ইসরায়েলের হামলায় দক্ষিণ গাজায় আহত দুই ফিলিস্তিনি
ইসরায়েলের হামলায় দক্ষিণ গাজায় আহত দুই ফিলিস্তিনি

ফিলিস্তিন, ঘরহারা মানুষের কাহিনি

পাখিরও আছে নীড়, শিয়ালেরও আছে গর্ত, কিন্তু ফিলিস্তিনি মানুষের কোনো ঘর নেই। ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত চলছে প্রায় ৭৫ বছর ধরে। সেই সংঘাতে গাজা আবারও রক্তাক্ত এক বিরান প্রান্তর। মানুষ ঘরহারা। সন্তানদের মৃতদেহ পিতাদের কাঁধে, চোখে অশ্রু, তবু বুকে তাঁরা জিইয়ে রেখেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন... সেই স্বপ্ন-সংঘাতের আখ্যান নিয়েই এবারের আয়োজন।

গাজায় তিন দিন

২০১১ সালের জুলাই মাসের কথা। এরেজ সীমান্তচৌকির পথ দিয়ে আমি গাজায় ঢুকব। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি, লম্বা লাইন, হাজারটা তল্লাশি, ভয়ালদর্শন কুকুরের হল্লা, তেতোমুখো পুলিশের জেরা। উল্টো পথে, অর্থাৎ গাজা থেকে ইসরায়েলে ঢোকার জন্য আরও দীর্ঘ লাইন। কয়েক শ মানুষ, তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু, কখন থেকে, কত দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। হঠাৎ পেছন থেকে পরিষ্কার বাংলায় একজন আমার নাম ধরে ডাকলেন—‘আরে হাসান, তুমি এখানে?’ তাকিয়ে দেখি জাতিসংঘে আমার সহকর্মী জেনিফার। বাঙালি গুরু শ্রী চিন্ময়ের শিষ্য, কবিতা লেখে, রবি ঠাকুরের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে।

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থার কাজ নিয়ে জেনিফার এখন পূর্ব জেরুজালেমে। সপ্তাহে একবার তাকে এই সীমান্তচৌকি পেরিয়ে গাজায় যেতে হয়। লাখ বিশেক মানুষের বাস সেখানে, প্রায় সবাই উদ্বাস্তু। পুরো এলাকাটি চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, গাজার যেকোনো এলাকা থেকে তাকালেই দেখা যায় এই দেয়াল। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। শুনেছি, এমন কড়া ইলেকট্রনিক নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে যে সামান্য নেংটি ইঁদুরের পক্ষেও সম্ভব নয় ওপরওয়ালাদের নজর এড়িয়ে এই দেয়াল গলে ইসরায়েলে ঢোকে। মিসরের সঙ্গে কয়েক মাইলের সীমান্ত যোগাযোগ আছে, রাফায় একটি চৌকি দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। মিসরীয়দের নির্দেশে তা-ও অধিকাংশ সময় বন্ধ, সীমান্ত পেরিয়ে মিসরে ঢুকে কেউ কোনো উটকো ঝামেলা না পাকাতে পারে, সে জন্য এই কড়া ব্যবস্থা।

ইসরায়েলের হামলায় গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে, সেখানে শোনা যাচ্ছে কেবল মানুষের ক্রন্দন

গাজাকে খোলামেলাভাবেই ‘ওপেন এয়ার প্রিজন’ নামে ডাকা হয়। জেনিফারের কাছ থেকে জানলাম, এরেজ সীমান্তচৌকিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে ফিলিস্তিনি মা ও শিশুরা যার যার পরিচয়পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনো হাসপাতালে চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছে। গাজায় কোনো আধুনিক হাসপাতাল নেই, ক্যানসার বা জটিল কোনো ব্যাধির নিরাময়ের জন্য ইসরায়েলে আসা ছাড়া তাদের অন্য পথ নেই। কোনো কোনো পরিবার ৮-১০ দিন ধরে এখানে পড়ে রয়েছে। আরও একটি লাইন রয়েছে, অনুমতি সাপেক্ষে ইসরায়েলে এসে গতর খাটানো কাজ করে, এমন লোকদের জন্য। যেকোনো সময় কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া এই দিনমজুরদের কাজ করার অনুমতি বাতিল হতে পারে।

