রণজিৎ গুহ কোনো প্রচলিত ধারণার ওপর অন্ধভাবে বিশ্বাস না রেখে তাকে অবিচল প্রশ্ন করা শিখিয়েছেন। এই প্রশ্ন আবার কাঠখোট্টা একাডেমিক জায়গা থেকে নয়, একেবারেই মানবিক জায়গা থেকে। নিম্নবর্গের ইতিহাসসাধনার অন্যতম পথিকৃৎ রণজিৎ গুহের প্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধা।
রণজিৎ গুহ গত এক শতকে বাংলা ভাষার চিন্তকদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী ও সৃজনশীল, যিনি প্রায় একাই দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস লেখা ও চিন্তা করার ধারণাটা পরিবর্তন করে দিয়ে গেছেন। শতবর্ষ পূরণের মাত্র দিন পঁচিশ আগে গতকাল তিনি মারা গেলেন কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেলেন কয়েক শতকের চিন্তা ও কর্ম।
গুহের বৈশিষ্ট্য কী? মোটাদাগে বললে, গুহ কোনো প্রচলিত ধারণার ওপর অন্ধভাবে বিশ্বাস না রেখে তাকে অবিচল প্রশ্ন করা শিখিয়েছেন। এ প্রশ্ন আবার কাঠখোট্টা একাডেমিক জায়গা থেকে নয়, একেবারেই মানবিক জায়গা থেকে। গুহ নিজেকে মূলত সাহিত্যের ছাত্র ভাবতে ভালোবাসতেন, যিনি সেই মনন নিয়েই পেশাদার ইতিহাসবিদ হয়েছিলেন।
এ কারণে আমরা দেখি গুহের রাষ্ট্রচিন্তায় কাব্য ও আবেগের উপস্থিতি, যেখানে তিনি রাষ্ট্র, পুঁজি আর ব্যক্তির সম্পর্ক খুঁজতে চাইছেন। কেবল একাডেমিক চিন্তা নয়, রাজনীতিতেও মানুষের ‘এজেন্সি’ বাদ দিয়ে যে ‘বায়বীয়’ ও কাঠামোগত চিন্তার জয়জয়কার তা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে চাইছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি ইউরোপের জ্ঞানকাণ্ডের যুক্তিকে ব্যবহার করলেন আর এর ফলে যে সংশ্লেষ হলো তা আবার ইউরোপে তথা পশ্চিমে ফিরে গিয়ে তাদের সমৃদ্ধ করল। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের যে ধারার তিনি সূচনা করলেন, তা চিন্তার নতুন এক জগৎকে খুলে দিল। গত শতাব্দীতে গ্রামসির পরে চিন্তাজগতে এ ধরনের মহাপরিবর্তনের উদাহরণ সম্ভবত আর দেখা যায় না।
গ্রামসির কথা আসায় গুহের যৌবনের আলাপ চলে আসে। তিনি জীবনের প্রথম ভাগে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ওনার শিক্ষক সুশোভন সরকার দ্বারা। সেই সুশোভন, যিনি ‘নোটস অন বেঙ্গল রেনেসাঁ’ লিখে আমাদের চিন্তার ভিত্তিমূলে আঘাত করেন। জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের অসারতায় প্রশ্ন তুলে দেন। ইউরোপের আদলে হওয়া রেনেসাঁ কীভাবে অসাম্যই জিইয়ে রাখে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখান।
নিজে সক্রিয় মার্ক্সবাদী হলেও এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো রচনা করলেও সুশোভন সরকারের চিন্তায় ফুটে ওঠে বাঙালির নবজাগরণ, যা মূলত হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণির উত্থান; যাতে অন্ত্যজ আর প্রান্তিক শ্রেণির উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে অনুপস্থিত।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি ইউরোপের জ্ঞানকাণ্ডের যুক্তিকে ব্যবহার করলেন আর এর ফলে যে সংশ্লেষ হলো তা আবার ইউরোপে তথা পশ্চিমে ফিরে গিয়ে তাদের সমৃদ্ধ করল। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের যে ধারার তিনি সূচনা করলেন, তা চিন্তার নতুন এক জগৎকে খুলে দিল। গত শতাব্দীতে গ্রামসির পরে চিন্তাজগতে এ ধরনের মহাপরিবর্তনের উদাহরণ সম্ভবত আর দেখা যায় না।
সেই চিন্তাকে আরও অনেক দূর নিয়ে যান রণজিৎ গুহ। জাতীয়তাবাদী তো বটেই, ভারতের কমিউনিস্ট রাজনীতিতেও তিনি ‘তলা থেকে’ ভাবার অনুপস্থিতি টের পান। স্বাধীনতার পর পার্টিগুলো যেন হয়ে ওঠে ‘ভদ্রলোকের তাত্ত্বিক চিন্তার’ জায়গা। ঠিক যেমনটা সোভিয়েত রাষ্ট্রের বেলাতেও দেখা যায়, মানুষকে মমত্ববোধের সঙ্গে দেখার বদলে কাঠামোগত আর তত্ত্বকেই জোর দেওয়ার নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা।
নানাবিধ কারণে আজীবন রাজনীতির প্রতি নিষ্ঠাবান গুহ পার্টির রাজনীতি ত্যাগ করেন। ইউরোপে একাডেমির সুখী জীবন বাদ দিয়ে ভারতের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি বুঝতে পারেন, ভারতকে বুঝতে হলে এর প্রান্তিক মানুষকে বুঝতে হবে। সেখান থেকে জন্ম নেয় ‘রুল অব প্রোপার্টি ফর বেঙ্গল’ বইয়ের, প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।
