দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুদিবস আজ ৫ ডিসেম্বর। ১১ বছর আগে এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই মহান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা। তাঁর লেখা কনভারসেশন উইথ মাইসেল্ফ অবলম্বনে প্রথম আলোর ২০১৩ সালের ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ‘নেলসন ম্যান্ডেল: ঐ মহামানব আসে’ শিরোনামে লেখাটি। এই লেখার ভূমিকা ও নির্বাচনে ছিলেন মতিউর রহমান। অনুবাদ করেছেন রামেন্দ্র চৌধুরী। তাঁর স্মরণে আজ লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে তিন কিস্তিতে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। এখন দেওয়া হচ্ছে দ্বিতীয় কিস্তি
আহমেদ কাথরাদা: আপনি কি গান্ধী সম্পর্কে পড়েছিলেন?
ম্যান্ডেলা: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
কাথরাদা: তাহলে এ কথা সত্য?
ম্যান্ডেলা: কিন্তু আমার আসল নায়ক ছিলেন (জওহরলাল) নেহরু ছিলেন।
কাথরাদা : ( লং ওয়াক টু ফ্রিডম বইয়ে) এভাবে কিছু কথা লেখা হয়েছে: ‘শৈশবে যা তাঁকে সুরক্ষা জুগিয়েছিল, সেই খ্রিষ্টানধর্ম পরিত্যাগের সময় তিনি কিছুটা অনুশোচনা বোধ করেছিলেন। যিশুখ্রিষ্টের প্রতি তিনবার অস্বীকৃতি ঘোষণার কালে সেন্ট পিটার যেমনটি অনুভব করেছিলেন।’ তাহলে, এখন আপনি বলুন তো, এটা কি সত্য কথাই লেখা হয়েছে যে, ‘আপনি আপনার খ্রিষ্টান বিশ্বাসসমূহ বর্জন করেছিলেন?’
ম্যান্ডেলা : না, কখনোই নয়।
কাথরাদা : তাহলে, এমন কথা বলা ভুল হবে, তাই নয় কি?
ম্যান্ডেলা : আমি বলছি, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কখনো আমার খ্রিষ্টান বিশ্বাসগুলো বর্জন করিনি।
কাথরাদা: ঠিক আছে।
ম্যান্ডেলা: আমি মনে করি, এটা (খ্রিষ্টান বিশ্বাস) যথার্থ, আপনি জানেন, তেমন হলে (বিশ্বাস বর্জন) অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।
কাথরাদা: ঠিক তাই।
ম্যান্ডেলা: হ্যাঁ, অনেক ক্ষতি হতে পারত।
আহমেদ কাদরাথার সঙ্গে আলাপচারিতা
একটা ফোর্ড ভি-৮ গাড়ি যাচ্ছিল। আর আমাদের তক্ষুনি থামতে হুকুম করা হলো। স্থানটি তারা খুব বুদ্ধি করেই বেছে নিয়েছিল। বাঁ দিকে খুবই খাড়াই (নদীর) পাড়। আমি বসেছিলাম বাঁ দিকে...তখন আমি খুবই সুস্থ-সবল ছিলাম। দক্ষতার সঙ্গে দেয়ালে চড়তে পারতাম। আমাদের গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখলাম, পেছনে আরও দুটো গাড়ি। তাৎক্ষণিকভাবেই মনে হলো পালানোর যেকোনো চেষ্টাই খুব হাস্যকর হয়ে যেতে পারে। ওরা আমাকে গুলি করবে। আমরা গাড়ি থামালাম। একটি লোক এগিয়ে এল। লম্বা, হালকা-পাতলা গড়ন, পরনে সাধারণ পোশাক। লোকটি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি সার্জেন্ট ভোরস্টার।’...সে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের করে দেখাল। সে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে করছিল। একদম ঠিকঠাক। তার আচরণও ছিল সৌজন্যপরায়ণ। লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?’ বললাম, ‘আমি ডেভিড মতসামায়ি।’ সে বলল, ‘না, আপনি কি নেলসন ম্যান্ডেলা নন?’ আমি বললাম, ‘আমি ডেভিড মতসামায়ি’। সে বলল, ‘আপনি নেলসন ম্যান্ডেলা। আর আপনার পাশে, সিসিল উইলিয়ামস।’ আপনাকে গ্রেপ্তার করছি। আপনাকে এবার পিটারম্যারিৎসবার্গে ফিরে যেতে হবে। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’ তিনি বললেন, ‘মেজর আপনার গাড়িতেই যাবেন, আপনার গাড়ির পেছনে বসে। আপনি শুধু গাড়িটা ঘুরিয়ে চালিয়ে যান।’...
তখন আমার কাছে লাইসেন্সবিহীন একটা রিভলবার ছিল। আমি সেটা হাতে তুলে দুটি সিটের মাঝখানে রেখে দিলাম। ড্রাইভারের ও আমার সিট ছাড়া আরও সিট ছিল গাড়িতে। সেগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো ছিল। ছোট্ট একটা খালি জায়গাও ছিল, যেটা সহজে চোখে পড়ে না। আমি রিভলবারটা সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। আমার কাছে একটা নোটবইও ছিল। পেছনের সিটে বসা মেজরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি নোটবইটাও সেখানে ঢুকিয়ে দিলাম। একসময় আমি ভাবছিলাম, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে আমি গড়িয়ে পড়তে পারব। কিন্তু আমি জানতাম না, (নদীর) পাড় কতটা দীর্ঘ আর সেখানে কী আছে। তার আশপাশের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম না। সে রকম করাটা জুয়াখেলার মতো হতো। তার চেয়ে বরং কিছুটা ভেবেচিন্তে পরেই সুযোগ কিছু একটা করা যাবে। তাই আমরা থানাতে গিয়ে পৌঁছালাম। ওরা আমাকে তালাবদ্ধ করে রাখল।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
ম্যান্ডেলা: এমন একটা পর্যায় আসে যখন কতৃর্ত্বশীল মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়...জনগণের কাছে সংগঠনের সংকল্পের কথা জানাতে হয়ে। কারণ, অন্যথায় জনগণ বেশ বাকপটু হয়ে ওঠে। কারো একটি ধারণা আছে, সংকল্প আছে, আর সে ভাবছে যে, তার ধারণাটা সঠিক; আর সে জনগণের সঙ্গে কাজ করছে, সে জানে কাদের শক্তি বেশি, কারা তথ্যাদি জোগাড় করতে পারে, কারা পদ্ধতিগতভাবে সঠিক পথে চলতে পারে ইত্যাদি—তারাই সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সুতরাং তার যদি কিছু করতে হয় এবং সে যদি নিশ্চিত হয় যে এটাই ঠিক কাজ, তাহলে পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাকে সেটা করতে হবে। এটা উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার কথা নয়। তাকে সম্ভাব্য সুযোগ বেছে নিতেই হবে এবং নিশ্চিত হতেই হবে যে, ইতিহাস তার পক্ষেই থাকবে।
স্টেঙ্গেল: আমি এমকে নামে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিস্তারিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’-এর সময় আপনি এ বিষয়ে সাধারণভাবে আলোচনা করেছেন। শেষদিকে আপনি বলেছিলেন, ১৯৬০ সালের শেষার্ধে আপনি কয়েকজন সহকর্মীসহ এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, সন্ত্রাসী ব্যবস্থাই অনিবার্য হয়ে উঠছে। সমগ্র প্রক্রিয়াটি কী করে ঘটেছিল? আপনি কি প্রথমে গোপনে কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, পরে কার্যকরী পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল? পর্যায়ক্রমিকভাবে কি সিদ্ধান্তটি প্রস্ত্তত করা হয়েছিল?
ম্যান্ডেলা : না, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল, তা হচ্ছে আমি প্রথমেই এ বিষয়ে কমরেড ওয়াল্টারের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। কারণ, কমরেড ওয়াল্টার ১৯৫৩ সালে যখন বিদেশে যাচ্ছিলেন, তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘আপনি যখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে পৌঁছাবেন, তখন তাঁদের অবশ্যই বলবেন যে, আমরা একটা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে চলেছি। এ জন্য আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেতে চাই।’ তারপর আমি সোফিয়া টাউনে এ ধরনের একটি বক্তৃতা করেছিলাম। সে কারণে আমাকে অনেক টানাহেঁচড়া সইতে হয়েছিল। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাদের জন্য সেটাই সঠিক কৌশল। পরে আত্মগোপনকালে আবার কমরেড ওয়াল্টারের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা বিষয়টি কার্যকরী পর্ষদের সভায় তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বিষয়টি আমরা কার্যকরী পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করেছিলাম, কিন্তু বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই তা বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ, দলের সম্পাদক, কার্যকরী পর্ষদ এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটিরও সদস্য (মোজেস) কোটানে—যুক্তি দেখালেন যে, তখনো সময় আসেনি, ‘সরকারের অনুসৃত প্রবল ব্যবস্থাদির মুখে পুরোনো পন্থায় আপনি আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারছেন না। বিদ্যমান অসুবিধাগুলো আপনাকে অবশ করে ফেলেছে এবং আপনি এখন একটি বিপ্লবী ভাষায় কথা বলছেন, সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলছেন। যদি আমরা কল্পনাপ্রবণ এবং সেই সঙ্গে যথেষ্ট সংকল্পবদ্ধ হতে পারি, তাহলে এখনো আমাদের অনুসৃত পুরোনো নিয়মে কাজ করার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। আপনি শত্রুর হাতে ধ্বংস হওয়ার জন্যই যেন, জনগণকে সামনে ঠেলে দিতে চাইছেন। বিষয়টি সম্পর্কে আপনি ভালো করে চিন্তাভাবনাও করেননি।’ সুতরাং এভাবেই তিনি আমাকে খারিজ করে দিলেন, তিনি খুব দ্রুত কথা বলছিলেন আর সবাই তাঁকেই সমর্থন করেছিল।
এ বিষয়ে আমি পরবর্তী সময়ে ওয়াল্টারের সঙ্গে আরও আলোচনা করেছিলাম...বিরোধিতা এতই প্রবল ছিল যে, ওয়াল্টার সাহস করে কোনো কথাই বলতে পারেনি। কিন্তু ওয়াল্টার গভীর কূটনৈতিক মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারেও তিনি খুবই বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। তাই আমরা সমগ্র বিষয়টি পর্যালোচনা করেছিলাম। তিনি বললেন, ‘না, মোজেস কোটানেকে একাকী আলোচনায় ডাকুন, তাঁর সঙ্গে আলোচনা করুন। তিনি যাতে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন, সে ব্যবস্থা আমিই করব।’ কারণ, আমি তখন আত্মগোপন অবস্থায় ছিলাম।
তিনি এসেছিলেন এবং সারা দিন আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। এবার আমি খুবই অকপট আচরণ করেছিলাম। বলেছিলাম, ‘সংক্ষেপে বলা চলে, কিউবাতে কমিউনিস্ট পার্টি যা করেছিল, আপনি তেমনটিই করছেন। তারা বলেছিল, বিপ্লবের পরিস্থিতি এখনো আসেনি। পুরোনো পদ্ধতি অনুসারে, আপনি লক্ষ করুন, স্তালিন যেমনটি বলেছিলেন, বিপ্লবের পরিস্থিতি সম্পর্কে কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে, লেনিন ও স্তালিনের অভিমত অনুসরণ করেই সেটা সম্ভব হতে পারে। এখানে আমাদের নিজেদের পরিস্থিতি অনুসারেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে বিপ্লবের, সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় হয়ে গেছে। কারণ, সহিংস সংগ্রামের লক্ষ্যে জনসাধারণ ইতিমধ্যেই মিলিটারি ইউনিট গঠন করতে শুরু করেছে। আমরা সে রকম কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও জনগণ নিজস্ব উদ্যোগেই এগিয়ে যেতে থাকবে। তাদের সংগতি নেই, অভিজ্ঞতাও নেই, এমনকি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তাদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠনও নেই। এ ক্ষেত্রে জনগণকে সহযোগিতা করার মতো একমাত্র সংগঠন হচ্ছে এএনসি। ব্যাপক জনগণের ওপর সংগঠনটির প্রভাবও রয়েছে। সৃজনশীল চিন্তার মাধ্যমে আপনার মনোভাব অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমরা যখন আইনসম্মত পথে সংগ্রাম করছিলাম, আপনার মনোভাব এখনো সেখানেই স্থির হয়ে রয়েছে। আমরা যে বেআইনি পথে চলছি, তার নেতৃত্ব প্রদানের কথা আপনি আদৌ ভাবছেন না।’ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য আমাকে এভাবে কিছুটা কাঠখোট্টা হতে হয়েছিল। আমি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছিলাম। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘ভালো কথা, আমি এখনি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না, তবে আপনার প্রস্তাবটি আবার উপস্থাপন করতে পারেন।’
আমি (পরের সভায়) আবার প্রস্তাবটি তুলেছিলাম এবং তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিত নই, তবে আমরা তাঁকে (ম্যান্ডেলা) একটা সুযোগ দিতে পারি। তিনি আমাদের সমর্থনসহ প্রস্তাবটি নির্বাহীদের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করতে হবে।’ সুতরাং আমরা বেরিয়ে পড়লাম এবং সবাই সম্মত হয়েছিলেন। আমরা ডারবানে গিয়ে এএনসির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় যোগ দিয়েছিলাম। তখন চিফ (অ্যালবার্ট লুথুলি), ইয়েংগোয়া প্রমুখ তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।
চিফের এ অবস্থান আমাদের অজানা ছিল না, কারণ তিনি নীতি হিসেবে অহিংসায় বিশ্বাস করেন, আমরা করি কৌশল হিসেবে। যদিও এ কথা আদালতে দাঁড়িয়ে বলা সম্ভব ছিল না। আদালতে দেশদ্রোহের মামলার সময় দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, আমরাও অহিংসার নীতিতে আস্থাশীল। কারণ, যদি বলতাম যে, কৌশল হিসেবেই আমরা অহিংসায় বিশ্বাসী, তাহলে রাজা ও রাষ্ট্র আমাদের অবস্থানের একটা ছিদ্র পেয়ে যেত। যখন-তখন তারা বলতে পারত যে, সুবিধাজনক ভাবলে আমরা হিংসার পথেও চলি। প্রকৃতপক্ষে আমরা তো তেমনই করছিলাম। সুতরাং আমরা সেটি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। আর তা মাত্র ওই একটি কারণে।
সর্বদা শুধু কৌশল হিসেবেই আমরা অহিংসায় বিশ্বাস করতাম। পরিস্থিতি যেখানে অহিংসার পথ অনুসরণের দাবি রাখত, আমরা সেখানে তা-ই করতাম। আবার যে ক্ষেত্রে অহিংসা বর্জনের প্রয়োজন হতো, আমরা তাই করতাম। সুতরাং আমরা জানতাম, চিফ আমাদের বিরোধিতাই করবেন, তিনি ভালোভাবেই তা করেছিলেন, কিন্তু আমরা তাঁকে সম্মত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলাম....।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
তাঁরা বললেন, ‘ভালো কথা, আপনি একটা প্রস্তাব প্রণয়ন করেছেন। আমরা এখন আপনার ওপরই কতৃর্ত্ব দিচ্ছি। আমরা আপনাকে অনুমতি দিচ্ছি। হ্যাঁ, ম্যান্ডেলা, আপনি এখন শুরু করতে পারেন...আপনি অন্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ ও সহযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু আমরা, এএনসির পক্ষ থেকে অহিংস নীতিই অনুসরণ করতে চাই। আর এ সিদ্ধান্তটি কেবল জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমেই পরিবর্তন করা যেতে পারে। আমরা এএনসির পুরোনো নীতিতেই অবিচল থাকব।’
এটা কার্যত একটি ভালো সিদ্ধান্ত বলে প্রতিপন্ন হয়েছিল। আমরা যখন আদালতে হাজির হলাম আর রাষ্ট্রপক্ষ যখন সিদ্ধান্ত পরীক্ষা করল, তখন দেখা গেল যে, তারা মামলাটির সমর্থনসূচক কিছুই বলেনি। কারণ, এখানে এএনসিই ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল অধিকারী। চিফ লুথুলি, মোজেস কোটানে, দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ডা. মন্টি নাইকারের২১ মতো ব্যক্তিরা সবাই বলেছিলেন, ‘আমরা হিংসার পথে যেতে চাই না।’ আমার উপস্থাপিত যুক্তি খণ্ডন করতে না পারায় তাঁরা বললেন, ‘তুমি গিয়ে সংগঠনটি শুরু করতে পারো, আমরা তোমার ওপর শৃঙ্খলা আরোপ করতে চাই না। কারণ, আমরা জানি, কেমন পরিস্থিতিতে তুমি এমন একটি লাইন বেছে নিয়েছ। কিন্তু তুমি আমাদের জড়াবে না, আমরা অহিংসার নীতিটাকেই অব্যাহত রাখতে চাই।’
