ক্যামেরা হাতে জ্যঁ–লুক গদার
ক্যামেরা হাতে জ্যঁ–লুক গদার

‘যা ঘটছে না, সিনেমার উচিত তা দেখানো’

‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’ সিনেমা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রসেনা ও প্রধানতম পোস্টার বয় জ্যঁ–লুক গদার প্রয়াত হয়েছেন ১৩ সেপ্টেম্বর। তিনি বানিয়েছেন প্রচুর সিনেমা, যেগুলোর অধিকাংশই ফিচার ফিল্ম। নিজস্ব পন্থায় আজন্ম বিপ্লবী এই ফ্রেঞ্চ-সুইস মাস্টার ফিল্মমেকার সেই বিরল উদাহরণ, যিনি শুধু নিজ ও পরবর্তী প্রজন্মগুলোকেই প্রভাবিত করেননি, বরং যাঁর সৃষ্টির প্রভাব পড়েছিল কয়েক দশকের অগ্রজ চলচ্চিত্রনির্মাতাদের ওপরও। গদারের শেষ সিনেমা দ্য ইমেজ বুককে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচক রবি কলিন এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ১২ মে এটি প্রকাশ পেয়েছিল দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। সেই সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ

প্রশ্ন

রবি কলিন: দ্য ইমেজ বুক-এ আরব বিশ্বের যে প্রতিকৃতি আপনি ফুটিয়ে তুলেছেন, এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?

জ্যঁ–লুক গদার: দেখুন, আমি স্রেফ সিনেমা বানাই। আর এ বয়সে এসে নানা ঘটনার প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়েছে। তবে এ আগ্রহ কী ঘটছে, শুধুই তার প্রতি নয়; বরং কী ঘটছে না সেসবের প্রতিও। ধরুন, দুজন লোক একসঙ্গে যাচ্ছে, আপনাকে তাদের মধ্যে সংযোগ খুঁজতে হবে...কী ঘটছে স্রেফ এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে না আপনার পক্ষে; তবু যা ঘটছে না, তা নিয়ে লোকে কথা বলে না। যা ঘটছে না, তা আমাদের একটি সামগ্রিক বিপর্যয়ের দিকে, একটি আকস্মিক প্রলয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

প্রশ্ন

রবি: দ্য ইমেজ বুক কি রাজনৈতিক সিনেমা?

গদার: না...। আরবদের কী করে অন্য কারও সাহায্যের আদৌ দরকার নেই—সেটি দেখাতে চেয়েছিলাম আমি; কেননা নিজেদের মতো বাঁচা তাদের নিজেদের পক্ষেই যথেষ্ট সম্ভব। তারা লেখালেখি উদ্ভাবন করেছে; তারা বহু কিছুই উদ্ভাবন করেছে। তাদের তেল আছে; আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি তেল আছে। তাই আমি মনে করি, তাদের বিষয়–আশয় তাদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত...। এ বছর (২০১৮) এবং পূর্ববর্তী বছরগুলোতে কানে (ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল) আসা বেশির ভাগ সিনেমাই দেখিয়েছে ‘কী ঘটছে’। তবে ‘কী ঘটছে না’ তা দেখিয়েছে খুব অল্প কয়টি সিনেমা। আশা করি, আমার সিনেমাটি সেই মাত্রা দেখাবে। আমি মনে করি, যেকোনো মানুষের তার নিজের মাথা দিয়েই শুধু নয়, বরং হাত দিয়েও ভাবা উচিত।

প্রশ্ন

রবি: আপনি একবার বলেছিলেন, একটি সিনেমার ‘একটি সূচনা, একটি মধ্যভাগ আর একটি সমাপ্তি’—এমন বিন্যাস থাকতেই হবে, তার কোনো মানে নেই। এখনো তা মনে করেন?

গদার: স্পিলবার্গ ও অন্য যাঁরা বলেন, প্রতিটি কাহিনিরই একটি সূচনা, একটি মধ্যভাগ ও একটি সমাপ্তি থাকতে হবে—তাঁদের বিরোধিতা করতে গিয়ে বহুদিন আগে এ কথা বলেছিলাম। এটিকে আমি কোনো সত্যিকারের খেলনা জিনিস বানাইনি; তবে একসময় একটি সমান্তরাল এঁকে নিয়েছিলাম: এটি ছিল একটি সমীকরণ, ‘এক্স+১’। প্রাইমারি স্কুলে পড়া যেকোনো শিশু খুব সহজেই এই সমীকরণ বুঝতে পারবে: যদি ‘এক্স+৩ = ১’ হয়, তাহলে ‘এক্স = ২ ’। আপনি যখন কোনো ইমেজ তৈরি করেন—হতে পারে সেটি অতীত, বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের—ভালো একটি ইমেজ পাওয়ার জন্য আপনাকে প্রতিবার দুটি করে ইমেজ নিতেই হবে। এটি এই সমীকরণের মতোই ব্যাপার। এটিই সিনেমার, একটি ভালো সিনেমার চাবিকাঠি। তবে যখন আপনি চাবি প্রসঙ্গে কথা বলবেন, তখন তালার কথাটিও ভুলে যাওয়া চলবে না! মানে, সাফল্য!

