মাত্র ৩৭ বছরের স্বল্পায়ু নিয়ে জন্মেও বাংলা চলচ্চিত্রাঙ্গন ও কথাসাহিত্যে প্রবাদপ্রতিম এক নাম জহির রায়হান। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক এক উত্তাল সময়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে কবিতা দিয়ে লেখালেখির হাতেখড়ি হয় তাঁর; সেই থেকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অন্তর্ধানের আগপর্যন্ত লিখে গেছেন কালজয়ী সব উপন্যাস এবং গল্প, সৃষ্টি করেছেন অসামান্য সব চলচ্চিত্র।
জহির রায়হানের জীবদ্দশায় প্রকাশিত তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ। তাঁর নিকটজনদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের শেষের দিকে এসে একটি গল্প সংকলন প্রকাশের ইচ্ছা ছিল তাঁর; এর মানে দাঁড়ায় সূর্যগ্রহণ-এ লিপিবদ্ধ গল্পগুলো ছাড়া আরও গল্প লিখেছিলেন তিনি।
তাঁর মৃত্যুর পর নানা অনুসন্ধানে বের হয়ে আসা আরও কিছু গল্প গ্রন্থিত হলেও অনেক গল্পই দুই মলাটে আবদ্ধ হয়ে পাঠকের হাতে এসে পৌঁছাতে পারেনি আর। জহির রায়হানের মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পর কাজী জাহিদুল হক নিবিড় অনুসন্ধানে বের করে এনেছেন তাঁর লেখা আরও সাতটি গল্প, যা আগে কখনোই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।
গ্রন্থাকারে বের না হলেও ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে লেখা এই সাতটি গল্পই তৎকালীন নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যখন যন্ত্রণা: অগ্রন্থিত গল্পগুচ্ছ নামের মলাটে ‘আবদ্ধ ঢেউ’, ‘মনের মতো বউ’, ‘অমিত্রাক্ষর’, ‘অনমিতা’, ‘যখন যন্ত্রণা’, ‘অকালসন্ধ্যা’ ও ‘বেড়ি’ নামের এই সাতটি গল্প পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল অদেখা সময়ে। তৎকালীন সমাজবাস্তবতা, মধ্যবিত্ত জীবনের নানা টানাপোড়েন, নারী স্বাধীনতার স্বরূপ, প্রেম-ভালোবাসা—সব জীবন্ত হয়ে উঠেছে জহির রায়হানের সেই চিরচেনা লেখার ঢং ও তাঁর কলমের জাদুতে।
গল্পগুলো ছোট ছোট, দু-তিন পৃষ্ঠার; কিন্তু প্রতিটি শব্দই বুকে বাঁধে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখিত ‘ঢেউ’ গল্পে দেখতে পাই মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ অবাঙালি রিজিয়াকে কীভাবে নিজের মাতৃভাষার প্রতি উজ্জীবিত করে তোলে! নিজের ভাষার প্রতি তৈরি হওয়া ভালোবাসার কারণেই রিজিয়া বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মাহাত্ম্যের সঙ্গেও একাত্ম হতে পেরেছিল।
‘অনমিতা’ গল্পটিতে একজন নারীর বিপ্লবী চেতনা দক্ষ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। নিজের দেশ ও আদর্শের প্রতি অটল নীলা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কাছে স্বামীর মাথা নত করাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না, নিজ দেশের মর্যাদার প্রশ্নে তাই স্বামীকে ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করে না সে!
‘মনের মতো বউ’ আর ‘বেড়ি’ গল্প দুটি যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একটি গল্পে আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগের বাঙালি সমাজে একজন নারীর স্বাধীনতার যে স্বরূপ আমরা দেখতে পাই, তার ঠিক উল্টো একটি চিত্র দেখতে পাই ‘বেড়ি’ গল্পের রাজুর জীবনে, যা স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েও অনেকটাই প্রাসঙ্গিক।
বইয়ের নাম–গল্পটি অসাধারণ! প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাউকে হঠাৎ পাওয়া, অবহেলায় হারিয়ে ফেলা, আবার পাওয়া এবং আবার হারানোর শূন্যতা; সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনবোধের এই অপ্রিয় সত্য অনুভূতির কী অসাধারণ প্রকাশ এই গল্প!
প্রতিটি গল্পই জহির রায়হানের অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করলেও আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় ‘অমিত্রাক্ষর’ ও ‘অকালসন্ধ্যা’ গল্প দুটি চিরস্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছে। তিন–চার পাতায় ক্ষুদ্র পরিসরে লেখা হলেও ‘অমিত্রাক্ষর’ একটি সার্থক রোমান্টিক-ট্র্যাজেডি গল্পের অনন্য উদাহরণ। অন্যদিকে ‘অকালসন্ধ্যা’ গল্পটি মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের এক চমৎকার উপস্থাপনা।
জীবনসংগ্রামে অবিরাম লড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন থেকে পরম আরাধ্য ভালোবাসা বা রোমান্টিকতার ছিটেফোঁটাটুকুও যখন হারিয়ে যায়, অবিরাম ছুটে চলার ক্লান্তিতে অকালে আসা বার্ধ্যক্যে বসে পেছন ফিরে তাকালে কী নিদারুণ হতাশা এসে গ্রাস করে, তার চিত্রই ফুটে উঠেছে এই গল্পে।
২১ শতকের এই পুঁজিবাদী সমাজে বস্তুবাদী আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটে ছুটে এভাবেই আমরা হারিয়ে ফেলি জীবনের ছোট ছোট আনন্দ!
জহির রায়হান তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন, সমাজকে দেখেছেন দূরদৃষ্টি দিয়ে। গল্পগুলো পাঠে পাঠক নতুন করে তাঁর বিরল প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে
prothoma.com এবং মানসম্মত
বইয়ের দোকানে।