গত সপ্তাহে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের বেশ কজন কৃতীকে। তাঁরা হলেন সাহিত্যিক বশীর আল্হেলাল, রম্যলেখক আতাউর রহমান, লেখক ও অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ও ছড়াকার আবু জাফর সাবু। বশীর আল্হেলাল ও বুলবুল চৌধুরীকে আমরা বিশেষভাবে মনে রাখব শিশুসাহিত্যে তাঁদের অবদানের জন্য। আনারসের হাসি, শিশিরের দেশে অভিযান, কাণ্ডারী ও প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নামে অসাধারণ কিছু বই লিখেছিলেন বশীর আল্হেলাল। কাজলরেখা, কাঞ্চনমালা, লাল কমল নীল কমল, ভালো ভূত, পুইট্টা চোর ও বুইট্টা চোর এবং গাঁওগেরামের গল্পগাথার মতো চমৎকার সব বইয়ের লেখক বুলবুল চৌধুরী। বশীর আল্হেলাল সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। বুলবুল চৌধুরীও এই পুরস্কার পেয়েছেন, এ ছাড়া তিনি ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে। তাঁদের আমরা স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে।
হেই হেই কী মজা! সকালবেলা বড় চাচা বাজার করে আনতে থলে থেকে বেরোল একজোড়া আনারস। পুতুল চোখ বড় বড় করে চেঁচিয়ে উঠল, ও দুটো কী? ও দুটো কী?
অমনি টুটুল জিজ্ঞেস করল, ও ডুটো টী? ও ডুটো টী?
আর মিঠুল তো এখনো ভাষাই শেখেনি। সে বলল, ডুডুডু ডু! ডুডুডু ডু!
বড় চাচা বললেন, কেন, মনে নেই? গেল বছর খাওনি?
টুটুলের তো কথাই নেই, পুতুলেরই কি মনে থাকে সেই গত বছর কী খেয়েছিল না খেয়েছিল তার কথা? আর কী তার নাম?
বড় চাচা বললেন, আনারস।
আনারস! আনারস! আনারস! পুতুল আবার লাফিয়ে লাফিয়ে হট্টগোল জুড়ে দিল। অমনি টুটুল বলল, আনা–অশশ! আনা–অশশ।
মিঠুল বলল, শশ–শশ শশ–শশ শশ–শশ!
বড় চাচা বললেন, এই, সব গন্ডগোল করিসনে। বাইরে যা, বাইরে যা।
টুটুল তার মুখে ড্যাডাং ড্যাং বোল ফুটিয়ে লাফাতে লাফাতে বাইরে চলে গেল। তার পিছু পিছু টলতে টলতে মিঠুলও বেরিয়ে গেল। কিন্তু পুতুল ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বলল, আমি আনারস খাব।
বড় চাচা বললেন, এখনো তেমন পাকেইনি। দুটো দিন যাক, তখন খাস।
পুতুল বলল, চাচা, ইশ, গন্ধ বেরোচ্ছে তো!
বড় চাচা বললেন, এ আর কী গন্ধ দেখলি, পুতুল! যত পাকবে তত গন্ধ ছাড়বে। তখন গন্ধের চোটে ঘরে টেকাই দায় হবে। তখনই তো খাওয়ার সময় রে।
পুতুল বলল, সত্যি?
বড় চাচা বললেন, সত্যি।
বড় চাচা আনারসজোড়া দেয়াললগ্ন আলমারির মাথায় ছিটকিনিতে ঝুলিয়ে রাখলেন। বললেন, আবার সকাল থেকেই যা মেঘ। যদি চড়া রোদ থাকত, এক দিনেই পেকে যেত।
এতটুকু পুতুল পেছনে তার মাথা হেলিয়ে আনারসের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। বলল, চাচা, আনারসের গাজুড়ে ওগুলো সব কী? ওই যে একটা দুটো দশটা তেরোটা চব্বিশটা?
ওগুলো সব চোখ।
চোখ?
হ্যাঁ।
অতগুলো চোখ?
হ্যাঁ।
চোখ দিয়ে আনারস কী করে?
হাসে।
হাসে?
হ্যাঁ, খিলখিলিয়ে হাসে।
খিলখিলিয়ে হাসে?
তাই তো, আনারসের চোখজুড়ে হাসি। যত চোখ তত হাসি।
সে জিজ্ঞেস করল, চাচা, মানুষ চোখে হাসে, না মুখে হাসে?
বড় চাচা বললেন, আনারসের তো মুখ নেই, তাই চোখে হাসে।
আনারসের তো মুখ নেই, তাই চোখে হাসে। ঠিক, ঠিক।
পুতুল বলল, চাচা, আনারস কখন খাব? আমি আনারসের হাসি খাব।
বড় চাচা বললেন, না, আনারসের হাসি খায় না। আনারসের হাসিতে খুব ধার।
তাহলে ঠোঁট কেটে যাবে?
হুঁ।
চাচা?
কী রে?
একটা আনারস কী রকম লাল দেখো! একদম হলুদ! আর একটা একদম সবুজ! তাই না?