প্রশ্ন

রবি: এই সিনেমায় ফিল্ম মেকিং প্রক্রিয়াকে আপনি সম্পূর্ণভাবে অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছেন বলে মনে হয়। (দ্য ইমেজ বুক প্রায় পুরোটাই বানানো হয়েছে আর্কাইভ ইমেজ দিয়ে।) ব্যাপারটি আপনাকে এখন বিরক্ত করে?

গদার: পুরোদস্তুর! আমি দ্রুতই বুঝে গিয়েছিলাম, শুটিং নয়, বরং এডিটিংই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ: এডিটিংই আসে প্রথমে। শুটিং তো আসলে পোস্টপ্রোডাকশন। এভাবে যে যত বেশি ভাবতে পারে, তার পক্ষে তত বেশি স্বাধীন হওয়া সম্ভব। কেননা, এডিটিং, এমনকি ডিজিটাল এডিটিংও হাতে করা হয়; এই সিনেমায় আমরা যেমনটা বলেছি, মানুষকে নিজের হাতের সাহায্যেও ভাবতে হবে। একবার স্রেফ কয়েক মিনিটের জন্য ভাবুন, নিজের হাত ব্যবহার করা ছাড়াই একটা পুরো দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন আপনি। কী করে সামলাবেন? কী করে মাথা সরাবেন? কী করে খাবেন? নিজের হাত কাজ না করলে কী করে ভালোবাসবেন? হাত বাদ দিয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। এ কারণে একদম শুরু থেকেই আমার সিনেমাগুলো এই (আমার) পাঁচ আঙুলের ওপর ভিত্তি করে সবকিছু দেখায়। আর যখন আপনার পাঁচটি আঙুল একসঙ্গে কাজ করবে, তখন আপনি একটা হাতের অধিকারী হবেন।

প্রশ্ন

রবি: আপনার কাজের কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা হলো ‘সিনেমা কাকে বলে?’ আপনি কি এ ব্যাপারে একমত?

গদার: এখানে কোনো কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা নেই। মানে, এখানে কিছু কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা আছে ঠিকই, তবে প্রান্তবর্তী জিজ্ঞাসাগুলোও রয়েছে; আর সব জিজ্ঞাসা একত্রে একাকার হয়ে গেছে। আপনার এক সহকর্মীকে আমি বলেছিলাম, যা ঘটছে সিনেমার মধ্যে, তা–ই অনেক বেশি দেখানো হয়। আপনার চারপাশে প্রতিদিন কী ঘটছে, তা আপনি (সিনেমায়) দেখতে পাবেন। কিন্তু যা ঘটছে না এবং যা আপনি কোথাও কখনো দেখেননি, এমনকি ফেসবুকেও না—সিনেমার উচিত তা দেখানো।

প্রশ্ন

রবি: নতুন সিনেমাটিতে সাউন্ড আর ইমেজের সমন্বয় ঘটেনি কেন?

গদার: ইমেজ থেকে সাউন্ডকে আলাদা করাই উদ্দেশ্য ছিল। সাউন্ডকে আমরা ইমেজগুলোর স্রেফ সহচর করে তুলতে চাইনি; সেখানে আমরা চেয়েছিলাম একটি সত্যিকারের সংলাপ, একটি ধারাবর্ণনা, একটি চলমান আলোচনা...। কোনো টিভি পর্দার চেয়ে বরং কোনো ক্যাফেতে (এই সিনেমা) দেখানোটাই জুতসই হতে পারে: মনে হবে, আপনি যেন কোনো নির্বাক সিনেমা দেখছেন, তারপর ‘এখান’-‘ওখান’ থেকে লাউডস্পিকারে সাউন্ড আসতে থাকবে, আর আচমকাই ক্যাফেতে বসে থাকা লোকটি উপলব্ধি করবেন, সাউন্ড আর ইমেজ আসলে একসঙ্গেই চলছে...। আমার ধারণা, এ ধরনের নিরীক্ষার ফল দারুণ হবে।

প্রশ্ন

রবি: দ্য ইমেজ বুক-এ আপনি যেহেতু কোনো অভিনেতাকে নির্দেশনা দেননি, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, অ্যাক্টিংয়ের প্রতি আপনার আর আস্থা নেই; এ কথা সত্য?

গদার: আমি কারও সঙ্গেই ঝগড়া করতে চাই না; অভিনেতারা, এবং সর্বোপরি অভিনেত্রীরা আমাকে অশেষ সহযোগিতা করেছেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। শুরুর দিকে আমরা অভিনেতা ছাড়াই সিনেমা বানিয়েছি। আমার ধারণা, তাঁরা (অভিনেতা) রাজনীতিতে অনেক বেশি সম্পৃক্ত...। আমার ধারণা, আজকের দিনের প্রচুর অভিনেতা শুটিংকৃত ইমেজগুলোর প্রশ্নে টোটালিটারিয়ানিজমের প্রতি অবদান রাখছেন, অথচ তাঁদের মাথায় থাকা ইমেজগুলো এর ঠিক উল্টো।