আনি এরনো: ব্যক্তির স্বরে সমষ্টির সুর

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ফরাসি কথাসাহিত্যিক আনি এরনো। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ও তাঁর লেখা অনুবাদ করেছেন লুনা রুশদী

ফরাসি কথাসাহিত্যিক আনি এরনো দেখিয়েছেন একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত—এই দুভাবে লেখা সম্ভব

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম আলো উপন্যাসে পড়েছিলাম, ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য তাঁর স্ত্রীবিয়োগের পর রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে শান্তি পেয়েছিলেন। প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল কিছুদিন আগে আনি এরনোর সিম্পল প্যাশন পড়ার সময়। ফরাসি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল পিউরা প্যাশন নামে, ১৯৯১ সালে। আর ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ১৯৯৩ সালে। আমার ধারণা ছিল, আমার মতো নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়ে, ভেঙেচুরে আর কেউ প্রেমে পড়ে না।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমাকে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই দপ করে একটা সম্পর্ক নিভে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল জীবন থেমে গেছে। আশপাশে কারও সঙ্গে সে বিষয়ে কথা বলতে না পারার কারণে বিষাদ ও একাকিত্ব আরও তীব্র হয়ে উঠছিল।

মাঝেমধ্যে পুরোনো একটা কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকতাম। দুপুরের দিকে জায়গাটা থাকত নির্জন। অক্টোবর মাস, মেলবোর্নে তখন বসন্ত শুরু হয়েছে, ঘাস আর চিড় ধরা পুরোনো কবরগুলোর ওপরে নরম রোদ বিছিয়ে থাকে, পাখি ডাকে। প্রায়ই হাতে করে বই নিয়ে যেতাম, পড়তে চেষ্টা করতাম এবং যথারীতি ব্যর্থ হতাম। আমার সব অনুভূতি, চিন্তা করার ক্ষমতা যেন একটা বিন্দুতে থেমে গিয়েছিল—সে ছিল, সে নেই।

নির্জন কবরস্থানে, দুপুরবেলায় ঘুঘুর ডাকের সঙ্গে সঙ্গে সেই না থাকাটুকু মিলে হাহাকার ছড়াত আমার মনে। স্থির দৃষ্টি সামনে মেলে ধরে কিছুই দেখতাম না। বাতাস বয়ে যেত। এ রকম এক দুপুরে সিম্পল প্যাশন–এর পাতা উল্টে প্রথমেই পড়লাম, ‘গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে আমি শুধু একজন পুরুষের জন্যই অপেক্ষা করেছি, তার ফোনের জন্য, আমার বাড়িতে সে আসবে, তার জন্য।’ যেন দূর থেকে নিজেকে দেখছেন এমন একটা উদাসী বিচ্ছিন্ন স্বরে এরনো বয়ান করেছেন তাঁর অসম বয়সী বিবাহিত প্রেমিকের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষার কথা। তিনি লিখেছেন, কীভাবে তাঁর সব কাজ, লেখা, ভাবনাজুড়ে শুধু সেই মানুষটাই থাকত। দুনিয়ার সবকিছুতেই তাঁর মনে পড়ত ওই ছেড়ে যাওয়া প্রেমিককে—তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, তার বলা কথাগুলো। এ ছাড়া আর কিছুই তাঁকে টানত না। আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘তখন আমি যেন সময়ে রূপান্তরিত হয়ে নিজের ভেতরে বয়ে চলেছিলাম।’

সিম্পল প্যাশন–এ এসব পড়ছিলাম আর এরনোকে খুব আপন লাগছিল। তিনি লিখেছেন, ‘আমি তার উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি ছাড়া কিছু টের পেতাম না’, আবার বলেছেন, ‘যৌনতার ঘোরের ভেতর বসবাস করা মানে ভবিষ্যৎ বেদনার মতো করে বর্তমান আনন্দকে অনুভব করা।’ লিখতে লিখতেই এরনো ভেবেছেন, কেন তিনি লিখছেন এসব! তাঁর ভাষায়, ‘আমি আমার এ আসক্তির ব্যাখ্যা দিতে চাই না। তাতে মনে হবে কোনো ভুল বা বিশৃঙ্খলাকে ন্যায্যতা দিতে চাইছি। আমি শুধু এর বর্ণনা করতে চাই।’

লিখেছেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই এসব লিখতে আমার লজ্জা লাগছে না। কারণ, যে মূহূর্তে কথাগুলো লেখা হচ্ছে, তখন শুধু আমি তা জানতে পারছি। অন্যরা যে মুহূর্তে লেখাটা পড়বে, হয়তো তা কখনোই আসবে না। তত দিনে আমার কোনো দুর্ঘটনা হতে পারে, মারা যেতে পারি আমি; একটা যুদ্ধ বা বিদ্রোহ শুরু হতে পারে। এই বিলম্বের কারণেই আমি লিখতে পারি, সেই ষোলো বছর বয়সে তপ্ত সূর্যের নিচে শুয়ে থাকার মতো করে, অথবা কুড়ি বছর বয়সে কোনো গর্ভনিরোধক ছাড়াই প্রেম করার মতো করে—পরিণতির কথা না ভেবে।’