রাষ্ট্র দেখল, এসব সিদ্ধান্তে (যা আমাদের সিদ্ধান্ত বলেই প্রতিপন্ন হয়েছিল) কোথাও তাঁদের হাত নেই। আমরা বিবাদীপক্ষ, এ দলিলটাই দেখিয়ে বলেছিলাম, ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি এটুকুই সমর্থন’ মিলেছে। সুতরাং, আপনি লক্ষ করবেন, ‘উমখন্তো উই সিজউয়ে’-এর ক্ষেত্রে এমনই ঘটেছিল।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
ম্যান্ডেলা : ব্রিটিশরা বিমানবন্দরে আমার জন্য বেশ দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। না, তারা রূঢ় আচরণ করেনি, আপনি জানেন, তাঁরা খুবই সূক্ষ্ম বুদ্ধির মানুষ।
কাথরাদা : হ্যাঁ।
ম্যান্ডেলা: আমাকে পাসপোর্ট দেখাতে হলো। কিন্তু প্রথমেই, আপনি জানেন, অলিভার (টাম্বো) বললেন, ‘আপনি ওই টেবিলে যান, আমি আরেকটাতে যাচ্ছি। আমরা দুজন দুদিকে গেলাম। টেবিলের লোকটির কাছে পাসপোর্ট দিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খুব নম্রভাবে সম্ভাষণ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন ইংল্যান্ডে এসেছেন?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি লাইব্রেরি, মিউজিয়াম—এসব দেখতে এসেছি। কারণ, আমি একটি বই লিখছি’। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কী বই?’ আমি বললাম, ‘ভালো কথা, বইটি লিখছি আফ্রিকায় রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তন নিয়ে।’ তিনি বললেন, ‘ওহ, স্যার, চমৎকার, নামটি চমৎকার। তা আপনি কত দিন থাকতে চান?’ আমি বললাম, ‘মাত্র দুই সপ্তাহ চাই।’ তিনি বললেন, ‘না, স্যার, দুই সপ্তাহের কথা বলবেন না, বলুন এক মাস।’ আমি ভাবলাম, আমার সময়টা এখানে খুবই ভালো কাটবে। বললাম, ‘আমি এক মাসই সময় পেতে চাই।’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার কি ফিরতি টিকিট রয়েছে?’
কাথরাদা: অ্যাঁ...
ম্যান্ডেলা: এ কথায় আমি কিছুটা নাড়া খেলাম। বললাম, ‘না, আমার সঙ্গে কিছু টাকাপয়সা আছে।’ আসলে আমার কাছে ২০ র্যান্ডের মতো ছিল। বললাম, ‘আমার কিছু টাকা আছে।’ দেখলাম, আমার হাত পকেটে ঢুকে গেছে। তিনি বললেন, ‘না, না, না, দুশ্চিন্তা করবেন না।’ কারণ, তিনি জানতেন আমার কাছে টাকা আছে, তবে তিনি সেটা (দেখতে) চাননি। তারা খুবই বিচক্ষণ।
কাথরাদা: হ্যাঁ।
ম্যান্ডেলা: ‘না, না, না, না, অমন করবেন না।’ আর তখন, আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি অন্য কাউন্টারের লোকটির দিকে ইশারা করে অলিভারকে দেখিয়ে বলছিলেন, ‘আপনি দেখছেন?’ অন্য কথায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘এই লোকটি...কালো তালিকাভুক্ত।’
কাথরাদা: আহ্।
ম্যান্ডেলা: ওই লোকটি এই লোকটিকে ইশারায় সতর্ক করে দিচ্ছিল। তবে এবার উঠে এসে খুব নম্রভাবে প্রশ্ন করল, ‘বেশ গোলমেলে ব্যাপার, আপনি জানেন?’
কাথরাদা: আহ্।
ম্যান্ডেলা : শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, ‘আমি আপনাকে অমুক ফরমটা দিচ্ছি...যেন আপনি এক মাস থাকতে পারেন।’ তার পর তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন। এর মধ্যেই তারা কী করতে পারে চিন্তা করছিল...জেনে গিয়েছিল যে, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু (ইংল্যান্ডে) আমার সময়টা বেশ সুন্দর কেটেছিল। আমি ব্রিটিশ রাজনীতিকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছি। তাঁরা আমাকে ভালোভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। আমি লেবার পার্টির ডেনিস হিলির আর...হিউ গেইটস্কেলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তাঁরা চেয়েছিলেন, আমি যেন প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলানের সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু আমরা আসলেই বোকা ছিলাম। আমাদের সময়ও ছিল খুবই কম, আমরা ডেভিড অ্যাস্টর, অ্যান্টনি (স্যাম্পসন) প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।
কাথরাদা: স্যাম্পসন...