এটা ঠিক মানবজীবন নয়, মানবেতর জীবন। ইসরায়েলের চলতি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, তারা মানবপশু—‘হিউম্যান অ্যানিমেল’। জেনিফার এ অঞ্চল খুব ভালো করে চেনে-জানে। কানে কানে আমাকে বলল, ‘দেখো, একদিন এই সব মানুষ উল্কার মতো ফেটে পড়বে। এরা তো মরেই আছে, মৃত্যুতে তো তাদের ভয় পাওয়ার কথা নয়।’

সে যাত্রায় আমি তিন দিন ছিলাম গাজায়। সকালে এরেজ দিয়ে ঢুকতাম, সন্ধ্যার আগে জেরুজালেমে ফিরে যেতাম। ওই তিন দিনেই জেনিফার বলা কথাটার অর্থ বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। কড়ে আঙুলের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখণ্ড, প্রস্থে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে সাত মাইল, দৈর্ঘ্যে ২৫ মাইল—সব মিলিয়ে ১৪১ বর্গমাইল। ২০০৭ সাল থেকে এলাকাটি ইসরায়েলি অবরোধের শিকার। ঢোকার পথ নেই, নেই বেরোনের পথ।

গাজার চিকিৎসাকেন্দ্রে কাঁদছেন দুই ফিলিস্তিনি

যে ২০-২২ লাখ মানুষের বাস গাজায়, তার অধিকাংশই ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কারোরই নিজের বাড়ি বলতে যা বোঝায়, তা নেই। শহরের উত্তরে ও দক্ষিণে মোট আটটি উদ্বাস্তু শিবির। শিবির বলছি বটে, কিন্তু অধিকাংশ স্থাপনাই পাকা, বহুতল ভবন। প্রতিটিতেই গাদাগাদি করে অসংখ্য উদ্বাস্তু ঠাঁই পেয়েছে, কয়েক প্রজন্ম ধরেই তারা মুরগির খোপের মতো এক বা দুই ঘরের বাসায় দিন কাটায়। অধিকাংশ মানুষই বেকার, জাতিসংঘের কাছ থেকে ত্রাণ ও উদ্বাস্তু ভাতা পেয়ে দিন গুজরান করে। বলার মতো কোনো মিল-ফ্যাক্টরি নেই, কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। যে সামান্য কিছু লোক কাজকর্মের সুযোগ পান, তাঁদের অধিকাংশই হয় ছোট ব্যবসা, নয়তো জাতিসংঘের কোনো না কোনো দপ্তরে কাজ করেন।

হামাস ও ‘ক্ল্যাসিক ডিভাইড অ্যান্ড রুল’

গাজায় আমার কাজ ছিল জাতিসংঘের একটি সাংবাদিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ। এখান থেকে ৬ জন ও পশ্চিম তীর থেকে ৬ জন করে মোট ১২ জন বাছাই করা সাংবাদিক সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। জনা তিরিশেক সংবাদকর্মীকে আগে থেকে প্রাক্‌-বাছাই করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে চূড়ান্ত বাছাই হবে।

সাক্ষাৎকার দিতে আসা সারাহ নামের একটি মেয়ের কথা আমার বেশ মনে আছে। কিছুটা আড়ষ্ট, অজ্ঞাত কোনো দ্বিধায় যেন সারাক্ষণ কুঁকড়ে আছেন। এক দিন লেগেছিল সেই ভাব কাটিয়ে তাঁর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বড়। গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেছেন দুই বছর আগে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজ জোটাতে পারেননি। এ শহরে সবকিছুই কার্যত শাসক দল হামাসের নিয়ন্ত্রণে। নামমাত্র স্বাধীন এক-আধটা রেডিও ও স্যাটেলাইট টিভি রয়েছে। তারই একটিতে সারাহ খণ্ডকালীন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

‘আমি এখান থেকে বেরোতে চাই। আমি আরও পড়তে চাই। বুক ভরে শ্বাস নিতে চাই। আর হামাস নয়, শান্তি চাই।’

ইংরেজিতে কথাগুলো সারাহ আমায় বলেছিলেন। হামাসের নাম করায় আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু দ্বিতীয়বার হামাসের নাম তিনি আর করলেন না। মনে হলো, কিছু একটা লুকাচ্ছেন। ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেগ পোহাতে হলো না। গাজা যেমন বাইরে থেকে ইসরায়েলি অবরোধের মুখে, ভেতরেও সে হামাসের হাতে ভিন্ন এক অবরোধের মুখে। রাজনৈতিক বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে এখানে কিছুই নেই। হামাসের ব্যাপারে সমালোচনা করলে এখন যে সামান্য চাকরিটুকু তাঁর রয়েছে, সেটিও যেতে পারে। শুধু সারাহ নয়, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী আরও অনেকের মধ্যেই একধরনের চাপা অস্থিরতা দেখলাম।

