গোলাম মুরশিদের সাক্ষাৎকার

বাংলা গানের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেগুলো ইতিহাস নয়

বাংলা গানের ইতিহাস নামে নতুন বই লিখেছেন গোলাম মুরশিদ। গবেষণাগ্রন্থটি এ মাসেই বের হবে প্রথমা প্রকাশন থেকে। নতুন করে কেন বাংলা গানের ইতিহাস লিখতে উৎসাহী হলেন এই সমাজনিষ্ঠ গবেষক? কেনই–বা তিনি বলছেন, আদতে বাংলা গানের ইতিহাস হয়নি? প্রশ্নোত্তরে নিজের জীবনের বর্ণিল স্মৃতিসমেত সেসব তিনি জানিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজকে।

গানের বর্ণিল ভুবনে বেড়ে উঠেছেন গোলাম মুরশিদ
অলংকরণ: আরাফাত করিম
প্রশ্ন

আলতাফ শাহনেওয়াজ: যত দূর জানি, এবারের বইমেলায় বাংলা গানের ইতিহাস নামে আপনার একটি বই বের হবে প্রথমা প্রকাশন থেকে। হঠাৎ বাংলা অঞ্চলের গানকে উপজীব্য করে বই লিখতে উৎসাহী হলেন কেন?

গোলাম মুরশিদ: হাফপ্যান্ট পরতাম যখন, তখন থেকেই গান শুনছি। সে তো আজকের কথা নয়! তখনকার দিনে টিভি কেন, বাড়িতে একটা রেডিও পর্যন্ত কল্পনা করতে পারতাম না। হেড স্যার স্কুলের জন্য রেডিও কিনতে বরিশাল শহরে নয়, সেই সুদূর ঢাকায় গেলেন। স্টিমারে ফিরে এলেন বিজয়ীর মতো। সঙ্গে বোঁচকা-বুচকি! কোনটার মধ্যে রেডিওটা লুকিয়ে আছে, কে জানে! আমরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। পেল্লায় বড় একটা বোঁচকার মধ্যে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য সেই রেডিও। তার সঙ্গে আছে আরেকটা কী যেন বলে! যেটা না হলে নাকি রেডিওটা চলে না, পরে শুনলাম ব্যাটারি। পরের দিন স্কুলে বলতে গেলে মচ্ছব, ছাত্রদের রেডিও শোনানো হবে লেইজারের সময়। তখন অবসর সময়কে আমরা বলতাম লেইজার। তা, রেডিওটা চালানো গেল না! কেউ জানে না, চালায় কী করে। কী হবে এখন! শেষকালে শোনা গেল, দারোগা সাহেবের ছেলে জানে। খোঁজো, খোঁজো তাকে। ছাত্ররা ছুটল উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে। পারলে বোধ হয় আকাশেও উড়ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই দারোগাপুত্র হাজির। সে এল যুবরাজের মতো।

সে তুকতাক কী করল। রেডিওটা ঘর্ঘর, কড়কড় নানা রকম শব্দ করতে লাগল। শেষে মানুষের কথা বের হলো রেডিওটার পেট থেকে। সেই রেডিওতে গান শোনা। আরেক দিন গান শুনেছিলাম কলের গানে, ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর।’ দিব্যি দিয়ে বলছি, কিচ্ছু অর্থ বুঝিনি। কিন্তু সেখানে একটি ছেলে ছিল, ত্যাঁদড়। সে একটু কেশে, চোখ টিপে এমন একটা ইঙ্গিত করল যে ছোটদের এ গান শুনতে নেই। আর যায় কোথায়! কথাগুলো মাথায় গেঁথে গেল।

আরেক দিন রাতের বেলা। ঝড়ের ভয়ে আমাদের নৌকাটা আশ্রয় নিয়েছিল একটা খালের মধ্যে। তখন পাশের বাড়িতে শুনেছিলাম কলের গানে, ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল গো!’ কত কথা ভুলে গেছি। আশ্চর্য! সত্তর বছরের বেশি হলো, গানটার কথা আজও ভুলে যাইনি।

