প্রায় ১০ বছর ধরে চোখে আর কিছুই দেখতে পান না শহীদ আখন্দ
প্রায় ১০ বছর ধরে চোখে আর কিছুই দেখতে পান না শহীদ আখন্দ

ভালোবাসার মতো একটা মানুষ যদি পেতাম

শহীদ আখন্দ অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক। জ্যঁ পল সার্ত্রের বই অনুবাদ করেছেন। তাঁর হাতে অনূদিত হয়েছে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর মতো বইও। ৯০ বছর বয়সী এই লেখক এখন দৃষ্টিশক্তিহীন। লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতে বাস করেন ঢাকার আদাবরে। নিজের সাহিত্য, জীবন ও বর্তমান নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

প্রশ্ন

আপনার জন্ম ১৯৩৫ সালে, তৎকালীন ময়মনসিংহের নান্দাইলের পাছদরিল্লাহ গ্রামে। ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের এক গণ্ডগ্রামে জন্মে ও বেড়ে উঠে কীভাবে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ শুরু হলো?

শহীদ আখন্দ: ময়মনসিংহের নান্দাইলের চণ্ডীপাশা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি আমি। প্রথম যেদিন ক্লাসে গেলাম, বেশ ভয়ে ভয়ে গেলাম। ক্লাসের ছেলেরা কেউ অন্যভাবে তাকাচ্ছে কি না, এসব খেয়াল করলাম। আমাদের স্কুলে একজন লাইব্রেরিয়ান ছিলেন—অমল চন্দ্র। তাঁকে আমি স্যার বলতাম। তিনি বললেন, ‘স্যার বলবি না। আর শোন, বড় বই নিবি না, ছোট বই নিবি।’

তো আমি বই নেওয়া শুরু করলাম। এক দিন পরই ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই নিয়ে যাই। একপর্যায়ে অমল চন্দ্র বললেন, ‘তুই যে গতিতে বই পড়তে শুরু করেছিস, এভাবে তো তোকে প্রতিদিন কেউ বই দেবে না। ‘এরপর তিনি একটা বড় বই দিলেন এবং বললেন,’ আস্তে আস্তে পড়বি।’ বইটার নাম পথের পাঁচালী। এরপর তিনি বললেন, ‘বইটা লুকিয়ে নিয়ে যাবি। কেউ যেন না দেখে। কারণ, এটা বড়দের বই।’ এটা ক্লাস সিক্সের ঘটনা।

বাড়িতে আমার বোন ছিল। সে বইটা দেখে ফেলল। আমি বললাম, ‘আমি আগে পড়ি। যদি পড়ে ভালো লাগে, তাহলে তোকে পড়তে দেব।’ বইয়ের প্রচ্ছদ তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। সাদামাটা কভার। খুবই অনিচ্ছায় খুলে পড়তে শুরু করলাম। ও মা! কিছুক্ষণ পরই আমি যেন বাঁধা পড়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, বই পড়ছি না, ছবি দেখছি। এভাবে আমি সেই ছোট বয়সেই সাহিত্যের সঙ্গে প্রবলভাবে জড়িয়ে গেলাম। সাহিত্যের বিখ্যাত সব বই পড়তে শুরু করলাম। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে প্রচুর বই ছিল, ইংরেজি সাহিত্যের বই। ১৯৪৫ সালে চণ্ডীপাশা স্কুলের লাইব্রেরিতে যত বই ছিল, আমার ধারণা, এই ২০২৪ সালে ঢাকার অনেক লাইব্রেরিতেও অত বই নেই। এখনকার স্কুলগুলোয় লাইব্রেরি দেখা যায় না। ছেলেমেয়েরা যে কী পরিমাণ বঞ্চিত হচ্ছে, বলার মতো নয়।

তখন আমরা জুল ভার্ন, রবিনহুড, গালিভার ট্রাভেলস, মার্ক টোয়েনসহ বিশ্বসেরা সাহিত্যিকদের বই নান্দাইলের স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে পড়েছি। কাউন্ট অব দ্য মন্টি ক্রিস্টো উপন্যাসও ওই সময় পড়েছি। পিজি উডহাউসের কিছু বইও তখন পড়েছিলাম।

প্রশ্ন

লেখালেখি কি তখন থেকেই করতেন? লেখকই কি হতে চেয়েছিলেন?