বইয়ে প্রেমিকের পরিচয় তিনি উল্লেখ করেছেন ‘এ’ নামে। তাঁর দিনলিপিতে একই ব্যক্তির উল্লেখ আছে ‘এস’ নামে।

‘এস’ তাঁর জীবনে এসেছিলেন ১৯৮৮ সালে। এরনোর বয়স তখন আটচল্লিশ, স্বামী ফিলিপের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে আরও আট বছর আগে। ডেভিড ও এরিক নামে প্রাপ্তবয়স্ক তাঁর দুই সন্তান প্রায়ই থাকতে আসে বাড়িতে। এস তখন সোভিয়েত রাশিয়ার কূটনীতিক হিসেবে প্যারিসে কর্মরত। সিম্পল প্যাশন বইটি লেখা হয়েছে ১৯৮৯ সালে, বার্লিনের দেয়াল ধসে পড়ার পরবর্তী সময়ে। তখন ইউরোপে অবস্থিত সোভিয়েত প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থার কারণে এরনোর প্রেমিকও কোনো রকম খবর না দিয়ে ফিরে গেছেন মস্কোতে।

এ বছরই প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় আনি এরনোর সে সময়ের দিনলিপির একটা অংশ প্রকাশিত হয়েছে। তার ভূমিকার শুরুতে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৮৯ সালের নভেম্বরের ১৬ তারিখে আমি প্যারিসে দূতাবাসে ফোন করে মিস্টার এসের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। সুইচ বোর্ড অপারেটর জবাব দিল না। বহুক্ষণ নীরবতার পর এক নারীকণ্ঠ জানাল, “মিস্টার এস তো গতকাল মস্কো ফিরে গেছেন।” সঙ্গে সঙ্গেই লাইনটা কেটে দিলাম। মনে হচ্ছিল আগেও কোথাও একই বাক্য শুনেছি। শব্দগুলো হয়তো আলাদা, কিন্তু অর্থ এক—ভয়াবহ ভারী ও অবিশ্বাস্য। আরও পরে মনে পড়েছিল, সাড়ে তিন বছর আগে আমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম টেলিফোনে। হাসপাতালের নার্স জানিয়েছিল, “আপনার মা আজ সকালে নাশতার পরে মারা গেছেন।”’

নোবেল কমিটির মতে, আনি এরনোর এ পুরস্কার পাওয়ার কারণ—তাঁর সহজ ও নিরপেক্ষ তীক্ষ্ণতা, যার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতির সামষ্টিক সংকোচ এবং বিচ্ছিন্নতার মূল উন্মোচন করেন।

লেখক ও অনুবাদক লরেন এলকিন ২০১৮ সালে প্যারিস রিভিউ–এ আত্মজীবনীমূলক লেখা প্রসঙ্গে এ লেখকের স্বর নিয়ে বলার সময় প্রায় একই কথা বলেছিলেন, এরনো সততার সঙ্গে সরল–সহজভাবে লেখেন। নিজেকে ব্যাখ্যা করেন না। কখনো তাঁর লেখা এতটাই অন্তর্লিখিত যে মাঝেমধ্যে মনে হয় কোনো মনোবিশ্লেষকের কেস স্টাডি এবং এরনোকে তাঁর অবিচল, নিস্পৃহ স্বরের জন্য মনে হয় তিনি একজন থেরাপিস্ট।

নিউইয়র্কার পত্রিকায় এডাম গোপনিক বলেছেন, আনি এরনোকে পুরস্কৃত করে নোবেল কমিটি যথার্থ কাজ করেছে। তিনি নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্যারিসে এরনোর লেখার সঙ্গে পরিচিত হন। গোপনিকের ভাষ্যে, ফরাসি এই লেখকের স্বর মর্মস্পর্শী, যা একবার পড়লে ভোলা যায় না। শুধু বাহ্যিক বা অন্তর্নিহিত রাজনীতিই নয়; বরং একেকটা সময়ের নিশ্বাস ধরা দেয় তাঁর বাক্যের গড়নে, জাদুকরি মন্ত্রে।

বহু নোবেলজয়ী লেখকই আত্মজৈবনিক লেখা লিখেছেন, যেমন ভিএসনাইপল, এলিস মুনরো, ডরিস লেসিং অথবা ওলগা তুকারচুক। তবে তাঁদের সবার সঙ্গেই এরনোর পার্থক্য হলো, তিনি আত্মজীবনীমূলক ফিকশন বা উপন্যাস লেখেন না; বরং নিজের জীবনের বিভিন্ন স্মৃতি ও অনুভব একটা দূরত্ব থেকে পাঠকের কাছে মেলে ধরে সর্বজনীন সত্য প্রকাশ করেন। সেজন্যই তাঁর মা–বাবার মৃত্যু, তাঁর প্রেম, গর্ভপাত ও অসহায়ত্বের গল্প আমাদের স্পর্শ করে। কারণ, গল্পগুলো কোনো না কোনো পর্যায়ে আমাদেরও।

