গোঁফের আমি, গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’ বহু পরিচিত চরণ দুটি সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়া ‘গোঁফচুরি’র শেষ দুই লাইন। লাইন দুটির ভাবার্থ হলো, গোঁফেই মানুষের পরিচয়, গোঁফ দিয়েই তাঁকে চেনা যায়। শুধু ছড়া নয়, এই গোঁফ নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প ফেঁদেছেন অনেক সাহিত্যিক। সুরসিক শিবরাম চক্রবর্তীর একটা গল্পে গোঁফের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন এভাবে। গল্পের শুরুতে শিবরাম লিখেছেন, ‘ইতু লঞ্চ থেকে পড়েছে নদীতে। সাঁতার না জানা হর্ষবর্ধন নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে তাকে উদ্ধার করতে। তিনি ফুটবলের মত ভেসে রইলেন। শেষে তাদের দুজনকে লঞ্চে তোলা হল।’ পরেরটুকু শিবরামের ভাষাতেই শোনা যাক, ‘যাক হর্ষবর্ধন যে তাকে উদ্ধার করেছেন সেজন্য তাকে ধন্যবাদ।’
‘উনি উদ্ধার করেছেন? আমায়? না আমি উদ্ধার করলাম ওনাকে?’ ইতু প্রকাশ করে, ‘সাঁতার জানেন না উনি, আমিই তো ওকে জলে ভাসিয়ে টেনে নিয়ে এলাম।’
‘তুই? কি করে আনলিরে ওই লাশটাকে?’
‘কি করে আবার? ওর গোঁফ ধরে। হাতের কাছে ধরার কিছু পেলাম না তো আর। ভাগ্যিস ওনার অমন ডাগর গোঁফ ছিল তাই রক্ষে।’
এ তো গেল গোঁফ নিয়ে সাহিত্যের গল্পগাথা। তবে বাস্তবেও খ্যাতিমান মানুষদের বিখ্যাত গোঁফ নিয়ে আছে বিচিত্র রকমের গল্প।
গল্পে গল্পে গোঁফ-আলাপ
প্রথমেই স্পেনের বিখ্যাত চিত্রকর সালভাদর দালির সেই আইকনিক গোঁফের গল্প। এই চিত্রকরের গোঁফের বিবর্তনটি বেশ মজার। ১৯০৪ সালে জন্ম নেওয়া দালি বিশ দশক পর্যন্ত গোঁফ–দাড়িবিহীন ছিলেন। ত্রিশের দশকে তিনি ‘ম্যানজু গোঁফ’ রাখা শুরু করেন। ঠোঁটের দুই কোণ থেকে গজিয়ে নিচে ঝুলে থাকা গোঁফকে ম্যানজু গোঁফ বলে। নিজেই এটিকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম গোঁফের সংস্করণ বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
১৯৩৪ সালে বিয়ের পর তাঁর গোঁফের বদল ঘটে ‘অ্যানটেনা গোঁফ’ হয়ে যায়। দালির অ্যানটেনা গোঁফের প্রেরণাদাতা কে ছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে দুজনের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত। প্রথম জন স্প্যানিশ শিল্পী দিয়েগো ভেলাসকেথ (১৫৯৯-১৬৬০) আর আরেকজন হলেন স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপ (১৬০৫-১৬৬৫)। তবে দালির স্ত্রী গালা (১৮৯৪-১৯৮২) এই গোঁফের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনিই তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
২০১০ সালে ১৪ হাজার ১৪৪ জন ইউরোপীয়র মধ্যে সর্বকালের ‘বেস্ট নোন গোঁফ’-এর জরিপ করা হয়। এতে ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দালি প্রথম স্থান লাভ করেন। জরিপে কেউ কেউ মন্তব্য করেন যে দালির গোঁফ ইউরোপিয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিল। ১৯৫৪ সালে ফিলিপস হালসম্যানকে সঙ্গে নিয়ে দালি নিজের তাঁর বিষয়ে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় একটা বইও লিখেছিলেন। এই বইতেই দালি তাঁর স্ত্রীকে গোঁফের ‘গার্জিয়ান অ্যাঞ্জেল’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে শেষ বয়সে তাঁর ধূসর গোঁফ আকারে ছোট হয়ে নিম্নগামী হতে থাকে।
শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে চোখ ফেরানো যাক রাজনীতিতে। সেখানকার অনেক ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই তো গোঁফের ছড়াছড়ি। তার মধ্য থেকে দু-একজনের গোঁফ-বৃত্তান্তের গোমর কিছুটা আলগা করা যাক।
জার্মান নেতা অ্যাডলফ হিটলারের গোঁফবিলাস শুরু হয় তরুণ বয়স থেকে। প্রথম মহাযুদ্ধকালে হালকাপাতলা হিটলারের ছিল বাভারিয়ান গোঁফ বা সেমি হ্যান্ডেলবার গোঁফ। যুদ্ধে গ্যাস মাস্ক পরতে অসুবিধা হওয়ার কারণে সৈনিকদের গোঁফ ছাঁটার আদেশ দেওয়া হয়। এই আদেশে হিটলারের হ্যান্ডেলবার গোঁফ টুথব্রাশ গোঁফে রূপান্তরিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় টুথব্রাশ গোঁফের প্রচলন হয়। এরপর এটি জার্মানি ও অন্যান্য দেশে পাড়ি দেয়। এই গোঁফ দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়। হিটলার বিশ্বনেতা হওয়ার পর এই গোঁফচর্চায় ভিন্নমাত্রা যোগ দেয়। এটির আরেক নাম হয় হিটলার গোঁফ। তখন অনেকেই এই গোঁফের ভক্ত হয়ে পড়েন। টুথব্রাশ গোঁফ, স্বস্তিকা চিহ্ন এবং দুই পাশ চাঁছা চুল হিটলারের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। হিটলারের পতনের পর এই গোঁফ কুখ্যাত হয়ে যায় এবং দৃশ্যপট থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে।