ম্যান্ডেলা : স্যাম্পসন এবং আরও অনেকে...
কাথরাদা : আপনি তো অ্যাস্টরের সঙ্গে থাকেননি, থেকেছিলেন কি?
ম্যান্ডেলা : না, না, আমি শুধু অলিভারের সঙ্গেই থেকেছি, হ্যাঁ।
কাথরাদা : আহ্।
ম্যান্ডেলা : ইংল্যান্ডে থাকাটা অবশ্যই উত্তেজনাকর ছিল...এবং একসময়ের রাজধানী...শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। আমি খুবই উপভোগ করেছিলাম, তাদের বইয়ের দোকানে যাওয়া...গেরিলা যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে লেখালেখিও সংগ্রহ করতে পেরেছি।
আহমেদ কাদরাথার সঙ্গে আলাপচারিতা
ম্যান্ডেলা: এখন বলতে পারি, আমি ভীত হইনি। কিন্তু আমরা ভাবছিলাম যে, মৃত্যুদণ্ডই হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, দণ্ডাদেশ ঘোষণার আগে, সকালবেলায়, আগেই বিচারক আমাদের দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। তাঁকে কিছুটা নার্ভাস লাগছিল। আমরা বলাবলি করছিলাম, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তিনি মৃত্যুদণ্ডই ঘোষণা করতে যাচ্ছেন...
কাথরাদা: আহ্।
ম্যান্ডেলা: ধারণা করেছিলাম, মৃত্যুদণ্ডই পাব, আর সে ধারণার কাছেই আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম। তবে এটা অবশ্যই একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা যে, কোনো এক ব্যক্তি আপনার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘এখানেই আপনার জীবনের ইতি।’ এটা যথার্থই উদ্বেগের বিষয় ছিল। তবে এ কথাও সত্য যে, আমরা এমন অবশ্যম্ভাবী পরিণতির চিন্তা থেকে যেন নিজেদের লুকিয়েই রাখতে চেয়েছিলাম, খুবই করুণ অবস্থা।
কাথরাদা: আহ্।
ম্যান্ডেলা: আর আমি তো সাহসী সঙ্গীদের সঙ্গেই ছিলাম, তাঁদের আমার নিজের চেয়ে বেশি সাহসী মনে হচ্ছিল। এ কথাটি আমি লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই।
আহমেদ কাদরাথার সঙ্গে আলাপচারিতা
স্টেঙ্গেল : গান গাওয়া কি নিষিদ্ধ ছিল?
ম্যান্ডেলা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্রথমে তা-ই ছিল। কারাগারের যেকোনো অংশে গান করা, বিশেষত, আপনি যখন কাজ করছেন।...তারা আমাদেরকে কোয়ারিতে চুনাপাথর তুলতে নিয়ে গিয়েছিল। কাজটি আসলেই কঠিন, ভারী কুড়ালের মতো হাতিয়ার ব্যবহার করতে হয়। পাথুরে স্তরে স্তরে চুনাপাথর সাজানো থাকে। একটা পাথরের স্তর হয়তো পাওয়া গেল...তখন চুনাপাথরের জন্য সেই স্তরটা ভাঙতে হবে।...তারা আমাদেরকে ওই কাজেই পাঠিয়েছিল।...দেখাতে চেয়েছিল, কারাবাসের ব্যাপারটা সহজ কিছু নয়, বনভোজন নয়। নিশ্চিতভাবেই কেউ আবার জেলে আসতে চাইবে না। আমাদের মনোবল ভেঙে ফেলাটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। তাই আমরা কী করলাম, কাজ করতে করতে স্বাধীনতার গান গাইতে শুরু করলাম। কাজের মাঝেই প্রত্যেকে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল...মনোবল চাঙা...অনেকে গানের তালে তালে নাচতেও শুরু করেছিল।
কতৃর্পক্ষ তখন বুঝতে পারল, এই লোকগুলো আসলেই রণমুখী, মনোবলও যথেষ্ট উঁচু। তখন তারা বলল, ‘কাজ করতে করতে গান করা চলবে না।’ সুতরাং কাজের রূঢ় দিকটা আপনাকে টের পেতেই হবে।...তাদের শৃঙ্খলাবিধিতেও একটা আইনে গান করা নিষিদ্ধ ছিল, (এবং) তারা সে আইনটাই প্রয়োগ করেছিল। তখনকার মতো আমরা তাদের কথা মেনে নিয়েছিলাম...যখন আমরা নিজেদের কারাকক্ষে ফিরতাম, বিশেষ করে, বড়দিন ও নববর্ষে আমার মিলেমিশে গান গাইতাম। আস্তে আস্তে তারাও ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
