নিজের বই দেখছেন জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন
নিজের বই দেখছেন জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন

বইয়ের মানুষ

এক গবেষকের সঙ্গে প্রাণবন্ত কিছু মুহূর্ত

নিজের লেখা বইয়ের প্রথম কপিটি হাতে নিলে সব লেখকেরই বোধ হয় এক অনাবিল আনন্দের অনুভূতি হয়, তা তিনি তিরিশের তরুণই হোন বা অশীতিপর প্রবীণ। প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের চেহারায়ও দেখা গেল সেই উদ্ভাস।

সম্প্রতি আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের লেখা জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ: ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স বইটি বের করেছে প্রথমা প্রকাশন। লেখকের হাতে নতুন বই তুলে দিতে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। ডাকযোগে পাঠালেও চলত। কিন্তু প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান চেয়েছেন শ্রদ্ধাস্পদ লেখকের বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতেই তুলে দেওয়া হোক সদ্য প্রকাশিত বই। এ নির্দেশ পেয়ে প্রাজ্ঞ ও প্রাণবন্ত মানুষটির সঙ্গে কিছু দুর্লভ মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ হলো আমার।

জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের শিক্ষা ও শিক্ষকতার জীবন বর্ণাঢ্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ছিলেন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি ও লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টার অ্যাট ল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০১২ সালে প্রফেসর ইমেরিটাস ও ২০২১ সালে ভূষিত হয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক পদে। ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। দেশ–বিদেশের বিখ্যাত জার্নালগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মূল্যবান গবেষণা অভিসন্দর্ভ। একুশে পদক, অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন।

বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন লেখক। আড্ডা ও আলাপে সদ্য প্রকাশিত বইটির বিষয় সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা পাওয়া গেল। জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ: ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স বইটিতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা আলোচনা করে বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। এই সূত্রে পাকিস্তানের জাতি গঠনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংকটগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। বাঙালি অর্থনীতিবিদদের দেওয়া দুই অর্থনীতির প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের কথাও আলোচিত হয়েছে এ বইয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বের বিভিন্ন দলিল এতে উদ্ধৃত হয়েছে। এর ভিত্তিতে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।

মুগ্ধ–বিস্ময়ে শুনছিলাম আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের কথা। বয়স তাঁর অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু প্রাণশক্তি কেড়ে নিতে পারেনি। এখনো নানা বিষয়ে লেখার আগ্রহ আছে তাঁর। আলাপ ও চা–পর্বের ফাঁকে সাগ্রহে নিজের সংগ্রহের বইপত্র দেখালেন। বিষয় অনুযায়ী বইপত্র রেখেছেন আলাদা আলমারি ও তাকে। সেখানে তাঁর ছেলে ড. উমর সিরাজুদ্দীনের (এখন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত) ছোটবেলার প্রিয় শিশুসাহিত্যের বইগুলো যেমন রাখা আছে, তেমনি আছে তাঁর প্রয়াত স্ত্রী অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দীনের (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক) বিশেষ আগ্রহের স্থাপত্য ও শিল্পকলাবিষয়ক বইগুলোও। নিজের লেখার পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত লেখার কপিগুলো সযত্নে গুছিয়ে রেখেছেন অধ্যাপক।

জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ: ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স

‘আপনার অনুপস্থিতিতে এত বইপত্রের দেখভাল করবে কে?’ এমন প্রশ্নে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়লেন যেন, এখনকার তরুণদের এমনকি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও পাঠবিমুখতা নিয়ে একটু হতাশা প্রকাশ করলেন। তবে তাঁর বইপত্রের সংগ্রহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারে দান করে যাবেন বলে জানালেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘কেউ না কেউ তো পড়বেই।’ একটু থেমে যেন আশাবাদও জাগিয়ে রাখতে চাইলেন, ‘নিশ্চয়ই পড়বে।’

আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের কথার সমর্থন জুগিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই পড়বে স্যার, জ্ঞান–তৃষ্ণার মৃত্যু নেই।’

আলাপটা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তাঁর মধ্যাহ্নভোজের সময়টাও মনে রাখতে হয়। অনেক নিষেধ উপেক্ষা করে তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন অধ্যাপক। গাঢ় নীল রঙের পোলো টি–শার্ট আর ধূসর রঙের প্যান্ট পরা দীর্ঘদেহী, সুদর্শন মানুষটিকে দেখে কে বলবে, তাঁর বয়স নব্বই ছুঁতে আর মাত্র তিন বছর?

আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন বিদায় জানালেন। মনে মনে বললাম, বয়স তো শরীরে থাকে না স্যার, থাকে মনে। আপনি এখনো তরুণ। আপনার সৃষ্টিমুখর দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী