জন্য পার্লামেন্টের প্রয়োজন হবে। নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে সে ধরনের পরিবর্তনের কথা ভাবা যেতে পারে।
তবে বিদ্যমান কাঠামো এমন নয় যে এর মধ্যে বড় ধরনের কাজ করার সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে করোনাকালের পরে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একাডেমিকে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। যদ্দুর বুঝতে পারি, এর ফলে একাডেমির নিয়মিত কাজে যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটেছে। এমতাবস্থায় প্রাত্যহিক কাজকর্মে যদি স্বাভাবিক গতি অক্ষুণ্ন রাখা যায়, আর প্রয়োজনীয় খাতে সরকারি অর্থ-বরাদ্দের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেও প্রভাবশালী কাজ করা সম্ভব। গত দুই মাসে বিভিন্নজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলোর প্রায় নব্বই ভাগ একাডেমির প্রাত্যহিক স্বাভাবিক কাজের মধ্যে পড়ে। কাজেই কাঠামোগত সংস্কারের পরিকল্পনা করার পাশাপাশি স্বাভাবিক কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারলে একাডেমির কাজ জনসমাজে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, বাংলা একাডেমিতে রাষ্ট্রীয় বা দলীয় নিয়ন্ত্রণ আর হবে না। কিন্তু অতীতে চাকরি, পুরস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে যেভাবে দলীয় প্রভাব কাজ করেছে, সে ক্ষেত্রে কীভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করা সম্ভব?
আজম: দলীয় প্রভাব বাংলা একাডেমির জন্য নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর হয়েছে। আমি জেনেছি, দলীয় বিবেচনায় কেবল নতুন নতুন লোকের জন্য সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে এমন নয়, পুরোনো যাঁরা বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও দলীয় বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। বই-পুস্তক প্রকাশ এবং অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই যথাবিহিত পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। বাংলা একাডেমির কাজের ধরন এমন যে, এ ধরনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসলে নতুন করে কিছু করার থাকে না। যেমন কোনো প্রকল্প যদি শেষ হয়ে যায়, কিংবা কোনো বই যদি প্রকাশিত হয়ে যায়, তাহলে খুব একটা কিছু করার সুযোগ থাকে না।
তবে যেগুলো সম্পন্ন হয়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বস্তুত এর অধিকাংশই আমি জয়েন করার আগেই করা হয়েছে। আমরা বাদ পড়াদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি। যেসব বই বা প্রকল্প আগে দলীয় বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোকে বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, এখন থেকে সিদ্ধান্তগুলো একাডেমির আইন, নীতি ও দরকারের ভিত্তিতে নেওয়া। ‘বঞ্চিত’দের ব্যাপারে মনোযোগ রেখে কাঠামোগত দরকারকে অগ্রাধিকার দিতে পারলে খুব কম সময়ের মধ্যে আগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলে আশা রাখি।
গবেষণা এ প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্র। তবে অনেক বছরই এখানে গবেষণার ক্ষেত্রটি অবহেলিত। অনেকে এ-ও বলেন, একাডেমি বর্তমানে বিভিন্ন সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যু-স্মরণ, তথা আনুষ্ঠানিকতার ঘেরাটোপে যতটা আবদ্ধ, মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে উৎসাহী নয়। আপনি নিজে একজন গবেষক। বাংলা একাডোমির গবেষণা কার্যক্রমে কীভাবে প্রাণসঞ্চার করবেন?