এই ফিলিস্তিন নারীর মতো দুর্ভাগ্য এখন সে দেশের অনেকেই

পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম মিলে ‘প্যালেস্টাইন স্টেট’ বা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির ভিত্তিতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে নবগঠিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আংশিক প্রশাসনিক দায়িত্ব পায়। দায়িত্ব পায় বটে, কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেল ইসরায়েলের হাতে। এখান থেকে ঢোকা বা বের হওয়া সবকিছুই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য যে পুলিশ বাহিনী গঠিত হলো, তাতেও শেষ কথা ইসরায়েলের। অসংখ্য সামরিক চেকপয়েন্ট, নিরাপত্তাবেড়ি ও দেয়াল থাকায় গাজা ও পশ্চিম তীরে সবকিছুই ইসরায়েলের থাবার নিচে। এর পাশাপাশি ফিলিস্তিন ভূমিতে ক্রমান্বয়েই বেড়ে চলেছে অবৈধ ইহুদি বসতি। এরা প্রত্যেকে সশস্ত্র, যখন-তখন গুলি চালাতে দ্বিতীয়বার ভাবে না।

কঠোর ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত হামাস, যা আসলে মিসরের সুন্নি মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ইসলামিক ব্রাদারহুডের একটি শাখা পিএলও ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি কখনোই মেনে নেয়নি। হামাসের যুক্তি, যে ভূমির ওপর ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রের পত্তন, তার পুরোটাই অবৈধ। কারণ সে ভূমির আসল মালিক ফিলিস্তিনিরা। ভূরাজনীতির কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েই ইয়াসির আরাফাত ও তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন ফাতাহ ইসরায়েলের সঙ্গে আপসে সম্মত হয়েছিল। আমার নিজের ধারণা, বয়সের ভারে নুয়ে আসা আরাফাত সামরিক প্রতিরোধের সাফল্য সম্ভাবনায় সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হাড়ে ভর করেছিল ক্লান্তি।

২০১১ সালে জেরুজালেমে পবিত্র আল-আকসা মসজিদের সামনে লেখক

ফাতাহর সঙ্গে হামাসের আরও একটি বড় প্রভেদ হলো ভবিষ্যৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চরিত্র প্রশ্নে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ফাতাহ মূলত একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তি আন্দোলন। অন্যদিকে হামাস কঠোরভাবে ইসলামপন্থী, তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রস্তাবিত শরিয়াহনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। ইসরায়েলের প্রতি অনমনীয় মনোভাবের জন্য ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বিপুল। ২০০৬ সালে ইসরায়েলবিরোধী ও ইসলামি অ্যাজেন্ডা নিয়েই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হামাস। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে নির্বাচনে তারা জয়লাভ করে। ফলে নতুন সরকার গঠনের অধিকার তারই। কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র হামাসের এই বিজয় মেনে নিতে অস্বীকার করে। ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মাহমুদ আব্বাস। প্রায় অথর্ব ও ইসরায়েলের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল আব্বাসও হামাসের হাতে সরকারের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আগেই হামাসকে ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এবার তাদের সঙ্গে সুর মেলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সীমান্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে যে আয়কর ফিলিস্তিন সরকারের প্রাপ্য, তা তুলে দিতে অস্বীকার করে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের প্রতিশ্রুত অনুদান পাঠাতে অসম্মতি জানায়। ফলে রাতারাতি প্রবল সংকটে পড়ে যায় ফিলিস্তিন সরকার। এদিকে পশ্চিম তীরে গুলিতে একজন ইসরায়েলি নিহত হলে প্রতিশোধ নিতে হামলা করে বসে ইসরায়েল। এই টালমাটাল অবস্থায় গাজায় নিজেদের সরকার গঠনের ঘোষণা দেয় হামাস। আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ফিলিস্তিন।

২০০৬ সাল থেকেই গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ চলছে। তার ভেতরেই ধুঁকে ধুঁকে চলছে জীবন। পশ্চিম তীরে মাহমুদ আব্বাস সরকার হয়তো ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো মূল্যে আপস করে যাবে টিকে থাকার জন্য। সেটিই তার একমাত্র পথ। কিন্তু হামাসের অবস্থা ভিন্ন। টিকে থাকার জন্যই তাকে লড়াই করতে হবে। এ পর্যন্ত পাঁচবার ছোট-বড় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। প্রতিটি যুদ্ধের ফলে নুয়ে পড়ার বদলে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়েছে। মৃত্যুর ভয় মুক্তির স্বপ্নকে পরাস্ত করতে পারে না।