শহীদ আখন্দ: তখন থেকেই টুকটাক লিখতাম। কিন্তু আমার লেখা প্রকাশ পেয়েছে অনেক পরে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে এমএ পড়ি, ইকবাল হলে (এখনকার সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকি। ওই সময় হলের বার্ষিক সাময়িকীতে বের হয় আমার প্রথম লেখা। এটা ১৯৫৫ সালের ঘটনা।

বাংলা বিভাগে আবদুল হাই ছিলেন আমার শিক্ষক। তিনি একদিন আমাকে বললেন, ‘তোমার মধ্যে একটা বিরল প্রতিভা আছে। তুমি লিখতে পারো। কিন্তু চাকরিবাকরিও তো করতে হবে। না হলে জীবন চলবে কী করে?’ পরে আমি কুমিল্লার বার্ডে একটা চাকরি পেলাম। এরপর তো আমার সরকারি চাকরি হলো। ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে গেলাম দিনাজপুরে। সেখান থেকে আমার পোস্টিং হলো কুড়িগ্রামে। তারপর ঢাকায়। ঢাকা থেকে চিটাগংয়ে। এরপর ফেনী। এভাবে আমার চাকরিজীবন কেটেছে।

আমার বাবা একবার জেদ ধরেছিলেন, তাঁর ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। কোনো কথা শুনবেন না। কিন্তু আমি তো মাদ্রাসায় পড়ব না। জেদ আমারও কম নয়। জেদ করে আমি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হলাম। ওখান থেকেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম। তারপর এলাম ঢাকায়। আমার বড় ভাই পুলিশে চাকরি করতেন। তিনি একটা ছোট পোস্টে আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন। বেতন ছিল ৬০ টাকা। ওই সময় শুরু হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। পরে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করলাম। আমার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গীতিকার মনিরুজ্জামান, হাসনা বেগম, রাজিয়া খাতুন। শিশুসাহিত্যিক হালিমা খাতুন আমার সহপাঠী না হলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

এরপর পড়ালেখা শেষ করে ১৯৬১ সালে আমি ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করি। প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার। আর যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছি ১৯৯৩ সালে। আমার পুরো নাম ছিল মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ আখন্দ। যখন চাকরিতে ঢুকলাম, তখন নাম ছোট করে শহীদ আখন্দ হয়ে গেলাম। তার আগপর্যন্ত আমার লেখা মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ আখন্দ নামেই লেখা ছাপা হয়েছে। সে সময় বিখ্যাত পত্রিকা ছিল সমকাল। সবার লেখা তারা ছাপত না। আর ছিল সওগাত, আজাদ, ইত্তেফাক—এসব পত্রিকা। এসব পত্রিকা আমার লেখা ছাপা হতে শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিচিত্রার ঈদসংখ্যায়ও প্রচুর লিখেছি। পত্রিকার সম্পাদকেরা যখন লেখা চাইতেন, যেভাবেই হোক লেখা দিতাম।

ছবি তোলার জন্য নিজের বই হাতে পোজ দিলেন শহীদ আখন্দ
প্রশ্ন

আপনার লেখালেখি শুরু হয়েছে একটু দেরিতে, সম্ভবত গেল শতকের মধ্যষাটের দিকে আপনার প্রথম উপন্যাস পান্না হলো সবুজ প্রকাশিত হয়। এর আগেই কি আপনি অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন? প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি মনে আছে?

শহীদ আখন্দ: আমার প্রথম বই ছিল অনুবাদের, উইলা ক্যাটারের মাই এন্টোনিয়া। ষাটের দশকে বের হয়েছিল। এরপর ১৯৬৪ সালে বের হলো মৌলিক উপন্যাস পান্না হলো সবুজ।

জীবন নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। জীবনে দুবার আমি ভালোবাসার ফাঁদে পড়েছিলাম। ভালোবাসার মতো, আমাকে বোঝার মতো একটা মানুষ যদি পেতাম! এটা একটা খেদ বলতে পারেন। আরেকটা খেদ হলো, জীবনকে কেন যে অসহায় ভাবলাম... কেন সহায় ভাবলাম না। এটা হয়তো আমারই ব্যর্থতা।
প্রশ্ন

তখন আপনার সাহিত্যিক বন্ধু কারা ছিলেন?

শহীদ আখন্দ: তখন আমার সাহিত্যিক বন্ধু ছিলেন আবুল হাসানাত। তারপর গোলাম কাদির। আমরা একসঙ্গে বাংলা বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। আমার বন্ধু ছিল খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন পাস করে বের হলাম, তখন আরও বন্ধুহীন হয়ে পড়লাম। এ সময় আমার একটা ভাঙা সাইকেল ছিল। যার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করত, ওই সাইকেল নিয়ে বের হতাম। শিশুসাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আমার বন্ধু ছিলেন।

শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক—এঁরা সবাই আমার সিনিয়র ছিলেন। তবে আমাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। জাহানারা ইমামের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল।

ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে আমি ইংরেজিতে পড়েছিলাম। আমার মনে হলো, এর বাংলা ভাষান্তর হওয়া দরকার। ভাবলাম, এই বিখ্যাত বই অনুবাদ করলে এর সঙ্গে আমার নামটা জড়িয়ে থাকবে। এটাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। প্রায় তিন মাস সময় নিয়ে বইটা অনুবাদ করেছিলাম।
প্রশ্ন

আপনার অনেক উপন্যাসের নামকরণ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে—পান্না হলো সবুজ, পাখির গান বনের ছায়া; রবীন্দ্রনাথ কি খুব প্রিয় আপনার?

শহীদ আখন্দ: রবীন্দ্রনাথ তখন পড়তেই হতো। উপায় ছিল না। আমি যে সময় জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, সে সময় রবীন্দ্রনাথের লেখার বেশ প্রভাব ছিল। তারপরও বিদেশি সাহিত্য অনেক পড়েছি। মার্ক টোয়েনের কিশোর ক্ল্যাসিকসহ অনেক কিছু অনুবাদ করেছি। জ্যঁ পল সার্ত্রের তিন খণ্ডের উপন্যাস রোডস টু ফ্রিডম অনুবাদ করেছিলাম। এর মধ্যে ছিল দ্য এজ অব রিজন, দ্য রিপ্রিভ ও আয়রন ইন দ্য সোল। দ্য রিপ্রিভ–এর বাংলা আমি করেছিলাম আরো কিছু জীবন। আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রভাববলয়ের বাইরে যাওয়ার উপায় কি আছে বাঙালির?

আদাবরের বাসায় এখন একাই কাটে শহীদ আখন্দের দিনকাল
প্রশ্ন

সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বইটি আপনি অনুবাদ করেছেন। এই বই অনুবাদের পেছনে কোন অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?

শহীদ আখন্দ: বাই হার্ট আমি একজন মুসলিম। ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে আমি ইংরেজিতে পড়েছিলাম। ইংরেজিতে এটি অনুবাদ করেছিলেন আলফ্রেড গিয়োম। তত দিনে পৃথিবীর বহু ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে, কিন্তু বাংলা ভাষায় ছিল না। আমার মনে হলো, এর বাংলা ভাষান্তর হওয়া দরকার। সম্ভবত আশির দশকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আমি প্রস্তাব দিলাম। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ছিলেন শামসুল আলম সাহেব। তাঁকে বললাম, বইটা অনুবাদ করতে চাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। আর আমি ভাবলাম, এই বিখ্যাত বই অনুবাদ করলে এর সঙ্গে আমার নামটা জড়িয়ে থাকবে। এটাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। প্রায় তিন মাস সময় নিয়ে বইটা অনুবাদ করেছিলাম। খুব পরিশ্রম হয়েছিল। এই বই বের হওয়ার পর আমার নতুন একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। পরে বইটি প্রথমা প্রকাশন থেকে নতুনভাবে বের হয়েছে।

প্রশ্ন

আপনার লেখকজীবনের একটা দুর্লভ বৈচিত্র্য আছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে খুব কমজনই আছেন, যাঁদের মধ্যে এমন বৈচিত্র্য বিদ্যমান। নিজের ভেতরকার এই বৈচিত্র্যকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

শহীদ আখন্দ: অনুবাদের বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমার কোনো গৎবাঁধা নিয়ম ছিল না। যখন যেটা ভালো লেগেছে, অনুবাদ করেছি। কাঠের মানুষ নামের একটি বই অনুবাদ করেছিলাম। বইটি পড়ার পর মনে হয়েছিল, সারা পৃথিবীর মানুষ এটি পড়ছে, অথচ আমাদের দেশে এর কোনো অনুবাদ নেই। এ পর্যন্ত ৭০-৮০টি বই অনুবাদ করেছি। এর মধ্যে কিশোর ক্ল্যাসিক যেমন আছে, তেমনি জ্যঁ পল সার্ত্রের বই আছে, আবার সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর মতো ধর্মীয় বইও আছে। একটা বিষয় আমার মনে হয়, এই বিশ্বের যা কিছু ভালো ও দরকারি, তার সবই তো আমার। লেখক বা অনুবাদক হিসেবে কোনো ছুঁতমার্গ আমার মধ্যে কাজ করে না। তবে একটা আফসোস আছে, এমন অনেক বই রয়েছে, যেগুলো ইচ্ছা থাকলেও আমি অনুবাদ করতে পারলাম না। সময় ফুরিয়ে আসছে।

শহীদ আখন্দের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি
প্রশ্ন

উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা ছিলেন আপনি। কিন্তু আপনার লেখার বড় অংশজুড়ে রয়েছে মধ্যবিত্তদের জীবন। এই জীবন কীভাবে দেখলেন?