এই লেখার একটি অনবদ্য দিক হচ্ছে, তিনি এতে শুধু ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রাজনৈতিক অর্থনীতির ঐতিহাসিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তিনি দেখান ইউরোপে রেনেসাঁ–পরবর্তী যুগের চিন্তাভাবনা কীভাবে ঔপনিবেশিক উত্তর সময়কে প্রভাবিত করেছে। গুহ পুরো বিষয়টা হোলিস্টিক বা সর্বদিক দিয়ে ভাবতেন। এ চিন্তা ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা।
এরপর বছর বিশেক তিনি একাডেমিকভাবেও কিছুটা সন্তের জীবন পালন করেন। একাডেমিক রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থেকে তিনি চিন্তা চালিয়ে যান এবং গভীর ও সামগ্রিক দর্শনের অব্যাহত পরিশ্রমের ফলাফল হিসেবে ১৯৮৩ সালে প্রকাশ করেন ‘এলিমেন্টারি এসপেক্টস অব পিজেন্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’। কাছাকাছি সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করেন ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ নামে ইতিহাস পরিবর্তন করে দেওয়া এক রচনার।
এর পরের কয়েক দশক ছিল সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের জোয়ার এবং তাঁর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গুহকে সবাই মেনে নেন। যা ছিল কাঠামোগত, প্রতিষ্ঠিত চিন্তার বাইরে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রশ্ন করে জ্ঞানকাণ্ডকে বিস্তৃত করার এক আন্দোলন।
যথারীতি গুহের সবচেয়ে বড় অবদান, প্রশ্ন করতে শেখানো, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখানো। এমনকি সাবঅল্টার্নকে ‘রোমান্টিকতায়’ পর্যবসিত করার বিপদ নিয়েও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং সমালোচনা করতে ছাড়েননি।
কিন্তু চিন্তার জগতে দুনিয়া টালমাটাল করার পরও চিরকাল সাহিত্য পড়া গুহ আরও একটা বড় কাজ করলেন। বাংলায় লেখালেখি। একাডেমিক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক স্তরে বিপুল সাফল্যের পরও তিনি বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্যই নিজের চিন্তা প্রকাশ করতে লাগলেন।
কাঠখোট্টা আর্কাইভাল জ্ঞানের বদলে সাহিত্য আর লোকগাথায় তিনি দর্শনের প্রশ্ন খুঁজতে লাগলেন। সেখানে তিনি প্রয়োগ করলেন নিজের দ্বান্দ্বিক চিন্তা। মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে বহু বিবাদের পরেও সম্ভবত মানতে হয়, চিন্তার দ্বান্দ্বিকতা তিনি কখনো ত্যাগ করেননি, এমনকি তাঁর শেষের দিকের বহু রচনাকে ভাববাদী তকমা দিলেও।
সেখান থেকেই তিনি ২০০৯ সালে লিখলেন ‘কবির নাম ও সর্বনাম’। কাব্যপাঠের এক বেদনার দ্বান্দ্বিকতা যার উপজীব্য ছিল ‘ত্রিগীত’ তথা ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’ ও ‘গীতালি’ এবং ‘বলাকা’ ও ‘গীতবিতানের’ কিছু গান।
এই বইয়ের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হলো, ‘ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বচরাচরের সম্পর্ক এখানে বিশেষ্য (নামপদ) এবং সর্বনামের সম্বন্ধ। আমি, তুমি, সে। আমি তাকে ডাকলাম, “সে” “তুমি” হলো। তোমাকে জানলাম, তুমি আমাকে। গড়ে উঠল দুই সত্তার আত্মীয়তা। তোমার ভিতর দিয়ে নতুন আমাকে জানলাম, আমার ভিতর দিয়ে তুমিও নিজেকে আবিষ্কার করলে। অপরকে জানা মানে, অপরের অবস্থানে নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দেওয়া। নামের পরিচয়ে ভিন্ন হলেও সর্বনাম আমাদের জন্য রচনা করেছে মিলনের তাঁবু। ব্যক্তি আমি-র সঙ্গে বিশ্ব-আমির মিলনের সূত্রগুলির ভিতর দেখবেন আপনার জন্য অপেক্ষমাণ বেদনার দ্বান্দ্বিকতা।’
গুহ চিন্তাজগতের সেই প্রমিথিউস, যিনি মনন আর সৃজনের আগুনটা কেবল দেবালয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সর্বত্র।
অমর্ত্য সেন বলেন, ‘রণজিৎ গুহ বিশ শতকের সবচেয়ে সৃজনশীল ভারতীয় ঐতিহাসিক,’ কথাটা সম্ভবত একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, রণজিত গুহ ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী মনন ও সৃজনশীল বাঙালি। মানবিক আবেগে গড়া এক একাডেমিক মহিরুহ।
আমাদের ভাবতে শেখানো গুহ শতায়ু না পেলেও ওনার প্রভাবের আয়ু কয়েক শতক হওয়ার কথা।