ফরাসি ভাষায় এরনোর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের নাম লা আরমোয়া ভিদে (১৯৭৪), যার আক্ষরিক অর্থ ‘শূন্য আলমারি’, ইংরেজি অনুবাদে ক্লিনড আউট (১৯৯০)। বইটি ছিল কিশোর বয়সে তাঁর গর্ভপাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পরবর্তী সময়ে একই ঘটনা ফিরে এসেছে তাঁর হ্যাপেনিং (২০০১) ও আ গার্লস স্টোরি (২০১৬)–তে।

মায়ের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে লিখেছেন আ ওমেনস স্টোরি (১৯৮৮)। এরও দশ বছর পর মায়ের অসুস্থতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আই রিমেইন ইন ডার্কনেস (১৯৯৮)। বাবাকে নিয়ে লেখা তাঁর বই আ ম্যানস প্লেস (১৯৮৩)। তবে তাঁর বাবা ফিরে ফিরে এসেছেন অন্য আরও অনেক গল্পে। সিম্পল প্যাশন–এর সময়টাকে নিয়ে তাঁর দিনলিপি গেটিং লস্ট প্রকাশিত হবে এ বছরের শেষে। যেন একই ঘটনা বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখে একটা গূঢ় সত্য খুঁজে পেতে চান এরনো।

তাঁর লেখার চরিত্রেরা আলাদা মানুষ হলেও তাদের একটা একক সত্তাও রয়েছে। তাই একজন আরেকজনের গল্পে রয়েছে মিলেমিশে। এই সব স্বর আমরা একসঙ্গে পাই দ্য ইয়ারস উপন্যাসে।

‘ছবিগুলো সব মুছে যাবে…’—এটি এরনোর দ্য ইয়ারস–এর প্রথম বাক্য। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক লেখায় দেখতে পাই, এই বই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাস্টারপিস হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। আর এরনোকে তুলনা করা হয়েছে মার্সেল প্রুস্তের সঙ্গে। বলা দরকার, ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল দ্য ইয়ারস। এই বইয়ের বিস্তার ১৯৪০ সালে তাঁর জন্মের সময় থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। নরমান্ডির শ্রমজীবী পরিবারে বড় হওয়া, প্যারিসে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ফরাসি সাহিত্য পড়ানো ও দুই ছেলেকে বড় করা, বিবাহবিচ্ছেদসহ ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনা স্থান পেয়েছে এখানে। তবে গল্পগুলো এতে দৈনন্দিন আত্মজীবনীর ঢঙে বলা হয়নি। গল্পের কথক এক ঐকতানিক স্বর, ‘আমরা’, যা কোথাও কোথাও হয়েছে ‘সে’। গার্ডিয়ান–এ লরেন এলকিন লিখেছেন, ‘নারীদের আত্মজৈবনিক লেখা বলতেই প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে লেখাটা হবে ছোট পরিসরের গার্হস্থ্যকেন্দ্রিক। আশা করছি, এই বইয়ের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটবে। এরনো দেখিয়েছেন একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত—এই দুভাবে লেখা সম্ভব।

বইটি লিখতে লিখতেই এর প্রসঙ্গে এরনো বলেছেন, এতে কোনো ‘আমি’ নেই। কারণ, বইটা নৈর্ব্যক্তিক আত্মজীবনী, যেখানে আছে শুধু ‘এক’ এবং ‘আমরা’, যেন এবার তাঁর সময় হয়েছে পেরিয়ে যাওয়া সময় নিয়ে কিছু বলার। তিনি লিখেছেন, ‘গদ্যটা হবে বেশ পিচ্ছিল, যা অবিরাম চলতে চলতে বর্তমানকেই সম্পূর্ণভাবে আত্মসাৎ করবে।’ এখানে তাঁর নিজস্ব স্মৃতির সঙ্গে মিলেছে ইতিহাস, জনপ্রিয় শিল্প-সংস্কৃতি, অপভাষা ও সংস্কৃতির সূক্ষ্ম রূপান্তর। এসেছে আলজেরিয়ার যুদ্ধের কথা, ভোগবাদের বিস্ফোরণ, পারমাণবিক হুমকি, গর্ভপাতের অধিকার, অভিবাসন, বেকারত্ব ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা। এসেছেন জঁ্য পল সাত্রে৴ আর সিমোন দ্য বোভোয়া।

লেখা প্রসঙ্গে এরনো একবার বলেছেন, ‘হয়তো আমার জীবনের সত্যিকার অভীষ্ট হলো আমার শরীর, চিন্তা আর বোধগুলোকে লেখায় রূপান্তরিত করে যাওয়া। অর্থাৎ যা বোধগম্য ও সর্বজনীন, যা আমার অস্তিত্বকে অন্যদের জীবন আর মস্তিষ্কের সঙ্গে মিলিয়ে দেবে।’

আমাদের ধারণা, ফরাসি এই অশীতিপর নারী সে অভীষ্টে পৌঁছেছেন।