আমজাদ হোসেনের অসমাপ্ত এই ছোট সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি, প্রথমা প্রকাশনের দপ্তরে। এখানে তিনি বলেছিলেন একেবারেই ব্যক্তিগত কিছু কথা। এরপর নিজের মনেই বলতে থাকলেন আরও কিছু প্রসঙ্গ—মুক্তিযুদ্ধের কথা, শহীদুল্লা কায়সার ও জহির রায়হানের কথা।
বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে রেকর্ডারটা চালু করলাম। ভেবেছিলাম, ডিসেম্বর মাসে যখন এটা ছাপা হবে, তিনি চমকে যাবেন। কিন্তু আফসোস, এখন যে মুহূর্তে এটা ছাপা হচ্ছে, তখন তিনি আর নেই।
আমজাদ হোসেনের সেদিন কথাগুলো ছিল বিক্ষিপ্ত, তবে বলছিলেন ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বর বিজয়ের পর দেশে এসে যেভাবে কাজ করছিলেন, কী দেখেছিলেন। তবে সাক্ষাৎকারটি ওই দিন আর শেষ হয়নি।
জাহীদ রেজা নূর: মুক্তিযুদ্ধের পরের ঢাকা সম্পর্কে বলুন।
আমজাদ হোসেন: জহির রায়হান এসে শুনলেন শহীদুল্লা কায়সার নেই। তিনি আমাকে সব ক্যামেরাট্যামেরা দিয়ে দিলেন। ওই যে সুকদেব (ভারতীয় চলচ্চিত্রকার) যে ছবিতে পুরস্কার পেয়েছে, পাকিস্তানি সৈনিকেরা যখন আত্মসমর্পণ করে, সেই ছবিটার কাজ। পাকিস্তানিদের হাতে তখন খোলা বেয়নেট, তার মধ্যে শুয়ে শুয়ে শট নিচ্ছি। ওখানে একটা ঘরে ঢুকে দেখলাম, কুঁচকানো টাকা, আরেকটা ঘরে ট্রানজিস্টার। আত্মসমর্পণের সময় সেটা, তবুও ভয় করে, খোলা বেয়নেট তো, তাই। ঘটনাগুলো ধারণ করতে করতেই শুনলাম, একজন নারী মরে পড়ে আছেন মিরপুরে। দৌড়ে সেখানে গেলাম, ক্যামেরায় ওই নারীকে ধারণ করলাম।
জাহীদ: সে সময় অনেক ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের হাসি–আনন্দের পাশাপাশি কান্নাও তো ছিল। এরপর আপনি কী করলেন, মনে আছে?
আমজাদ: তারপরএকসময় আমার মনে হলো, বধ্যভূমিতে যাওয়া দরকার। সেখানে যদি শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সিরাজুদ্দীন হোসেনকে পাই। রায়েরবাজার বধ্যভূমির শহীদদের উঠিয়ে আনতে সেখানে আমি নিজে নেমেছি, গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে। তাঁদের খুঁজেছি, কিন্তু কাউকেই পেলাম না।সেখানে পেলাম কাকে জানেন? আমাদের চলচ্চিত্রের এক খলনায়ক, পাবনার, নয়াবাজারে থাকত, ওর নামটা যেন কী ছিল (তিনি নামটা মনে করতে পারেননি)? এত সব খোঁজার পরে পেলাম তাকে। তার মৃতদেহটা ওপরে উঠিয়ে দিলাম। ওপরে লোক ছিল। ওঠানোর সময় তার হাঁটু দুটি ঠুস ঠুস করে খুলে নিচে পড়ে গেল। সেগুলো কুড়িয়ে আবার দিয়ে দিলাম ওপরে। তারপর আমি উঠে বমি করছি। সে সময় খসরু (মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র অভিনেতা) দুই রাজাকারকে ধরে নিয়ে এসেছে। বলছে, আমজাদ ভাই, শুট করতে হবে। আমি এই রাজাকারদের শুট করব। আপনি শুট করেন। আমি ক্যামেরাম্যানকে বললাম, শুট করো। তো এসব কথা আমি বলিনি কখনো। এই রকম বহু ঘটনা আছে।
জাহীদ: কোনো দৃশ্য কি আপনার মনে গাঢ় হয়ে আছে?
আমজাদ: এই টেকনিক্যাল থেকে (তিনি ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার বলতে চেয়েছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়) আমি নিজে শুট করেছি, আমাদের কাছে তো ইন্দিরা গান্ধির অনুমতিপত্র ছিল। আমি দেখি, এক হাজার মোরগ জবাই করলে যে রক্তটা পড়ে, সে রকম রক্ত সিঁড়িতে। অরুণ রায় ছিল ক্যামেরাম্যান। আমি অরুণকে বললাম, ‘অরুণ, এই শটটা আমি নিই। তুই আমাকে পেছনে ধরিস।’ এটা শুট করতে করতে ওপরে গেলাম। দরজা খুললাম, ভেতরে গেলাম, দেখলাম দুটো বাজারের থলি। অরুণকে বললাম, ‘খোল অরুণ।’ একটার মধ্যে খালি চোখ (এ সময় তাঁর কণ্ঠস্বর কান্নায় রুদ্ধ হয়ে যায়), আরেকটার মধ্যে ...(অস্পষ্ট)। এ রকম বধ্যভূমির চিত্র অনেকই ধারণ করেছি। সেগুলো সব ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিতে হয়েছে, সুকদেবের কাছে।
জাহীদ: সুকদেবকে পাঠাতে হলো কেন?
আমজাদ: স্টপ জেনোসাইডটা সুকদেব আরম্ভ করেছিলেন। পরে জহির ভাই সেটা নিজে করবেন বলে অনুরোধ করেছিলেন। সুকদেব সেটা জহির ভাইয়ের জন্য ছেড়ে দেন। তবে জহির ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর শর্ত ছিল, যদি দেশ স্বাধীন হয়, তাহলে পরেরটা সুকদেব করবেন। সেই সূত্রে আমরা এগুলো শুটিং করেছি। জহির ভাই তো তখন শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজছেন, তাই আমরাই শুটিং করেছি।
জাহীদ: কেমন ছিল সেই সময়টা?
আমজাদ: জহির ভাইয়ের চিত্রনাট্যের কাজ করতাম আমি। তখন আমার ঘাড়ে পাঁচটা পরিবার চেপেছে। সে সময় আমি নামকরা কেউ না, অত পয়সাও নেই। আমি যদি কোথাও চলে যাই, এরা সবাই না খেয়ে মরবে। আবার জামালপুর থেকে আমার বাবা চিঠি লিখেছেন, ‘তুমি তো কমিউনিস্ট পার্টি করো, তুমি এই পাড়ায় এসো না, ওরা তোমাকে রাতে খুন করবে। (কাদের কথা বলছেন, তা ষ্পষ্ট করেননি। হতে পারে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বা রাজাকারদের কথা বলেছিলেন।)’
জাহীদ: মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে যেসব কাজ করেছেন, সেগুলো নিয়ে আপনি কি তৃপ্ত?
আমজাদ: দেখেন, জীবন থেকে নেয়া আমার লেখা। মানে মুক্তিযুদ্ধের আগে জীবন থেকে নেয়া আমি লিখলাম। (জহির রায়হান এ ছবির চিত্রনাট্য আমজাদ হোসেনকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন), তারপর অনেক পরে আমি একটা ছবি বানালাম, জন্ম থেকে জ্বলছি। ওটাও মুক্তিযুদ্ধের ওপরে। তারপর তো তৌকীর আমার একটা উপন্যাসের ওপর ছবি করল। জয়যাত্রা। বাচ্চাদের আর বড়দের জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লিখেছি। আমাদের জীবনের একেবারেই উত্তপ্ত সময়, যখন ফুল ফোটে, তখন উনসত্তর থেকে, মানে আসাদ থেকে একাত্তর পর্যন্ত পুরোটাই আমাদের চোখে দেখা। জীবন থেকে নেয়া মুক্তি পাওয়ার পর পালিয়ে পালিয়ে থাকতাম। কর্নেল বশীর বলে এক সেনা কর্মকর্তা জীবন থেকে নেয়ার ব্যাপারে আমাকে খুঁজে চলেছিল। আমার আত্মীয়স্বজনের কাছে খোঁজ নিত।
জাহীদ: আরও কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে?
আমজাদ: ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত এমইএসের (মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার সার্ভিসেস) ঠিকাদারি করতাম আমি। যশোরে ছিল কাজ। তখনই শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে একদিন ফোন করে বলল, ‘আমজাদ, তুই যদি আমাকে আমার সিনেমার জন্য উপন্যাস না দিস, তাহলে তোকে গুলি করে মেরে ফেলব।’ সেই সময় আমি আমার নিরক্ষর স্বর্গে উপন্যাসটা লিখে পাঠিয়ে দিলাম সিনেমা পত্রিকার ঈদসংখ্যার জন্য, যশোর থেকে। সেটা থেকেই পরে নয়নমনি সিনেমাটা তৈরি করলাম। শেখ মনি আমাদের বন্ধু ছিল। চলচ্চিত্র পরিচালক ফকরুল আলম আছে না, মনি ছিল তার বন্ধু। বিন্দু থেকে বৃত্ত ছবিটির প্রযোজক ছিল। ছবির নামটা আমারই দেওয়া। ইন্দিরা রোডে বাসা ছিল। স্বাধীনতার আগে মনিকে কখনো পায়জামা–পাঞ্জাবি আর স্যান্ডেল ছাড়া দেখিনি। রাজনীতির প্রতি খুবই আন্তরিক ছিল সে। মিছিলটিছিল প্রচুর করেছে। স্বাধীনতার পরই কেবল ওকে স্যুট পরতে দেখেছি।