তবে কৌতুক অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের বদৌলতে টুথব্রাশ গোঁফ পুরোপুরি তিরোহিত হতে পারেনি। মজার বিষয় হলো, চার্লি চ্যাপলিন সাধারণভাবে গোঁফহীন থাকলেও তাঁর বিখ্যাত টুথব্রাশ গোঁফ ও বউলার হ্যাট তিনি অর্জন করেছিলেন অভিনয়সূত্রে। পরে এ ধারার গোঁফের সঙ্গে তিনি এতটাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যান যে অনেকেই তাঁকে গোঁফহীন অবস্থায় চিনতে ভুল করেন।
এবার এক ‘বাংলার বাঘ’-এর গল্প। তিনি আশুতোষ মুখার্জি (১৮৬৪-১৯২৪)। একাধারে ব্যারিস্টার, গণিতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, আট বছরের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই মানুষটি তাঁর গোঁফের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর গোঁফ যে ধরনের, এ ধরনের গোঁফের নাম ‘ওয়ালরুস’। অনেকে রসিকতা করে একে ‘ছাঁকনি গোঁফ’ বলেন। কেউ কেউ বলতেন, ‘গোঁফ রাখতে হলে আশু মুখুজ্জের মতো গোঁফ রাখা দরকার।’ অমিতাভ বচ্চনের শারাবি সিনেমার বিখ্যাত ডায়ালগ সম্ভবত এখান থেকেই নেওয়া হয়েছিল, ‘মোচে হো তো নত্থুলাল জ্যায়সি হো, ওয়ারনা না হো (গোঁফ রাখলে নত্থুলালের মতো রাখো, না হলে রাখিয়ো না)।’ এই নত্থুলাল ধরনের গোঁফকে ইমপেরিয়াল গোঁফ বলা হয়। আশুতোষ মুখার্জির গোঁফ নিয়ে এক রসিকজন লিখেছেন, ‘আজকের ভেজালের যুগে জলীয় যা কিছু ভেজাল, ওই রকম গোঁফে ছেঁকে বাইরে থেকে যাবে, পেটে ঢুকবে না। ও কম্মো চার্লি-গোঁফ বা জন গিলবার্ট মার্কাগোঁফের হওয়া অসম্ভব। চাই ছাঁকা বা ছাঁকনি-গোঁফ।’
সভ্যতায় সভ্যতায়
গোঁফ–দাড়ি প্রাপ্তবয়স্ক বা লায়েক হওয়ার দৃশ্যমান স্বীকৃতি। প্রকৃতির নিয়মেই পুরুষ মানুষের মুখমণ্ডলে প্রথমে গোঁফ, তারপর দাড়ির আবির্ভাব ঘটে—এটা জৈবিক রীতির অংশ। পুরুষের দাড়ি গজানোর আগেই গোঁফের আবির্ভাব ঘটে। তবে জনপ্রিয়তার বিচারে বোধ হয় দাড়ির চেয়ে গোঁফ অনেকটাই এগিয়ে আছে। পরিমলচন্দ্র সরকার উল্লেখ করেছেন, ‘দাড়ির কথা বলতে গেলে গোঁফের কথা স্বতঃসিদ্ধভাবে এসে যায়, কারণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দাড়ি ও গোঁফ অবিচ্ছিন্ন। দাড়ি থাকলেই গোঁফ থাকবে, কিন্তু গোঁফ থাকলেও দাড়ি না–ও থাকতে পারে। তাই এক হিসেবে গোঁফের মূল্য বেশি হওয়া উচিত।’
তবে কিছু জাতির মধ্যে গোঁফ–দাড়ির আকাল দেখা যায়। পীত জাতি বা মঙ্গোলয়েড বর্গের মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা খুব বেশি। তাই চায়নিজ ও তত্সংলগ্ন জাতিগুলোর মধ্যে গোঁফ–দাড়ি বেশ দুর্লভ। প্রাচীন দার্শনিক কনফুসিয়াস, যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ সনজু থেকে শুরু করে হালের হো চি মিন পর্যন্ত সবার গোঁফ–দাড়ি বেশ সীমিত—থুতনি থেকে অল্প কিছু ঝুলে আছে। কথিত আছে, কনফুসিয়াসের গোঁফ, দাড়ি ও জুলফির অংশবিশেষ আজও চীনে সংরক্ষিত আছে।
প্রাচীনকালে গ্রিসের অধিবাসীরা গোঁফ–দাড়ির প্রভূত কদর করতেন এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত থাকতে পছন্দ করতেন। প্রাচীন ইতিহাস খুঁজলে এটরুসকান বা রোমান সভ্যতাতেও গোঁফ–দাড়ির কদর দেখা যায়। গ্রিক ও রোমানদের দেবতা বা উপদেবতা—যেমন স্যাটার্ন, জুপিটার, নেপচুন, প্লুটো, ভলকান, মার্কারি প্রমুখ প্রায় সবাই ছিলেন শ্মশ্রুমণ্ডিত। একমাত্র ব্যতিক্রম ভেনাস। কারণ, তিনি ছিলেন চিরতারুণ্যের প্রতীক। গ্রিক বীর হারকিউলিসেরও একমুখ গোঁফ–দাড়ি ছিল। আর স্বাস্থ্য বা মেডিসিনের দেবতা আসক্লেপিয়াসের গোঁফ–দাড়ি ছিল সবচেয়ে বেশি। সমৃদ্ধ।
মহাকাব্য ইলিয়ড ও ওডিসির রচয়িতা হোমারের জন্ম খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৯০০ বছর আগে। তাঁর মহাকাব্যের প্রায় সব নায়কই ছিলেন শ্মশ্রুমণ্ডিত।
গ্রিক সভ্যতার আগে–পরে আসিরিয়ান, ব্যাবিলিয়ান, পারসি, আরব, তুর্কি—সবাই গোঁফ–দাড়ির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন। তাঁদের গোঁফ–দাড়ির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর গল্পগাথা। তবে মিসরীয় বা ফারাওদের মধ্যে গোঁফ–দাড়ির প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি ছিল। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের মিসরীয় শিল্পকর্মে হালকা পেনসিল গোঁফের নিদর্শন পাওয়া গেলেও সার্বিকভাবে মিসরীয়দের মধ্যে গোঁফ–দাড়ির প্রতি বিরাগই লক্ষণীয়। গ্রিক ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসচর্চার জনক হেরোডোটাস যিশুখ্রিষ্টের প্রায় ৫০০ বছর আগে বলেছিলেন, ছেলে হোক কি মেয়ে, কোনো মিসরীয়ই শ্মশ্রুমণ্ডিত গ্রিককে চুমা দেবে না; তার ব্যবহৃত চাকু, তরবারি বা বাসনকোসন ছোঁবে না। এমনকি তাদের জবাই করা পশুর মাংসও খাবে না।