ইসরায়েলি সাংবাদিক রনেন বার্গম্যান বলেছেন, হামাসকে চাইলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে ইসরায়েল, কিন্তু নিজের প্রয়োজনেই সে হামাসকে টিকিয়ে রেখেছে। বার্গম্যান জানিয়েছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনে করেন, মাহমুদ আব্বাসকে চাপের মুখে রাখার জন্যই তাঁর প্রয়োজন হামাসকে টিকিয়ে রাখা। এটা হলো ‘ক্ল্যাসিক ডিভাইড অ্যান্ড রুল’।

৭ অক্টোবর ২০২৩

এক যুগ আগে জেনিফার আমাকে বলেছিলেন, আজ হোক বা কাল, ফিলিস্তিনিরা ফুঁসে উঠবেই। তাদের সে ক্রোধের প্রকাশ দেখলাম ৭ অক্টোবর।

এদিন হামাসের অতর্কিত ও আকস্মিক হামলায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইসরায়েল। যাদের এত দিন মানবেতর ভাবা হয়েছে, তারা এমন সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালাবে তা, কল্পনারও বাইরে ছিল। সেনাছাউনির পাশাপাশি ইহুদি বসতির ওপরেও আক্রমণ হয়, নিহত হন বেসামরিক নাগরিক, নিরপরাধ নারী ও শিশুচুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে অপহরণ করা হয় নারী ও হুইলচেয়ারের বসা বৃদ্ধদের। ঠিক যে সন্ত্রাসের জন্য এত দিন ইসরায়েল নিন্দিত হয়েছে, সেই রকম সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালায় হামাস।

বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ইসরায়েল এখন শুরু করেছে পাল্টা হামলা। তিন লাখের বেশি সৈন্য গাজা সীমান্তে মোতায়েন করার আয়োজন চলছে, শুরু হয়েছে অহর্নিশ বোমাবর্ষণ, পাখির মতো মরছে মানুষ। নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসকে তিনি এমন শিক্ষা দেবেন যে অনন্তকাল সে কথা স্মরণ করে তারা ভয়ে কাঁপবে।

ইসরায়েলি বিচারমন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ত বলেছেন, গাজায় তাঁরা পানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেবেন। সেখানকার মানুষের সামনে এখন শুধু তিনটি পথ খোলা—পরাজয় মেনে ইসরায়েলি বশ্যতা স্বীকার, গাজা ছেড়ে পালানো অথবা মৃত্যু।

‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’ হিসেবে ইসরায়েল উত্তর গাজার ১২ লাখ মানুষকে এক দিনের মধ্যে সরে যেতে বলেছে। কোথায় যাবে তারা, কোথায় পাবে নিরাপদ আশ্রয়? ইসরায়েলি সাংবাদিক গিদিয়ন লেভি বলেছেন, এবার তাঁদের হয় সমুদ্রে ডুবে মরতে হবে, নয়তো সরে আসতে হবে আরও দক্ষিণে। আবারও তারা ঘরছাড়া হবে।

গাজা থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে অহতদের

আরেক নাকবা

আট দশক আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার শুরু করেছিলেন তাঁর ‘ফাইনাল সলিউশন’। লক্ষ্য হয় হত্যা, নয়তো বহিষ্কার—যেভাবেই হোক জার্মানিকে ইহুদিমুক্ত করা। এই ফাইনাল সলিউশনের ফলে ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়, যে ঘটনা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। সেই ইহুদিদের হাতেই শুরু হয়েছে আরেক হলোকাস্ট, যার লক্ষ্য গাজা থেকে শেষ ফিলিস্তিনিকে নিধন অথবা বহিষ্কার।

আজকে নয়, ১০০ বছরের বেশি আগে এ বহিষ্কারের কাজটি শুরু হয়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ফিলিস্তিনেই একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। সে সময় ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ। একটি নিজস্ব বাসভূমির জন্য ইহুদি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিল। যেকোনো স্থানে, এমনকি আফ্রিকার যেকোনো জায়গায়ও সে দেশ হতে পারে। বেলফোর ঘোষণা তাদের হাতে যেন চাঁদ এনে দিল। শুরু হলো পূর্ব ইউরোপ থেকে ইহুদি অভিবাসন।

জায়নবাদী আন্দোলনের নেতা খাইম ওয়াইজম্যান, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে যিনি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছিলেন। বেলফোর ঘোষণার পর মন্তব্য করেছিলেন, ফিলিস্তিনের মাটিতে একবার পা ঠেকাতে পারলেই হলো, বাকিটা তাঁরা দেখে নেবেন। ‘তাঁবুতে শুধু উটের নাকটা ঢোকানো গেলেই হলো, বাকিটা উট নিজেই ঠেলেঠুলে ঢুকে যায়।’

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনকে কেটে দুই ভাগ করে এক ভাগ দেওয়া হয় নতুন রাষ্ট্র ইসরায়েলকে, অন্য ভাগে স্বাধীন ফিলিস্তিন। ছয় লাখ ইহুদি, যাদের অধিকাংশই পূর্ব ইউরোপ থেকে সদ্য আসা, তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয় মোট ভূমির ৫৩ শতাংশ। আর ১৫ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য ৪৭ শতাংশ, যে ভূমির একটা বড় অংশ হয় তপ্ত মরুভূমি অথবা কৃষিকাজের অযোগ্য পাথুরে মাটি।

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে রাতারাতি তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে হয় পশ্চিম তীর, নয়তো গাজায় এসে আশ্রয় নিতে হয়। কেউ কেউ আশ্রয় পায় প্রতিবেশী কোনো আরব দেশে। এ ঘটনা তাদের চোখে ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়। কিন্তু বিপর্যয়ের সেই শেষ নয়, বরং শুরু। ফিলিস্তিনসহ এ অঞ্চলের কোনো আরব দেশ ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা মেনে নেয়নি, প্রতিবাদ হিসেবে ১৯৪৮ সালে শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ।

এরপর আরও দুবার—১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়। ১৯৬৭-এর যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে নেয় ইসরায়েল। ১৯৭৩-এ মিসরের আকস্মিক আক্রমণে প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পড়েছিল ইসরায়েল। তাদের বাঁচিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে বলেছিলেন, অবিলম্বে হামলা না থামালে আমেরিকা আণবিক বোমা ফেলতে দ্বিধা করবে না।

১৭ অক্টোবর দক্ষিণ গাজা থেকে তোলা এএফপির ছবিতে আহত ফিলিস্তিনি

এরপর কী

গত ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট, ফিলিস্তিন সমস্যার অর্থপূর্ণ সমাধানে ইসরায়েল আগ্রহী নয়। এ জন্য যে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন, তা নেই। খোদ ফিলিস্তিনিরা নেতৃত্ব নিয়ে একে অপরের সঙ্গে লাঠালাঠিতে ব্যস্ত। আরব দেশগুলোও সমস্যাটি তাদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে আগ্রহী। আমেরিকার দূতিয়ালিতে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে অধিক অগ্রহী। প্রয়োজন হলে মাঝেমধ্যে টাকাপয়সা দেওয়া যাবে, তার বেশি নয়।

কিন্তু সত্যি কি বোমা ও অবরোধের ভয় দেখিয়ে একটি জাতিগোষ্ঠীকে অনন্তকাল ক্লীব করে রাখা সম্ভব? হামাসের সঙ্গে পাঁচটি যুদ্ধ তো ভিন্ন কথা বলে। ইসরায়েলকে এ কথা বুঝতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির একমাত্র পথ ঔপনিবেশিক অধিগ্রহণের বদলে একটি প্রকৃত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন। সামরিক প্রতিরোধ দিয়ে হামাস সে লক্ষ্য অর্জন করবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ এ মুহূর্তে নেই। শিশু ও বেসামরিক নাগরিক হত্যাও মুক্তির পথ নয়। একমাত্র বিকল্প ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের অস্তিত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে শান্তি আলোচনা। এ আলোচনা সার্থক হওয়ার একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও বৃহত্তর আরব ঐকমত্য। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াকে সৌদি আরব বা উপসাগরীয় দেশগুলো যদি দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারে সক্ষম হয়, ইসরায়েলকে আপসে আগ্রহী করা যাবে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের অভিভাবক না হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হতে হবে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী।

এসবই প্রায় অসম্ভব কল্পনা। গাজায় এখন শিলাবৃষ্টির মতো পড়ছে ইসরায়েলি বোমা। এ সময় শান্তির কথা বলা নিরর্থক। আমি জানি, সারাহ এখনো মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস গ্রহণের অপেক্ষায়। তাঁর জন্য, তাঁর মতো অসংখ্য ফিলিস্তিনির জন্য আশায় বুক বাঁধা ছাড়া আর কী পথ আছে!