কারাগারে অতিথি
(কারাগারে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ মিলত) প্রথম দিকে ত্রিশ মিনিট। ত্রিশ মিনিট সাক্ষাতের সুযোগের জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করে থাকতে হতো। পরে অবশ্য তারা ত্রিশ মিনিটের সময়টুকু বাড়িয়ে এক ঘণ্টা করেছিল। তবে বলা হতো, ত্রিশ মিনিট পাওয়াটা আপনার অধিকার, বাড়তি ত্রিশ মিনিট হচ্ছে কতৃর্পক্ষের অনুগ্রহ। ইচ্ছা করলেই তারা সেটা বাতিল করে দিতে পারে।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি, আমাদের জন্য যখন এক ঘণ্টার সাক্ষাতের সময় বরাদ্দ ছিল, তখন আমাদেরকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো, কে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। কিন্তু একদিন তারা কেবল বলল যে, ‘আপনার একজন সাক্ষাৎকারী এসেছেন’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’ তারা বলল, ‘না, সেটা আমাদের জানা নেই।’ তখন আমি বললাম, ‘তাহলে কমান্ডিং অফিসারকে আসতে বলুন। আমি কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ কমান্ডিং অফিসার এলে আমি বললাম, ‘আমার একজন সাক্ষাৎকারী এসেছেন। আমি কারারক্ষীদের কাছে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলাম। কিন্তু তারা বলল, তারা জানে না।’ কমান্ডিং অফিসার বললেন, ‘ভালো কথা, আমি খোঁজ করে দেখব, কে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।’ কিন্তু তিনি আর ফিরে এলেন না।
আমাকে এ সম্পর্কে কিছু না জানিয়েই ভিজিটিং কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। হঠাৎ অধ্যাপক ফাতিমা মির এসে সেখানে ঢুকলেন। তাঁর কারণেই তারা আমাকে সাক্ষাৎপ্রার্থীর পরিচয় জানাতে চায়নি। কারণ, ফাতিমা মির ছিলেন কালো তালিকাভুক্ত। আমাকে তাঁর পরিচয় না জানালেও তারা বাধ্য হয়ে তাঁকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দিয়েছিল। তাই তখন আমি ভেবেছিলাম, সাক্ষাতের জন্য এক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। অথচ ত্রিশ মিনিট পরেই তারা বলল, ‘আর নয়, সময় শেষ।’ আমি বললাম, ‘কিন্তু আপনাদের তো আমাকে এক ঘণ্টা সময় দেওয়ার কথা।’ তিনি বললেন, ‘না, আপনার জন্য ত্রিশ মিনিটই বরাদ্দ রয়েছে। বাকি ত্রিশ মিনিট আমাদের ইচ্ছার ওপর। সাক্ষাতের সময় শেষ।’
অপ্রত্যাশিত হলেও তারা উপযুক্ত কাজই করেছিল। প্রথম দিকে এমন অবস্থাই ছিল। কিন্তু...ওই এক ঘণ্টার সময় তারা অব্যাহতই রেখেছিল, কখনো এর চেয়ে বাড়তি সময় দেয়নি। আমাকে ভিক্টর ভারস্টারে নিয়ে রাখার আগ পর্যন্ত এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।...সেখানে অবস্থাটা ছিল বন্দী আর মুক্ত মানুষের মাঝামাঝি। আমাকে একটি কটেজে রাখা হয়েছিল। আমি একা থাকতাম। সেখানে দরজা তালাবদ্ধ করা হতো না। ইচ্ছা করলে আমি মধ্যরাত পর্যন্তও বাইরে থাকতে পারতাম। আমাকে একজন কারারক্ষীও বরাদ্দ করা হয়েছিল। সে আমার জন্য খাবার রান্না করত।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা