স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর
স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর

বই আলোচনা

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামগ্রিক ইতিহাসের জন্য জরুরি যে বই

পূর্ব বাংলার, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে যাঁরা ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম আর গুরুত্বপূর্ণ কামরুদ্দীন আহমদ (১৯১২-১৯৮২)। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসের সমান্তরালে কামরুদ্দীন আহমদের লিখিত ইতিহাস পাঠ করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের আগে থেকেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। কিন্তু মুসলিম লীগের উগ্র আর কট্টরপন্থা এবং জনসমাজ-জনপরিসরের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় দল তিনি ছেড়ে দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন বেশ দৃঢ়ভাবে। আর তারপর যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। কিন্তু সেই যোগদানের বিষয়টি যতটা না তিনি কর্মীর মতো করে গেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছেন তাত্ত্বিকের অবস্থানে থেকে, তাত্ত্বিকভাবে। ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম তাত্ত্বিক হিসেবেই তিনি পরিগণিত হবেন। তাঁর বইগুলোয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলের ঐতিহাসিক বিবরণ যেমন সহজলভ্য, তেমনি এসব বইয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে আর প্রয়োজনীয়তাও জরুরি বিষয় হিসেবে হাজির থেকেছে।

কামরুদ্দীন আহমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই পূর্ববাংলার সমাজ ও রাজনীতি। বইটি কামরুদ্দীন আহমদেরর ‘ম্যাগনাম ওপাস’ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই বইয়ের পর আরও দুটি বই কামরুদ্দীন আহমদ লিখিত ইতিহাসের ধারাক্রম বোঝার জন্য জরুরি: ১. বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ (২ খণ্ড); ২. বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী। আর এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর শিরোনামের একটি বই। এই বইয়ে গ্রন্থিত হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্র হয়ে ওঠা এবং রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পর সেই রাষ্ট্রের ভেতরে ঘটে যাওয়া আরও নানা বিষয় নিয়ে। বলা যেতে পারে, কামরুদ্দীন আহমদ বেঁচে থাকা অবধি তিনি যা দেখেছেন, তার এক পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক বয়ান।

আগে লিখিত বইগুলোয় সময় অনুযায়ী, বিশেষ করে বই প্রকাশের পূর্ববতী আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখ আছে, সমালোচনামূলক পদ্ধতিতে। কিন্তু এই বইয়ে কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর সমসাময়িক সময়ের বর্ণনা যেমন দিয়েছেন, তেমন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, সে বিষয়ও আমলে নিয়েছেন। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বাস্তবতার একটি সমালোচনামূলক বিবরণ এখানে স্পষ্ট হয়েছে, যা নানা রকম যুগ্মবৈপরীত্যের সংশ্লেষণের মাধ্যমে লিখিত হয়েছে।

বইয়ে কী আছে, পাঠক তা পাঠ করেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু কীভাবে আছে, তা বোঝাটা জরুরি। দৈশিক বিষয় আলোচনার জন্য তিনি এর সঙ্গে বৈদেশিক প্রসঙ্গও সংযুক্ত করেছেন। বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে সংযুক্ত থাকে, তা তিনি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক প্রসঙ্গের আলাপ-আলোচনার একটি বিষয় হিসেবে সংযুক্ত করেছেন।

এ ছাড়া এই বই তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ১. আগেই বলেছি, ইতিহাস রচনার যে প্রচলিত পদ্ধতি-প্রবণতা—অর্থাৎ আনুষঙ্গিক উৎস থেকে তথ্য নিয়ে যে ইতিহাস রচনাপদ্ধতি প্রচলিত আছে, সেই প্রবণতা থেকে তিনি সহজেই বের হতে পেরেছিলেন। এরই ফলে তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতো করে ইতিহাস রচনা করেছেন। বিষয়টি আবার ২ নম্বর গুরুত্বের কারণ হবে। আমরা দেখি, অধিকাংশ ইতিহাস মূলত কিছুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে লেখা হয়। সেসব মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাস এই ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে বটে। কিন্তু এ বিষয় একটি অঞ্চলের ইতিহাস রচনার বেলায় একটি বড় সংকটও তৈরি করে। মানে জনসমাজ আর জনসমাজে ‘সাধারণ’ মানুষের যাপিত জীবনের কোনো ধরনের বর্ণনাই আর এ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। যেটা সর্বব্যাপী ইতিহাস নির্মাণে বড় বাধা হিসেবে পরিগণিত হয়। কামরুদ্দীন আহমদ ইতিহাস রচনার এই বাধা এই বইয়ে নানাভাবেই ভাঙার চেষ্টায় রত ছিলেন। কিন্তু তিনি কি পেরেছেন? পুরোপুরি পারেননি; কিন্তু আংশিক হলেও তো পেরেছেন।

গুরুত্বের দিক থেকে ৩ নম্বর বিষয় হলো কামরুদ্দীন আহমদ কোনো কর্তৃত্বের মুখপাত্র হয়ে ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেননি। এ কারণে প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তিনি একপক্ষীয় হয়ে ইতিহাস রচনার পরিবর্তে পুরোদমে সমালোচনামূলক থাকতে পেরেছেন। বিষয়টি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিবেচনায় বোধ হয় ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের বিষয় একেবারেই নয়। এ কারণেই এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়েও যিনি বাংলাদেশের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার পাননি।

সবশেষ বলতে হবে, কামরুদ্দীন আহমদের অন্য বইগুলো যেভাবে ‘মধ্যবিত্ত’ ব্যাপারটিকে প্রতিনিধিত্ব করেছে, ঠিক এই বইয়ে তিনি ব্যাপারটিকে এককভাবে গুরুত্ব দেননি। কেন দেননি, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যেকোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মধ্যবিত্তের সক্রিয়তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু যে পর্বে এসে তিনি এই বই রচনা করছেন, সেই পর্বে বাংলাদেশে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি মোটামুটি নির্মিত হয়ে গেছে। ফলে ‘মধ্যবিত্তের বিকাশ সমাপ্ত’ সম্পূর্ণরূপে হয়ে গেছে, তা না বলা গেলেও একটি পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা বলা সম্ভব ছিল, যা কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর লেখায় ব্যবহৃত করেছেন। সামগ্রিক বিবেচনায় এই বই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের সামগ্রিক ইতিহাসের জন্য অতি জরুরি।

  • সোহানুজ্জামান