জয়ের প্রথম উচ্চারণ ছিল, ‘মোশাররফ করিমকে আমার প্রণাম।’ সদ্যসমাপ্ত ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিন কবিতাপাঠের আসরের শুরুতে কবির মুখে বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীর নাম শুনে দর্শক–শ্রোতারা একটু-চমকেই গেলেন।
জড়াজড়ি করে আছে পৌষালি শীত আর হিম কুয়াশা। সব মিলিয়ে গেল ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত নজরুল মঞ্চের গোটা পরিবেশকে যেনবা ‘শীত–কুয়াশার সংকলন’ নামেই ডাকা যাবে। এ বাস্তবতায় রৌদ্রছায়ার সংকলন–এর কবি জয় গোস্বামী কি সেদিন তীব্র শীতে জবুথবু হয়ে ছিলেন? প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেয়ে উপস্থিত দর্শক সেই সময় এই কবির কবিতা শোনার জন্যই বেশি উদ্গ্রীব। বাংলাদেশের কবি শামীম রেজার সঞ্চালনায় ‘মুখোমুখি’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে নিজের কবিতা স্বকণ্ঠে পড়ে শোনাবেন কবি। সবাই তাই অধীর হয়ে আছেন, জয় কখন বলবেন সেই সব অমলিন পঙ্ক্তি, ‘জন্মান্ধ মেয়েকে জ্যোৎস্নার ধারণা দেব বলে/ এখনো রাত্রির এই মরুভূমি জাগিয়ে রেখেছি।’
হ্যাঁ, জয় গোস্বামীর একের পর এক কবিতার মৌতাতে সেদিন দর্শকেরা মুগ্ধ হয়েছিলেন; এবং তাঁর মুখে স্বদেশি অভিনেতার নাম শুনে কিছুটা হয়েছিলেন উল্লসিতও। তবে কলকাতার এই জনপ্রিয় কবির মোশাররফ–মুগ্ধতা কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি।
বাংলাদেশের এই অভিনেতা যে তাঁর মনকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে আছেন, সেটি আরও ভালোভাবে বোঝা গেল কবির সঙ্গে আমাদের যখন অন্তরঙ্গ কথোপকথন হলো, তখন। ঢাকায় সস্ত্রীক তিনি উঠেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের অতিথিশালায়। ৭ জানুয়ারি বিকেলবেলা কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকসহ আমরা যখন যেখানে উপস্থিত হলাম, কবি সে সময় শারীরিকভাবে একটু কাহিল। তবু টুকরা টুকরা কথা তিনি বলছিলেনই। কবিতার কথা এল, তার লেজে লেজ জোড়া দিয়ে এল শাস্ত্রীয় সংগীতের কথাও। কিন্তু এর মধ্যে মোশাররফ করিম কীভাবে?
তিনিও এলেন ওই কবিতার সূত্রেই। কবিতা পড়তে পড়তেই জয় বললেন, ‘গত রাত্রে (৬ জানুয়ারি) মোশাররফ করিমকে আমি সারা রাত্তির স্বপ্নে দেখেছি।’
পরে খোলাসা করলেন সেই স্বপ্নের আদ্যোপান্ত। অনেক উঁচু থেকে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁকে উদ্ধার করেন মোশাররফ করিম।
কবি বলতে থাকেন আর কল্পনার চোখে আমরা দেখি যে অনেক উঁচু থেকে পড়ে যাচ্ছেন অবিন্যস্ত চুল–দাড়ির জয়। আর একছুটে সুপারহিরোর মতো তাঁকে ধরে ফেলছেন মোশাররফ। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একধরনের সিনেমাটিক আবহ আছে।
তা মানুষের জীবন সব সময়ই যে সিরিয়াস ভঙ্গিতে চলবে, এ দিব্যিই–বা কে দিয়েছে!
এবার জয় গোস্বামীর মুখ থেকেই তাঁর মোশারফ–বন্দনার বিত্তান্ত শোনা যাক, ‘কলকাতায় সারা দিন আমি বাসায় একা থাকি। আমার মেয়ে আমাকে ল্যাপটপে মোশাররফের নাটক ছেড়ে দিয়ে যায়। আর আমি দেখতে থাকি... কী দারুণ অভিনয়! ঈশ্বর ওঁকে নায়কোচিত চেহারা দেননি ঠিক, তবে অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে সবকিছু পুষিয়ে দিয়েছেন...কী অসাধারণ ওঁর অভিব্যক্তি!’
