উপন্যাসটি প্রায় বিস্মৃত ছিল সবার কাছে। বাংলা সাহিতে৵র কালজয়ী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিশিপদ্ম প্রথম প্রকাশের ছয় দশক পর আবার আলোয় এল।
‘হিঙের কচুরি’ গল্পে কুসুম প্রতিবেশীর ছেলেটাকে বড় আদর দিত। খেতে দিত হিঙের কচুরি। মাতৃস্নেহের পরশ পেয়ে ছেলেটাও সুযোগ পেলেই ছুটে আসত কুসুমের কাছে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুসুম তাকে বলত, ‘তুমি এবার বাড়ি যাও। এবার আমার বাবু আসবে।’ শিশুটির তখন অভিমান হতো। প্রথমবার বলেছিল, ‘বাবু কে? কী করবে বাবু আমায়। আমি থাকব।’ তারপরও তাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিত কুসুম।
এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চদশ গল্পগ্রন্থ জ্যোতিরিঙ্গণ-এর দ্বিতীয় গল্প। ১৯৪৯ সালে মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২টি গল্প স্থান পায়।
‘হিঙের কচুরি’র মতো একই ঘটনা পাওয়া যায় লেখকের নিশিপদ্ম উপন্যাসে। ছয় দশক বিস্মৃত থাকার পর সম্প্রতি স্বতন্ত্র উপন্যাস হিসেবে রাজশাহী থেকে ‘সতীর্থ প্রকাশনা’ নামের একটি সংস্থা প্রকাশ করেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই নিশিপদ্ম।
এ উপন্যাসে কুসুমের ভূমিকায় রয়েছে পুষ্প। সে প্রতিবেশী হারাধনের ছেলে ভুতুকে একই রকম আদর দিত। ফুলকপির শিঙাড়া খেতে দিত। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একইভাবে পুষ্প তাকে বলত, ‘তুমি এখন যাও, অন্য লোকজন আসবে এখানে। তাদের সামনে তোমার থাকতে নেই।’ এতে অভিমান করত ভুতু। বলত, ‘আমি থাকব। কী করবে তারা?’ এ সময় পুষ্প ভুতুকে বুঝিয়ে বলত, ‘কেউ তোমাকে কিছু করতে পারবে না। এমন করে না লক্ষ্মীটি, যাও বাবা।’ এভাবেই বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাত।
বিভূতিভূষণের ‘হিঙের কচুরি’ গল্পের কুসুম আর নিশিপদ্ম উপন্যাসের পুষ্প—দুজনেরই ছিল বারবণিতার জীবন। দুজনেই নিঃসন্তান। দুই নারীরই ছিল বুকভরা মাতৃস্নেহ। গল্পের শিশুটির জ্বর আসে। জ্বর আসে উপন্যাসের ভুতুরও। কুসুম আর পুষ্প—দুজনেই মাতৃস্নেহে ব্যাকুল হয়ে তখন জ্বরগ্রস্ত শিশুর জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। চুরি করে কচুরি ও শিঙাড়া দেয়। গল্প ও উপন্যাসে একইভাবে সৎমায়ের ভয়ে বালক শিঙাড়া-কচুরি বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলে। বড় হয়ে শিশু দুটি একইভাবে পুষ্প আর কুসুমকে খুঁজে বেড়ায়। একই কাহিনি। গল্পটির সম্প্রসারিত রূপ এই উপন্যাস। ‘হিঙের কচুরি’ ও নিশিপদ্ম-র এই বালকের মুখ কোথায় যেন পথের পাঁচালীর অপুর সঙ্গে মিশে যায়। আবার আদর্শ হিন্দু হোটেল-এর হাজারী বামুনের জন্য নিঃসন্তান বিধবা কুসুমের মায়া যেন ‘হিঙের কচুরি’র কুসুম আর নিশিপদ্ম-র পুষ্পের সঙ্গে একই সুতোয় বাঁধা। হাজারী বামুন বয়সী মানুষ হলেও অবোধ শিশুর মতোই কুসুমের মায়ায় জড়িয়েছিল। কুসুমও তাকে সন্দেশ দিয়ে আপ্যায়ন করেছে।
আবার নিশিপদ্ম উপন্যাসে পুষ্পের নিজের গ্রাম কার্তিকপুরে ফেরার বর্ণনায় রয়েছে, ‘বৈঁচি আর আশশেওড়ার জঙ্গলের পাশ দিয়ে, বোসদের পুকুরপাড়ের বিরাট আমবাগানের মধ্য দিয়ে, বাঁধানো ঘাটের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে ডালপালার বেড়া দেওয়া জীর্ণ একটি খড়-মাটির কুঁড়েঘরের সামনে থমকে থামে।’ এই বর্ণনাও কোথায় যেন অপু-দুর্গার পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বর্ণনাকে মনে করিয়ে দেয়, যা একান্তই বিভূতিভূষণের বর্ণনাশৈলী।
