সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ

আমি একধরনের আউটসাইডার

হেলাল হাফিজ
হেলাল হাফিজ

হেলাল হাফিজ: ২০০০-২০২০।

তাঁর মা কোকিলা খাতুন। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার। কবি। কবির পুত্র কবি হয়েছেন। তাঁর সব কবিতা কি আমি পড়েছি? পড়েছি। একাধিকবার। মুদ্রিত যত কবিতা। যদিও আমি কবিতার তেমন ভালো পাঠক না কখনোই। ছন্দ বুঝি না, মাত্রা বুঝি না। ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে হলে কি আর সিনেমা বানানোর কৌশল জানতে হয় দর্শককে? সাধারণ দর্শকের একরকম দেখা আছে। তেমন একরকম পড়া আছে সাধারণ পাঠকেরও। বোঝাপড়া আছে।
আমি খুব সাধারণ একজন পাঠক। বুঝে না বুঝে কবিতা পড়ি। হেলাল হাফিজের কবিতা পড়ি বারবার।
গত বছর, আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ঘটনা। হেলাল ভাই খুব অসুস্থ শুনলাম। তাঁকে দেখতে গেলাম আর কোথায়, প্রেসক্লাবে, আর কোথায়? সঙ্গী কবি মোস্তফা ইকবাল। মর্মে বিঁধল পাথরের কিছু অভিমান কিংবা এক শামুক, গুটিয়ে থাকা।
কিছুদিন পর ‘দিব্যপ্রকাশ’ থেকে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ করতে বলা হলো আমাকে। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ের প্রচ্ছদ। হেলাল ভাইয়ের নতুন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। কত দিন পর!
প্রচ্ছদ বানালাম। একটা না, তিনটা। অ্যাক্রিলিকে পেইন্টিং। হেলাল ভাই পছন্দ করলেন। কিন্তু কাজ এখানেই শেষ না, বইয়ে কবিতা থাকবে ৩৫টা। অলংকরণ যাবে কবিতার সঙ্গে।
‘অক্টোবরের মধ্যে করে দিবি তুই।’
অবশ্যই। পাণ্ডুলিপির প্রুফ কপি দিয়ে গেল সোহরাব। ছোট ছোট ৩৫টা কবিতা। একবার পড়লাম। দীর্ঘতম কবিতা ১৮ লাইন। হ্রস্বতম কবিতা ১ লাইন, ৫ শব্দ। আরও আট-নয়-দশবার পড়লাম এবং ভুলে গেলাম। এটা হিরণদার কাছ থেকে শিখেছি। হিরণ মিত্র। -কবিতা পড়ো এবং ভুলে যাও। না হলে তুমি আঁকবেটা কী? - বিশদ করি একটু। কবিতা কী? শব্দের নেকলেস। শব্দ, অক্ষরের নেকলেস। অক্ষর? ছবি। শেষ পর্যন্ত কবিতা তো অক্ষর দিয়ে বানানো ছবিই। ছবির পাশে ছবি। দুই ছবি এককথায় বললে কি হবে? অতএব সব ভুলে গিয়ে আমি ৩৫টা কবিতা আঁকলাম। কী হলো না হলো এখন হেলাল ভাই বলবেন।
বই প্রকাশিত হলো অক্টোবরেই। সোহরাব ‘সৌজন্য’ এক কপি বই নিয়ে এল।
‘হেলাল ভাই আপনার সাথে কথা বলবেন, দাদা।’
বলে সোহরাব কল দিল এবং ধরিয়ে দিল হেলাল ভাইকে।
‘হেলাল ভাই?’
‘কে? ধ্রুব?’
‘হ্যাঁ, হেলাল ভাই।’
‘তুই আয় তোর ঠ্যাঙ ভেঙে দেব।’
‘ই!’
‘তুই এই সব কী করছিস বল তো? এই সব কি কবিতার অলংকরণ হলো? আমি তো ভাবতেই পারি নাই...।’
আমি...আমার কী হলো, লেথোলজিকা?
‘বাকরুদ্ধ’ শব্দটাই মনে পড়ল না।
‘আরে না রে শোন। তোর সমস্ত অলংকরণই আমার খুব পছন্দ হয়েছে! তুই আয়, এখনই আয়।’
পাথরের, নদীর বা গাছের উচ্ছ্বাস। আমি সামান্য, আর কত চাই!
