ইরানের আন্দোলনে গতি দিয়েছে আশ্চর্য এক গান, যে গানের কোনো একক রচয়িতা নেই
এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে ইরানে। কয়েক সপ্তাহ আগে ইরানের ‘নীতি পুলিশে’র হাতে নিহত হন ২২ বছর বয়সের কুর্দি তরুণী মাসা আমিনি। অপরাধ, তাঁর মাথার চুল কাপড়ে ঢাকা ছিল না। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন, সে দেশের তরুণ-তরুণী। মাথায় কাপড় দেব কি দেব না, সেটা আমার সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্র সে নির্দেশ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। এই দাবি জানিয়ে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, পুলিশি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করছেন। গুলি, লাঠির বাড়ি ও বিক্ষোভ-ভাঙা তপ্ত জল উপেক্ষা করে এখন তাঁরা রাস্তায়। হাত তুলে, মাথা দুলিয়ে সমস্বরে বলছেন, মৃত্যু হোক একনায়কের। তাঁরা গলায় তুলে নিয়েছেন এক বিস্ময়কর গান। যে স্লোগান তাঁরা সড়কে দাঁড়িয়ে সোৎসাহে উচ্চারণ করেন, সেই স্লোগান দিয়েই তৈরি হয়েছে সে গান—নাম ‘বারোইয়ে’, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘এই কারণে’ বা ‘এই জন্য’।
পৃথিবীর সব দেশেই প্রতিবাদী মানুষ সংগীতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের গলায় ছিল প্রতিবাদী গান, সম্মিলনের গান। সে গান আমাদের সংহত করেছে, শক্তি জুগিয়েছে। তারও আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পুলিশি লাঠি অগ্রাহ্য করে আমরা
গান ধরেছি। সে গান লেখার জন্য নজরুলকে জেলে যেতে হয়েছে। আমেরিকার কালো মানুষ, দাস প্রভুর বন্দুককে উপেক্ষা করে গান গেয়েছে, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। বাংলায় সে গান,
‘আমরা করব জয়’, আজও আমাদের প্রতিবাদী সংগীত।
২০১০-১১ সালে আরব বিশ্বজুড়ে দাবানলের মতো বিপ্লবী আগুন জ্বলে ওঠে। ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত সামরিক ও আধা সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে লড়াইয়ের শুরু তিউনিসিয়ায়। পুলিশ ও সেনা প্রহরা উপেক্ষা করে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ান দেশের তরুণ-যুবা। তাঁদের কণ্ঠে এক নতুন গান—‘কেমতি হররা’, আমার শব্দমুক্ত, শৃঙ্খলহীন। ২৮ বছর বয়সী তিউনিসিয়ীয় শিল্পী এমেল মাথলুথির লেখা ও গাওয়া সে গান শুধু তিউনিসিয়ায় নয়, কায়রো থেকে বৈরুত—সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আমার গান এখন শৃঙ্খলহীন, আমাকে আর ভয় দেখিয়ে চুপ রাখতে পারবে না।
আমার শব্দ শৃঙ্খলহীন
আমরা স্বাধীন, আমরা নির্ভীক
আমরা সেই গোপন হাতিয়ার যার মৃত্যু নেই
যারা প্রতিবাদী আমরা তাদেরই কণ্ঠস্বর।
আমরা ভুলে যাই না তাদের কথা
যারা আমাদের কান্নার জন্য দায়ী,
যারা জনতাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
তিন বছর আগে ভারত সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির প্রতিবাদে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের একটি গান সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। গানটির নাম ‘হাম দেখেঙ্গে’। পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক জিয়াউল হকের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ১৯৮৫ সালে ফয়েজের জন্মদিনে লাহোরে প্রথম সে গান গেয়েছিলেন ইকবাল বানু। সকল ভীতি উপেক্ষা করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েক শ মানুষ সে গান তাঁদের গলায় তুলে নিয়েছিলেন। বন্দুকের বিরুদ্ধে কবির কথা, শিল্পীর গান হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের এক প্রবল হাতিয়ার।
আমরা দেখব, আমরা দেখব
নির্ঘাত জানি, আমরা দেখবই
একনায়কের সকল ধ্বজা উড়ে যাবে
ভেঙে ফেলা হবে সব রাজাসন
আমরা দেখব, হাম দেখেঙ্গে।
প্রথমে ভারতের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের, তারপর সব ধরনের ছাত্রছাত্রীদের গলায় এই গান ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দু-মুসলিম হাতে হাত ধরে সে গান গেয়েছে। আর এভাবে কবির কথা হয়ে পড়েছে প্রতিবাদের এক প্রবল ব্যারিকেড।
বিপ্লবের সেই ঐতিহ্যের প্রতিধ্বনি দেখি ইরানেও। কবিতা ও সংগীত ইরানি সংস্কৃতির শিকড়ে। ফলে স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভে কবিতা ও গান তাদের সঙ্গ দেবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অভিনবত্ব এই, এবার যে গান তারা গলায় তুলে নিয়েছে, তার লেখক কোনো একজন কবি নয়, বিক্ষোভকারীরা নিজেরাই। টুইট ও স্লোগান আকারে প্রচারিত বাক্য ও অর্ধবাক্য জোড়া দিয়েই তৈরি হয়েছে এই গান। ক্লাসরুমে, ক্লাসরুমের বাইরে, চত্বরে ও উন্মুক্ত সড়কে সেই গান এখন তেহরানে, ইস্পাহানে, সিরাজে। কেন তাঁরা রাস্তায়, এই গান সেই প্রশ্নের উত্তর।
‘খোলা রাস্তায় নাচব, সে অধিকারের জন্য
যেন ভীত না হই চুমু খেতে, সে জন্য
আমার, তোমার, আমাদের ভগিনিদের জন্য
মগজ ধোলাইয়ের প্রতিবাদের জন্য
আমাদের গরিবির লজ্জার জন্য
স্বাভাবিক জীবনের জন্য
পাতাকুড়ানি বালকটি, যে জানে না স্বপ্ন কি, তার জন্য
গলা টিপে ধরা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি বাতিলের জন্য
এই কলুষিত বাতাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য
ভালিসারের দীর্ঘ সড়ক ও তার শুষ্ক পত্রালির জন্য
চিড়িয়াখানার টিকে থাকা শেষ চিতা ফিরুজের জন্য
নিষিদ্ধ কুকুরশাবকের জন্য
সীমাহীন চোখের জলের জন্য
যেন গোলায় বিধ্বস্ত না হয় যাত্রীবাহী বিমান তার জন্য
হাস্যোজ্জ্বল মুখের জন্য
এই কৃত্রিম স্বর্গ চাই না, সে কথা বলার জন্য
ছাত্রদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য
কারাবন্দী বুদ্ধিজীবীর জন্য
আফগান শিশুদের জন্য
আমাদের সকল দাবির জন্য
সকল শূন্যগর্ভ স্লোগান বাতিলের জন্য
তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া গৃহের জন্য
শান্তির জন্য
দীর্ঘনিশি শেষে সূর্যের আলোর জন্য
উদ্বেগ ও নিদ্রাহীনতার বড়ির জন্য
লিঙ্গান্তরের অধিকারের জন্য
নারী, জীবন ও মুক্তির জন্য
মুক্তির জন্য
মুক্তির জন্য
মুক্তির জন্য।
অতি আটপৌরে গান, অথচ এর প্রতিটি কথা সাধারণ ইরানি নাগরিকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার দিনলিপি। একই সঙ্গে এতে রয়েছে তাদের স্বপ্নের উচ্চারণ। শুধু ইরান নয়, এই গান এখন পৃথিবীর সব অধিকারহীন মানুষের লড়াইয়ের সংগীত।