বলার কথা হলো, বিভূতিভূষণের নিশিপদ্ম উপন্যাসটি তাঁর জীবদ্দশায় আলোর মুখ দেখেনি। উপন্যাসটি পাণ্ডুলিপি আকারে বিভূতিভূষণ ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির’-এর তৎকালীন প্রকাশক কিরীটীকুমার পালের কাছে জমা দেন। এর কিছুদিন পর লেখকের অকালমৃত্যু হলে সেই সময়ে এটি আর প্রকাশ পায়নি। উপন্যাসটি কয়েক বছর কিরীটীকুমারের কাছে সংরক্ষিত ছিল। তবে শেষ বয়সে এসে কিরীটীকুমার উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির থেকে বিভূতিভূষণের ছেলে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাসমেত নিশিপদ্ম-র পাণ্ডুলিপিটি উপন্যাস হিসেবে সংকলিত করেন। বিভূতিভূষণের মৃত্যুর ১৩ বছর পর ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে (শ্রাবণ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ) মনোরমা নামের সংকলনগ্রন্থে লেখকের আরও আটটি গল্পের সঙ্গে এ উপন্যাস প্রকাশিত হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। প্রকাশক হিসেবে তখন এতে কিরীটীকুমার পালের নাম ছিল।
একই প্রকাশনী থেকে মনোরমার আরেকটি সংস্করণও পাওয়া যায়। তাতে প্রথম প্রকাশের তারিখ দেওয়া হয়েছে জুলাই ১৯৮০ (শ্রাবণ ১৩৮৭)। আর প্রকাশকের নামের স্থলে লেখা আছে সুপ্রিয়া পালের নাম। শুধু তা–ই নয়, এ সংস্করণে প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতাদের নামও যুক্ত হয়েছে—শরৎচন্দ্র পাল ও কিরীটীকুমার পাল।
বিভূতিভূষণের নিশিপদ্ম উপন্যাসটি তাঁর জীবদ্দশায় আলোর মুখ দেখেনি।
এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, সুপ্রিয়া পাল কিরীটীকুমার পালেরই উত্তরাধিকারী। এ উপন্যাস অবলম্বনে সত্তর দশকের শুরুতেই বাংলা ও হিন্দিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ বিষয় আমলে নিলে বইটি যে প্রথম ১৯৬৩ সালেই প্রকাশিত হয়েছিল, তা আরও স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হতে পারে। তাহলে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত সংস্করণে আবার ‘প্রথম প্রকাশ: জুলাই ১৯৮০’ লেখা হলো কেন?
এর পেছনে প্রকাশকের কোনো ব্যবসাবুদ্ধি থাকবে হয়তো। তবে মনোরমার সব সংস্করণই শুরু হয়েছে নিশিপদ্ম দিয়ে। পরে ছিল গল্পগুলো। ১৯৮৬ সালে এ সংকলনের আরেকটি মুদ্রণ প্রকাশিত হয়।
১৯৭০ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় নিশিপদ্ম নামের চলচ্চিত্র। মহানায়ক উত্তম কুমার ও সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সিনেমাটির ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে দুই বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালে একই সিনেমা হিন্দিতে অমর প্রেম নামে রিমেক করা হয়। এতে সেই সময়ের বলিউডের সুপারস্টার রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর অভিনয় করেন।
মনোরমা নামে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বইটি তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতা থেকে বেরিয়েছিল, সেটি তেমন আলোচিত নয়; উপরন্তু দুষ্পাপ্যও বটে। আর এ সংকলনগ্রন্থে প্রকাশিত নিশিপদ্ম উপন্যাসটিও কখনো সেভাবে আলোচনায় আসেনি। বলা চলে, বিভূতিভূষণের একটি অনুদ্ঘাটিত, বিস্মৃত লেখা হয়েই এটি রয়ে গেছে। প্রথম প্রকাশের ছয় দশক পর সতীর্থ বইটি যখন আবার নতুনভাবে বের করল, তখনই জানা গেল এই দুর্লভ উপন্যাস পাওয়ার নেপথ্য কাহিনি।
প্রকাশনার কর্ণধার মো. তাহমিদুর রহমান জানান, বইটির খোঁজ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মারফত ‘লাইটহাউস বুকশপ’ নামে বাংলাদেশের একটি পুরোনো বই বিক্রির ফেসবুক পেজে। এখানে বইটির সূচিপত্র এবং যে পৃষ্ঠায় লেখকের ছেলে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা আছে, তার ছবি ছিল। সূচিপত্রে ‘নিশিপদ্ম’ নামের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা রয়েছে ‘উপন্যাস’।
এরপর চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে সতীর্থ প্রকাশনা থেকে যোগাযোগ করা হলো লাইটহাউস বুকশপের সঙ্গে। একপর্যায়ে দুষ্পাপ্য মনোরমা বইটির একটি কপি তাদের হাতে এল। এরপরেই শুরু হয় ভারতে অবস্থানরত লেখক আর প্রকাশকদের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও কিরীটীকুমার পালের উত্তরাধিকারীদের খুঁজে পাওয়া ছিল বেশ দুষ্কর। অতঃপর নানা ঘাট ঘুরে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র পাওয়া গেল।
প্রথমে যোগাযোগ করা হলো উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দিরের বর্তমান পরিচালকের সঙ্গে। কয়েক দফা চেষ্টায় মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। পুরোটা শুনে তিনি কিছুদিন পর যোগাযোগের আশ্বাস দেন।
এর মধ্যে বিভূতিভূষণের পরিবার তথা তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বইটির ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে সবিস্তার আলোচনা হয়। অবাক ব্যাপার হলো, তারাদাসের উত্তসূরিরা বিভূতিভূষণের এ বই এবং এতে থাকা তারাদাসের ভূমিকার বিষয়ে কিছুই জানতেন না! তাহামিদের মাধ্যমেই প্রথম তাঁরা ভূমিকাটি পড়েন এবং নিশ্চিত করেন যে এটি তারাদাসেরই লেখা।
ভূমিকায় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্য, প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে তাঁর পরিচয় সর্বজনস্বীকৃত এবং এই পরিচয়ের আড়ালেই চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁর মানবপ্রেমিক সত্তা। কয়েক বছর আগে সমস্ত বাংলাদেশের জনচিত্তে দোলা দিয়ে ব্যবসায়িক সাফল্যের চূড়ায় উঠেছিল বিভূতিভূষণের রচিত কাহিনি অবলম্বনে তৈরি একটি চলচ্চিত্র নিশিপদ্ম।...সাধারণের চোখে হেয় এক পতিতার মাতৃহৃদয়ের স্নেহধারা একটি বালকের প্রতি কেমন করে উৎসারিত হয়েছিল, নিশিপদ্ম তারই গল্প। এযাবৎ এ কাহিনি কোথাও কোনো অমনিবাসে সংকলিত হয়নি। বিভূতি-সাহিত্যের আরেকটি অনুদ্ঘাটিত উন্মোচিত করে কিরীটীকুমার পাল সবার ধন্যবাদার্হ হলেন।’
প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে ‘হিঙের কচুরি’ গল্পের বিষয়েও বলা প্রয়োজন। গল্পটি বিভূতিভূষণের জীবনের একটি ঘটনার প্রতিরূপ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহপাঠী, বন্ধু এবং একই মেসের বাসিন্দা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা দাই হ্যান্ড, গ্রেট অ্যানার্ক বইয়ের ‘বন্ধু বিভূতিভূষণ’ শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, চার-পাঁচ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে কলকাতায় এসে বিভূতিভূষণ যে এলাকায় বসবাস শুরু করেন, সেখানকার এক নারী বিভূতিভূষণকে খুব স্নেহ করতেন। বিভূতিভূষণও তাঁর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। প্রায় সারা দিনই তাঁর স্নেহছায়ায় থাকতেন। তো সন্ধ্যার সময় সেই নারী বিভূতিভূষণকে বলতেন, ‘বাছা, এবার বাড়ি যাও। আমার বাবু আসিবেন।’
এ ঘটনার বহু বছর পর নীরদচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে সেই নারীকে খুঁজতে যান বিভূতিভূষণ। তত দিনে এলাকাটি একটি পতিতালয়ে পরিণত হয়েছে। তাই ওই নারীকে খুঁজতে গিয়ে বেশ বিব্রতকর ঘটনার সম্মুখীন হন তাঁরা। নিজের শৈশবজীবনের এ ঘটনা ‘হিঙের কচুরি’ ও নিশিপদ্ম উপন্যাসে বিশদ করে লিখেছেন বিভূতিভূষণ।
দীর্ঘদিন বিস্মৃত থাকার পর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিশিপদ্ম প্রথমবারের মতো একক গ্রন্থরূপে বাংলাদেশের একটি মফস্সল থেকে প্রকাশিত হলো, আমাদের জন্য এটি গর্বের না হয়ে কি পারে!