হ্যাঁ। হলুদটা এক দিন পর খাওয়া যাবে। তার পরদিন সবুজটা।
তা বেশ।
বড় চাচার সাড়ে নটায় অফিস। গায়ে তাঁর ততক্ষণে পাঞ্জাবি চড়ানো হয়ে গেছে এবং পায়ে রাবারের জুতো। তিনি বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু এতটুকু পুতুল পেছনে মাথা হেলিয়ে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হুই ওপরে বড় বড় চোখ দুটো তুলে ছিটকিনিতে ঝুলিয়ে রাখা আনারস দুটো দেখতেই থাকল। একটা কেমন হলুদ, আর একটা সবুজ। আর খালি হলুদ হলুদ চোখ, খালি সবুজ সবুজ চোখ। যত হলুদ হলুদ চোখ, তত হলুদ হলুদ হাসি। যত সবুজ সবুজ চোখ, তত সবুজ সবুজ হাসি।
তারপর হঠাৎ ঝিপ ঝিপ করে বৃষ্টি নামল। তখন পুতুলের কচি ঘাড়ে কোথা থেকে সব ব্যথা এসে জমল। চোখ দুটো টনটনিয়ে গেল।
পুতুল তখন টানটান হয়ে বিছানায় শুলো। তখন সে শুয়ে শুয়েই আনারস দুটো দেখছে। দেখছে তো দেখছেই। আনারসের শরীরজুড়ে চোখ। চোখজুড়ে হাসি।
পুতুলের হঠাৎ সন্দেহ হলো, আনারস দুটো কি তাকে মুখ ভেঙচে হাসছে? এক শ চোখে পিটপিটিয়ে বলছে, খুকুর চোখে লোভ ঝরছে, লোভ? বলছে, এ খুকু, খাবে, আমাদের খাবে? কই খাও, এসো ধরো?
পুতুল বলল, দূর! তাই কি কখনো হয়? আমাদের আনারস ভারি মিষ্টি, ভারি শিষ্টি, ভারি দয়ালু। আহ্হা, তাদের হাসিগুলোয় গন্ধ মাখানো।
পুতুল অমনি রান্নাঘরে ছুটল। দেখল, ততক্ষণে মায়ের হাতে সেই আনারস দুখণ্ড। এত বড় চকচকে বঁটির পাটায় বসে মা তখন আনারসের চামড়া ছাড়াচ্ছেন। দেখতে দেখতে সেই আনারস সাদা।
পুতুল তখন আনারসের চোখ গুনছে, হাসি গুনছে। এক দুই দশ তেরো চব্বিশ...এক দুই দশ তেরো চব্বিশ।
তখন কালো মেঘের ছায়া দুনিয়াটাকে ঢাকল। বৃষ্টির গান ঝম ঝম করে কত সুরেই বাজল। সেই গান শুনতে শুনতে পুতুল কখন ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমের মধ্যেও পুতুল বৃষ্টির গান শুনতে পাচ্ছিল, মেঘের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। আনারসের দুই ঝুড়ি চোখ তখন তার চোখের ওপর নেমে এল। আর তক্ষুনি থই থই অথই অথই হলুদ হাসি আর সবুজ হাসিতে ডুবে গেল পুতুল।
আর তখনি হঠাৎ পুতুলের লাল টুকটুক ঠোঁট দুটোয় কাঁপন লাগল। হঠাৎ যেন কে কাঁদল? মা গো, হঠাৎ যেন কে কাঁদল? মেঘগুলো কি কাঁদছে? তবে কি দুষ্টু টুটুল কাঁদল? নাকি মিষ্টি মিঠুল কাঁদল?
অমনি পুতুলের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ দুটো দুই হাতে ঘষে সে উঠে বসল। দেখল, মেঘের মুখ আরও গোমড়া হয়েছে। সমানে বৃষ্টি ঝরছে।
আর ও মা, একি কাণ্ড? আলমারির মাথায় যে দেখি ছিটকিনি থেকে একটা আনারস গায়েব! কখন কখন কখন হলো গায়েব? কে করল গায়েব? ও মা, এসে দেখো আনারস থরথরিয়ে কাঁপছে।
যেন এক বৃন্তে ছিল দুটি ভাই। হলুদ ভাইকে এইমাত্র কে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
পুতুল অমনি রান্নাঘরে ছুটল। দেখল, ততক্ষণে মায়ের হাতে সেই আনারস দুখণ্ড। এত বড় চকচকে বঁটির পাটায় বসে মা তখন আনারসের চামড়া ছাড়াচ্ছেন। দেখতে দেখতে সেই আনারস সাদা।
পুতুল বলল, মা গো, আনারসের চোখ কোথা গেল? চোখে কত হাসি ছিল। হাসিতে কত ধার ছিল, মা গো?
তাই শুনে মায়ের কত হাসি। ভেজা হাতেই তিনি মেয়েকে টেনে নিয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, মেয়ের আমার শোনো কথা। হ্যাঁ রে, ধার বলেই তো কেটে ফেলে দিতে হলো। না হলে খেতিস কেমন করে?
তখন টুটুল আর মিঠুল আরও ঘনিয়ে ঘনিয়ে আসছে। পুতুলের ওপর মায়ের একতরফা আদর তারা গেরাহ্যি করল নাকো। টুটুল বলল, মা, আনা–অশশ দাও।
মিঠুল বলল, মা, শশ–শশ দহ্!
পুতুল আবার দুই হাত দিয়ে চোখ ঘষল। তখন সে দেখল, আনারসের সারা গায়ে অশ্রু মাখানো। সেই অশ্রুরা সব ছলছলিয়ে পুতুলের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল।
পুতুল ভাবল, আনারসের ঝুড়ি ঝুড়ি চোখ কোথায় পালিয়ে গিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে রাশি রাশি চোখের পানি। পুতুল শুধু ফিক করে একটুখানি হাসল। সেই হাসিটা ফিকে।
(সূত্র: বশীর আল্হেলালের আনারসের হাসি। অলংকরণও নেওয়া হয়েছে আগামী প্রকাশনীর এই বই থেকে।)