আজ বুধবার। ৮ জানুয়ারি। ২০২০।
যুবক অনার্য হেলাল ভাইয়ের আরও কিছু কবিতা ইংলিশে অনুবাদ করেছেন। বই হয়েছে। বইয়ের নতুন সংস্করণ হবে। যুবক অনার্য এবং প্রকাশক এসেছিলেন গত সপ্তাহে। হেলাল ভাই বলেছেন, নতুন সংস্করণের বইটার প্রচ্ছদ আমাকে করে দিতে হবে। কী ড্রয়িং, রঙের আন্দাজ, এসব বালাই এখন নেই আর। উন্নততর প্রযুক্তি মুদ্রণকাজ সহজতর করে দিয়েছে। কম্পিউটারে যা দেখা যায়, ধরে নেওয়া যায় সেটাই ‘প্রিন্টেড’ প্রচ্ছদ। ডিজাইন বানিয়ে কালার প্রিন্ট করে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম হেলাল ভাইকে। গতকাল দুপুরে। আবার মায়া, স্নেহের উষ্ণতা।
কবি হেলাল হাফিজের ৪ না, ৫টা, সব বইয়ের প্রচ্ছদ তাহলে আমি করেছি।

আমার লেখা শেষ এখানেই। না, কূটনামি করি একটু। হেলাল ভাই কবি। হেলাল ভাই প্রেমিক। নেত্রকোনার হেলেন সেই কবে আমাদের কাছে ট্রয়ের হেলেন হয়ে গেছেন। হেলাল ভাই প্যারিস হলেন না। কেন হবেন? অবিমৃশ্যকারী বোকা প্যারিস। নাসরিন আপা, তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে কি হেলাল ভাইয়ের প্রেম ছিল? আমি একদিন তাঁদের একসঙ্গে দেখেছিলাম রিকশায়। আর একটা সন্দেহজনক কবিতা ‘অচল প্রেমের পদ্য’ প্যাকেটে ছিল, আছে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইতেও। তিন লাইনের বলে উঠিয়ে দিচ্ছি,
ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’,
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।
‘তনা’ কে?
তসলিমা নাসরিন?
আচ্ছা, এরা কারা? জুলেখা, শিরি, সাবিত্রী, রজকিনীর আড়ালে–আবডালে?
হেলাল ভাই এবং তাঁর প্রেমিকাদের নিয়ে দারুণ একটা ফিকশন লেখা যায়। নিশ্চয় কেউ লিখবেন কখনো। তার সঙ্গে দেখা হবে শিরি, সাবিত্রীর। এবং দেখা হবে ভাবনাদের। এক ভাবনার কথা বলি। হেলাল ভাইয়ের প্রেমিকা। কবি বলেছেন, ‘আই লাভ হার।’ আমাকে বলেছেন। চিরকাল যৌবন যার...কবিকে ভাবনা জনসমক্ষে চুম্বনের অধিকার দিয়েছেন। কবি যখন তাঁর ভাবনাকে চুমু খান, আমাদের ভাবনা করতে দোষ নেই, কবি তখন গাছ, নদী, পাথর। কবি তখন পক্ষিমাতা এক।
আর কূটনামি না করি। একজনের কথা বলি। হেলাল ভাইয়ের কবিতায় ইনি আছেন। মুহূর্তে আছেন। এখনো। চেতনে-অবচেতনে। মাতৃগর্ভের অন্ধকারেই হয়তো ঠিক হয়ে গিয়েছিল কবি হবেন কোকিলা খাতুনের ছেলে। মা অকালে চলে গেলেন, সেই ছেলেকে কে বড় করে তুলল, কবি হেলাল হাফিজ করে তুলল? সে এক বিদুষী রূপবতী। তার কবিসত্তা নিয়ে কথা উঠলেই হেলাল ভাই স্মরণ করেন দুজন মানুষকে। একজন তাঁর কবি বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার। আরেকজন সেই বিদুষী রূপবতী। সবিতা সেন। পাড়াতুতো দিদি, স্কুল মিস্ট্রেস। কবি যে হেলাল হাফিজ, একাধারে তাঁর মা, বড় বোন এবং প্রেমিকা। হয়ে ওঠা এক আশ্চর্য গল্প। হেলাল ভাই যখন বলেন গল্পটা, দেখা যায় সবিতা সেনকে, ভোরের নদীর পাড় দেখা যায় এবং কচুরিপানা ফুলের জাদুকরি রং।
‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইটা নিয়ে আর দুটা কথা বলি। আমার আমীরুল ভাই (আমীরুল ইসলাম) হসপিটালে। তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম আজ সন্ধ্যায়। দর্শনার্থী এক কবি কেবিন থেকে বেরিয়ে কথায় কথায় ‘বেদনাকে...’ নিয়ে পড়লেন। নাহ্! হেলাল হাফিজ এই বইটায় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি! আমার আবার লেথোলজিকা হলো। বিশেষ একটা শব্দ আমি ভুলে গেলাম। বারবার ভুলে যাই। না হলে কবি সাহেবকে বলতাম। আরে, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে কেউ? গেছে কখনো? আমরা এমন অনেক চটকদার কথা বলি, অর্থ হয় না, কিছু হয় না।
বিশ্বাস করি তর্কে বহু দূর। তর্ক করি না। হেলাল হাফিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটা? ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’? ‘অস্ত্র সমর্পণ’? ‘বাম হাত তোমাকে দিলাম’? না ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ের ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’? ‘লীলা’? ‘কৃষ্ণপক্ষ’?

শ্রেষ্ঠ কবিতা। গোলমেলে ব্যাপার, বিরক্তিকর এবং সর্বতোভাবেই বাণিজ্যিক ধারণা। কবি তার সর্বস্ব নিয়েই কবি। সব শব্দ সব অক্ষর নিয়ে। তাহলে শ্রেষ্ঠ কবিতা নির্বাচন বাদ থাক। ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বইয়ের ‘বাসনা’ কবিতাটা,
আগামী, তোমার হাতে
আমার কবিতা যেন
থাকে দুধে-ভাতে।
কী দারুণ উচ্চারণ! পৃথিবীর সব কবির হয়ে এক কবির।
শব্দ সব প্রকাশ করতে পারে না। যতটুকু পারে, মানে আমি যতটুকু পারি, লিখলাম। এই হলেন আমার হেলাল ভাই। আমার কবি হেলাল হাফিজ।

পুনশ্চ: বহুদিন আগে হেলাল ভাই আমাকে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের কথা বলেছিলেন। নাম ঠিক করে রেখেছেন। সেটা ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ না, আরেকটা নাম। সেই নামটা আমার মনে আছে।

৯ জানুয়ারি ২০২০।
দুপুরে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ করেছি, ‘সাংবাদিকতায় সাক্ষাৎকার’। মিথুনের (কামরুল হাসান) আসার কথা দুইটায়। সময়ানুবর্তী ছেলে। সে এল ১টা ৫৯ মিনিটে।
‘চলো মিথুন।’
গন্তব্য প্রেসক্লাব। যাত্রা শুরু করে মনে হলো কথাটা, ‘সাংবাদিকতায় সাক্ষাৎকার’ বইটা পড়া থাকলে কি ভালো হতো? সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছি! উত্তেজনা বোধ এবং সংকোচের ককটেল ভেতরে। ফাটল বলে। দূর! আমি কি সাংবাদিক নাকি? সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছি? তা তো না, কিছু কথা বলব। বলবও না, আসলে শুনব।
ঠিক ৩টায় আমরা প্রেসক্লাবে। তিনতলায় উঠলাম। মিডিয়া সেন্টারে। হেলাল ভাই অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য। বেতফল রঙের দিন। অল্প শীতার্ত। আলোর সোর্স কম। তাও মিথুন কিছু ছবি তুলল। বেতফল রঙের দিনে এক কবি। তিনি কী বলেন?

প্রশ্ন: হেলাল ভাই, আপনি শেষ কবে কবিতা লিখছেন?
হেলাল হাফিজ: ‘বাসনা’ এই বইয়ের (বেদনাকে বলেছি কেঁদো না) শেষ কবিতা। এটা হতে পারে। নাকি...ঠিক মনে নেই।
প্রশ্ন: কবিতা কি লেখেন? না টাইপ করেন?
হেলাল হাফিজ: লিখি। লিখি। লেখা স্ক্যান করে ফেসবুকে দিই।
প্রশ্ন: আপনি কি এখনো কার্ড খেলেন?
হেলাল হাফিজ: না। ভাইরাস যত আছে সবই ছেড়ে দিয়েছি। আগে দিনে তিন প্যাকেট সিগারেট খেতাম, ছেড়ে দিয়েছি। শরীরের কারণে। শরীর আর নিতে পারে না। পানাহারের অভ্যাস ছিল। সেইটাও ছেড়ে দিয়েছি। জুয়া খেলতাম, সেইটাও ছেড়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: এখন সময় কাটে কীভাবে?
হেলাল হাফিজ: বেশি পড়তেও পারি না, চোখ খারাপ। অল্প কিছু সময় কাটে লাইব্রেরিতে। বেশির ভাগ সময় কাটে ফেসবুকে।
প্রশ্ন: নিঃসঙ্গ?
হেলাল হাফিজ: নিঃসঙ্গতা তো আমার প্রিয় বন্ধু বা প্রেমিকাও বলা যায়।
প্রশ্ন: এই যে কবিতার এই আকালে আপনার বই এত বিক্রি হয়, এটা কি আপনাকে আনন্দিত করে?
হেলাল হাফিজ: আমার যেহেতু কিছুই নেই, আমার কবিতা যদি মানুষ পছন্দ করে বুকে টেনে নেয়, এর চেয়ে বড় আনন্দ তো আর কিছু নেই। এইটাই আমার অক্সিজেন। আমি প্রকৃতি থেকে যেভাবে অক্সিজেন নিই বাঁচার জন্য, তার চেয়ে বড় অক্সিজেন হলো আমার মানুষের ভালোবাসা।
প্রশ্ন: আচ্ছা হেলাল ভাই, সেই কবে তারুণ্যে প্রথম আমরা আপনার কাছে আসছি, তারুণ্যের এই স্রোত তো আপনার কাছে এখনো বহমান। তরুণেরা আসে, তরুণীরা আসে, কেমন লাগে?
হেলাল হাফিজ: এইটাই তো আমার অক্সিজেন। আমি যদি তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে না পারি, এরা যদি আমাকে ভালো না বাসে, বলতে হবে যে আমি ফেল করেছি। আমার টার্গেট তো হলো তরুণ প্রজন্ম, যে আরও পঞ্চাশ বছর বাঁচবে বা ষাট বছর বাঁচবে। এই যে আমি ‘বাসনা’ কবিতাটা লিখেছি এটা তো ওদের জন্য। ওদের হাতে আমার কবিতা যেন দুধে–ভাতে থাকে।
প্রশ্ন: বহু আগে আপনি আমাকে আপনার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম বলছিলেন। সেটা ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ না।
হেলাল হাফিজ: তোর নাম মনে আছে?
প্রশ্ন: হ্যাঁ। ‘কার কী নষ্ট করেছিলাম’।
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, ‘কার কী নষ্ট করেছিলাম’। দ্বিতীয় না, প্রথম বইই ওটা হওয়ার কথা ছিল। এই নামে বই-কভারও ছাপা হয়ে গিয়েছিল। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’-এর আগে। নামটা পরে আর পছন্দ হয়নি।
আবু হাসান শাহরিয়ার ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়েছিল। পরে দুই বছর অপেক্ষা করেছি। ’৮৩ সনে।
প্রশ্ন: আচ্ছা। তার আগের কথা কিছু বলবেন?
হেলাল হাফিজ: আমার তো ছোটবেলায় মা মারা গেছে। আব্বা খুব নামকরা শিক্ষক নেত্রকোনায়। আমাদের এলাকাটা হিন্দুপ্রধান। গান, বাজনা, কবিতা—এসবের খুব চর্চা হয়। মুসলিম পার্টটা একটু অনগ্রসর। হিন্দু জনগোষ্ঠী, তারা খুব প্রাগ্রসর শিল্প–সাহিত্যে। যখন আম্মা মারা যায়, তিন বা সাড়ে তিন বছর বয়স। আমার বড়, ভাই। এই দুই ভাইকে নিয়ে আব্বা মা ও বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। খাওয়াদাওয়া, রান্নাবান্না। চার বছর পর আবার বিয়ে করলেন।
এই যে আমার শৈশব কৈশোরের পুরো সময়টা, আমার জীবন কিন্তু কেটেছে অন্য রকমভাবে। ক্লাসফ্রেন্ড তার দিদি, মা, আদর করতেছেন। আমি হয়তো বাইর হইয়া কোনো মাসিমার বাসায় গেলাম, সারা দিন আমায় রাইখা দিছে, গোসল করাইছে, খাওয়াইছে। এই ছিল আমার জীবন। আব্বা জানত তার ছেলেকে সবাই আদর করে। আর আমি তো তখন দেখতে একদম টুকটুকে ফুলের মতো, কিউট একদম, আম্মার মতন চেহারা। নানু বলত।
তখন থেকেই আমি একধরনের আউটসাইডার। গৃহহীন। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: সবিতা সেন সেই কৈশোরেই...?
হেলাল হাফিজ: সবিতা সেনের কথা তোকে আগে বলেছি। শি ইজ মাই সোল। শি ওয়াজ মাই সোল। সে হল সবিতা সেন।
আমি যখন ফোরে পড়ি, এই সবিতা সেন আমাদের স্কুলের উল্টো দিকের গার্লস স্কুলের মিস্ট্রেস। অসম্ভব সুন্দরী এবং অসম্ভব ভালো গান করেন। রূপসী ও বিদূষী—দুটোই। শহরের এমন কেউ নেই যে ওয়ান সাইডেড প্রেমে পড়েনি।
তিনি তো আর সবার প্রেমে পড়বেন না, কিন্তু বাকি সবাই তাঁর প্রেমে পড়েছে—এই রকম অবস্থা আরকি। তিনি একজন মুসলমান ছেলেকে ভালেবাসতেন। হক ভাই নাম। আমাদের নেত্রকোনার ছেলে। নেত্রকোনার মগরা নদীর ওই পাড়ে থাকতেন। শহরে থাকতেন দিদি। ওই প্রেম তো পরিণতি লাভ করেনি। হক ভাই অন্য জায়গায় বিয়ে করে ফেলছেন, দিদি আর বিয়ে করেননি। এই ১০–১২ বছর আগে মারা গেছেন।
তিনি আমাকে তাঁর আঁচলের নিচে আশ্রয় দিলেন। একেবারে আপন গর্ভের ছেলের মতো আমাকে লালনপালন করছেন। আমি যখন সিক্স–সেভেনে উঠেছি, তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে আমি কবিতা আবৃত্তি সুন্দর করি, শিল্প–সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক, তখন থেকে আমায় তৈরি করতে নানা ধরনের উপদেশ, আদরের ছলে ‘এইটা করবে, এইটা করবে না, এইটা করলে ভালো হবে, এভাবে তিনি আমাকে তৈরি করেছেন। আমি তাঁকে তখন কখনো দিদির মতন, কখনো মায়ের মতন মনে করি। এইভাবে তিনি আমাকে তৈরি করলেন। মানুষ করলেন। স্কুলজীবনে আমি ছিলাম অসম্ভব খেলাধুলার পাগল। খেলাধুলা ছিল আমার মূল নেশা। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন (ক্রিকেট অতটা টানত না), ভলিবল; ওই সময়ে আমি ওই রকম একটা মহকুমা শহরে লন টেনিস খেলা শিখেছি। লন টেনিস তো সব অভিজাত লোক খেলত। শহরের ডাক্তার, লইয়্যার, প্রিন্সিপাল—এই ধরনের লোকেরা লন টেনিস খেলত। আমাকে তারা সুযোগ দিয়েছে খেলা শেখার, কারণ, আব্বা খুব নামকরা শিক্ষক। সবাই আমাকে স্যারের ছেলে বলত। খেলাধুলা করতে করতে নাইনে উঠলাম। তখনই কবিতার পোকা আস্তে আস্তে মাথায় ঢুকেছে। সবিতা সেন বুঝতে পেরেছেন, আমাকে নার্সিং করতে থাকলেন, এইভাবে পড়াশোনা করতে হবে বড় কবি হতে হলে, লেখালেখির জন্য। এইভাবে তিনি আমাকে তৈরি করলেন।
আমি যখন নাইনে উঠলাম, এই যে মা এবং ছেলের বা দিদি এবং ছোট ভাই—তাঁর এক ভাই আমার ক্লাসফ্রেন্ড—তাঁর বড় ভাই আমার বড় ভাইয়ের ক্লাসফ্রেন্ড, তাঁর ছোট ভাই আমাদের সবারই আদরের, তাঁর দুই বোন ছিল, তাঁরাও আমার বন্ধুর মতন, মানে সমবয়সী আমার, সবিতা সেন আমার ১৩–১৪ বছরের বড়। আগে তো ৯–১০ বছর বয়সে একটা মেয়ের বিয়েই হয়ে যেত, ফলে তাঁকে মা ভাবতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি, সে–ও আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখত ছেলের মতো। কিন্তু ঘটনাটা যেটা ঘটল, সেটা হলো আমি যখন সেভেন থেকে এইটে উঠলাম, আমার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। জৈবিক এবং মানসিক পরিবর্তন যে সময়টায় হয়, এই সময়টা—আমাদের সম্পর্কটাতে মা-ছেলে, বোন-ভাই সম্পর্কে ফ্রয়েড ঢুকে গেছে। ধীরে ধীরে। আমার মনে এবং মগজে। এখন মনে হয়, পরে যখন আমি বিশ্লেষণ করেছি, তার মনেও ঢুকেছে। এটা স্বাভাবিক, রক্তমাংসের মানুষ। তাকে মা-ই ভাবি, দিদিই ভাবি, কিন্তু এটার সঙ্গে ফ্রয়েড মিশে গেছে। এটা যখন আমরা দুজন বুঝতে পারলাম, আমরা আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। তখন তিনি আমাকে বোঝালেন যে তুমি যদি কবিতাই লেখো, এই স্মৃতি তোমার কাজে লাগবে। কিন্তু আমরা ওর বেশি অগ্রসর হব না। মানে আমাদের বিছানায় যাওয়া ওই সব। কারণ তখনো তো তিনি আমার কাছে মায়েরই মতো, বোনের মতো। আমার আপন বোনও নেই।

এই যে হক ভাই তাঁর প্রেমিক। তখন তো নদীতে ব্রিজ হয়নি। এমনকি শীতকালেও, ভোররাতে সাঁতার কেটে হক ভাই আসতেন সবিতাদির সঙ্গে দেখা করতে। নদীর পাড়ে বাসা সবিতাদির। আমি তো অধিকাংশ সময় তার বাসায় রাত্রে রইছি। কিংবা আমি যদি আমার বাসায় রইছি, তো আগের দিন উনার ছোট ভাইকে দিয়ে খবর দিছে, হেলালকে গিয়ে বইলা আয়, কালকে সকালে যেন আসে আমাদের বাসায়। তার মানে হক ভাই আসবেন। সবিতাদি নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়ে থাকবেন। কিন্তু একা তো দাঁড়াতে পারেন না নদীর পাড়ে। ৫৫–৬০ বছর আগে চিন্তা কর, সমাজটা কেমন রক্ষণশীল, কত সচেতন থাকতে হতো। এই তখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভোরবেলা আজানের সময় নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন মগরা নদীর পাড়ে। হক ভাই সাঁতরায়ে পার হতেন এবং প্রত্যেক দিন। তখন গ্রীষ্মকালেও নদী ভরাট থাকত। হক ভাই একটা করে কচুরিপানার ফুল নিয়ে আসতেন সবিতাদির জন্য।

প্রশ্ন: হক ভাই, তাঁর প্রতি কি তখন আপনার কোনো রকম ঈর্ষা জাগে নাই?
