ঈদ শেষ হয়েছে। নাড়ির টানে যাঁরা বাড়ি ফিরেছিলেন, তাঁরা ফিরতে শুরু করেছেন কর্মস্থলে। সেকালে বাঙালির ঈদযাত্রা ও ঈদ শেষে নগরে ফেরার চিত্রটি কেমন ছিল?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। “অমঙ্গল অশ্রুসজল” বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।”’
ছুটিতে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা এবং জীবিকার দায়ে শহরে ফেরা বাঙালি সমাজের চিরচেনা আচার। যান্ত্রিক জীবনের অসহনীয় ব্যস্ততা, দিনযাপনের গ্লানি, নিরন্তর কর্মযজ্ঞের মধ্যে ছুটি আজও মানুষকে এনে দেয় হাঁপ ছাড়ার অবসর, নতুন কর্মোদ্যমে চাঙা হয়ে ওঠার সুযোগ। আর তাই ঈদের মতো ধর্মীয় উৎসবে ঘরমুখো মানুষের স্রোত নামে কেবল ধর্মের টানে নয়, ওই একটুখানি প্রশান্তির লোভেও। ঘরে ফিরলে মানুষ পায় দুটি দিন কর্মস্থলের মেহনত আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত কিছু মুহূর্ত, প্রিয়জনের সঙ্গে যৌথ জীবনভোগের অবিমিশ্র স্বাদ, গণ্ডিবদ্ধ জীবনের সীমানাবহির্ভূত পৃথিবীর রূপ–রস উপভোগের নতুন দিগন্ত। আজকের মানুষের কাছে উৎসবের সবচেয়ে বড় মূল্য, সবচেয়ে গভীর তাৎপর্য এখানেই নিহিত।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করার পর মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেন এবং নানা রকম সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসেন। তখন থেকেই পূর্ববঙ্গে একটি অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়। কারণ, গ্রামীণ জোতদাররা তাঁদের সন্তানদের শহরের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য পাঠাতে থাকেন। তাঁরা লেখাপড়া শিখে চাকরি–বাকরিও জুটিয়ে নেন। ক্রমে এসব শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীর বরাতের জোরেই ত্বরান্বিত হয় বাঙালি মুসলমানের ঈদযাত্রা। সেকালে দুই ঈদই ছিল বড় ধরনের উৎসব। ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি চলত রমজান মাসজুড়েই। যাঁরা ঢাকা ও কলকাতায় পড়ালেখা, চাকরি করতেন, তাঁরা একে একে গ্রামে আসতেন। আর যাঁরা আসতে পারতেন না, তাঁরা অন্যদের সঙ্গে ঈদের বাজার করে পাঠিয়ে দিতেন গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু ঈদের বাজার পেলেও পরিবারের সদস্যরা তুষ্ট হতেন না। প্রিয়জনের সশরীর উপস্থিতির অভাবে তাঁদের মধ্যে যে অভিমানের মেঘ জমত, তা কাটানো এত সহজ ছিল না। সৈয়দ মুজতবা আলী সুলেখা দাশগুপ্তকে লেখা এক চিঠিতে তেমনই এক চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন, ‘ছুটি পেলুম না বলে ঢাকা যেতে পারলুম না। স্ত্রী-পুত্র ভেবেছে, আমার দোষ। এই করে ধীরে ধীরে ওরা আমাতে বিশ্বাস হারাবে। দুঃখ সেইখানে।’
তখনকার দিনে চাকরিজীবীদের অধিকাংশই ছিলেন রেল বিভাগ, প্রেস ও বেঙ্গল কেমিক্যালসের কর্মচারী। দু-একজনের কলকাতায় ব্যবসাও ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাঁরা ঢাকায় এসে ব্যবসা চালু করেন। এসব ব্যবসায়ীও গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদ করতেন। ঈদের বাজার করে নিয়ে আসতেন। যাঁরা গ্রামেই থাকতেন, তাঁরা ঢাকায় যেতেন ঈদের বাজার করতে। ঈদ উপলক্ষে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার এই যোগাযোগ যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার উদ্বোধক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শামসুজ্জামান খান তাঁর বাংলাদেশের উৎসব বইয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যাওয়া মানুষেরা যদি পুরোপুরি শহরমুখী জীবনে খাপ খাইয়ে নিত, গ্রামে আর ফিরতে না চাইত, তা হলে এই আদান-প্রদান সম্ভব হতো না। ঈদ উৎসব উদ্যাপনের জন্য শহরের মানুষেরা গ্রামের দিকে ছুটে যায়। আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে কটি দিন। এ সময় তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে গল্প-আড্ডাও হয়। তাতে করে দেশের রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক বিষয়ে তাদের মেধা, চিন্তা বিনিময় হয়। এভাবেই ভোট প্রদানের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত হয়।’