তবে মিসরে ফারাওদের আমলে গোঁফ–দাড়ি কর্তনের নিয়ম থাকলেও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা শোকযাত্রায় ধাতু দিয়ে তৈরি পরচুলা ও নকল দাড়ি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। এসব অনুষ্ঠানে নারীরাও স্বর্ণনির্মিত কৃত্রিম দাড়ি ব্যবহার করতেন। এই ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়, মিসরীয়রাই প্রথম পরচুলা আর নকল দাড়ি ব্যবহারের ফ্যাশন চালু করেছিল।
অপার ভারতবর্ষে, বিপুলা বাংলায়
ভারতবর্ষে মোগল আমল থেকেই মুসলমান-অমুসলমানভেদে রাজা–বাদশাহদের মধ্যে গোঁফ–দাড়ির কদর ছিল। তাঁদের কারণে রাজসভার সদস্যরাও শ্মশ্রুমণ্ডিত থাকতেন। মোগল সম্রাটদের মধ্যে প্রথম দাড়ি কামান আকবর, এরপর জাহাঙ্গীর। ফলে তাঁদের সভাসদদের মধ্যেও দাড়ি কামানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। অতঃপর শাহজাহান আবারও দাড়ির প্রতি অনুরাগী হন। রাজদরবারে আসে ফিরে আসে গোঁফ–দাড়ি। বলা ভালো, সম্রাটদের গোঁফ–দাড়ি রাখা ও কাটার প্রভাব সেই সময় সারা ভারতবর্ষের অভিজাত সমাজেই প্রতিফলিত হতো।
এই মোগল সম্রাটদের দাড়িরও আবার ছিল প্রকারভেদ। যেমন শাহজাহানের দাড়ির কায়দা ছিল এক রকম, আওরঙ্গজেবের আরেক। বয়সভেদে শাহজাহানের রূপ ছিল ভিন্ন। যৌবনের দাড়ির সঙ্গে তাঁর বৃদ্ধাবস্থার দাড়ির পার্থক্য লক্ষণীয়।
বাঙালির গোঁফ–দাড়ি প্রসঙ্গে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি গ্রন্থে গবেষক গোলাম মুরশিদ উল্লেখ করেন:
প্রাচীন ভাস্কর্যে দাড়ি দেখা যায় না। কিন্তু মধ্যযুগের কোনো পাণ্ডুলিপিচিত্রে দাড়িওয়ালা পুরুষ দেখা যায়। মনে হয়, এটা হয়েছিল মুসলিম প্রভাবে। উনিশ শতকের গোড়ায় রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ বিশিষ্ট হিন্দুদের দাড়ি ছিল না।
ঢাকার মহররম এবং ঈদের শোভাযাত্রার যে চিত্রের কথা আগেই উল্লেখ করেছি (উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আলম মুসওয়ারের আঁকা), তাতে ৬৩ জন লোকের মধ্যে মাত্র দুজনের দাড়ি দেখা যায়। পক্ষান্তরে, গোঁফ আছে প্রায় সবারই। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবার অনেকে দাড়ি রেখে ফ্যাশন করতে শুরু করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমুখ দাড়ি অথবা গালপাট্টা রেখেছিলেন, সম্ভবত ইংরেজদের প্রভাবে। রবীন্দ্রনাথ দাড়ি রেখেছিলেন ইংরেজদের প্রভাবে, না পরিবারের প্রভাবে বলা শক্ত।
উনিশ শতকের রসিক কবিয়াল ভোলা ময়রা বাঙালি বাবুদের গোঁফ–দাড়ির সহাবস্থান নিয়ে কবিতায় লিখেছেন:
চোরে চোরে যেমন হয় মাসতুতো ভাই
দাড়ির সঙ্গে গোঁফের সম্পর্ক যে তাই
একটি থাকলে অপরটিকে খুঁজে ফিরি তাই
একে অপরের সঙ্গী ভঙ্গীর আর তুলনা নাই
হারুর সঙ্গে ময়রা ভোলার ময়ান যেমন খাঁটি
গোঁফ-দাড়ি যেন বায়া-তবলায় একসঙ্গে চাটি।
বাঙালির গোঁফ–দাড়ির ঐতিহ্য নিয়ে অমিয় দত্ত কিছুটা ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘বাঙালীরা একসময় গোঁফ–দাড়ি রাখতেন। কিন্তু বাংলা যখন মোগল–পাঠানদের কবলে এলো, তখন থেকেই বাঙালী পুরুষেরা দাড়িকে বিদায় দিয়ে গোঁফ রাখাকে প্রাধান্য দিলেন। গোঁফ সহযোগে দাড়ি তখন একযোগে মুসলমানদের মুখের শোভা হয়ে গেল। এক শ বছর আগেও প্রায় প্রতি জমিদার গোঁফ রাখতেন।’ এখানে অমিয় দত্ত বাঙালি বলতে শুধু হিন্দুদের বোঝাতে চেয়েছেন।
সময়ের বিবর্তনে ক্রমেই বাতিল হয়েছে দাড়ি, তারপর গোঁফ। ভারতীয় হিসেবে শতকরা পাঁচজন হিন্দু বাঙালির গোঁফ–দাড়ি একত্রে সহাবস্থানে আছে। শতকরা ৫৫ জন রেখেছেন শুধু গোঁফ আর বাকি সবাই দুটোকেই উড়িয়ে দিয়েছেন হয় নিজের তাগিদে, নয়তো গিন্নির গঞ্জনায়।
এবার মসিজীবীদের গোঁফ–দাড়ি নিয়ে কিছু কথা। আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের পুরোধা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) গোঁফ–দাড়ি ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরও (১৮২০-৯১) গোঁফ–দাড়ি ছিল না। রসরাজ অমৃতলাল বসুর তাজ্জব ব্যাপার নাটকে এ নিয়ে একটি ডায়ালগ আছে, ‘বিদ্যাসাগর স্ত্রী কি পুরুষ ছিলেন, সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর যা ছবি আছে, তা দেখলে বোধ হয় যে যদিও অনেকটা পুরুষের মতো কাপড় পরতেন বটে, তবু তিনি স্ত্রীলোক ছিলেন। তার গোঁফ-দাড়ি কিছুই নাই।’