জয় কথা বলছেন আর আমরা ভাবছি, এভাবে মোশাররফের অভিনয় দেখা এবং তাঁকে নিয়ে ভাবার কারণেই কি বাংলাদেশের এই তারকা কলকাতার জনপ্রিয় কবির স্বপ্নে সুপারহিরো হয়ে হানা দেন, তাঁকে উদ্ধার করেন? একদা স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিগমন্ড ফ্রয়েড এভাবেই তো বলেছিলেন। কিন্তু না, ফ্রয়েডের স্বপ্ন–সমীক্ষণের সেই চেনা ব্যাখ্যা থেকে মুহূর্তেই জয় আমাদের টেনে নামান বাস্তবতার মাটিতে। তিনি তখন আশফাক নিপুণের মহানগর ওয়েব সিরিজে হারুন নামে মোশাররফ যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেই লোভী দারোগার চরিত্রটি অভিনয় করে দেখাচ্ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটে জন্ম নেওয়া এই কবি কবিতার পাশাপাশি যে অভিনয়েও পারঙ্গম, তাঁর অভিনয় না দেখলে সেটি ঠাওর করা কঠিন।
তাঁকে আমরা বললাম, মোশাররফ করিমের সঙ্গে দেখা করতে চান? এ কথা শুনে কবির স্ত্রী কাবেরী গোস্বামী বললেন, ‘দিন না, দিন না। লোকটা সারা দিনই মোশাররফ মোশাররফ করে।’
এ সময় ‘না হু না হু’ করে উঠলেন স্বয়ং জয়ই, ‘না না, উনি শিল্প নিয়ে আছেন, থাকুন। তাঁকে বিরক্ত করা একদমই উচিত হবে না। উনি এত বড় অভিনেতা!’
তো, সেই অভিনেতাকে নিয়ে কবি যে আস্ত কবিতা লিখে ফেলবেন, তা কে জানত!
অতঃপর মোশাররফ করিমকে নিয়ে বাংলাদেশে বসে জয় গোস্বামী লিখে ফেললেন একটি কবিতা! শুধু কি তাই, কবিতাটি পড়ে তা ভিডিও করতে বললেন এই আকাঙ্ক্ষায় যে তাঁর স্বকণ্ঠের এই পাঠ মোশাররফ যেন শুনতে পারেন।
একটি স্বপ্নের সূত্র ধরে ৬৮ বছর বয়সী কবি কত–কী না করলেন! পরে সেই কবিতা উৎসর্গ করতে গিয়ে ওস্তাদ আমীর খাঁনের একটি রাগের বন্দিশের কথার সঙ্গে এক মোহনায় মিলিয়েও দিলেন মোশাররফ করিমকে। এমন আকাশ–পাতাল মিল তো কবির পক্ষেই দেওয়া সম্ভব।
‘হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে’ নামে তাঁর সেই বহুশ্রুত কবিতায় একদিন লিখেছিলেন, ‘কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।’
এখন বাংলাদেশের মোশাররফ করিমের অভিনয়ে মুগ্ধ জয় গোস্বামী যে কবিতাটি লিখলেন, যা কিছু করলেন, তাতে রানাঘাট থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে তাঁর হৃদি কি ভেসে গেল না বরিশালের পিঙ্গলকাঠি গ্রামে বেড়ে ওঠা মোশাররফ করিমের পানে!
একটি স্বপ্নের সূত্রে
[‘করিম নাম তেরো’; ওস্তাদ আমীর খান সাহেবের গাওয়া রাগ মিয়া কি মল্লারের
বিলম্বিত বন্দিশের মুখড়া]
দরজা খুলেই দেখলাম একদিন
দাঁড়িয়ে আছেন মোশাররফ করিম—
তৎক্ষণাৎ মাথার ভিতর আমার
জ্বলে উঠল হাজার পিদ্দিম!
এখন আমি কী করব? কী করি?
তাঁকে বরণ করব কোন উপায়ে?
চৌকাঠের সামনে হাঁটু গেড়ে
মুখ রেখেছি মোশাররফের পায়ে...
তাঁর পায়ে তো জুতো! জুতোর ধুলো
লাগল আমার গাল–চিবুক–ঠোঁটে—
লাগুক, আমি জানি তো মোশাররফ
পর্দায় যেই আসেন—সূর্য ওঠে!
আমি প্রত্যহই পুণ্যবান
অভিনয়ের সে–সূর্যঝলকে—
এই বৃদ্ধ বয়সের শ্রদ্ধাই
ভরে রাখছি কবিতার স্তবকে...
আমার কাছে অভিনেতাই আজ
সাক্ষাৎ ঈশ্বর—
বাংলাদেশের মাটিতে রেখে দিলাম
মোশাররফের জন্য আমার প্রণাম দিয়ে গড়া
ছোট্ট চালাঘর!
৮ জানুয়ারি ২০২৩, ঢাকা