কেমন ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসের পথ

বর্তমান স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনো আকস্মিক, বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়। এর পেছনে রয়েছে শোষণ–নিপীড়নের দীর্ঘ ইতিহাস এবং এর বিরুদ্ধে এই ভূখণ্ডের নিপীড়িত মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম।

১৯৪০ ও ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ দুই কালপর্ব। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন লাহোরে। এটা ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবের মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষের যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বীজ নিহিত ছিল, তা ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূরণ হয়। শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু বইয়ে লেখক আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটনাবহুল এই পুরো সময় তুলে ধরেছেন।

ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে  স্বাতন্ত্র্যবাদী আবুল মনসুর আহমদ সব সময় বিশ্বাস করতেন, পূর্ব বাংলার মানুষের বিশ্বাস, চিন্তা, জীবনবোধ, রাজনৈতিক চেতনাসহ সবকিছু পরিপূর্ণ বিকশিত হতে পারে কেবল নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির লালন ও চর্চার মধ্য দিয়ে। আর বইটি তিনি লিখেছিলেন পাকিস্তান আমলে। ফলে এখানে উদ্ধৃত ‘পাক–বাংলার কালচার’ আদতে পূর্ব বাংলার মানুষেরই কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। 

বইটির সূচনাপর্বে লেখক প্রাসঙ্গিকভাবে আলাপ করেছেন কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে। কোনো জাতির কৃষ্টি–সংস্কৃতিকে উপলব্ধি না করা গেলে ওই জাতির রাষ্ট্রচিন্তাকে যে ঠিকঠাক বোঝা যায় না, লেখক এটা বিলক্ষণ জানতেন। তাই তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ঢুঁড়ে প্রথমে আবুল মনসুর দেখান যে বহু ধর্ম ও সংস্কৃতি এখানে এসে এক মোহনায় মিশেছে। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ে পশ্চিমা প্রভাব। এ সময় পূর্ব বাংলার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশ্চাত্য এবং পশ্চিম বাংলার ‘বাবু সংস্কৃতি’র ধারক–বাহক হয়ে যেন ছিল ‘জাতে ওঠার’ চেষ্টায়। স্বভাবতই বাংলার বহুমাত্রিক সংস্কৃতি অবহেলার শিকার হয়। তাই বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের স্বরূপ চিহ্নিত করে ‘আমাদের কৃষ্টিক পটভূমি’ শিরোনামের রচনার উপান্তে আবুল মনসুর লেখেন, ‘পরাধীন আমলে বাংলা ভাষার ওই বৈশিষ্ট্যটুকু ধ্বংস করা হয়। তারই ফলে পশ্চিম বাংলার বাক্​বিন্যাস ও উচ্চারণ অভিজাত বলিয়া আমরা গ্রহণ করিয়াছি। মুসলিম পুনর্জাগরণে পাক–বাংলার সে স্বকীয়তার উদ্ধার আমরা করিব না কি?’

এই প্রশ্নের আলোকেই মূলত এই বইয়ে খোঁজা হয়েছে পূর্ব বাংলার স্বরূপ। শেরেবাংলা, বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি এখানে আলোচিত হয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিও। এসেছে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক সমাজবাদ, মুসলিম জাহানের দৈশিক জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদ বনাম পুঁজিবাদসহ নানা প্রসঙ্গ। এভাবে বিচিত্র বিষয়পরম্পরায় বইটিতে লেখক বিশদ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা। আর এই আকাঙ্ক্ষার সূত্রেই এসেছে ‘দেশ’, ‘রাষ্ট্র’ ও ‘নেশন’ প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনা। বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘১৯৪৭ সালের আগে আমাদের বাসস্থান ছিল, কিন্তু দেশ ছিল না। আমরা জাতি ছিলাম, কিন্তু নেশন ছিলাম না। কারণ, আমাদের রাষ্ট্র ছিল না। রাষ্ট্রের অভাবে রাষ্ট্রীয় চিন্তা ছিল আমাদের অস্পষ্ট, অগভীর, ভাসা ভাসা।’ 

পুরো বইয়ের ৬০টি নিবন্ধে আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্য এমনই স্পষ্ট। পর্যবেক্ষণও গভীর। বইটিতে একজন নিখাদ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি যেন আতশি কাচের নিচে ফেলে ইতিহাসের এসব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাপ্রবাহের জটিল বাঁকগুলোর ভাঁজ মেলে ধরেছেন। বিশেষ করে শেরেবাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত সময়ের রাজনীতির ক্রমবিকাশের একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় বইটিতে।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ভারত–পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে পূর্ব বাংলার মানুষ একবাক্যে ভোট দেয় পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু দেশভাগের পর দেখা গেল, যে স্বপ্ন নিয়ে তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল, তা শুধুই মরীচিকা। তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি, কেবল এক উপনিবেশ থেকে আরেক উপনিবেশে গড়িয়েছে ভাগ্যের চাকা।

শেরেবাংলার উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের পেছনে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কী আকাঙ্ক্ষা বা মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল, কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো, কেনই–বা পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নেমে এল সেই পুরোনো ঔপনিবেশিক শোষণের খড়্গ, কেন তাদের শেষ পর্যন্ত বেছে নিতে হলো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ—এই বইয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে এসব জিজ্ঞাসার উৎস অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক, যা পাঠককে ইতিহাসের এসব ঘটনার গভীরে সহজেই টেনে নিয়ে যায়।

আনিসুর রহমান

শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু

আবুল মনসুর আহমদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ৩৯২ পৃষ্ঠা; দাম: ৮০০ টাকা।

বই পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে