কথাশিল্পী হরিপদ দত্ত ১২ বছর পর তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে এসেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে। আবার চলেও গেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নির্বাসিত জীবনের পাশাপাশি জন্মভূমি হারানোর বেদনা ও দীর্ঘশ্বাসের কথা বলেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও সারফুদ্দিন আহমেদ
১২ বছর পর বাংলাদেশে এলেন? কী পরিবর্তন দেখছেন?
হরিপদ দত্ত: পরিবর্তন তো হয়েছে। বড় বড় দালান হয়েছে, রাস্তাঘাটও প্রশস্ত হয়েছে। এসব তো সব দেশেই হয়। সেই সঙ্গে মানুষও বদলে যায়। এক জায়গায় স্থির থাকে না। মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন এসেছে।
এই মাটির শস্য খেয়েই তো আমি বড় হয়েছি। তাই বলব, জন্মভূমি থেকে চলে যাওয়াটা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। আমি ভুল করেছিলাম।হরিপদ দত্ত
জন্মভূমি থেকে আপনার চলে যাওয়াটা কি অনিবার্য ছিল?
হরিপদ: আমি এখন অনুভব করি, আগে হয়তো এভাবে ভাবতাম না। এখানে একটা মানুষ জন্ম নিল, এখানকার আলো-হাওয়ায় বড় হলো। এই মাটির শস্য খেয়েই তো আমি বড় হয়েছি। তাই বলব, জন্মভূমি থেকে চলে যাওয়াটা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। আমি ভুল করেছিলাম। সেই ভুল তো শোধরানোর উপায় নেই। প্রথমে যাওয়াটা ছিল আবেগে। এর মধ্যে কিছু যুক্তি আছে, আবার যুক্তি নেইও। আমার জন্মভূমি ত্যাগের পর যে সময়টা চলে গেছে, সেটা আর ফিরবে না। আমার যাওয়াটা বৃথা। এ কারণে আমি আর কলকাতা শহরে ঢুকি না। জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া নিয়ে আমার ভেতরে দুঃখবোধ আছে, যারা জন্মভূমি ছেড়ে যায়, তাদের ভেতরে একধরনের দুঃখবোধ থাকে এবং আমৃত্যু তারা এই দুঃখবোধ নিয়ে বেঁচে থাকে।
যেখানে গেলেন, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কতটা একাত্ম হতে পেরেছেন?
হরিপদ: আমি আধা গ্রাম, আধা শহর—নদীয়ার শান্তিপুর–ফুলিয়া এলাকায় থাকি। এখানকার অধিকাংশ মানুষের আদি বাড়ি টাঙ্গাইল। তাঁদের কাছে গেলে আমি মাটির গন্ধটা পাই। রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থাকি। সেখানে প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে পাই, যাঁরা এপার বাংলা থেকে গেছেন। একজন বৃদ্ধাকে দেখে জিজ্ঞেস করি, দিদি, তোমার বাড়ি কই? এখানে কোথায় এসেছ? বললেন, মেয়ের বাড়ি এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে যাব। মেয়ের বাড়ি কি কেউ বেশি দিন থাকে? আরেক দিন বরিশালের এক মহিলার সঙ্গে দেখা হলো। বললেন, তিনি আসতে চাননি। স্বামী জোর করে এখানে নিয়ে এসেছেন। এরপর কানে কানে বলেন, আমি তো এখন স্বাধীন হয়ে গেছি। ছেলে ভাত দেয় না। পঞ্চায়েতের ভয়ে কিছু কিছু দেয়। মেয়ে কিছু টাকা পাঠায়। পাসপোর্ট করতে পারলে দেশে চলে যেতাম। দেশ মানে বাংলাদেশ। ভদ্রমহিলা আরও বললেন, তাঁর পাশের বাড়ির এক মুসলমান বান্ধবী ছিল, এখনো মাঝেমধ্যে টেলিফোন করে বলে, ‘তুই ওখানে পড়ে আছিস কেন? এখানে আইয়া পড়।’ কিন্তু আমি তো পথঘাট চিনি না, কই যামু! এখানেই মইরা পইড়া থাকুম।
আপনি বলেছেন, যারা জন্মভূমি ছেড়ে যায়, তাদের ভেতরে একধরনের দুঃখবোধ থাকে। প্রশ্ন হলো, এই যে ছেড়ে যাওয়া, এর পেছনে জন্মভূমির কোনো ভূমিকা থাকে কি না?