ভিক্টোরিয়া আমলের গোঁফ–দাড়ির ঐতিহ্য বা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) লম্বা দাড়ি রেখেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথের মতো ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫-১৯৬৯) দাড়িও ছিল দীর্ঘ। অন্যদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) ছিল শৌখিনভাবে ছাঁটা গোঁফ–দাড়ি। মীর মোশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) যৌবনে দাড়ি ছাড়া থাকলেও পরিণত বয়সে দাড়ি রেখেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (১৮৬৩-১৯১৫) ছিল লম্বা গোঁফ–দাড়ি।
মসিজীবীদের গোঁফ-দাড়ির গল্প বলতে গিয়ে আবারও রবীন্দ্রনাথে ফেরা যাক। নোবেলজয়ী এই বাঙালি কবি প্রথম জীবনে ছিলেন গোঁফ-দাড়িহীন, যাকে বলে মাকুন্দ। বিয়ের সময় তাঁর দাড়ি ছিল না, ছিল সুন্দর করে ছাঁটা গোঁফ। বিয়ের পরই বাড়তে থাকে দাড়ি। প্রচার (নাকি অপপ্রচার) আছে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গোঁফ–দাড়ি অন্য কেউ অনুসরণ করলে বেশ ক্ষুব্ধ হতেন। এ বিষয়ে কথাসাহিত্যিক শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর তাঁকে নিয়ে একটি বৈঠকি গল্প আছে। অমিয় দত্তের লেখা থেকে জানা যায়:
শরত্চন্দ্র একদিন তার বৈঠকে বললেন, তোমরা জানো ’ত রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিলো তা এখন বিবাদে পরিণত হ’য়েছে, রবীন্দ্রনাথ প্রবাসী সম্পাদক—রামানন্দবাবুর ওপর খুব চটে গেছেন। কারণ রামানন্দবাবু বিলেতের বিভিন্ন জায়গায় রবীন্দ্রনাথের নাম নিয়ে খুব সম্বর্ধনা নিচ্ছেন, মালা পরছেন আর হাততালি পাচ্ছেন। সবাই বললে, এ আবার কী কথা। রামানন্দবাবু আর রবীন্দ্রনাথ তো একরকম দেখতে নয়। শরত্চন্দ্র বললেন আরে গন্ডগোল করেছে ওই গোঁফ-গাড়ি।
রবীন্দ্রনাথের গোঁফ-দাড়ির সাইজ ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের গোঁফ-দাড়ির সাইজও প্রায় এক। আর মুখ! ওদের কাছে সব ভারতীয়র মুখ প্রায় এক, যেমন আমরা চিনেম্যান বা জাপানিদের এক রকম দেখি। গোঁফ-দাড়ি দেখেই ওরা রবীন্দ্রনাথকে চিনত, রামানন্দ বাবুর গোঁফ-দাড়ি দেখে রবীন্দ্রনাথ বলে ওরা তাঁকে সম্মান জানাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের দাড়ি তাঁর ‘শিক্ষক’ ব্যক্তিত্বেরও প্রতীক, এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ। অরুণকুমার সেনশর্মার লেখায় পাই, ‘শ্রদ্ধেয় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই দাড়ি–গোঁফের অন্তরালে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রখর ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন। বিশ্বভারতীতে অসংখ্য শিক্ষাবিদকে লক্ষ করেছি, কেমনভাবে তারা এই দাড়ি–গোঁফের সাহায্যে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাকে আকর্ষণ করতেন।’
খানিক আগে রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন এ-ও বলা সংগত হবে যে প্রথম জীবনে শরৎচন্দ্রও গোঁফ-দাড়ি শোভিত ছিলেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তখন বের হয় তাঁর চরিত্রহীন উপন্যাসটি। এ সময় বাজারে আরেক শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ঔপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভূত হন চাঁদমুখো নামে একটি উপন্যাসের মাধ্যমে। আসলে এই শরৎচন্দ্র ছিলেন গল্পলহরী পত্রিকার সম্পাদক এবং চরিত্রহীন-এর লেখক শরৎচন্দ্রের মতো তাঁরও দাড়ি ছিল। এ অবস্থায় ওই শরৎচন্দ্র থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার জন্যই শরৎচন্দ্র তাঁর দাড়ি বিসর্জন দেন।
গোঁফ–দাড়ির আন্দোলন
ইতিহাসজুড়ে গোঁফের খ্যাতি ও চাহিদা থাকলেও ১৪৪৭ সালে ব্রিটেনে আইন করে গোঁফ রাখা নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে ব্রিটিশদের মধ্যে গোঁফের কদর শূন্যের কোঠায় চলে আসে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সারা ইউরোপের পুরুষকুলের মুখ থেকে কেশ উধাও হয়ে যায়।
উনিশ শতকের শুরুতে পশ্চিমা সমাজে গোঁফ–দাড়ির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। গোঁফ–দাড়ির প্রত্যাবর্তনের আগাম বার্তা হিসেবে বাড়তে থাকে কানের পাশে বড় জুলফির জনপ্রিয়তা। জুলফির জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে কিছু চতুর ব্যবসায়ী নকল জুলফি তৈরি করে বিক্রি করতে শুরু করে।
আর ভারতীয়দের জন্য গোঁফ–দাড়ি শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হওয়ার বিষয়টি ব্রিটিশ অভিজাতদের, বিশেষত রাজকীয় সৈনিকদের প্রভাবিত করে। এ সময়ের কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিও গোঁফ–দাড়ির পক্ষে অবস্থান নেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য জর্জ ফ্রেডারিক মুনটজ। তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেন ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারী ও লেখক স্যার রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন, ফিল্ড মার্শাল ফ্রেডারিক রবার্টসহ অনেকে। তাঁরা নিজেরা গোঁফ–দাড়ি রাখা শুরু করেন এবং অন্যদেরও গোঁফ–দাড়ির প্রতি উত্সাহিত করেন। এ থেকেই ব্রিটেনে শুরু হয় একটি আন্দোলন, যা ‘মোচটাচ মুভমেন্ট’ বা গোঁফ আন্দোলন নামে পরিচিত।
পরে ব্রিটেনে গোঁফের সংস্কৃতি সমাজের এতই গভীরে প্রবেশ করে যে ভদ্রলোকদের ক্লাবে গোঁফহীন কেউ প্রবেশ করলে বাকিরা তাঁর দিকে এমনভাবে তাকাতেন যেন সে পরিধেয় বস্ত্র ছাড়াই ক্লাবে ঢুকে পড়েছেন।
১৯৭৬ সালে দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকায় ছাপানো ডিউট ই রবিনসনের গোঁফ–দাড়ি নিয়ে একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ ছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে প্রায় ৬০ শতাংশ ব্রিটিশ পুরুষেরই মুখে গোঁফ দেখা যেত। ধীরে ধীরে কিন্তু দৃপ্ত পদক্ষেপে ভিক্টোরিয়া যুগে গোঁফ–দাড়ি স্বমহিমায় ফিরে আসতে থাকে। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে আশুতোষ মুখার্জির মতো বড় কিংবা রাজকীয় গোঁফওয়ালাদের চা-কফি পানের অসুবিধা দূর করার জন্য ১৮৬০ সালে আবিষ্কৃত হয় ‘মুসটাশ কাপ’। নব আবিষ্কৃত এই কাপে পানীয় পানের সময় গোঁফধারীদের গোঁফ শুষ্ক রাখা সহজ হয়ে গেল। আন্দোলনটি আরও গতিশীল হলে দাড়িও এর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ‘বিয়ার্ড অ্যান্ড মুসটাশ মুভমেন্ট’ নাম ধারণ করে। এ আন্দোলন বেগবান করার পেছনে সে সময় গণমাধ্যম বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৫২ সালের অক্টোবর মাসে টেটস এডিনবার্গ সাময়িকী প্রকাশ করে, ‘আ ফিউ ওয়ার্ডস আপন বিয়ার্ড’ শিরোনামে একটি লেখা। সেখানে বলা হয়, ‘তাদের শতাব্দীপ্রাচীন নির্বাসনের দিন শেষ হয়ে আসছে। আর পুরুষের আদি শাসন পুনরুদ্ধার করার দিন ঘনিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে সেই বার্তাই স্বীকৃত ঘোষকের মতো জানান দিচ্ছে সামরিক গোঁফ, উদ্ধত দাড়ি আর প্রতিদিন বাড়তে থাকা খাড়া গোঁফ।’
পরের বছর ১৮৫৩ সালে সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স সম্পাদিত হাউসহোল্ড ওয়ার্ল্ড–এ প্রকাশ পায়, ‘হোয়াই শেভ?’ নামে একটি নিবন্ধ। সেখানে দাবি করা হয়, দাড়ি শ্বাসতন্ত্রকে রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ওয়েস্টমিনস্টার রিভিউ প্রকাশ করে, ‘দ্য বিয়ার্ড! হোয়াই ডু উই কাট ইট অফ?’ নামে এক লেখা। সেখানে লেখক উল্লেখ করেন, গোঁফ বিদায় দেওয়ার পর তিনি মামসের পীড়ায় আক্রান্ত হন। ওই বছরই দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন প্রকাশ করে ‘দ্য বিয়ার্ড অ্যান্ড মুসটাশ মুভমেন্ট’। সেখানে লেখক উল্লেখ করেন যে নবজাতককে জন্মদান অপেক্ষা গোঁফ–দাড়ি কামানো অধিক কষ্টদায়ক। কারণ, নবজাতক একবারই জন্ম নেয়, কিন্তু যাঁরা শ্মশ্রুহীন থাকেন, তাঁদেরকে প্রতিদিনই গোঁফ–দাড়ি চেঁছে নবজাতক সাজতে হয়।
এভাবে ক্রমেই গোঁফ–দাড়ির পক্ষে আন্দোলন উত্তাল হতে থাকে। একসময় এর ব্যাপ্তি ইংল্যান্ড থেকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫৪ সালের জুন মাসে দ্য ইলাস্ট্রেটেড সিডনি নিউজও ‘বিয়ার্ড অ্যান্ড মুসটাশ মুভমেন্ট’-এর সংবাদ প্রকাশ করে।
এখানেই শেষ নয়, গোঁফ–দাড়ির পক্ষে প্রবল জনমত লক্ষ করে টি এল গোয়িং ১৮৫৪ সালে দ্য ফিলোসফি অব বিয়ার্ড নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। সেই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, পৃথিবীর সব সভ্য জাতি, যেমন মিসরীয়, ভারতীয়, আসিরিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান, পারসি, আরব, গ্রিক, রোমান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, টার্ক, স্লাভ—সবারই গোঁফ–দাড়ি ছিল স্বাভাবিক পছন্দ। গোয়িং তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদে আরও উল্লেখ করেন, ‘দাড়ির অনুপস্থিতি সাধারণভাবে দুর্বল শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রমাণ।’ চার্লস ডারউইনও (১৮০৯-৮২) তাঁর দ্য ডিসেন্ট অব মেন বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে আদিম জাতিগুলো সভ্য জাতির সংস্পর্শে এসে গোঁফ–দাড়ির সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচিত হয়, এর আগে তাঁরা শ্মশ্রুহীন থাকতেন। সভ্য জগতের প্রতিনিধি হিসেবে ডারউইনেরও বড় আকারের গোঁফ–দাড়ি ছিল।
