নিজের মতো একটা জীবন কাটিয়ে গেলেন কবি হেলাল হাফিজ। তাঁর এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অকপট এ আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন নিজের জীবন, কবিতা ও নারীদের নিয়ে। বলেছেন খেদ আর অপ্রাপ্তির কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত রাব্বানী
তেত্রিশ বছর পর নতুন কবিতার বই বের হলো, এ আনন্দ কেমন?
হেলাল হাফিজ: আনন্দের চেয়ে ভয়ই বেশি। সব সময় এ ভয় কাজ করেছে যে বেদনাকে বলেছি কেঁদো না যদি যে জলে আগুন জ্বলের ধারেকাছে যেতে না পারে! কয়েক বছর ধরে ঘষামাজা করে প্রায় ২০০ কবিতা থেকে মাত্র ৩৪টি বাছাই করে এই বই করেছি।
প্রকাশের পরপরই তো বইয়ের কয়েকটি সংস্করণ বের হয়ে গেল...
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। বইমেলা থেকে অনেকে বই কিনে এখানে এসে অটোগ্রাফও নিচ্ছে।
বইমেলায় যেতে ইচ্ছে করে না?
হেলাল হাফিজ: ইচ্ছে করে না, তা নয়। ইচ্ছে করে। কিন্তু শরীর তো খুব নাজুক।
শরীরের এই নাজুক অবস্থার জন্য আপনি নিজেও কি দায়ী নন?
হেলাল হাফিজ: (মুচকি হাসি।)
আচ্ছা, বেদনাকে বলেছি কেঁদো না প্রসঙ্গে ছিলাম। ছোট ছোট সব কবিতা বইয়ে। এর কারণ কী?
হেলাল হাফিজ: স্মার্টফোনের নেশা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেশা। মানুষ বড় ব্যস্ত। কারও কোনো সময় নেই বই পড়ার। এই বই পড়তে বিশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। এ–ই ছিল একটা ভাবনা।
আরও কোনো ভাবনা ছিল?
হেলাল হাফিজ: একটু খেয়াল করে দেখো, আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি, একটা আকাল...
জীবনানন্দের কবিতার লাইনের মতো?
হেলাল হাফিজ: কোন লাইন?
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আস্ফালন নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। এই ভাবনাই কাজ করেছে। নষ্ট-ভ্রষ্ট সময়ে দাঁড়িয়ে আমি প্রেমের কথা বলেছি, বিরহের কথা বলেছি। প্রেমও প্রতিবাদের ভাষা। প্রেম দিয়েই অনেক কিছু জয় করা যায়।
এই কবিতাগুলো তো কবিতা ৭১–এ–ও ছিল!
হেলাল হাফিজ: সব কটা ছিল না। কিছু ছিল। ওটা তো আমার মৌলিক গ্রন্থ নয়। তা ছাড়া কবিতাগুলোর আলাদা শিরোনামও ছিল না। অচল প্রেমের পদ্য শিরোনামে ধারাবাহিক লেখা ছিল।
এখন মন তো চায়, কেউ একজন থাকুক। সারা দিন প্রেসক্লাবে কতজন দেখা করতে আসে, এভাবে দিন কেটে যায়। প্রেসক্লাব আমার সেকেন্ড হোম নেই আর, ফার্স্ট হোম। কিন্তু রাতে যখন হোটেলে যাই, মনে হয় কেউ একজন যদি থাকত অন্তত কথা বলার জন্য। শারীরিক কারণে নয়, মানসিক কারণেই মনে হয়, একজন সঙ্গী থাকা দরকার ছিল।—হেলাল হাফিজ
এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই তো মানুষের জানা—
হেলাল হাফিজ: তুমি তো আমার কবিতা পড়েছ। তুমি তো ‘বুকের দোকান’ কবিতাটি আগে পড়োনি। এই কবিতা সম্ভবত সত্তরের দশকে লেখা। তখন নিউমার্কেটে তুমুল আড্ডা দিই। সে সময় তো খোলামেলা পোশাক তেমন ছিল না। কিছু কাপড়ের দোকানে ব্লাউজ ঝুলিয়ে রাখত, যা ভালো করে দেখলে অবিকল নারীর দেহ মনে হতো। বয়সই ছিল উসকানি দেওয়ার মতো। এই কবিতা তখন লেখা।
তবে এত দিন পেলাম না কেন?
হেলাল হাফিজ: আমিই ভুলে গিয়েছিলাম এ কবিতার কথা। কয়েক মাস আগে পেলাম। তা–ও একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে। এই বইয়ে কিন্তু আমার আব্বার লেখাও আছে।
এটা কীভাবে?