হরিপদ: মাতৃভূমি বা জন্মভূমি—এ তো একটা নৈর্ব্যক্তিক বিষয়। কিন্তু জন্মভূমির মানুষগুলোর মধ্যে মেজরিটি-মাইনরিটি প্রশ্ন আছে। তারপরও বলব, আমার ওখানে চলে যাওয়ার সঙ্গে অন্য দশজনের চলে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। ব্রিটিশ আমলে আমার বাবা ছিলেন প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক ও ডাক বিভাগের কর্মচারী। আইয়ুব খানের সরকার ’৬৪-৬৫-এর দিকে ইউরিয়া সার কারখানার জন্য আমাদের পুরো গ্রামটি অধিগ্রহণ করল। এর মধ্যে আমাদের বাড়িঘরও পড়ল। আমাদের যৌথ পরিবার ভেঙে গেল। কেউ কেউ উত্তরবঙ্গে চলে গেলেন—শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি। আমাকে নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়াতে হলো। আমি আরামবাগে থাকতাম। নিউ মডেল স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এখানে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হলো। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, যে দেশ আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন করলাম, যে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করলাম, সেই দেশে দাঙ্গা হবে—এটা ভাবতেও পারিনি। বলা যায়, আমার বিশ্বাসে একটু ফাটল ধরেছে। আমার ছেলে তখন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে এইটে পড়ত, মেয়েটা তখন তিন বছরের। এরপর আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে গেল। আমি একাই মেসে ভাঙা চৌকিতে জীবন কাটিয়ে দিলাম। ওদের নিয়ে চিন্তা করতাম, কেমন আছে, কীভাবে আছে ইত্যাদি।
শিক্ষকতায়ই থেকে গেলেন?
হরিপদ: না, একসময় শিক্ষকতা ছেড়ে দিলাম। টিউশন করতাম। একপর্যায়ে আমি নতুন দিগন্ত–এর সঙ্গে যুক্ত হলাম। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পত্রিকাটির সম্পাদক। নতুন দিগন্ত–এর সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো সময় কাটত। এর মধ্যে একদিন আমার জ্বর হলো। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি হাই পাওয়ারের প্যারাসিটামল দিলেন। এতে আমার শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো। জ্বর আর কমে না। কলকাতায় আমার এক চাচাতো ভাই ছিলেন ডাক্তার। তাঁর কাছে গেলে তিনি কিডনি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করেন? বললাম, শিক্ষকতা করি। তিনি বললেন, সর্বনাশ করে ফেলেছেন। এক হাজার এমজির পেইন কিলার কীভাবে খেলেন? এরপর দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলাম। চিকিত্সা শেষে যখন ভালো হলাম, দেশে ফেরার ব্যাপারে পরিবার থেকে বাধা এল। ছেলেমেয়ে তখন বড় হয়েছে। চাকরিবাকরি পেয়েছে। মেয়ের বিয়ে হলো। শিক্ষকতা করত। ওখানে শিক্ষকদের ভালো বেতন। মেয়ে আমার চিকিত্সার খরচ দিত। এবারও ঢাকায় আসার সময় পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিল। ছেলেও ভালো চাকরি করে। আমার যা প্রয়োজন, ওরা দেয়। কিন্তু আমার মনটা ভালো নেই। ওরা বলত, তুমি সারাক্ষণ কী চিন্তা করো, এখানে কারও সঙ্গে মেশো না।
এটাকে লেখকের নির্বাসিত জীবন বলবেন?
হরিপদ: মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, আমার দেশ কোথায়? পশ্চিমবঙ্গ বা এখানে আমার নামে কোনো সম্পত্তি নেই। আমি গৃহহীন। আমার অর্থনৈতিক খুঁটি নেই। আমার ব্যাংক হিসাবে মোট ১ হাজার ৮০০ টাকা আছে। আমি বলেছি, ব্যাংকে লাইন ধরে ৫০০ টাকা, ১ হাজার টাকা জমা দিতে পারব না।
এই সময় আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?
হরিপদ: এখানে থাকতে কলকাতার লিটলম্যাগে লেখাটেখা পাঠালে ছাপাত। পরে দেখলাম, ওখানকার পত্রিকায় একটা আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার আছে। তারা বাংলাদেশের এমন লেখকের লেখা ছাপে, যার মার্কেট পাওয়া যাবে। এখন আমি ওপারের কোনো কাগজে লিখি না। কোনো লেখা তৈরি হলে বাংলাদেশে নতুন দিগন্ত–এর নির্বাহী সম্পাদক মজহারুল ইসলাম ওরফে বাবলার কাছে পাঠাই। ওপারে আমি যেখানে থাকি, সেখানকার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও জানে না, আমি লেখক। লেখাপড়া জানি। আমি কাউকে বলিনি।
তারপরও ওপারে চলে গেলেন কেন?