যাহোক, উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে গোঁফের প্রতি এই অদম্য আকর্ষণে ভাটা পড়তে শুরু করে। লন্ডনের মানুষ আবারও গোঁফ–দাড়ি বিসর্জন দিতে শুরু করে। আর এর মধ্যে প্রচার হয়ে যায় যে গোঁফ–দাড়িতে জীবাণু বসবাস করে। ব্যস, হাসপাতালে ভর্তির সময় রোগীদের গোঁফ–দাড়ি চেঁছে ফেলার রেওয়াজ চালু হয়ে গেল।
যোদ্ধার গোঁফ–দাড়ি: কে কার অলংকার
প্রাচীনকাল থেকেই গোঁফ–দাড়ি যেমন সৈনিকদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আর অবিভাজ্য, তেমনি তা যোদ্ধাদের বীরবেশ ও পৌরুষের পরিচায়কও। একসময় সাধারণ সৈনিক থেকে সেনাপতি পর্যন্ত কাউকে গোঁফ–দাড়িবিহীন কল্পনা করা ছিল বেশ দুষ্কর। কথিত আছে, সেনাবাহিনীতে গোঁফ–দাড়ি কর্তনের প্রথা চালু হয় গ্রিক সেনাপতি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়ে। সে সময়ে যুদ্ধের শুরুটা হতো তির, ধনুক, বল্লম আর তলোয়ার দিয়ে আর শেষ হতো হাতাহাতি দিয়ে। শত্রুপক্ষের সৈনিকেরা যাতে গ্রিক সৈন্যদের দাড়ি ধরে পেড়ে ফেলতে না পারে, তাই আলেকজান্ডার দাড়ি কাটার এই আদেশ দেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, আলেকজান্ডার মদ্যপ অবস্থায় এই আদেশ দিয়েছিলেন। যা–ই হোক না কেন, কট্টর গোঁফ–দাড়িপন্থীরা বলেছেন, এই আদেশে গ্রিকদের দাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে তাদের আধিপত্যও অক্কা পেয়েছিল। কেননা এরপরই রোমান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি শুরু হয়।
তবে আলেকজান্ডারের আদেশটির পর গ্রিসে গোঁফ–দাড়িহীনদের দাপট বেড়ে যায়, তবে নামকরা গ্রিক দার্শনিক এবং জ্ঞানের পূজারিরা সবাই এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন এবং গোঁফ–দাড়ির প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন। গ্রিক সম্রাট দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান তাঁর রাজত্বকালে (৫৬৫-৫৭৮ সাল) সেনাবাহিনীতে গোঁফ–দাড়িকে যথাযথ মর্যাদাসহ আবারও ফিরিয়ে আনেন।
আবার অনেক আগে থেকেই ভারতীয়দের কাছে গোঁফ ছিল বীরত্ব ও পৌরুষত্বের প্রতীক, গোঁফহীনদের তাঁরা অর্ধনর বলে ভাবতেন। মহিশুরের নবাব টিপু সুলতান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অ্যাংলো-মহিশুর যুদ্ধে (১৭৮০-৮৪) নিজের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শিল্পী দিয়ে যুদ্ধের ছবি আঁকান। সেখানে তিনি সব ইংরেজ সৈন্যকে শ্মশ্রুহীন দেখান। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ইংরেজ সৈন্যরা নারীতুল্য বা অপূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
দুই শ বছর আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গোঁফ–দাড়ি রাখা আইনত অপরাধ ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের ‘বিয়ার্ড অ্যান্ড মুসটাশ মুভমেন্ট’–এর হাওয়ায় অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। ১৮৩১ সালে ১৬তম লান্সার্স ইউনিটের সৈনিকদের গোঁফ রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ঠান্ডার কারণে ক্ষুর ব্যবহার কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়মিত গোঁফ–দাড়ি কামানোর আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ফলে সৈনিকেরা আবার গোঁফ–দাড়ি রাখা শুরু করেন। ১৮৫৬ সালে সৈনিকেরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন গোঁফ–দাড়ি ছাড়া, ফিরে আসেন গোঁফ–দাড়িসহ। এসব যুদ্ধফেরত সৈনিকদের গোঁফ–দাড়িসহ দেখে রানি ভিক্টোরিয়া মন্তব্য করেছিলেন, তিনি প্রকৃত যোদ্ধাদের দেখতে পাচ্ছেন।
১৮৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেনাপতি লর্ড ফ্রেডারিক ফিটজ ক্লারেন্স তাঁর অধীন ‘বম্বে আর্মি’তে গোঁফ রাখা বাধ্যতামূলক করেন। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ বাহিনীতে গোঁফ রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে গোঁফ সৈনিকের পোশাকের অংশ হয়ে যায়। এই আদেশবলে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গোঁফ চাঁছা শৃঙ্খলা–পরিপন্থী কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো। সেনা আইনে উল্লেখ ছিল, ‘মাথার চুল ছোট করে ছাঁটতে হবে, থুতনি ও নিচের ঠোঁটের মধ্যবর্তী অংশ শেভড থাকবে, তবে ঠোঁটের ওপরের অংশ ছাঁটা যাবে না।’
সেনাবাহিনীতে গোঁফ–দাড়ির ওপর আঘাত আসে প্রথম মহাযুদ্ধকালে। এ সময় বায়ো-কেমিক্যাল যুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সৈনিকদের গ্যাস মাস্ক পরিধানের নিয়ম প্রচলিত হয়। গোঁফ–দাড়িওয়ালাদের জন্য গ্যাস মাস্ক পরিধান সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানে গোঁফ–দাড়ির যত্নের অভাবে সৈনিকদের চেহারা উস্কোখুস্কো হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কিশোর সৈনিক যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। তাদের তখনো ভালো মতো গোঁফ–দাড়ি গজায়নি। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গোঁফ–দাড়ির গৌরব স্তিমিত হয়ে গেল। ১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিল যে এখন থেকে গোঁফ–দাড়ি আর বাধ্যতামূলক নয়, ঐচ্ছিক।
রসিকজনেরা অবশ্য ব্রিটিশ সৈনিকের মুখে গোঁফ–দাড়ির সঙ্গে তাঁদের সাম্রাজ্যের উত্থান–পতনের তুলনা করেছেন। ব্রিটেন যখন অর্ধবিশ্ব রাজত্ব করত, তখন তার সৈনিকের মুখ গোঁফ–দাড়িতে সুশোভিত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে যখন সৈনিকের মুখমণ্ডল থেকে গোঁফ–দাড়ি তিরোহিত হলো, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যও অস্তমিত হতে শুরু করল।
ব্রিটিশ রাজত্বের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও যে গোঁফ–দাড়ি আদরণীয় অবস্থায় ছিল, তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় ভারতীয় মেজর জেনারেল চন্দ্র এন দাশের লেখায়, ‘গোঁফ আর দাড়ি রাখার অভ্যাস শত বছর ধরে চলে আসছে। বলা হয় যে দাড়ি-গোঁফ রাখার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে যোদ্ধাদের চেহারা ভয়ংকর করে তোলা। রাজপুত যোদ্ধাশ্রেণী খাড়া গোঁফ রাখত শুধু যুদ্ধে ভয়ংকর দেখানোর জন্য নয়। এই গোঁফ নিজেদের পুরুষালি দেখাতে আর শান্তির সময় তাঁরা যে যোদ্ধা শ্রেণীর লোক, তা বোঝানোর জন্য কাজে দিত। শিখদের মধ্যে আবশ্যিকভাবে কেশ, গোঁফ আর দাড়ি রাখারও এমন উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা যেতে পারে।’
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গোঁফ–দাড়ির কদর সেই ইংরেজ আমল বা তারও আগে থেকে। তখন দেশীয় সৈনিকেরা তো বটে, ব্রিটিশ অফিসাররাও গোঁফ–দাড়ির বেশ যত্ন নিতেন। কিছু সৈনিক তাদের দীর্ঘ ও বাহারি গোঁফ মোম দিয়ে বিশেষভাবে পাকিয়ে রাখতেন। ব্যতিক্রমী গোঁফ–দাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্রিটিশ সময় থেকে সৈনিকদের বিশেষ ভাতাও দেওয়া হতো। পাকিস্তান সময়েও এই ভাতা প্রযোজ্য ছিল। বর্তমান সময়ে সৈনিকের মুখ থেকে ব্যতিক্রমী গোঁফ উধাও হয়েছে, ভাতাও রহিত হয়েছে।
গোঁফ দেখে যায় চেনা
গোঁফ–দাড়ি মানুষ বা কোনো চরিত্রের প্রতীকও হয়ে উঠেছে। এই কয়েক দশক আগেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যেত নাটক–সিনেমার রোমান্টিক নায়কেরা সুকেশের অধিকারী আর গোঁফ–দাড়িবিহীন। ক্ষেত্রবিশেষে একচিলতে গোঁফ থাকতে পারে, তবে দাড়ি? কদাপি নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খলনায়কের গোঁফ–দাড়ি থাকতে দেখা যায়। যেন গোঁফ–দাড়ি না থাকলে চরিত্রটিকে বেশি নিষ্ঠুর বা অত্যাচারী হিসেবে দেখানো কঠিন হয়ে পড়ে।
শুধু নায়ক ও খলনায়ক নয়, নাটক–সিনেমার আরও কিছু চরিত্রও আর্কিটাইপ—মানে গোঁফ–দাড়ি দেখে যায় চেনা। যেমন উদাসীন ও খুব ভালো মানুষের মুখে দাড়ির প্রলেপ থাকে। একইভাবে ধার্মিক ও নীতিমান মানুষের দাড়ি থাকা বাঞ্ছনীয়। পার্শ্বচরিত্রের গোঁফ–দাড়ির প্রকারভেদ আছে। নায়ক–নায়িকার দুঃখী পিতা বা গরিব চাষির ক্ষেত্রে খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকা জরুরি। নায়কের ভাঁড়রূপী বন্ধুর টুথব্রাশ গোঁফ দেখা যায়, আর যাত্রার ভাঁড়দের থাকে ল্যাম্পশেড গোঁফ।
আর যাত্রার বিবেক এবং পাগলের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কী দরকার? একমুখ অগোছালো গোঁফ–দাড়ি থাকতেই হবে। আবার সেনাপতি চরিত্রকে আরও মানানসই করার জন্য তাগড়াই গোঁফ দিয়ে দিলে তো কথাই নেই, এক শতে এক শ।
একইভাবে আমাদের এখানে দাঁড়ির আরও কিছু আর্কিটাইপ আছে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তরুণেরা যে খোঁচা খোঁচা দাড়ি রাখেন, তা দেবদাস দাড়ি নামে পরিচিত। এই নামটি এসেছে শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের নায়ক দেবদাসের তরফ থেকে।
কোনো কিছুর প্রতিবাদ জানাতেও পুরুষেরা গোঁফ–দাড়ি রাখেন। গালের ক্ষত ঢাকতে, তোবড়ানো গাল ভরাট দেখাতে, কোনো কিছুতে সফল হওয়ার সংকল্পপূরণে আর না হয় আঁতেল আঁতেল ভাব ধরতে—নানা কারণেই মানুষ রাখেন। বার্নার্ড শ দাড়ি রেখেছিলেন মুখের দাগ ঢাকার জন্য। তবে এই নাট্যকারের নাকি খুব দুঃখ ছিল রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁর লম্বা দাড়ি হয়নি বলে। আবার মুক্তিযুদ্ধকালে মেজর জলিলসহ বেশ কয়েকজন সেক্টর বা সাবসেক্টর অধিনায়ক এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত গোঁফ–দাড়ি না কাটার ব্রত নিয়েছিলেন।