হেলাল হাফিজ: এই যে প্রতিদিন একটা করে ফুল আনেন সবিতাদির জন্য, এইটা ধীরে ধীরে আমার মনে ঈর্ষা তৈরি করল। এইটা সবিতাদি বুঝতে পারছে যে হেলালের মনে কষ্ট হচ্ছে। একদিন বলল কি (হক ভাইকে), কালকে থেকে তুমি দুইটা করে ফুল আনবা। কচুরিপানার ফুল। একটা আমাকে আরেকটা দিদিকে দিতেন তিনি।
আমি যখন আইএসসি পাস করে ঢাকা চলে এলাম, তখন আমাদের প্রেম আরও গভীর হলো। দূরত্ব, বিচ্ছেদে আরও গভীর হলো। মানে তাঁর জন্য মাসে অন্তত দুই–তিনবার আমি নেত্রকোনা চলে যাইতাম। এমনও হইছে আমি নেত্রকোনা গেছি, কিন্তু আমার বাসায় যাইনি। যেন আব্বা টের না পায়। সোজা দিদির বাসায়। একদিন–দুইদিন থেকেছি। শহরে বের হইনি।
প্রশ্ন: আর হেলেন?
হেলাল হাফিজ: হেলেনও আমার প্রেমিকা, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমার প্রেমিকা হিসেবে তার নামটাই সবাই জানে। সবিতাদির নাম খুব কম লোকই জানে। আজকে যে হেলাল হাফিজের পাশে বসে আছ, এই হেলাল হাফিজের পেছনে তিনজন মানুষের খুব বড় অবদান। একজন আমার বাবা, কবি খোরশেদ আলী তালুকদার। সেকেন্ড সবিতা সেন। এবং কবি হিসেবে আমাদের সমসাময়িক সময়ের ধরো...রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ—তাঁরা তো আছেই, তাঁরা তো নানাভাবে প্রভাবিত করছেন, কিন্তু আমাদের সমসাময়িককালে আবুল হাসান আমাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। আমার খুব কষ্ট হয়েছে তার প্রভাব থেকে বের হয়ে কবিতা লিখতে। স্বকীয়তা তৈরি করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি মনে করি আমরা যারা ষাটের দশকে লেখালেখি করেছি, তাদের মধ্যে আবুল হাসান সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি। শ্রেষ্ঠ কবি।
ও...সেই সময়ের প্রেমিকাদের মধ্যে শঙ্করীর নামটাও দিয়ো। ক্লাসফ্রেন্ড ছিল।
প্রশ্ন: হেলাল ভাই, আপনি তো তারুণ্যেই কিংবদন্তি। আপনি, আপনার কবিতা, আপনার প্রেমিকারা, সবই আমাদের গল্প। ফিসফাস। সে মফস্বলের চায়ের দোকান বলেন, আর হাকিম চত্বরের চায়ের দোকান বলেন, আপনারে নিয়া চিরকালই আলোচনা। প্রথমবার আপনারে যে রকম দেখছি—আপনি দাড়িওয়ালা একজন মানুষ, দাড়ি কাটলেন কেন? কোনো প্রেমিকার আবদারে? নাকি এমনি?
হেলাল হাফিজ: দাড়ি রেখেছিলাম কিন্তু একজন নারীর জন্যেই। সে আমাদের সমাজের কোনো নারী না। অন্ধকার সমাজের নারী। পতিতাই বলা যায়। তার সঙ্গে যখন আমার একধরনের সখ্য গড়ে উঠল, তখন সে একদিন যখন বলল যে তুমি যদি একটু দাড়ি রাখো, তো আমার ভালো লাগবে।
এটা ধর ’৭২ সালের কথা। বা আরেকটু আগের, ’৭০-এর দিকে। তার আগে আমার ক্লিন শেভ ছিল। এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় ছিল। তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সে একটা আকাঙ্ক্ষা জানাল। সে একদিন যাচ্ঞা করল, ‘কবি, তুমি একটু দাড়ি রাখো না, খুব সুন্দর লাগবে।’ ’৬৯-এ ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লেখার পর তো সবাই আমারে, অধিকাংশ লোক তো আমারে কবিই ডাকে। খ্যাতি হয়ে গেছে ‘এখন যৌবন যার’—এই কবিতায়। বলছে, ‘তুমি যদি একটু দাড়ি রাখো তো আমার খুব ভালো লাগবে। আমি আনন্দ পাব,মানসিকভাবেও আনন্দ পাব।’ তরুণ। প্রেমিকা বলছে, দাড়ি রাখলাম।
’৭১-এর যুদ্ধের সময় মনে হয় দাড়ি কেটেছিলাম। আবার ’৭২ সালে দৈনিক পূর্বদেশে জয়েন করলাম, প্রথম চাকরি হলো, তখন আবার দাড়ি রাখা শুরু করলাম। আমি দাড়ি রেখেছিলাম ফ্যাশনের জন্যও নয়, কবি হওয়ার জন্যও নয়, আমি দাড়ি রেখেছিলাম এক রমণীর অনুরোধে, যার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ছিল। ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে। তার একটা আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করে, একটা আবেদন আমি না রেখে থাকতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছরও ক্লিন শেভই করতাম। ৭০ সালে এই ঘটনা। ওই মহিলা আমায় বলল। মেয়েরা একটু ওই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুমুটুমু খাওয়ার সময় বহু মেয়ে আছে, যে দাড়ি পছন্দ করে। সেক্স তো জীবনের বড় একটা অংশ। একটা সময় পর্যন্ত। আমাদের দেশে না, আমরা পশ্চাৎপদ, তোর শরীর সুস্থ রাখার জন্য হলেও সেক্স দরকার।
প্রশ্ন: আমরা এখন ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ নিয়ে একটু কথা বলি, হেলাল ভাই?
হেলাল হাফিজ: আব্বার একটা কবিতাও আছে এই বইয়ে—‘পিতার পত্র’।
১৯৮৬ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বেরিয়েছে। আর ২০১৯-এ বেরোল ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এই যে ৩৪ বছর পর মাত্র ৩৪টি কবিতা (আব্বার ১টা সহ ৩৫টা) দিয়ে বইটা বের করলাম, এই বইটার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দুইটা। দুইটা জিনিস আমার মগজে এবং মনে কাজ করেছে। এবং আমাকে প্রভাবিত করেছে। একটা হলো এই যে আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, মা–বোনরা বের হতে পারছে না, ঘর থেকে, রেপ হচ্ছে, শিশুরা রেপ হচ্ছে, মানে একটা ভয়াবহ অস্থিরতা সময়কে গ্রাস করে ফেলেছে। এই রকম একটা সময়ে বসে আমি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমার এই বইয়ের ৩৪টি কবিতায় কেবলই প্রেমের কথা বলেছি। কেবলই ভালোবাসার কথা বলেছি। বিরহের কথা বলেছি। বিরহ প্রেমের একটা বড় অংশ। কেবলই সু-আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছি। বিরহের কবিতার শেষে গিয়ে ইতিবাচকতা ব্যক্ত করেছি। পুরো দেশ পুরো সমাজ একদিকে, এক স্রোতে যাচ্ছে, সেই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। সেই স্রোতটা কী? কোলাহল, অনাচার, অত্যাচার, নারীর সম্ভ্রমহানি, শিশু অত্যাচারিত, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ। এইটার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেবলই প্রেমের কথা বলছি। কেবলই ভালোবাসার কথা বলছি। এটার উদ্দেশ্যটা কী? দুইটা কারণ(প্রেমও কিন্তু প্রতিবাদের একটা ভাষা)—তুমি যত খারাপই হও, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার ভালোবাসা যাচ্ঞা করি। পুরো সমাজ এক রকম। আমি অন্য রকম বই বের করলাম। এটা আমার প্রতিবাদ। একসময় আমি বলেছিলাম, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এইটাও একধরনের যুদ্ধ। প্রেমের কথা বলছি, এটা আরেক ধরনের যুদ্ধ। চলমান সময়ের চলমান স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রেম দিয়ে যদি কিছু মানুষকে আমি কোমল করতে পারি, প্রেমিক করে তুলতে পারি, ধৈর্যশীল করে তুলতে পারি, সুষ্ঠু–সুন্দর জীবনের প্রতি তাড়িত-জাড়িত করতে পারি, এটাই আমার প্রতিবাদের ভাষা। আরেকটা পয়েন্ট হলো এই বইতে আমি একটা কাজ করেছি। বর্তমান সময়ে, সারা পৃথিবীতে এখন সমস্ত, সব বয়সের মানুষের সবচেয়ে বড় নেশা কী? অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। অনলাইন। কম্পিউটার। শিশু, যুবক–যুবতী, কিশোর, তরুণ–তরুণী, মধ্যবয়স্ক, বৃদ্ধ, চাকর–চাকরানি, রিকশাওয়ালা—সবার হাতে মোবাইল। গুঁতাচ্ছে। আমারও...এই যে অবসর জীবন কাটাচ্ছি, ফেসবুকের সামনে বসে থাকি সারা দিন, কম্পিউটারের সামনে বসে থাকি, এই প্রযুক্তি আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। কী প্রভাব? আমরা যে মুঠোফোনে এসএমএস করি, আমরা তো চিঠির মতো দীর্ঘ করে লিখতে পারি না। দুই লাইন তিন লাইনে বইলা ফেলতে হবে কথাটা সংক্ষেপে। সেটা যত বড় কথাই হোক, বইলা ফেলতে হবে সংক্ষেপে। এইটা আমাকে খুব ভাবিত করেছে। আচ্ছা, তাহলে কি অল্প কথায় কবিতা হতে পারে না? এক লাইন দুই লাইন তিন লাইনে? এইভাবে কি কবিতা হতে পারে না?
প্রশ্ন: দুই লাইনের কবিতা আপনার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইতেও ছিল। নিউট্রন বোমা বোঝো...।
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। এই বইতে আমি সেটাই করেছি। অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনকে কাব্য আকারে, কবিতার আকারে দুই মলাটে ঢুকিয়ে দিয়েছি।
এই হইল, এইটা প্রযুক্তিগত দিক। এটা আমি করতে চেয়েছি।
সমাজ বদলে দেওয়া তো কবির কাজ নয়। কবি কেবল উসকে দিতে পারে। একটা ভাবনা সঞ্চালিত করে দিতে পারে।
আমি প্রায় ১৮০ বা ২০০ কবিতা নিয়ে বসেছিলাম ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’-এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট রেডি করার জন্য।
প্রশ্ন: হেলাল ভাই, ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ তো মনে হয় বাংলাদেশের কবিতার সবচেয়ে প্রতীক্ষিত বই, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র পর। দীর্ঘ অপেক্ষা। বইটা তো প্রকাশিত হলো। প্রচুর বিক্রি...।
হেলাল হাফিজ: হেলেনের সঙ্গে যেহেতু বয়স আমার কাছাকাছি, আমি তাকে পছন্দ করতাম। সে–ও আমাকে পছন্দ করত। নানা কারণে বিয়ে হয়নি আমাদের। সে-ই জানিয়ে দিয়েছে, ‘আমি আরেকজনকে বিয়ে করতে চাই।’ করো। তোমার ইচ্ছে। বিয়ে তো জোর করে হয় না। ভালোবাসা জোর করে হয়। আমি দূর থেকে ভালোবাসব। বিয়ে তো তা না। বিয়ে করলে তো একসঙ্গে থাকতে হবে। বিয়ে তো দুইজনের সম্মতি ছাড়া সম্ভব না। ভালোবাসা একজনের সম্মতিতেও হয়।
খোরশেদ আলী তালুকদার এবং সবিতা মিস্ট্রেস। দে ওয়্যার মাই সোউল।
আমার প্রথম জীবনে যেভাবে উচ্চারণ করেছিলাম—‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’, ঠিক এইভাবে এই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এটাও আরেক ধরনের দ্রোহ। আরেক ধরনের প্রতিবাদ।
’৮৬ সালে যখন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বেরিয়েছিল, তখন মেলাতেই তিনটা এডিশন বেরিয়েছিল।
৩৪ বছর পর ৩৪টি কবিতা দিয়ে এই বইটা। একটা কবিতা আব্বার। আমি মূল সুর ধরেছি আব্বার কবিতাটি, রেটিনার নোনাজলে...এই যে ২০০ কবিতা থেকে ৩৪টা কবিতা দিয়ে ম্যানুস্ক্রিপ্ট করলাম, বাকি কবিতাগুলো কিন্তু আলোর মুখ দেখবে না কোনো দিন, যেহেতু এই বইতে আমি দিইনি, সেহেতু বাতিল। এইটা ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র সময়ও আমি করেছি। প্রায় ৩০০ কবিতা নিয়ে বসেছিলাম ম্যানুস্ক্রিপ্ট তৈরি করতে। সেখান থেকে ৫৬টি কবিতা দিয়ে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বাকি কবিতার খোঁজ কেউ জানবেই না। আমি ডেস্ট্রয় করে দিয়েছি। আমি মনে করি, যে কবিতা আমি বইয়ে দিতে পারলাম না, আমার বিবেচনায় সেই কবিতা পাঠক গ্রহণ করবে না।
প্রশ্ন: ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইয়ে কবিতা রচনার সাল–তারিখ ছিল। ‘বেদনা’-তে নেই...।
হেলাল হাফিজ: এই বইয়ে কয়েকটা কবিতা আছে ৬৮, ৬৯ সালের। কয়েকটা সাম্প্রতিক। আমি একটা সুর ধরতে চেয়েছি কালাকাল হিসাব না করে...।

কথা কি ফুরাল? কথা কি ফুরায়? আপনজনের কথা? বেতফল রঙের দুপুর শুধু বেতফল রঙের বিকেল পার হয়ে দ্রুত সন্ধ্যার দিকে হেঁটে যায়।

সাক্ষাত্কার নিয়েছেন ধ্রুব এষ
কবির ছবি ও শ্রুতলিখন: কামরুল হাসান মিথুন