হরিপদ: প্রশ্নটা শুনে আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে হলো। জগন্নাথ কলেজে শওকত আলী আমার শিক্ষক ছিলেন। প্রখ্যাত কথাশিল্পী। আমি তাঁকে বললাম, স্যার, আমি আপনার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে লেখাগুলো পড়েছি। কিন্তু আপনি কেন বাংলাদেশে চলে এলেন। ওখানে আবুল বাশার তো বড় লেখক। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁরা দেশ ছাড়লেন না। আপনি ছাড়লেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, একই ঘটনা আমার ক্ষেত্রেও ঘটল। আমি জন্মভূমি ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলাম। তিনি জীবিত থাকলে আজ আমাকে এই প্রশ্নটাই করতেন। স্যার নেই, কিন্তু এই প্রশ্নটা যদি আমাকে কেউ করেন, আমি কী উত্তর দেব। কোনো উত্তর নেই। পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আমি সব হারিয়েছি। এই প্রথম আলোতে আমার অনেকগুলো গল্প ছাপা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। যেটুকু লেখালেখি করি এখানকার পত্রিকায়। এখানে ঈদসংখ্যায় যে চারটি ছোট উপন্যাস বের হয়েছে, বাবলা ভাইয়ের সৌজন্যে। চার পৃথিবীর মানুষ নামে বই বেরিয়েছে একটা অখ্যাত প্রকাশনী থেকে।
আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর পর এখান থেকে ওপারে যাঁরা গেলেন, তাঁদের জন্য সাহিত্যে অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। মেঘে ঢাকা তারার মতো সিনেমা হয়েছে। তাঁদের উত্তরপুরুষেরা কোথায় গেল, সেই খোঁজ তাঁরা নিলেন না কেন? শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, ‘অবণী বাড়ি আছো?’ উত্তরবঙ্গের এক গ্রামে গিয়ে দেখলাম, কেউ নেই। এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলাম, সমরানন্দ কোথায় গেলেন? বললেন, নেই। মারা গেছে। হতদরিদ্র অবস্থায়। এখান থেকে যাওয়া মানুষদের উত্তরপুরুষেরা কেমন আছেন, সে খবর কলকাতার লেখকেরা জানেন না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো পূর্ব-পশ্চিম লিখেছেন।
হরিপদ: ওটা তো পত্রিকা ও নানা সূত্র থেকে লেখা। মানুষের কাহিনি কোথায়? বড় বড় কোটেশন। ওখানে শিল্প নেই। আমরা তো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাছ থেকে গদ্য শিখেছি। মানিক-তারাশঙ্করের কাছ থেকে গদ্য শিখেছি।
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মত কী?
হরিপদ: পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য পড়ে আমি হতাশ। দেশ পত্রিকা আমি কিনি কবিতা পড়ার জন্য। ওখানে যে গল্প থাকে, কিছুই হয় না। পশ্চিমবঙ্গের লিটলম্যাগে কিন্তু উন্নত মানের লেখা থাকে। বর্ধমান, পুরুলিয়া, হুগলি ইত্যাদি জায়গা থেকে বের হয়। এদের মধ্যে মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। তবে এসব লেখায় প্রচণ্ড হতাশা আছে। এমন একটি কবিতাও পাওয়া যাবে না, যেখানে আশা আছে।
আর বাংলাদেশের সাহিত্য?
হরিপদ: ওখানে যাওয়ার পর বাংলাদেশের সাহিত্যও সব পড়তে পারি না। গত ১২ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকার একজন লেখকের মৃত্যুতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। বুলবুল চৌধুরী। তাঁর গদ্য অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন জগন্নাথ কলেজে। বুলবুলের গদ্যে স্থানীয় ভাষার শব্দ ব্যবহারে দারুণ মুনশিয়ানা আছে। ইমদাদুল হক মিলনের গদ্যেও সেটি আছে। আরও অনেকে আছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে নিজস্ব একটা গদ্য তৈরি হচ্ছে, যেটি কলকাতা থেকে আলাদা। কে বলেছে কলকাতার গদ্য শক্তিশালী? এটা ভুল ধারণা। শুঁটকি খেতে খেতে একসময় ইলিশ মাছও ভালো লাগে না।
কিন্তু প্রবন্ধ সাহিত্য সম্পর্কেও কি আপনি একই কথা বলবেন?
হরিপদ: না, প্রবন্ধ সাহিত্যে কলকাতা কিছুটা এগিয়ে আছে। আমি বলব, এখান থেকে পূর্ব–প্রজন্মের যাঁরা গেছেন, তাঁদের উত্তর–প্রজন্মই সেটি তৈরি করেছে। তাঁরা চিন্তাশীল লেখালেখি করছেন।
বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর একসঙ্গে থাকলেও জানাশোনার মধ্যে কোনো ঘাটতি লক্ষ করেছেন কি?
হরিপদ: ঘাটতি তো আছেই। এক হাজার বছরে হিন্দু পরিবারটি মুসলমান পরিবারে ঢুকতে পারেনি। মুসলমান পরিবারটিও হিন্দু পরিবারে ঢুকতে পারেনি। এটা সাম্প্রদায়িকতা নয়। একধরনের বিচ্ছিন্নতা। আমি কিন্তু উপন্যাস লিখতে গিয়ে মুসলমানের অনেক রীতিনীতি জানার চেষ্টা করেছি। ওই সমাজকে নিয়ে লিখতে গেলে তাদের ভেতরে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ঈদের সেমাই ও পূজার নাড়ুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বামপন্থীরাও এই বিচ্ছিন্নতা দূর করার চেষ্টা করেননি। বামপন্থীরা কৃষক আন্দোলন করেছেন, শ্রমিক আন্দোলন করেছেন, কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মন এক করার চেষ্টা করেননি। শ্রমিকের বিপ্লব, মজুরির বিপ্লব করলেই সব হয়ে যায় না। আসল কাজটিই হয়নি।