বেঁচে থাক গোঁফ–দাড়ি
হালে গোঁফ–দাড়ির কদর বেশ কমে গেলেও একবারে তিরোহিত হয়নি। উপরন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে যে পাশ্চাত্যে গোঁফ–দাড়ির পুনরুত্থান হচ্ছে। ২০০৩ সালে ‘মুভেম্বর ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। পরে সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে তাদের শাখা খুলেছে। এই সংস্থার ‘মুভেম্বর’ শব্দটি ‘মুসটাশ’–এর ‘মু’ আর ‘নভেম্বর’–এর ‘ভেম্বর’ শব্দ দুটিকে একত্র করে সৃষ্ট। সংগঠনটি প্রতিবছর নভেম্বর মাসজুড়ে গোঁফ রাখার মধ্য দিয়ে পুরুষের স্বাস্থ্য, সুখ, দীর্ঘ জীবন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে। তাদের কিছু কর্মকাণ্ডে বিতর্ক থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ লাইব্রেরিও প্রায় দুই শতাব্দীপ্রাচীন দ্য ফিলোসফি অব বিয়ার্ড বইটি পুনর্মুদ্রণ করেছে। এটি ব্রিটেনে গোঁফ–দাড়ির পুনরাগমনের ইঙ্গিত মনে হতে পারে। এ ছাড়া গোঁফ–দাড়ির সমর্থকদের জন্য ক্ষীণ আশার আলো দেখাচ্ছেন খোলোয়াড়েরা, বিশেষত ক্রিকেটাররা। কারণ, অল্প বয়স্ক অনেক ক্রিকেটারের মুখেই দেখা যাচ্ছে গোঁফ–দাড়ি। তাঁদের অনেকের ধারণা এমন, আনশেভড ফেস হলো সৌভাগ্যের প্রতীক। অবশ্য খেলোয়াড়দের গোঁফ–দাড়ি রাখার গুরু ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেস। তাঁর ছিল বিরাট দাড়ি। বাংলায় ক্রিকেটের জনক সারদারঞ্জন রায়চৌধুরীরও ছিল একমুখ দাড়ি। এখন তরুণদের মধ্যেও গোঁফ–দাড়ি মৃদু পায়ে ফিরে আসছে, যদিও তার রূপ ও রং ভিন্ন ও অপ্রচলিত।
(বক্স আইটেম)
কী চমৎকার দাড়ির বাহার
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দাড়ির সংখ্যা কত হতে পারে? উত্তর হচ্ছে, প্রায় ২৫ হাজার। আর এই দাড়ি প্রতিদিনে কী পরিমাণে বৃদ্ধি পায়? গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ২৪ ঘণ্টায় এক ইঞ্চির এক শতাংশ অর্থাৎ একজনের দিনে দাড়ির সামষ্টিক বৃদ্ধি ঘটে প্রায় ২১ ফুট। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর একটি দাড়ি প্রায় সাড়ে ছয় ইঞ্চি বৃদ্ধি পায়। সেই হিসাবে কোনো ব্যক্তি যদি ৮০ বছরের আয়ু পান এবং তিনি যদি একজীবনে ক্ষুর–কাঁচি ব্যবহার না করেন, তবে তাঁর দাড়ির দৈর্ঘ্য হতে পারে ২৭ ফুট।
এ মুহূর্তে কানাডার অধিবাসী শরণ সিংয়ের ২.৪৯৫ মিটার লম্বা দাড়ি বিশ্বের দীর্ঘতম দাড়ি হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে।
আর ২০২২ সালে দীর্ঘ গোঁফ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের পল স্লোসার ৬৩.৫ সেন্টিমিটার দীর্ঘ গোঁফের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে উল্লেখ ছিল, আমেরিকানরা গড়ে প্রতিবছর ৩৬ মিলিয়ন কর্মদিবস নষ্ট করেন শেভ করতে গিয়ে।
গোঁফ–দাড়ি কামানোর সরঞ্জামের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন এ নিয়েও বলা যাক দু–চার ছত্র। বলা দরকার, দূর অতীতে গোঁফ–দাড়ি কামানো ও বিন্যস্ত রাখার জন্য মানুষেরা নিজেরাই যথেষ্ট ছিলেন, বড়জোর পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিতেন। পরে উদ্ভব ঘটল নাপিত সম্প্রদায়ের। পয়সার বিনিময়ে তাঁরা বিভিন্নজনের গোঁফ–দাড়ির পরিচর্যা করে দিতেন।
শেভিং বা গোঁফ–দাড়ি কর্তন বা সুসজ্জিত করার জন্য প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সরঞ্জাম আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথম অবস্থায় পাথর দিয়ে, পরে ধারালো কাচ, লোহা পিটিয়ে ক্ষুরও কাঁচির মাধ্যমে গোঁফ–দাড়ি কামানো হতো। আধুনিককালে সেফটি রেজর, ট্রিমিং মেশিন, টুউজার, সঙ্গে চিরুনি, বিভিন্ন জাতের শেভিং ক্রিম, লোশন—এসবই গোঁফ–দাড়ি কাটাছাঁটার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পরনির্ভরশীলতা ও সময় বাঁচানোর জন্য গোঁফ–দাড়ির সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৮৭০-এর দশকের প্রথম দিকে একধরনের সেফটি রেজর বাজারে আসে। তবে এ সমস্যা সমাধানে জোরালো অবদান রাখেন আমেরিকার আবিষ্কারক কিং ক্যাম্প জিলেট। ১৮৯৫ সালে তিনি উন্নত মানের সেফটি রেজর আবিষ্কার করেন। নিরাপদ এবং কাটাছেঁড়ার ঝুঁকি না থাকায় এটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। জিলেটের একটি সেফটি রেজর সেই আমলেই বিক্রি হতো ৫ ডলারে, যা আজকের হিসাবে ১৫০ ডলারের বেশি। তারপরও এর বিক্রির সংখ্যা ছিল মিলিয়নের ঘরে। যদিও কিং জিলেট সারা জীবনই ছিলেন গোঁফধারী।