আজম: প্রথমে বলে নিই, এ ধারণার মধ্যে একটা বিভ্রান্তি আছে। গবেষণা করা একাডেমির প্রধান কাজ নয়, যে অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করে থাকে। একাডেমি জাতীয় কিছু বিষয়ে সামষ্টিক পাণ্ডিত্যের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। যেমন অভিধান প্রণয়ন করা, গবেষণাগ্রন্থ প্রণয়ন করা, প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া ইত্যাদি।
তবে সাধারণভাবে আপনার বলা কথাটা ঠিক। গবেষণা না হলেও একাডেমির কাজ নিশ্চয়ই গবেষণামূলক। সে কাজে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা এ ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাপকভাবে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। যেমন পাঠ্যপুস্তক ও অনুবাদমূলক গ্রন্থ প্রণয়নের বড় উদ্যোগ আসন্ন।
যে কাজ আমরা ইতিমধ্যে করেছি, তার কথাও বলি। সাক্ষাৎকারটি যখন পাঠকেরা পড়বেন, তার আগেই একাডেমির পক্ষ থেকে গবেষণাবৃত্তির এক বিশদ বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নে আমরা ৫০টি গবেষণা-প্রবন্ধের জন্য বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেছি। সঙ্গে ১০টি বার্ষিক গবেষণাবৃত্তির জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। এ উদ্যোগের সাফল্যের নিরিখে সরকারের কাছে এ ধরনের বৃত্তির জন্য আরও বড় বরাদ্দ চাইব আমরা। আশা করি, এতে গবেষণাকর্মকে সহায়তা দেওয়ার জন্য একাডেমির ভূমিকা দেশের স্বাধীন গবেষণা খাতে এবং বাংলায় বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করবে।
সামনেই ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এবারের বইমেলায় গুণগত কী পরিবর্তন হবে?
আজম: বইমেলায় বিগত বছরগুলোর কিছু অনিয়ম সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আমাদের জানিয়েছেন। তার ভিত্তিতে আমরা সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেব। স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনা জোরদার করা এবং একাডেমির পক্ষ থেকে করা আয়োজনগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।
বইমেলায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪-এর থিমকে উচ্চকিত করার জন্য প্রকাশক থেকে শুরু করে সব পক্ষের জোরালো দাবি আছে। আমরা অনুষ্ঠান, আলোচনা, মেলার অবকাঠামো এবং সামগ্রিক বিন্যাসে সে ব্যাপারগুলোর প্রতিফলন ঘটানোর ব্যাপারে সচেষ্ট থাকব।
একুশে বইমেলা আয়োজন এখন বাংলা একাডেমির মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের অনেকটা সময় একাডেমিকে এ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আগে এ বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সম্প্রতি বাংলা একাডেমির সভাপতি আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, একুশে বইমেলাকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। আপনি কী মনে করেন?
আজম: এটা একটা বড় সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে মেলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সক্ষমতার প্রসঙ্গ যুক্ত। কাজেই একক কোনো সিদ্ধান্ত এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও সরকার এ ব্যাপারে কোনো নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে এবং মানসিক ও বস্তুগত সক্ষমতার জন্য একটা সময়কাল বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে এ ব্যাপারে আমার দ্বিমত করার তো কোনো কারণ দেখি না।
একসময় কবিতা, কথাসাহিত্য ও গবেষণা—তিন শাখায় দেওয়া হতো বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে দলীয় বিবেচনা এবং নানাজনকে পুরস্কার দেওয়ার মানসে বিভিন্ন শাখা তৈরি করে অত্যধিক পুরস্কার দেওয়া হয়, যাতে একাডেমির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই বাস্তবতায় সাহিত্য পুরস্কারটি আবারও আগের তিনটি শাখায় দেওয়ার দাবি তুলেছেন সাহিত্যামোদিরা। কী বলবেন?
আজম: এসব ব্যাপারে চালু বিতর্ক ও মতগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। পুরস্কার বিষয়ে স্বেচ্ছাচারের দিকটা সম্পর্কেও আমি ওয়াকিবহাল। ফলে পুরো প্রক্রিয়ায় রুচি, শৃঙ্খলা ও গুণগত উৎকর্ষ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা আমরা নিশ্চয়ই করব। তবে একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে কোনো একক সিদ্ধান্তের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করে সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতেই তা করা হবে। অনুমান করি, পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে বহু গুণী ও যোগ্য মানুষ যুক্ত থাকবেন। তাঁদের মতামত ও প্রজ্ঞা থেকে যেন প্রক্রিয়াটা বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করাই আপাতত আমার লক্ষ্য।
একাডেমি একসময় বিভিন্ন ধ্রুপদি বই বের করত। বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত দার্শনিকদের বই অনুবাদ হয়ে বের হতো এখান থেকে। অনেক দিন হয় এমন উদ্যোগ নেই। এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে আপনার?