তারপর ঢাকায়। গান শুনলাম গুলিস্তানে, সংগীত সম্মেলনে। নাম শুনেছি এমন গায়কদের অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় গণিত পরীক্ষার আগের রাতে গান শুনেছিলাম সদরঘাটে, মাস্তান গামা ও গুল মোহাম্মদ খানের। ভেবেছিলাম হোস্টেলে ফিরে মেরে দেব। রাত দুটোর সময় ফিরে এসে মারা আর হলো না, ঘুমে অচেতন।

প্রশ্ন

আলতাফ: বাংলা গানের একটি সমৃদ্ধ পরম্পরা আছে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ–এ যতটা কবিতা, তার চেয়ে বেশি ছিল ধর্মীয় সংগীত। এরপরের কাব্যসমূহ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা কবিগান বা অনেক পরের বৈষ্ণব পদাবলি—এগুলো তো আসলে গীতই হতো। এসব সূত্রে দেখা যায়, বাংলা গানের একটি প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস রয়েছে। তবু আপনার আবার বাংলা গানের ইতিহাস লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভবের পেছনের কারণগুলো কী?

গোলাম মুরশিদ: একটা বড় নদীতে নেমে সাঁতার কাটছেন। অনেকক্ষণ ধরে। ইতিমধ্যে বাঁক নিয়েছে নদীটা। আপনি দেখতে পাননি। দেখা যায় না। কিন্তু নদীর ধারে যে পাহাড় আছে, সেই পাহাড়ে চড়ে একজন মানুষ নদীটা যে বাঁক নিয়েছে, তা দেখতে পাচ্ছেন। একটু দূর থেকে না দেখলে, পরিপ্রেক্ষিতটা ভালো করে দেখা যায় না। একটা বিশেষ সময়ে বৈষ্ণব পদাবলির বান ডেকেছিল। এ কথা বলে আপনি সেই পদাবলিনির্ভর কীর্তন গানের বিচিত্র বিকাশের কাহিনি বললেন। আমার বিবেচনায়, এটা ঠিক ইতিহাস হলো না। কারণ আমি বুঝতে পারছি না, কেন কীর্তন গান ঠিক ওই সময় অমন শত ধারায় পাহাড় থেকে নেমেছিল। মুসলমান কবিরা তাঁদের কাহিনি-কাব্যে মানব-মানবীর প্রেমের ছবি এঁকেছিলেন। হিন্দু কবিরা আঁকেননি। কেন? ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে বঙ্গদেশে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গসংগীত এসেছিল। কেন? মুসলমান সমাজে গান শোনা বারণ ছিল। তারপর একসময় তারা গান শুনতে আরম্ভ করল। কারণটা কী?

বাংলা গানের যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেগুলো তাই ইতিহাস নয়, খাঁটি ইতিহাস চাই।

আরও একটা কারণ, আদতে বাংলা গানের ইতিহাস হয়নি। হয়েছে বাংলা গানে রাগ–রাগিণীর ইতিহাস। ধরা যাক, আপনি একটা গান লিখেছেন। তাতে ইমন-কল্যাণ সুর দিচ্ছেন। কিন্তু সুরটা হয়ে গেল ইমন-ভূপালি। অথবা কোনো রাগিণীরই সুর হলো না। কিন্তু আপনার বন্ধুরা শুনে বললেন, চমৎকার লাগছে সুরটা। এই সুরটি হলো খাঁটি বাংলা গানের সুর। চর্বিত চর্বণ করিনি, আমি লিখতে চেষ্টা করেছি এই বাংলা গানের ইতিহাস, আমার মতো করে। গ্রন্থপঞ্জিতে যেসব পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইয়ের নাম লেখা আছে, সেগুলোর সঙ্গে আমার মতের মিল হবে না। সরি!

প্রশ্ন

আলতাফ: আপনার বইয়ের বৈশিষ্ট্য কী? এখানে নতুন এমন কী আছে, যা বাংলা গানের প্রতিষ্ঠিত যে ইতিহাস রয়েছে, তার মধ্যে অনুপস্থিত?

গোলাম মুরশিদ: বাংলা গানের ইতিহাস বলে যেসব বই আছে, সেগুলো মোটেই ইতিহাস নয়—দেশ, কাল, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, সেগুলোতে আছে গান সম্পর্কে একমাত্রিক আলোচনা। ছবিটাকে ত্রৈমাত্রিক করতে হলে আরও দুটো মাত্রা যোগ করতে হবে। তখনকার সমাজ আর তখনকার পরিপ্রেক্ষিত।

আরেকটা কারণে আমি বাজারে চালু বইগুলোকে বাংলা গানের ইতিহাস বলে স্বীকার করি না। এসব বইতে যে গানের কথা আছে, সে গানের বেশির ভাগই বাংলা গান নয়। লেখকেরা তাতে দেখিয়েছেন, এসব গানে কী কী রাগ–রাগিণী ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা কতটুকু ঠিক হয়েছে। ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের গান। তিনি সংগীতজীবন শুরু করেছিলেন ভাঙা গান দিয়ে। সুরে তাঁর আদৌ কোনো অবদান ছিল না তখন। কেবল কথাগুলো তাঁর। অবশ্য সে–ও কম নয়। তারপর ধীরে ধীরে তিনি সুরের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। দিন যায়, তিনি রাগ–রাগিণীতে মিশেল দেন। আরও দিন যায়, তিনি আরও ভেজাল দেন। তার অর্থ, তিনি রাগ–রাগিণী যতই বিসর্জন দিয়েছেন, ততই তিনি আপনার সুর সৃষ্টি করেছেন। এর উল্টোটা করেছেন নজরুল। যত দিন গেছে, ততই রাগ–রাগিণীর দাসত্ব স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু আধুনিক বাংলা গান সে অর্থে রাগ–রাগিণীর প্রভাবমুক্ত খাঁটি বাংলা গান।

আমি বাজারে চালু বইগুলোকে বাংলা গানের ইতিহাস বলে স্বীকার করি না। এসব বইতে যে গানের কথা আছে, সে গানের বেশির ভাগই বাংলা গান নয়। লেখকেরা তাতে দেখিয়েছেন, এসব গানে কী কী রাগ–রাগিণী ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা কতটুকু ঠিক হয়েছে।
প্রশ্ন

আলতাফ: এ বই লেখার চিন্তা কখন আপনার মাথায় এল?

গোলাম মুরশিদ: বলা মুশকিল—বছরের মাপে বলতে পারব না। বরং অন্য এক একক দিয়ে বলি—যবে থেকে সংগীত সুন্দরীর প্রেমে পড়লাম। তবে প্রথম প্রণয় থাকে মোহাচ্ছন্ন। তখন প্রেমিকার চরিত্র বিচার করা যায় না। ঘোর যখন কেটে যায়, তখন খোঁজখবর নেওয়া যায়। যদ্দুর মনে পড়ে, যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিই, মোটামুটি তখন ওর দিকে নজর গেল। এ সময় হাত মকশো করার জন্যে দুখানা বই কিনি। একখানা শান্তিদেব ঘোষের রবীন্দ্রসংগীত; আরখানা নারায়ণ চৌধুরীর সংগীত পরিক্রমা। সে বইয়ের লেখক নারায়ণ চৌধুরী আর প্রকাশক শ্রীশ কুণ্ডের সঙ্গে নাটকীয় পরিচয় হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। একদিন ‘জিজ্ঞাসা’র মালিক শ্রীশবাবুর কাছে গিয়েছিলাম বইপত্র দেখতে আর এক কাপ চা খেতে। দেখি, সেখানে এক প্রৌঢ় ‘ভদ্দোল্লোক’ বসে গপ্পো করছেন। আমি বসার পর, শ্রীশবাবু বললেন, ইনি নারায়ণ চৌধুরী। তারপর কোনো বিশেষণ যুক্ত করার আগেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল দুটো শব্দ—সংগীত পরিক্রমা! ‘ভদ্দোল্লোক’ খুশিতে আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসলেন। শ্রীশবাবুও।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ভর্তি হলাম কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে। ঢাকা হলে থাকি। হঠাৎ মাথায় এক মতলব এল—যাবই, আমি বাণিজ্যেতে যাবই। উচ্চাঙ্গসংগীত শিখতে না পারলে জীবনই বৃথা। শুভলগ্ন দেখে চলে গেলাম নাজিমুদ্দিন রোডে রেডিও পাকিস্তানের অফিসের উল্টো দিকে যে চায়ের দোকান, সেখানে। কেন? সেখানে ওস্তাদ আয়াত আলি খান তাঁর অনুষ্ঠান শেষ হলে চা খেতে আসবেন। ওস্তাদজি বিখ্যাত সুরবাহার বাদক। আলাউদ্দীন খানের ছোট ভাই। চায়ের দোকানটা ছিল ঢাকা হলের কাছেই। রিকশা লাগে না। ভাবলাম, তাঁর সঙ্গে কয়েকবার কথা বলার পর, আমি তাঁকে বলেই ফেলব যে দয়া করে আমাকে আপনার শিষ্য করে নেন। আপনার কিশোরী কন্যার প্রতি আমার অসম্ভব মোহ তৈরি হয়েছে। ওদিকে, আমার পেছনে লাগল এক ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমার এক আত্মীয় যখন জানতে পারলেন, আমি সংগীতবালার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন তিনি বাবাকে লিখলেন। বাবা খবর পেয়ে ঢাকায় এসে আমার কান ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘চল তোর আর পড়ালেখার দরকার নেই।’ এ ঘটনা থেকে সংগীত–সুন্দরীর প্রতি আমার কৌতূহল কখন ডানা মেলল, তার একটা খসড়া ধারণা পেতে পারেন।