হেলাল হাফিজ: আমার আব্বা কবি ছিলেন। কবিতা লিখতেন। একবার এক চিঠিতে কবিতাটি লিখেছিলেন—‘রেটিনার লোনাজলে তোমার সাঁতার/ পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার।’ আব্বা এই লাইন কটি লিখে আরও লিখেছিলেন, ‘এই বেদনা তুমি লালন করবে এবং চেষ্টা করবে এই বেদনাকে শিল্পে রূপান্তর করতে।’ আব্বাকে সম্মান জানিয়ে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে কবিতাটি রেখেছি। নাম দিয়েছি ‘পিতার পত্র’।
এই সব কারণে কি একাই থেকে গেলেন? জীবনের এই সময়ে এসে কী মনে হয়?
হেলাল হাফিজ: এখন মন তো চায়, কেউ একজন থাকুক। সারা দিন প্রেসক্লাবে কতজন দেখা করতে আসে, এভাবে দিন কেটে যায়। প্রেসক্লাব আমার সেকেন্ড হোম নেই আর, ফার্স্ট হোম। কিন্তু রাতে যখন হোটেলে যাই, মনে হয় কেউ একজন যদি থাকত অন্তত কথা বলার জন্য। শারীরিক কারণে নয়, মানসিক কারণেই মনে হয়, একজন সঙ্গী থাকা দরকার ছিল।
সে সুযোগ কি নেই এখন? আপনার তো নারীভাগ্য চমৎকার...
হেলাল হাফিজ: জুয়ার ভাগ্যও কিন্তু চমৎকার। তবে আমি জুয়া খেলতাম জীবিকার প্রয়োজনে। অনেক দিন এই জুয়াই ছিল আমার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম।
আমরা আপনার নারীভাগ্য নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম...
হেলাল হাফিজ: সবকিছু এই কবিতার কারণেই। আমি তো পরিণত যৌবনে জিগেলো ছিলাম। পয়সাওয়ালা নারীরা টাকার বিনিময়ে আমাকে নিয়ে যেত। এমনটা তো সচরাচর আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় হয় না।
তা তো বটেই। এই নারীরা কি কবিতায় কোনো প্রভাব ফেলেছে?
হেলাল হাফিজ: কারা? যারা আমাকে ভাড়া নিয়ে যেত?
হ্যাঁ...
হেলাল হাফিজ: সবাই-ই তো কিছু না কিছু প্রভাব রেখে যায়৷ যে জলে আগুন জ্বলের কবিতাগুলোতেও অনেক নারীর উপস্থিতি আছে।
সবিতা মিসট্রেস, হেলেন, হীরণবালা, তনা—এই তো?
হেলাল হাফিজ: আরেকজনের নাম আছে—রানা। ‘অন্যরকম সংসার’ কবিতায় আছে দেখো, ‘এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাব।’
রানা কে?
হেলাল হাফিজ: আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গী। পুরো নাম রানা মল্লিক। হিস্ট্রিতে পড়ত। ওর বড় বোন পড়ত ফিজিকসে। আলো করা সুন্দর ছিল ওরা৷ পথে যখন ওরা হাঁটত, সবাই তাকিয়ে থাকত ওদের দিকে, এমন সুন্দর ছিল।
সবিতা সম্পর্কে তো আগে থেকেই জানা আছে আমাদের...
হেলাল হাফিজ: তিনি তো আমার ১২ বছরের বড়। কোনো সুন্দরী মহিলাকে দেখলেই মনে হয়, ইস ইনি যদি আমার মা হতেন! সবিতা সেন তেমন। যার সঙ্গে শারীরিক উদ্দীপনার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার অমিত লাবণ্য আমাকে কল্পনায় অনুপ্রাণিত করত।
হেলেন তো আপনার প্রেমিকা ছিলেন!
হেলাল হাফিজ: হেলেন আমার প্রায় সমবয়সী ছিল। আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। হেলেন কিন্তু আহামরি সুন্দরী ছিল না, সুন্দরী ছিল ওর মা।
কিন্তু হেলেনের নামে কোনো কবিতা দেখলাম না। হিরণবালাই কি হেলেন?
হেলাল হাফিজ: হিরণবালা একদম আলাদা। তার নামেই রচিত হয়েছে একটি কবিতা। হিরণবালা পেশায় সেবিকা ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের সময় ক্লাস বন্ধ থাকায় নেত্রকোনায় চলে যাই কয়েক দিনের জন্য। গিয়েই ওখানকার বন্ধুদের মুখে শুনি, এক জাঁদরেল নার্স এসেছে। পরিচয় হলেও তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি সেবার। একটা চুমু পর্যন্তও খেতে পারিনি। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে পরেরবার। প্রায় ২০ দিনের ছুটি। যৌবনের তৃষ্ণাকাতর মন ও জীবন মুক্তি পেল। হিরণবালা কিন্তু বিবাহিত ছিলেন। ওর স্বামীর সঙ্গে বসেও আড্ডা দিয়েছি। কবি হিসেবে ঢাকায় তখন আমার পরিচয় আছে, সে জন্য কদর একটু বেশি। গণ–অভ্যুত্থানের পর আমি ঢাকায় ফিরি। হিরণবালার কর্মস্থলের পরিবর্তন হয় এরপর। তারপর যোগাযোগ হয়নি আর।
আর তনা?
হেলাল হাফিজ: তসলিমা, তসলিমা নাসরিন। আমার ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’ কবিতাও তসলিমাকে নিয়ে লেখা। এদের বাইরে আরও একজন আমার কবিতায় মিশে আছেন, তিনি রেণু আপা।
এই নাম ঠিক খেয়াল হচ্ছে না...
হেলাল হাফিজ: সবিতা, হেলেন, হিরণবালার নাম সরাসরি কবিতায় এসেছে। তাদের কথা তোমার জানা। কিন্তু এর বাইরেও একজন নারী আছেন, যাঁর নাম সরাসরি কোনো কবিতায় নেই।
রেণু আপা! তিনি কে ছিলেন?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, তিনি রেণু আপা। তিনি আমাকে সাংঘাতিক প্রভাবিত করেছেন। রেণু আপা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। বিদুষী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। আমি মগ্ন ছিলাম তাঁর অবিমিশ্র প্রেমে। আমি মুন্সিগঞ্জে চাকরি করেছি বাবার সঙ্গে অভিমান করে, তা তো তুমি জানোই। তখন রেণু আপাকে ঘিরে ভালোবাসা গাঢ় হয়। রেণু আপা তখন চাঁদপুরে। আমার ফুফা মানে রেণু আপার বাবা তখন মুন্সিগঞ্জে। প্রথম সেখানেই থাকতাম। রেণু আপা রোববারে আসতেন। সোমবারে চলে যেতেন। তাঁকে লঞ্চে তুলে দিতে যেতাম আমি। ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে দিত, আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ত। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেবল অনুভূতি। তখনকার রক্ষণশীল পরিবারের জন্য তাঁকে কিছু বলতে পারিনি। তিনি তো ছিলেন আমার চেয়ে ১২–১৩ বছরের বড়। আমার ‘প্রতিমা’, ‘ইচ্ছে ছিল’—এসব কবিতা তাঁকে নিয়ে লেখা।
আপনার মতো এমন প্রেমের ভাগ্য পেয়েছিলেন আবুল হাসান...
হেলাল হাফিজ: আমার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে আবুল হাসানকেই আমি একমাত্র ঈর্ষা করি। এই ঈর্ষা নোংরা নয়, শৈল্পিক। যেকোনো শিল্পীর এই ঈর্ষা থাকতে হবে।
এই সময়ে এসে কোনো অপ্রাপ্তির কথা মনে পড়ে?
হেলাল হাফিজ: মাতৃস্নেহ। এই একটা অপ্রাপ্তিই আমার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মা মারা যান। তাঁর কোনো স্মৃতি নেই আমার। এ ছাড়া কোনো অপ্রাপ্তি দেখি না। আমি আমার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি আদর পেয়েছি। এই সবই আমার সঞ্চয়। সারা জীবন মানুষ জমাতে চেয়েছি। সবাই জমায় টাকা, আমি চাই মানুষ জমাতে।
অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলাম। আরেকটা বিষয় জানতে চাই।
হেলাল হাফিজ: বলো।
কবিতার আরও বই করার ইচ্ছা আছে?
হেলাল: আরেকটি কবিতার বই করতে চাই। দেখি কতদূর পারি। আলস্য তো আমার নারীর চেয়েও প্রিয়৷ তা ছাড়া আমার আত্মজীবনীটা লিখতে চাই।
এটা লিখুন, প্লিজ।
হেলাল হাফিজ: শুরু করেছি। কিছু অংশ লেখা হয়েছেও। কিন্তু শরীর খুব একটা সায় দিচ্ছে না। বাঁ–চোখে তো দেখি না একদম।