আজম: সত্যের খাতিরে বলতে হয়, বাংলা একাডেমি এ ধরনের প্রকল্পের কথা আগে থেকেই ভেবেছে এবং সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছে। আমাদের কাজ হবে প্রথমত, এ প্রকল্প দ্রুত কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা; দ্বিতীয়ত, অনুবাদের ক্ষেত্রে সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের ক্ল্যাসিক ও সমসাময়িক বইগুলোর অন্তত একাংশ অনুবাদের বন্দোবস্ত করা। এ ব্যাপারে আমরা প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছি।
বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে সংরক্ষিত প্রাচীন পুঁথির অনেকগুলোই অযত্নে ক্ষতিগ্রস্ত, কিছু পুঁথি নাকি লোপাটও হয়েছে। ব্যবহারকারী-গবেষকদের অভিযোগ, গবেষণার জন্য পুঁথিগুলো চেয়েও অনেক সময় পান না তাঁরা। পুঁথিগুলো সংরক্ষণ এবং তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একাডেমি কী ভাবছে? পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ যেমন তাদের কাছে থাকা পুঁথিগুলো বছরের কোনো একটা সময়ে জনসাধারণের দেখার ব্যবস্থা করে, তেমন কোনো পরিকল্পনা আপনাদের আছে?
আজম: বাংলা একাডেমিতে থাকা মূল্যবান পুঁথিগুলোর সংরক্ষণ, ডিজিটাইজেশন এবং পাঠোদ্ধারের একটা বড় উদ্যোগ একাডেমি নিয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে স্কলারশিপের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তবে প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করে সেই ঘাটতি অনেকাংশে দূর করা সম্ভব। আমরা আশা করি, অনতিবিলম্বে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করা যাবে।
আমাদের আরও পরিকল্পনা আছে, বাংলাদেশের অন্যত্র যেসব পুঁথি আছে, সেগুলোকেও সরকারের মধ্যস্থতায় এ প্রকল্পের অধীন নিয়ে আসার চেষ্টা করা। তাতে পারস্পরিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে ডিজিটাইজেশনের কাজটা একসঙ্গে হওয়া সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে; আর পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে একই বিষয়ে বিদ্যমান অন্য পুঁথিগুলো একসঙ্গে করে সমন্বিত পাঠ প্রস্তুত করা যাবে। দেখা যাক, এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ সফল করা যায় কি না। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে বাংলা একাডেমিতে মজুত পুঁথিগুলো নিয়েই আমরা কাজ শুরু করব। ডিজিটাইজেশন, সংরক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও পাঠোদ্ধার সমানতালে চলবে।
একাডেমিতে যে পুরোনো সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের সংগ্রহ আছে, তার অনেক কিছুই গবেষক বা ব্যবহারকারীরা অনেককাল ব্যবহার করতে পারেননি। যেমন বিগত সরকারের আমলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের সংবাদপত্রগুলো দেখতে ও ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। ভবিষ্যতে এ ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনার খপ্পরে যাতে আর না পড়তে হয়, সে জন্য কিছু কি ভেবেছেন?
আজম: পুরোনো পত্রিকা ও বইয়ের ডিজিটাইজেশনের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ একাডেমিতে চলছে। এক কোটি সাতাশ লাখ পৃষ্ঠার ডিজিটাইজেশন এ প্রকল্পের অংশ। প্রকল্পটি ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। আমরা এরপর জনপরিসরে এসব উপাদান ব্যবহারের ধরন নিয়ে কাজ শুরু করব।
বাংলা একাডেমি একদিক থেকে কোনো অজ্ঞাত কারণে বেশ পিছিয়ে আছে। এখানকার ব্যবস্থাপনা, প্রকাশনা, বিক্রয় ও লাইব্রেরির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ডিজিটাইজেশন ঘটেনি। এটা জনসাধারণ, গবেষক ও সংশ্লিষ্ট সবার জন্য যেমন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনই একাডেমির অভ্যন্তর-ব্যবস্থাপনায়ও সংকট তৈরি করছে।
এ প্রেক্ষাপটে আমরা ইতিমধ্যেই বাংলা একাডেমির সামগ্রিক ডিজিটাইজেশনের জন্য কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করেছি। ব্যবস্থাপনা, লাইব্রেরি, বিক্রয়, বই ও পত্রিকার প্রকাশনাসহ সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আমরা নিজেদের একটি ফন্ট তৈরির জন্য উদ্যোগ নিয়েছি এবং একাডেমির সব প্রকাশনা যেন অনতিবিলম্বে ইউনিকোডে ছাপা হয়, যেন সেগুলোর ই-বুক সারা দুনিয়ায় সহজলভ্য হয় এবং পুরোনো বইগুলোর অন্তত ই-বুক সহজপ্রাপ্য করা যায়, তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আমাদের বিক্রয়কেন্দ্রকেও এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। সারা দেশে অনলাইন বিক্রি শুরু হবে। বিক্রয়কেন্দ্র রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
তবে লাইব্রেরিকে এ রকম সেবার আওতায় আনা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা আশা করি, আংশিকভাবে লাইব্রেরি-সেবা উন্মুক্ত করা শিগগিরই করা যাবে। সে ক্ষেত্রে পাঠকদের লাইব্রেরির সদস্য হতে হবে। আর পত্রিকাগুলো যেহেতু সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশনের আওতায় এসেছে, কাজেই পত্রিকা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বা অপ্রাপ্যতার সংকট অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে ভরসা করা যায়। আশা করছি, পুরো প্রক্রিয়াটা ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
বিগত সময়গুলোয় একাডেমির সাধারণ ও জীবন সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। কীভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এটি নির্বাচন করা যেতে পারে?
আজম: এ ধরনের বিস্তর অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সুরাহা করা খুব সহজ নয়। আমরা এ ব্যাপারে ন্যূনতম শৃঙ্খলায় ফেরার জন্য কাজ করছি।
সদস্যপদের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হলো, প্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি, আর প্রতিবছর বরাদ্দকৃত নতুন সদস্যের সংখ্যা এত কম—বছরে ২১ জন মাত্র—যে এর কোনো সন্তোষজনক মীমাংসা হয়তো শিগগিরই সম্ভব হবে না। তবে যদি স্বচ্ছতা ও যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে সম্ভবত অভিযোগের হার কমিয়ে আনা যাবে। আমরা সে চেষ্টাই করব।
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাস্তবতায় জনসাধারণের মতো কবি-সাহিত্যিকদের চাওয়াও হলো বাংলা একাডেমিতে কিছু মৌলিক সংস্কার। যেমন তাঁরা চান কারও অধীন না থেকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করুক প্রতিষ্ঠানটি। আপনি কি মনে করেন বিষয়টি সম্ভব?
আজম: বাংলা একাডেমির অধিকতর স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই সম্ভব। তবে তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এর বাইরে কিছু অভ্যন্তরীণ সংস্কার এখনই সম্ভব।
অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত প্রচারের ঝুঁকি নিয়ে এখানে এ কথাটাও বলে রাখতে চাই যে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন বাংলা একাডেমির জন্য প্রধান সমস্যা নয়। আমার এ মন্তব্যের দুর্বলতার দিক এই যে আমার অভিজ্ঞতা এখানে খুবই কম দিনের। তবে আমি যতটা বুঝতে পেরেছি, অনেক সময়ই সরকারি বা দলীয় হস্তক্ষেপের আগেই কর্তাব্যক্তিরা উদ্যোগী হয়ে অতিরিক্ত আনুকূল্য দেখাতে গেছেন বা নিজেরাই রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রস্তাব করেছেন। এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করা এত সহজ নয়। তবে একাডেমি আর্থিক বরাদ্দপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যদি তুলনামূলক স্বাধীনতা পায়, আর পরিচালনার ক্ষেত্রে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন পায়, তাহলে তো ভালোই হয়। সে ক্ষেত্রেও লাগবে স্বাধীনচেতা প্রশাসক, জনসমাজ ও বিদ্বৎসমাজ। আমাদের দেশে সে অবস্থা একসময় তৈরি হবে, এ আশা করতে দোষ কী!