প্রশ্ন

আলতাফ: বইটি যদি চর্যাপদ থেকে শুরু হয়, তবে এর শেষ বিন্দুটি কোথায়, আপনি কোথায় গিয়ে থেমেছেন?

গোলাম মুরশিদ: নাম দিয়েই এই সীমানা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত। যদি চর্যাপদ একটা দিকের সীমানা, অন্যদিকের সীমানা হবে বিশ দশক। আমি তো বিশ বিশের ইতিহাস লিখতে পারি না। কারণ, তার মধ্যে আমি যে এখনো সাঁতার কাটছি। একটা লেন্স চোখের একেবারে কাছে নিয়ে এলে ছবিটা বড় হয় না, বরং হারিয়ে যায়। আমার জন্মের ইতিহাস চেষ্টা করলে লিখতে পারি। কিন্তু শত চেষ্টা করলেও আমার মৃত্যুর ইতিহাস লিখতে পারব না। ইতিহাসে পরিণত হতে কিছু দূরত্ব লাগে। অন্তত পঞ্চাশ/ষাট বছর। মোটামুটি মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেখতে পাই। তাই সেটাই আমার দিকের সীমানা।

প্রশ্ন

আলতাফ: আপনার সামনের দিনের পরিকল্পনা কী? নতুন আর কী লিখতে চান?

গোলাম মুরশিদ: বহু বছর ধরে ভাবছিলাম, গানের ইতিহাস লেখার পর লিখব বঙ্গীয় স্থাপত্যের ইতিহাস। এই স্থাপত্যের বয়স হাজার বছরের বেশি। বঙ্গের ভেজা আবহাওয়ায় বেশির ভাগ স্থাপত্যই বিলীন হয়ে গেছে। ইতিহাসকারেরা এই স্থাপত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন, একটা মসজিদ কতটা লম্বা, কতটা চওড়া, দেয়ালগুলো কতটা পুরু, কী দিয়ে তৈরি, দরজা-জানালার বিবরণ, খিলানগুলো কী রকম, কটা গম্বুজ আছে, মসজিদটাকে ভেতরে–বাইরে কী দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে ইত্যাদি। বাঙালিরা বর্ণনা দেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ। সেখানে কোনো ঘাটতি পাবেন না। ঘাটতি আছে বিশ্লেষণে। যেমন, যুগে যুগে এই স্থাপত্যের স্টাইলে যে বিবর্তন হয়েছে, তার ইতিহাস কেউ লেখেননি। আমি সেই ইতিহাস লিখতে চাই। কিন্তু সে বাসনা এখন পূরণ হবে কি না, সন্দেহ হয়। আমার শরীরটা এখন একাত্তরের ঢাকার মতো। চারদিক থেকে নানা রোগ গেরিলাদের মতো নিঃশব্দে প্রবেশ করছে। সম্প্রতি সেসব গেরিলার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পারকিনসন ‘সায়েব’!