‘পিতার নিকট টাকা চাহিয়া একখানি পত্র লেখো’—পরীক্ষার খাতায় এই পত্রলেখকেরা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পরিবারহীন বিদ্যায়তনিক একঘেয়ে পরিবেশের জরা ঘোচাতে ঈদ এলেই তাঁরা বাড়ির দিকে ছুটতেন। ষাট বা সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি চলাকালে হলগুলোয় পিনপতন নীরবতা নেমে আসত, চারপাশ ভুতুড়ে আবহাওয়ায় জমে উঠত। যাঁরা হলে থাকতেন, তাঁদের কেউ কেউ পরিবারের কথা মনে করে অশ্রুসিক্ত হতেন। আর যাঁরা বাড়িতে যেতেন, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন দীর্ঘ এক বছরের স্নেহ।
একবার ঈদের ছুটিতে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এক ছাত্র বাড়িতে গিয়েছিলেন, খবর বের হয় যে ওই ছাত্র দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ খবর জানার পর তাঁর মা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্ত কিছুদিন পর দেখা গেল, ওই ছাত্র বেঁচে আছেন! নিজের মৃত্যুর গুজবে মায়ের মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে তিনি একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন! এমনকি পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারেননি।
সেকালে যাতায়াতের জন্য এত রাস্তা ও যানবাহন ছিল না। দূরপথ পাড়ি দিতে হলে উঠতে হতো ট্রেন, বাস, লঞ্চ কিংবা নৌকায়। মূলত ট্রেনেই সিদ্ধ হতো ঈদযাত্রা। কিন্তু ওই রেলগাড়ি পর্যন্তু যাত্রীরা পৌঁছাতেন হেঁটে বা গরুর গাড়িতে করে। জাহানারা ইমাম তাঁর অন্যজীবন বইতে লিখেছেন, ‘আব্বাজানের প্রথম পোস্টিং হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণনগর যেতে হলে প্রথমে গরুর গাড়িতে করে কান্দী। তারপর সেখান থেকে বাসে ও ট্রেনে। সুন্দরপুর থেকে কান্দী পর্যন্ত ছইয়ের সামনে–পেছনে চাদর মোড়া গরুর গাড়িতে যেতে মেজ চাচির পর্দার কোনো হানি হতো না। কিন্তু বাসে ও ট্রেনে? আব্বাকে রীতিমতো ফাইট করতে হয়েছিল দাদাজানের সঙ্গে। শেষে রফা হয় বোরকা বানিয়ে এবং ওই একই শর্তে ঈদে-বকরিদে ও সন্তান-প্রসবের সময় বাড়িতে আসতে হবে।’
১৯৫৯ সাল থেকে পূর্ববঙ্গে দ্রুতগতির শিল্পায়ন শুরু হওয়ার ফলে রাস্তাঘাট অভূতপূর্ব উন্নয়নের আওতায় চলে আসে। বৃদ্ধি পায় ট্রেন, বাস ও লঞ্চ। যাত্রীদের ভোগান্তিও কমতে শুরু করে। এ সময় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও খুলনা শিল্প এলাকায় কর্মরত শ্রমিকেরা যাতে নির্বিঘ্নে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ফিরতে পারেন, সে জন্য বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করা হতো। বাসে সংকুলান না হলে মোটরযানে করে কেউ কেউ বাড়িতে যেতেন। ট্রেনের টিকিট হস্তগত করা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না। লঞ্চের যাত্রী অবশ্য কম ছিল, কারণ, মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ভয়ে অনেকেই লঞ্চে ওঠার ঝুঁকি নিতে চাইতেন না।
ঈদযাত্রার বাহন হিসেবে বিমান সবচেয়ে ব্যয়বহুল। সাধারণত বিত্তবানেরা বিমান ছাড়া চলাচল করেন না, ঈদের মৌসুমে তো নয়ই। এবিএম মূসা তাঁর আমার বেলা যে যায় আত্মজৈবনিক রচনায় লিখেছেন, ‘...সকাল সাতটায় ঢাকা পৌঁছালাম। আমাকে বাসায় নিতে বিমানবন্দরে স্ত্রী আর দুই মেয়ে এসেছিল। বিমান থেকে নামতেই ছোট মেয়ে সুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কী মজা, তুমি ঈদের দিন এসে গেলে!”’ বিমানের সঙ্গে বিত্তবানেরা ব্যক্তিগত গাড়িতে করেও ঈদে বাড়িতে ফিরে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ঈদযাত্রাকে আরও সহজ ও গতিশীল করে তুলেছে।
ঈদে বাড়িতে ফেরার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একরাশ ভোগান্তি। টিকিট না পাওয়া, দুর্ঘটনা, যানজট, ছিনতাইয়ের ভয়ের ওপর চেপে বসে আরেক ভয়—বাড়তি ভাড়া। এত কিছুর পরও থেমে থাকে না মানুষের শিকড়ে ফেরার গল্প। অনাত্মীয় শহর ছেড়ে একচিলতে মমতার খোঁজে গ্রামের দিকে ছুটে চলা যেন এক স্বপ্নযাত্রা। আর তাই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে বেজে ওঠে মর্মভেদী সুরেলা সংগীত, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার!’