শহীদ অখন্দ: আমার লেখালেখিতে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন বেশি জায়গা পেয়েছে। কারণ, আমার আত্মীয়স্বজন ঠিক মধ্যবিত্ত না হলেও মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতেন। তাঁদের জীবনযাপন দেখে দেখেই আমি লিখেছি। সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন আমার কাজিন, ইউপিএলের প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমদ ছিলেন ভায়রা। এঁদের প্রত্যেকের জীবনযাপনের মধ্যেই একটা সীমারেখা ছিল।

প্রশ্ন

বহু বছর ধরে আপনি দৃষ্টিশক্তিহীন। পাঠ ও দেখার জগৎ থেকে এই যে সরে আসা বা দূরে থাকা, এটা আপনার জীবনে কেমন অনুভূতির জন্ম দিয়েছে?

শহীদ আখন্দ: আমার চোখে সমস্যা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। চোখে প্রথমে গ্লুকোমা ধরা পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে গেলাম। ২০১৪ সালের দিক থেকে চোখে আর কিছুই দেখি না।

প্যারিসে আমি পাঁচবার গিয়েছি চোখের চিকিৎসা করাতে। কিছুতেই কাজ হলো না। আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে শুরু করল। তখন আমি যে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, এটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হতো। রাতে চুপি চুপি কাঁদতাম। এখন আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো, আমি বই পড়তে পারি না। পৃথিবীর কত রূপ, কিছুই দেখতে পারি না। খুব খারাপ লাগে। কষ্ট লাগে। তবে অলীক কল্পনার মতো মাঝেমধ্যে ভাবি, যদি কখনো মিরাকল ঘটে, দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাই, পৃথিবীকে তাহলে আবার নতুন করে দেখব!

প্রশ্ন

আপনার এখন সময় কাটে কীভাবে?

শহীদ আখন্দ: বাসায় আমি একাই থাকি। আমার দেখাশোনার জন্য দুজন পরিচারিকা আছে। ডাকলে ওদের পাই। আর আমার ছেলে ঢাকায়ই থাকে, গুলশানে। নাতিরা প্রায়ই আসে। তাদের সঙ্গে সময় কাটাই। প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় আমার। তারপরও বিছানায় শুয়ে থাকি। কাউকে ডেকে বিরক্ত করি না। কখনোবা উঠে বসি। গান শুনি। দিন কেটে যায়। রাত সাড়ে ৯টায় খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এইতো রুটিন। আসলে কথা বলার একটা মানুষ দরকার, ভীষণ জরুরি।

শহীদ আখন্দ অনূদিত জ্যঁ পল সার্ত্রের আরো কিছু জীবন ও সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর প্রচ্ছদ
প্রশ্ন

এখন কি কিছু লেখার কথা ভাবছেন?

শহীদ আখন্দ: আমার তিন মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েরা সবাই দেশের বাইরে থাকে। ছোট মেয়ে থাকে নিউইয়র্কে। তো ওর ছোট মেয়ে হীতা একদিন আমাকে নালিশ করে বলল, ‘নানা, তুমি তো অনেক বই লিখেছ; কিন্তু আমরা পড়তে পারি না। আমাদের জন্য ইংরেজিতে একটা বই লেখো।’

এরপর ইংরেজিতে ছোটদের জন্য একটা উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। কিন্তু এখন তো আমি চোখেই দেখি না, লিখব কী করে? ভাবছি, স্কেল আর কাঠপেনসিলের সাহায্যে লেখা যায় কি না। এভাবে যদি না পারি, তাহলে ডিকটেশন দিয়ে লেখাব।

প্রশ্ন

জীবন নিয়ে কোনো খেদ আছে আপনার?

শহীদ আখন্দ: দীর্ঘ একটা জীবন পেয়েছি। নিঃসন্দেহে আমি ভাগ্যবান। না, জীবন নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। জীবনে দুবার আমি ভালোবাসার ফাঁদে পড়েছিলাম। ভালোবাসার মতো, আমাকে বোঝার মতো একটা মানুষ যদি পেতাম! এটা একটা খেদ বলতে পারেন। আরেকটা খেদ হলো, জীবনকে কেন যে অসহায় ভাবলাম... কেন সহায় ভাবলাম না। এটা হয়তো আমারই ব্যর্থতা। আমার জীবনকে আমি নিজেই এগোতে দিইনি।