জীবনে কত অভিজ্ঞতা হলো মন্দ–ভালোর, ইচ্ছা করে তার ভাগ দিই আপনজনদের। আবার মনে হয়, কী হবে এই স্মৃতির আবর্জনা দিয়ে অন্যদের ভারাক্রান্ত করে? একবার লিখতে শুরু করেছিলাম। লিখেছিলাম ‘অ-শিক্ষার ইতিকথা’ আর ‘অ-সংবাদের ইতিকথা’। বাকি থাকল ‘অশিক্ষা বিস্তারের ইতিকথা’, ‘স্বশিক্ষার ইতিকথা’ আর ‘গরু খোঁজার ইতিকথা’। ‘অ-শিক্ষার ইতিকথা’ আমার শিক্ষাজীবনের কাহিনি। অসংবাদের ইতিকথা মানে আমার বিবিসি জীবনের গালগপ্পো, অশিক্ষা বিস্তারের ইতিকথা মানে আমার শিক্ষকজীবনের ব্যর্থতার দুঃখকথা, স্বশিক্ষার ইতিকথা মানে নিজে নিজে শেখার বৃত্তান্ত। আর গরু খোঁজার ইতিবৃত্ত মানে আমার গবেষণাজীবনের অ-বিজ্ঞতা।

প্রশ্ন

আলতাফ: নিজের কাজ তথা লেখালেখির দিকে ফিরে তাকিয়ে সংক্ষেপে শেষ কথাটি কী বলবেন?

গোলাম মুরশিদ: এ প্রশ্নটা সবচেয়ে কঠিন। আমাকে আত্মহত্যা করার আদেশ দেওয়ার মতো। যিশু খ্রিষ্টকে নাকি ক্রুশবিদ্ধ করার আগে যে ক্রসে চড়িয়ে হত্যা করা হয়, সেই ক্রুসটা তাঁকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল বধমঞ্চ পর্যন্ত। তারও আগে সক্রেটিসকেও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে বলার মতো। এমন দুটো বিখ্যাত নজির থাকার পর আমি আর দ্বিধা করি কেন!

দেখুন, আমি কটা বই লিখেছি, আমি নিজেই তার হিসাব জানি না। ভড়ং নয়, সত্যি বলছি। তবে কাগজপত্র দেখে বলতে পারব। তিরিশটার মতো। আমিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে বিশ্বাস করি না। দেবেন্দ্রনাথ করলে কী হতো আমাদের! কার গান দিয়ে, জন্মদিন থেকে মৃত্যুদিবস অবধি সুখ–দুঃখে, বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত—সব রকমের জুতসই গান পেতাম কোথায়! এসব বইয়ের মধ্যে আমার পিএইচডি ডিগ্রির অভিসন্দর্ভ, রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ, আশার ছলনে ভুলি: মাইকেল-জীবনী, কালাপানির হাতছানি: বিলেতে বাঙালির ইতিহাস, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল জীবনী, আঠারো শতকের বাংলা গদ্য: ইতিহাস ও সংকলন—এগুলো লিখেছি সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। আমার এই স্নেহের সন্তানেরা যেন ‘থাকে দুধে–ভাতে’! মোট কথা, গবেষণা করা আর বই লেখা আমার নেশা। তবে আমি পরিবেশবাদী। আমার তাই একটাই দুঃখ, বছর বছর বইয়ের জন্ম দিয়ে সবুজ গাছ ধ্বংস করা। কী দুর্ভাগ্য ভেবে দেখুন, একটা বই সম্পাদনা করলাম—বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান, তা তারও ওজন হলো ৯ কিলোগ্রাম! কত গাছ গেল! ছি ছি ছি!